হিজরি বছরের প্রথম মাস হলো মুহাররম। কুরআন ও সুন্নাহয় এ মাসের কিছু ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত মাসের দশম তারিখ তথা আশুরা দিবসটি এতে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। কিন্তু আমাদের সমাজে এ দিবসকে কেন্দ্র করে ইসলামের নামে যা ঘটে তার সিংহভাগই ইসলাম সমর্থিত নয়। বিভিন্ন মিথ্যা ঘটনাবলীর বর্ণনা ও মানবরচিত কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালিত হয় এ দিবস। অধিকাংশ মানুষই জানে না, এ দিবসের পালনীয় বিষয়গুলো কী এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো কী? জানে না তারা, রাসুলুল্লাহ সা.-এর সময়ে এ দিবস কীভাবে পালিত হতো? তাই আজ আমরা গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর আলোকে আশুরা দিবসের পালনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরব এবং সাথে এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রুসুম-রেওয়াজ ও মিথ্যা কল্প-কাহিনীর অসারতা প্রমাণ করব। আল্লাহ-ই তাওফিকদাতা।
প্রথমত আমরা কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর আলোকে মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে আলোচনা করব। যাতে মানুষ এ অনুসারে আকিদা ও আমল ঠিক করে নিতে পারে।
এক :
মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত মাসগুলোর একটি। বান্দার জন্য এ সম্মানিত মাসগুলোর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। এসব মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত করবে এবং গুনাহ থেকে বিশেষভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এ মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহ অন্যান্য মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহর চেয়ে অধিক গুরুত্ব রাখে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন :
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ.
‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস হলো বারটি; আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। অতএব এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত মাস বলে অভিহিত করেছেন। সে চারটি মাস হলো, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الزَّمَانُ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ وَذُو الحِجَّةِ وَالمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ، الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ.
‘আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত, নবি সা. বলেছেন,আল্লাহ যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন,সেদিন থেকে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবেই আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। ধারাবাহিকভাবে রয়েছে তিনটি মাস তথা জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত।’ (সহিহুল বুখারি : ৪/১০৭, হা. নং ৩১৭৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
উপরিউক্ত আয়াত ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদিস থেকে প্রমাণ হলো যে, মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট সম্মানিত একটি মাস। সম্মানিত মাসগুলোতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে গুনাহ করা থেকে বেঁচে থাকতে বিশেষভাবে আদেশ দিয়েছেন। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, এসব মাসে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চাইতে অধিক অপরাধ। আর শরিয়তের মূলনীতি হলো, যেখানে গুনাহ অধিক অপরাধের কারণ সেখানে ইবাদতও অধিক পূণ্যের কারণ।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বলেন :
ثُمَّ اخْتَصَّ مِنْ ذَلِكَ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ فَجَعَلَهُنَّ حَرَامًا وَعَظَّمَ حُرُمَاتِهِنَّ وَجَعَلَ الذَّنْبَ فِيهِنَّ أَعْظَمَ والعمل الصالح والأجر أَعْظَمَ. وَقَالَ قَتَادَةُ فِي قَوْلِهِ: فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ إِنَّ الظُّلْمَ فِي الْأَشْهُرِ الْحُرُمِ أَعْظَمُ خَطِيئَةً وَوِزْرًا مِنَ الظُّلْمِ فِيمَا سِوَاهَا، وَإِنْ كَانَ الظُّلْمُ عَلَى كُلِّ حَالٍ عَظِيمًا وَلَكِنَّ اللَّهَ يُعَظِّمُ مِنْ أَمْرِهِ مَا يَشَاءُ.
‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা এ মাসগুলো থেকে চারটি মাসকে আলাদা করে হারাম করেছেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এ মাসগুলোতে গুনাহকে অধিক জঘণ্য করেছেন এবং সৎকর্ম ও সওয়াবকে বৃদ্ধি করেছেন। কাতাদা রহ. আল্লাহর বাণী “অতএব এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না” এর ব্যাখ্যায় বলেন, নিশ্চয় হারাম মাসগুলোতে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চেয়ে অধিক অপরাধ ও ভয়ঙ্কর। যদিও সর্বাবস্থায়ই গুনাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কোনো বিষয়কে বড় ও গুরুত্ববহ করে দেন।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৪/১৩০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
দুই :
এ মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখবে। কেননা, নফল রোজার জন্য সবচেয়ে উত্তম মাস হলো মুহাররম। যেমন সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ.
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাযের পর সবচেয়ে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮২১, হা. নং ২০২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসির আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এ হাদিস থেকে যখন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, এ মাসে রোজা রাখার সওয়াব অন্যান্য মাসে রোজা রাখার চেয়ে বেশি; তাই এতে অধিক পরিমাণে রোজা রাখা উচিত। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহর রাসুল সা. তো রমজানের পর সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন শাবান মাসে, তাহলে শাবানের চেয়ে মুহাররম মাসের রোজা রাখা উত্তম হয় কী করে? ইমাম নববি রহ. এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন :
لَعَلَّهُ لَمْ يَعْلَمْ فَضْلَ الْمُحَرَّمِ إِلَّا فِي آخِرِ الْحَيَاةِ قَبْلَ التَّمَكُّنِ مِنْ صَوْمِهِ أَوْ لَعَلَّهُ كَانَ يَعْرِضُ فِيهِ أَعْذَارٌ تَمْنَعُ مِنْ إِكْثَارِ الصَّوْمِ فِيهِ كَسَفَرٍ وَمَرَضٍ وَغَيْرِهِمَا.
‘সম্ভবত তিনি মুহাররমের এ ফজিলতের কথা জীবনের শেষ দিকে জানতে পেরেছেন, কিন্তু রোজা রাখার আর সুযোগ পাননি। কিংবা এ মাসে তার বিভিন্ন সমস্যা; যথা সফর, অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে অধিক রোজা রাখতে পারেননি।’ (শরহু মুসলিম, নববি : ৮/৩৭, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
তিন:
বিশেষ করে আশুরা দিবস তথা মুহাররমের দশ তারিখে রোজা রাখবে। কেননা, এ রোজা রাখলে বান্দার পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ: رَجُلٌ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ... ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ...وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.
‘আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সা.-এর নিকটে আসল। ...অতঃপর রাসুলুল্লাহ সা. বললেন,... আশুরা দিবসের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকটে আশাবাদী যে, তিনি এদ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮১৮, হা. নং ১১৬২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
চার :
আশুরার রোজা রাখা মুসতাহাব। এটা ফরজ, ওয়াজিব কোনো রোজা নয়। তাই কেউ রোজা রাখতে না চাইলে তার ওপর কোনো চাপাচাপি ও জোরজবরদস্তি নেই। যেমন সুনানে আবু দাঊদের বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: «كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تَصُومُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُهُ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، فَلَمَّا قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ،، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ هُوَ الْفَرِيضَةُ، وَتُرِكَ عَاشُورَاءُ، فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ، وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ.
‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ সা. নিজেও জাহিলিয়াতের যুগে এ রোজা রাখতেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সা. যখন মদিনায় আসলেন তখন তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং (সাহাবিদেরকে) রোজা রাখার আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমযানের রোজা ফরজ করা হলো তখন তা আবশ্যক হয়ে গেল এবং আশুরার রোজার আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে গেল। অতএব যার ইচ্ছা সে এ রোজা রাখবে এবং যার ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করবে।’ (সুনানু আবি দাউদ: ২/৩২৬, হা. নং ২৪৪২, প্রকাশনী : আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)
পাঁচ:
আশুরার রোজা শুধু একটি রাখা ঠিক নয়; বরং তার সাথে আগে বা পরে আরেকটি রোজা রাখতে হবে, অন্যথায় তা মাকরুহ হবে। অর্থাৎ মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলে যেকোনো দুটি রোজা রাখা নিয়ম। এর কারণ হলো, ইহুদিরাও ১০ই মুহাররম রোজা রাখত। তাই আমাদের ইবাদতকে তাদের ইবাদতের সাথে অমিল করার জন্য অতিরিক্ত আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ دَاوُدَ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا.
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে রোজা রাখো এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো। তোমরা এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখো।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪/৫২, হা. নং ২১৫৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসে দশ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ যেকোনো একদিন রোজা রাখার কথা বলা হলেও সবচেয়ে উত্তম হলো ৯ তারিখের সাথে মিলিয়ে রাখা। কেননা, রাসুলুল্লাহ সা. নিজেও এদিনে রোজা রাখার ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَبْدَ اللهِ بْنَ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، يَقُولُ: حِينَ صَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ. قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
‘আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. যখন নিজে আশুরা দিবসে রোজা রাখলেন এবং রোজা রাখার আদেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এটা এমন এক দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা নয় তারিখেও রোজা রাখব। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কিন্তু আগামী বছর আসতে না আসতেই রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাত হয়ে যায়।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৭৯৭, হা. নং ১১৩৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
ছয়:
আশুরা দিবস গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এবং এদিনে রোজা রাখার কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়কে এদিন জালিম ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তিদান করেছেন। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ فَرَأَى اليَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ: مَا هَذَا؟، قَالُوا: هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ، فَصَامَهُ مُوسَى، قَالَ: فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ، فَصَامَهُ، وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ.
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আল্লাহর রাসুল সা. মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে,ইহুদিগণ আশুরা দিবসে রোজা রাখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এদিনে রোজা রাখছ কেন?)তারা বলল,এ অতি উত্তম দিন। এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেছেন,ফলে এদিনে মুসা আ. রোজা রেখেছেন। আল্লাহর রাসুল সা. বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিনে রোজা রাখেন এবং (অন্যদেরকেও) রোজা রাখতে নির্দেশ দেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৩/৪৪, হা. নং ২০০৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বিশুদ্ধে সূত্রে প্রমাণিত এতটুকুই হলো আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল। এর বাহিরে আমাদের সমাজে যেসব কিচ্ছা-কাহিনী ও রুসুম-রেওয়াজ আছে, তার অধিকাংশই অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা কিংবা জাল ও মিথ্যা হাদিস। অবশ্য সাহাবি ও তাবিয়িদের থেকে দুয়েকটি বিশুদ্ধ রিওয়ায়াতও পাওয়া যায়। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তাকারে সবগুলো বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
এক :
আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা। বলা হয় যে, এদিনে কেউ নিজ পরিবারে খাবারের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা অবলম্বন করলে আল্লাহ সারা বছর তার রিজিকের মধ্যে প্রশস্ততা দান করবেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ فِي يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَوْسَعَ اللَّهُ عَلَيْهِ سَنَتَهُ كُلَّهَا.
‘আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ তাআলা সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।’ (আল মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৯/১২১, হা. নং ৯৩০২, প্রকাশনী : দারুল হারামাইন, কায়রো- আল মুজামুল কাবির : ১০/৭৭, হা. নং ১০০০৭, প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, কায়রো- মুজামু ইবনিল আরাবি : ১/১৪০, হা. নং ২২৫, প্রকাশনী : দারু ইবনে জাওজি, সৌদিআরব- শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩১, হা. নং ৩৫১২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ- ফাজায়িলুল আওকাত : পৃ. নং ৪৫২, হা. নং ২৪৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মানার, মক্কা)
এ হাদিসটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের একাধিক মত পাওয়া যায়। কারও মতে হাদিসটি মুনকার (প্রত্যাখ্যাত)। আর কারও মতে হাদিসটি দুর্বল হলেও একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ায় হাসান লি-গাইরিহি, যা আমলযোগ্য হাদিস। যেমন ইমাম বাইহাকি রহ. একাধিক সনদে অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করে বলেন :
هَذِهِ الْأَسَانِيدُ وَإِنْ كَانَتْ ضَعِيفَةً فَهِيَ إِذَا ضُمَّ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ أَخَذَتْ قُوَّةً، وَاللهُ أَعْلَمُ "
‘এ সনদগুলো যদিও সব দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে। আল্লাহই ভালো জানেন।’ (শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩৩, হা. নং ৩৫১৫, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
হাফিজ সুয়ুতি রহ. বলেন :
"مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ" لا يثبت، إنما هو من كلام محمد بن المنتشر. قلت: كلا بل هو ثابت صحيح، أخرجه البيهقي في الشعب من حديث أبي سعيد الخدري وأبي هريرة وابن مسعود وجابر، وقال: أسانيده كلها ضعيفة، ولكن إذا ضمّ بعضها إلى بعض أفاده قوة.
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।’ এটা সুসাব্যস্ত হাদিস নয়; বরং এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী। আমি বলব, কক্ষনো নয়; বরং এটা সুসাব্যস্ত এবং বিশুদ্ধ। হাদিসটি ইমাম বাইহাকি রহ. শুআবুল ঈমানে আবু সাইদ খুদরি রা., আবু হুরাইরা রা., ইবনে মাসউদ রা. ও জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। শেষে বলেছেন, “এ সনদগুলোর সবই দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে।”’ (আদ দুরারুল মানসুরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা : পৃ. নং ১৮৬, হা. নং ৩৯৭, প্রকাশনী : ইমাদাতু শুউনিল মাকতাবাত, জামিআ মালিক সাউদ, রিয়াদ)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন :
وَلَوْلَا الرَّجُلُ الْمُبْهَمُ لَكَانَ إِسْنَادُهُ جَيْدًا لَكِنَّهُ يَقْوَى بِالَّذِي قَبْلَهُ.
‘যদি (এতে) অস্পষ্ট রাবিটি না থাকত তাহলে এর সনদটি ভালো বলে বিবেচিত হত। তথাপি পূর্বের রিওয়ায়াতের ভিত্তিতে এটা শক্তিশালী হয়ে যায়।’ (আল-আমালিল মুতলাকা : পৃ. নং ২৮, প্রকাশনী : আল মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত)
হাফিজ সাখাবি রহ. তার আল মাকাসিদুল হাসানা গ্রন্থে হাফিজ ইরাকি রহ.-এর বক্তব্য নকল করতে গিয়ে বলেন :
قال العراقي في أماليه: لحديث أبي هريرة طرق، صحح بعضها ابن ناصر الحافظ.... قال: وله طريق عن جابر على شرط مسلم، أخرجها ابن عبد البر في الاستذكار من رواية أبي الزبير عنه، وهي أصح طرقه، ورواه هو والدارقطني في الأفراد بسند جيد، عن عمر موقوفا عليه.
‘ইরাকি রহ. স্বীয় আমালিতে বলেছেন, আবু হুরাইরা রা.-এর হাদিসের অনেক সনদ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু সনদকে হাফিজ ইবনে নাসির রহ. বিশুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ....তিনি আরও বলেন, হাদিসটি আরেকটি সনদে জাবির রা. থেকে সহিহ মুসলিমের (বিশুদ্ধতার) শর্তানুযায়ী বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি ইমাম ইবনে আ. বার রহ. আল ইসতিজকার গ্রন্থে আবুজ জুবাইর রহ. সূত্রে জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদ। এছাড়াও তিনি এবং ইমাম দারা কুতনি রহ. আল-আফরাদে উমর রা.-এর বাণী হিসাবে উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন।’ (আল মাকাসিদুল হাসানা : পৃ. নং ৬৭৪, হা. নং ১১৯৩, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এর বিপরীত আরেকদল মুহাদ্দিসের নিকটে হাদিসটি বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। যেমন হাফিজ ইবনে কাইয়িম রহ. বলেন :
وَمِنْهَا أَحَادِيثُ الاكْتِحَالِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَالتَّزَيُّنِ وَالتَّوْسِعَةِ وَالصَّلاةِ فِيهِ وَغَيْرِ ذَلِكَ مِنْ فَضَائِلَ لا يَصِحُّ مِنْهَا شَيْءٌ وَلا حَدِيثٌ وَاحِدٌ وَلا يَثْبُتُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيهِ شَيْءٌ غَيْرُ أَحَادِيثِ صِيَامِهِ وَمَا عَدَاهَا فَبَاطِلٌ.
‘আরেকটি হলো, আশুরা দিবসে সুরমা লাগানো, সাজসজ্জা করা, খাবারের মান উন্নত করা, বিশেষ নামাজ পড়াসহ বিভিন্ন যেসব ফজিলতের কথা পাওয়া যায় তার একটা বর্ণনাও বিশুদ্ধ নয়। রাসুলুল্লাহ সা. থেকে এদিনে রোজা রাখা ছাড়া অন্য কিছু প্রমাণিত নয়। রোজা রাখার হাদিস ছাড়া সকল বর্ণনা বাতিল।’ (আল-মানারুল মুনিফ : পৃ. নং ১১১, হা. নং ২২২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যা, হালব)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আশুরা দিবসের বিভিন্ন রুসুম-রেওয়াজের আলোচনা করে বলেন :
فَهَذَا مِنْ الْبِدَعِ الْمُنْكَرَةِ الَّتِي لَمْ يَسُنُّهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا خُلَفَاؤُهُ الرَّاشِدُونَ..... وَإِنْ كَانَ بَعْضُ الْمُتَأَخِّرِينَ مِنْ أَتْبَاعِ الْأَئِمَّةِ قَدْ كَانُوا يَأْمُرُونَ بِبَعْضِ ذَلِكَ وَيَرْوُونَ فِي ذَلِكَ أَحَادِيثَ وَآثَارًا وَيَقُولُونَ: " إنَّ بَعْضَ ذَلِكَ صَحِيحٌ فَهُمْ مُخْطِئُونَ غَالَطُونِ بِلَا رَيْبٍ عِنْدَ أَهْلِ الْمَعْرِفَةِ بِحَقَائِقِ الْأُمُورِ. وَقَدْ قَالَ حَرْبٌ الكرماني فِي مَسَائِلِهِ: سُئِلَ أَحْمَد بْنُ حَنْبَلٍ عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ: {مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ} فِلْم يَرَهُ شَيْئًا.
‘এসব রুসুম-রেওয়াজ সব বর্জনযোগ্য বিদআত, যা রাসুলুল্লাহ সা. ও খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ নয়। .....যদিও পরবর্তী কিছু ইমাম এগুলোর কিছু করার অনুমোদন দেন এবং এ ব্যাপারে হাদিস ও আসার বর্ণনা করে বলেন, এর কিছু বর্ণনা সহিহ; কিন্তু আমি বলব, বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে অবগত বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে তারা নিঃসন্দেহে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ইমাম হারব কিরমানি রহ. তার ‘আল মাসায়িল’-এ বলেন, আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-কে আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করার হাদিসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এটাকে কোনো হাদিস বলে গণ্যই করলেন না।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/৩১২-৩১৩, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
শাইখ আলবানি রহ. বলেন :
وللحديث طرق أخرى كلها ضعيفة ولكن إذا ضم بعضها إلى بعض ازدادت قوة كما قال السخاوي. قلت: هذا رأي السخاوي ولا نراه صوابا لأن شرط تقوي الحديث بكثرة الطرق وهو خلوها من متروك أو متهم لم يتحقق في هذا الحديث.
‘হাদিসটি আরও অনেক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার সবগুলোই দুর্বল। তবে দুর্বল সনদ সব মিলে শক্তিশালী হয়ে যায়; যেমনটি বলেছেন হাফিজ সাখাবি রহ.। আমি বলব, এটা হাফিজ সাখাবি রহ.-এর সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমি এটাকে সঠিক মনে করি না। কেননা, একাধিক দুর্বল সনদে হাদিস শক্তিশালী হওয়ার জন্য সনদে মাতরুক (পরিত্যাক্ত) ও মুত্তাহাম (মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত) রাবি না থাকা শর্ত, যা এ হাদিসে অনুপস্থিত।’ (তামামুল মিন্নাহ : পৃ. নং ৪১০, প্রকাশনী : দারুর রায়া, কায়রো)
তিনি প্রত্যেকটি সনদের দুর্বলতাগুলো বিশদভাবে আলোচনা করেছেন তার ‘আস-সিলসিলাতুজ জইফা’ গ্রন্থে। বিস্তারিত জানার জন্য গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে। (আস সিলসিলাতুজ জইফা : ১৪/৭৩৮, হা. নং ৬৮২৪, প্রকাশনী : দারুল মাআরিফ, রিয়াদ)
ইমাম ইবনে জাওজি রহ. আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করা সংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম উকাইলি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন :
قَالَ العقيلى: وَسليمَان مَجْهُول والحَدِيث غير مَحْفُوظ وَلا يثبت عَنْ رَسُول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَدِيث مُسْند.
‘ইমাম উকাইলি রহ. বলেন, সালমান নামক রাবিটি অজ্ঞাত। আর হাদিসটি মাহফুজ (সংরক্ষিত) নয়। (ইবনে জাওজি রহ. বলেন,) আর এসংক্রান্ত কোনো মুসনাদ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে কিছু বর্ণিত হয়নি।’ (আল-মওজুআত: ২/২০৩, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)
মুল্লা আলি কারি রহ. হাফিজ জারকাশি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন :
قَالَ الزَّرْكَشِيُّ لَا يَثْبُتُ إِنَّمَا هُوَ مِنْ كَلَامِ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْتَشِرِ.
‘হাফিজ জারাকাশি রহ. বলেন, এ হাদিস (রাসুলুল্লাহ সা. থেকে) সুসাব্যস্ত নয়। এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী মাত্র।’ (আল-আসরারুল মারফুআ : পৃ. নং ৩৬০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসটির ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে আরও অনেক মন্তব্য রয়েছে। কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সব এখানে উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি না। সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে, সেটা হলো, হাদিসটি রাসুলুল্লাহ সা.-এর বাণী হিসাবে শক্তিশালী সূত্রে প্রমাণিত নয়; বরং সনদের বিবেচনায় অত্যাধিক দুর্বল বলেই সাব্যস্ত হয়। অবশ্য কিছু সাহাবি ও তাবিয়ি থেকে এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এ ব্যাপারে আমার মত হলো, এ নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কেউ করতে চাইলে কিছু উলামায়ে কিরামের মতের দিকে তাকিয়ে করার অনুমতি দিলেও দেওয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু এটা বিদআত হওয়ার কথাও অনেক উলামায়ে কিরাম লিখেছেন, তাই এ থেকে পারতপক্ষে বিরত থাকাই নিরাপদ ও শ্রেয়; বরং মূলনীতি অনুসারে আবশ্যক হয়ে যায়। কেননা, যখন কোনো আমল সুন্নাত বা বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে তখন উক্ত আমলকে পরিত্যাগ করাটা আবশ্যক।
ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. বলেন :
مَا تَرَدَّدَ بَيْنَ الْوَاجِبِ وَالْبِدْعَةِ يَأْتِي بِهِ احْتِيَاطًا، وَمَا تَرَدَّدَ بَيْنَ الْبِدْعَةِ وَالسُّنَّةِ تَرَكَهُ لِأَنَّ تَرْكَ الْبِدْعَةِ لَازِمٌ وَأَدَاءَ السُّنَّةِ غَيْرُ لَازِمٍ.
‘কোনো কাজ ওয়াজিব ও বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে সতর্কতামূলক তা পালন করবে। আর বিদআত ও সুন্নাত হওয়া নিয়ে কোনো কাজে সংশয় সৃষ্টি হলে তা পরিত্যাগ করবে। কেননা, বিদআত পরিত্যাগ করা আবশ্যক, কিন্তু সুন্নাত আদায় করা (সে পর্যায়ের) আবশ্যক নয়।’ (ফাতহুল কাদির : ১/৫২১, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
নির্ভরযোগ্য কোনো ইমামের মতেই আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়; এমনকি সুন্নাতও নয়; বরং কতিপয় উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে এটা জায়িজ বা সর্বোচ্চ মুসতাহাব একটি আমল। সুতরাং আমলটি অন্যান্য উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে বিদআত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমাদের এমন আমল থেকে বিরত থাকা উচিত।
দুই:
আশুরার রাতে বিশেষ নামাজ। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নুরের মিম্বর তৈরি করবেন। যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি।’
এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫০, তালখিসুল মওজুআত, জাহাবি : ১/১৮৪
তিন.
আশুরা দিবসের বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসি, এগারোবার সুরা ইখলাস, পাঁচবার করে সুরা ফালাক ও নাস পড়বে, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর আল্লাহর নিকট সত্তরবার ইসতিগফার করবে আল্লাহ তাআলা জান্নাতুল ফিরদাউসে তাকে একটি শ্বেত অট্টলিকা দান করবেন, যার মাঝে সবুজ জামরাদ পাথরের তৈরি একটি ঘর থাকবে, যার আয়তন হবে তিন পৃথিবীর সমপরিমাণ।’
এটা ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৪৭, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : ১/৪৭৪, আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ,, লাখনৌবি : ১/৯০, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৪৬, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/৮৯
চার:
সালাতুল খাসমা নামে বিশেষ এক নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘সালাতুল খাসমা, যা আশুরা দিবসে চার রাকআত নামাজকে বলে।’
এটা ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : ১/১১১, কিতাবুল কাসসাস ও মুজাক্কিরিন, ইবনুল জাওজি : ১/৩১২
পাঁচ :
বিশেষ প্রার্থনার নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরা দিবসের নামাজ ছয় রাকআত। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর সুরা শামস, দ্বিতীয় রাকআতে সুরা কদর, তৃতীয় রাকআতে সুরা জিলজাল, চতুর্থ রাকআতে সুরা ইখলাস, পঞ্চম রাকআতে সুরা ফালাক, ষষ্ঠ রাকআতে সুরা নাস। সালামের পর সিজদা দেবে এবং সাতবার সুরা কাফিরুন পড়ে আল্লাহর নিকট প্রয়োজন পূরণের দুআ করবে।’
ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ, লাখনৌবি : ১/১১০
ছয় :
আশুরার বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘ইশরাকের সময় দুই রাকআত নামাজ পড়বে। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি এবং দ্বিতীয় রাকআতে ‘লাউ আনজালনা হাজাল কুরআনা’ থেকে সুরা হাশরের শেষ পর্যন্ত পড়বে। সালামের পর বলবে, ইয়া আউয়ালাল আউওয়ালিন, ইয়া আখিরাল আখিরিন, লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতা আউয়ালা মা খালাকতা ফী হাজাল ইয়াউমি ওয়া তাখলুকু আখিরা মা তাখলুকু ফি হাজাল ইয়াউমি, আ’তিনি ফিহি খাইরা মা আ’তাইতা ফিহি আম্বিয়াআকা ওয়া আসফিয়াআকা মিন সাওয়াবিল বালায়া ওয়া আসহিম লানা মা আ’তাইতাহুম ফিহি মিনাল কারামাতি বিহাক্কি মুহাম্মাদিন আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।’
ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
সাত :
আশুরার শেষ রাতের নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরার শেষ রাতের নামাজ হলো, চার রাকআত নামাজ, যার প্রত্যেক রাকআতে ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি তিনবার, সুরা ইখলাস এগরোবার এবং নামাজ শেষে সুরা ইখলাস একশবার।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
আট :
আরেকটি বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরার রাতের নামাজ হলো একশ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহার পর তিনবার করে সুরা ইখলাস পড়বে।
ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
নয় :
আশুরার রোজায় দশ হাজার শহিদের সওয়াব। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৪, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
দশ :
আশুরার রোজায় দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৬, আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯২, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
এগারো :
আশুরার রোজায় ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব লিখে দেবেন।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি: ২/২০২, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: পৃ. নং ৪০২, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৮, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
বারো :
আশুরার রোজার আরও ফজিলত। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসের রোজা রাখবে তাকে হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে তাকে সাত আসমান ও তাতে অবস্থানরত সকল ফেরেশতাদের সওয়াব দেওয়া হবে। আশুরা দিবসে যার নিকট বসে কোনো মুমিন ইফতার করবে তার কাছে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকলেই ইফতার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো ক্ষুধার্তকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে সে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকল দরিদ্রের পেট ভরিয়ে দিল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো এতিমের মাথার হাত বুলিয়ে দিল তার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে জান্নাতে তার একটি করে মর্যাদা সমুন্নত করা হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান: ১/২৬৫, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯২, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
তেরো :
বনের পশুরাও আশুরা দিবসে রোজা রাখে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘নিশ্চয় বন্য জন্তু-জানোয়ারেরাও আশুরা দিবসে রোজা রাখে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- তাজকিরাতুল মওজুআত, ইবনে তাহের পাটনি : পৃ. নং ১১৮, আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৪, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫৬
চোদ্দো :
পাখিদের মধ্যে কাঠঠোকরা সর্বপ্রথম আশুরার রোজা রেখেছে। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘নিশ্চয় পাখিদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাঠঠোকরা আশুরার রোজা রেখেছে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস : ২/৫৫৫, আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫৬, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৪১৫
পনেরো :
আশুরা দিবসে গোসল করলে কোনো রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
ষোলো :
আশুরা দিবসে মিসকিনদের পরিবারকে খানা খাওয়ালে পুলসিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হওয়া যাবে। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে দরিদ্র লোকদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবে সে বিদ্যুতের ন্যায় পুলসিরাত অতিক্রম করবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
সতেরো :
আশুরা দিবসে রোগীর দেখাশোনা করলে সমগ্র মানবজাতির শুশ্রূষার সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল সে যেন আদম সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
আঠারো :
আশুরা দিবসে সুরমা ব্যবহার করলে প্রদাহজনিত রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে তার চোখ সারাবছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস, আজালুনি : ২/৩০৬, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৩৩২, আত-তাজকিরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা, জারকাশি : ১/১৫৯
ঊনিশ :
আশুরা দিবসে হুসাইন রা.-এর শাহাদাতে কান্না করলে কিয়ামতের দিন সে শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘কোনো বান্দা হুসাইন রা.-এর শাহাদতের দিন তথা আশুরা দিবসে কান্না করলে সে কিয়ামতের দিন অবশ্যই শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৪৪০, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/৩৯, লিসানুল মিজান, ইবনে হাজার : ২/৪৫১
বিশ :
আশুরা দিবসে আল্লাহ অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন নবিদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে কলম সৃষ্টি করেছেন, লাওহে মাহফূজ সৃষ্টি করেছেন, জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, অন্যান্য সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করেছেন, আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহিম আ. জন্মগ্রহন করেছেন, তাঁকে আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ইসমাইল আ.-কে জবেহ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ফিরআউনকে নিমজ্জিত করেছেন, ইদরিস আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন, দাউদ আ.-এর ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন, নবি সা. জন্মগ্রহণ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন হয়েছেন এবং কিয়ামতও এদিনেই সংঘটিত হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান : ১/২৬৬, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯, আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৫
একুশ :
আশুরা দিবসে আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন বর্নিত হয়েছে-
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন আশুরা দিবসে সৃষ্টি করেছেন।”
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল মানারুল মুনীফ, ইবনে কাইয়িম জাওজি: ১/৫২, কাশফুল খাফা ওয়া মুযীলুল ইলবাস, আজালূনী: ২/৫৫৭, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: পৃ. নং ৪২৭, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি : ২/১১৪
বাইশ :
আশুরা দিবসে বিভিন্ন নবিদের মুক্তি ও স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরা দিবসে আদম আ.-এর তাওবা কবুল হয়েছে, নূহ আ.-এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়েছে, ইয়াকুব আ.-এর নিকট ইউসুফ আ.-কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ইবরাহিম আ.-কে আগুন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/৩০০, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৯, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৮
তেইশ :
দীর্ঘ ছয়মাস পানিতে ভাসার পর আশুরা দিবসে নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে গিয়ে থামে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘রজবের প্রথম তারিখে নুহ আ. নৌকায় আরোহন করেন। অতঃপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা সবাই রোজা রাখেন। তাদেরকে নিয়ে নৌকা ছয়মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। মুহাররম মাসে গিয়ে এর চলা বন্ধ হয় এবং আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা স্থির হয়। অতঃপর নুহ আ. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা রাখলেন এবং তার সাথে থাকা সকল মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারকেও রোজা রাখতে আদেশ করলেন।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- মিজানুল ইতিদাল, জাহাবি : ৫/৬২, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৯
ইবনে জাওজি রহ.-এর মওজুআত’-এর বর্ণনায় একসাথে অনেকগুলো ভিত্তিহীন বিষয় বর্নিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ افْتَرَضَ عَلَى بَنِي إِسْرَائِيل صَوْمَ يَوْمٍ فِي السَّنَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهُوَ الْيَوْمُ الْعَاشِرُ مِنَ الْمُحَرَّمِ، فَصُومُوهُ وَوَسِّعُوا عَلَى أَهْلِيكُمْ فِيهِ، فَإِنَّهُ مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ مِنْ مِالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وُسِّعَ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ، فَصُومُوهُ فَإِنَّهُ الْيَوْمُ الَّذِي تَابَ اللَّهُ فِيهِ عَلَى آدَمَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي رَفَعَ اللَّهُ فِيهِ إِدْرِيسَ مَكَانًا عَلِيًّا، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي نَجَّى فِيهِ إِبْرَاهِيمَ مِنَ النَّارِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ فِيهِ نُوحًا مِنَ السَّفِينَةِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ التَّوْرَاةَ عَلَى مُوسَى، وَفِيهِ فَدَى اللَّهُ إِسْمَاعِيلَ مِنَ الذَّبْحِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ اللَّهُ يُوسُفَ مِنَ السِّجْنِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي رَدَّ اللَّهُ عَلَى يَعْقُوبَ بَصَرَهُ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي كَشَفَ اللَّهُ فِيهِ عَنْ أَيُّوبَ الْبَلاءَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ اللَّهُ فِيهِ يُونُسَ مِنْ بَطْنِ الْحُوتِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي فَلَقَ اللَّهُ فِيهِ الْبَحْرَ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي غَفَرَ اللَّهُ لِمُحَمَّدٍ ذَنْبَهُ مَا تَقَدَّمَ وَمَا تَأَخَّرَ، وَفِي هَذَا الْيَوْمِ عَبَرَ مُوسَى الْبَحْرَ، وَفِي هَذَا الْيَوْمِ أَنْزَلَ اللَّه تَعَالَى التَّوْبَةَ عَلَى قَوْمِ يُونُسَ، فَمَنْ صَامَ هَذَا الْيَوْمِ كَانَتْ لَهُ كَفَّارَةُ أَرْبَعِينَ سَنَةً، وَأَوَّلُ يَوْمٍ خَلَقَ اللَّهُ مِنَ الدُّنْيَا يَوْمُ عَاشُورَاءَ، وَأَوَّلُ مَطَرٍ نَزَلَ مِنَ السَّمَاءِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَأَوَّلُ رَحْمَةٍ نَزَلَتْ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا صَامَ الدَّهْرَ كُلَّهُ، وَهُوَ صَوْمُ الأَنْبِيَاءِ، وَمَنْ أَحْيَا لَيْلَة عَاشُورَاء فَكَأَنَّمَا عبد الله تَعَالَى مِثْلَ عِبَادَةِ أَهْلِ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ، وَمَنْ صَلَّى أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ يَقْرَأُ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ الْحَمْدَ مَرَّةً وَخَمْسِينَ مَرَّةً قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ غَفَرَ اللَّهُ خَمْسِينَ عَاما مَاض وَخمسين عَاما مُسْتَقْبل وَبَنَى لَهُ فِي الْمَلأِ الأَعْلَى أَلْفَ أَلْفِ مِنْبَرٍ مِنْ نُورٍ، وَمَنْ سَقَى شَرْبَةً مِنْ مَاءٍ فَكَأَنَّمَا لَمْ يَعْصِ اللَّهَ طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَمَنْ أَشْبَعَ أَهْلَ بَيْتٍ مَسَاكِين يَوْمَ عَاشُورَاءَ، مَرَّ عَلَى الصِّرَاطِ كَالْبَرْقِ الْخَاطِفِ. وَمَنْ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا لَمْ يَرُدَّ سَائِلا قَطُّ، وَمَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَمْرَضْ مَرَضًا إِلا مَرَضَ الْمَوْتِ، وَمَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُورَاء لم ترمد عَيْنَيْهِ تِلْكَ السَّنَةَ كُلَّهَا، وَمَنْ أَمَرَّ يَدَهُ عَلَى رَأْسِ يَتِيمٍ فَكَأَنَّمَا بَرَّ يَتَامَى وَلَدِ آدَمَ كُلَّهُمَ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَاب عشرَة ألف مَلَكٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَابَ أَلْفِ حَاجٍّ وَمُعْتَمِرٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَابَ أَلْفِ شَهِيدٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ سبع سموات وفين خلق الله السَّمَوَات والارضين وَالْجِبَالَ وَالْبِحَارَ، وَخَلَقَ الْعَرْشَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَلَقَ الْقَلَمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخلق اللوج يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَلَقَ جِبْرِيلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَرَفَعَ عِيسَى يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَأَعْطَى سُلَيْمَانَ الْمُلْكَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَيَوْمُ الْقِيَامَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَمَنْ عَادَ مَرِيضًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا عَادَ مَرْضَى وَلَدِ آدَمِ كُلَّهُمْ.
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের ওপর বছরে একদিন শুধুমাত্র আশুরা দিবসের রোজা আবশ্যক করেছিলেন। আর আশুরা হলো মুহাররমের দশ তারিখ। অতএব তোমরা এদিনে রোজা রাখো এবং তোমাদের পরিবারের জন্য খরচে প্রশস্ততা অবলম্বন করো। কেননা, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে স্বীয় সম্পদ থেকে নিজ পরিবারের খরচে প্রশস্ততা করবে তার সারা বছরে প্রশস্ততা দান করা হবে। অতএব তোমরা এ দিবসে রোজা রাখো। কেননা, এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইদরিস আ.-কে উচ্চ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ.-কে (নমরুদের) আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা নুহ আ.-কে জাহাজ থেকে বের করে এনেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইসমাইল আ.-কে জবেহ হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইউসুফ আ.-কে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইয়াকুব আ.-এর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আইয়ুব আ.-কে বিপদমুক্ত করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-কে মাছের পেট থেকে বের করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পথ করে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সা.-এর আগে-পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এদিনেই মুসা আ. সমুদ্র অতিক্রম করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-এর সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি এদিনে রোজা রাখবে তার জন্য এটা চল্লিশ বছরের গুনাহের কাফফারা হবে। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর জন্য দিন সৃষ্টি করেছেন। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম রহমত অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে সে যেন সারাবছরই রোজা রাখল। এটা সকল নবিদের রোজা। যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নুরের মিম্বর তৈরি করবেন। যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি। আর যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে মিসকিনদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে সে পুলসিরাত বিদ্যুতের ন্যায় অতিক্রম করবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সদকা করবে সে যেন কখনও কোনো ভিক্ষুক ও প্রার্থীকে খালী হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে তার চোখ সারাবছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না। যে ব্যক্তি কোনো এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সে যেন মানবজাতির সকল এতিমের সাথে সদ্ব্যবহার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে এক হাজার হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে এক হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তার জন্য সাত আসমান সমপরিমাণ পূণ্য লেখা হবে। এদিনেই আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন, পাহাড়, সাগর সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই আরশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই কলম সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই ইসা আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি আশুরা দিবসেই সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন। আশুরা দিবসেই কিয়ামত হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল সে যেন আদম সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল।’ (আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি : ২/২০০-২০১, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)
হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম ইবনে জাওজি রহ. বলেন :
هَذَا حَدِيث لَا يشك عَاقل فِي وَضعه.
‘এ হাদিসটি মওজু হওয়ার ব্যাপারে কোনো বিবেকবান সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।’ (প্রাগুক্ত)
বি. দ্র. : এ হাদিসের অধিকাংশই মওজু হলেও দুয়েকটি অংশ ঠিক আছে। যেমন মুসা আ.-এর জন্য সাগরে রাস্তা করে দেওয়া এবং এদিনে ফেরআউন সাগরে নিমজ্জিত হওয়া। এটা অন্যান্য সহিহ হাদিসের সাথে মিল আছে। আর কিছু কথা অন্যান্য দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আদম আ.-এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা, নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হওয়ার কথা এবং ইসা আ.-এর জন্মগ্রহণের কথা। এছাড়া বাকি সব কথা ভিত্তিহীন, দুর্বল ও মিথ্যা।
এ ব্যাপারে আল্লামা আ. হাই লাখনৌবি রহ. বলেন :
قلت الَّذِي ثَبت بالأحاديث الصَّحِيحَة المروية فِي الصِّحَاح السِّتَّة وَغَيرهَا أَن الله تَعَالَى نجى مُوسَى على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام من يَد فِرْعَوْن وَجُنُوده وغرق فِرْعَوْن وَمن مَعَه يَوْم عَاشُورَاء وَمن ثُمَّ كَانَت الْيَهُود يَصُومُونَ يَوْم عَاشُورَاء ويتخذونه عيدا وَقد صَامَ النَّبِي حِين دخل الْمَدِينَة وَرَأى الْيَهُود يصومونه وَأمر أَصْحَابه بصيامه وَقَالَ نَحن أَحَق بمُوسَى مِنْكُم وَنهى عَن اتِّخَاذه عيدا وَأمر بِصَوْم يَوْم قبله أَو بعده حذرا من مُوَافقَة الْيَهُود والتشبه بهم فِي إِفْرَاد صَوْم عَاشُورَاء وَثَبت بروايات أخر فِي لطائف المعارف لِابْنِ رَجَب وَغَيره أَن الله قبل تَوْبَة آدم على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام وَثَبت بِرِوَايَة أُخْرَى أَن نوحًا على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام اسْتَوَت سفينته على الجودي يَوْم عَاشُورَاء كَمَا فِي الدّرّ المنثور وَغَيره معزوا إِلَى أَحْمد وَأبي الشَّيْخ وَابْن مرْدَوَيْه وَابْن جرير والأصبهاني وَغَيرهم وَفِي رِوَايَة للأصبهاني فِي كتاب التَّرْغِيب والترهيب أَن يَوْم ولادَة عِيسَى يَوْم عَاشُورَاء كَمَا فِي الدّرّ المنثور أَيْضا وَأما هَذِه الْأَحَادِيث الطوَال الَّتِي ذكر فِيهَا كثير من الوقائع الْعَظِيمَة الْمَاضِيَة والمستقبلة أَنَّهَا فِي يَوْم عَاشُورَاء فَلَا أصل لَهَا وَإِن ذكرهَا كثير من أَرْبَاب السلوك والتاريخ فِي تواليفهم وَمِنْهُم الْفَقِيه أَبُو اللَّيْث ذكر فِي تَنْبِيه الغافلين حَدِيثا طَويلا فِي ذَلِكَ وَكَذَا ذكر فِي بستانه فَلَا تغتر بِذكر هَؤُلَاءِ فَإِن الْعبْرَة فِي هَذَا الْبَاب لنقد الرِّجَال لَا لمُجَرّد ذكر الرِّجَال.
‘আমি বলব, সিহাহ সিত্তা এবং অন্যান্য সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে যতটুকু বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে তা হলো, আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে মুসা আ.-কে ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরআউন ও তার সঙ্গীসাথীরা নিমজ্জিত হয়ে মারা গিয়েছে। এ কারণেই ইহুদিরা এদিনে রোজা রাখত এবং এটাকে তারা তাদের ইদ ও উৎসবের দিবসে পরিণত করেছিল। রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় আসার পর ইহুদিদের রোজা রাখতে দেখে তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে আদেশ দিলেন; একথা বলে যে, আমরা তোমাদের (ইহুদিদের) চেয়ে মুসা আ.-এর অধিক নিকটতর। অবশ্য এদিনে ইদ উৎসব করতে নিষেধ করলেন। ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্যতা থেকে বাঁচার জন্য আশুরার আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখার আদেশ দিলেন। এছাড়াও ইবনে রজব রহ.-এর লাতাইফুল মাআরিফ ও অন্যান্য আরও বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ তাআলা এদিনে আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। অন্য আরেকটি বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নুহ আ.-এর নৌকা আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়; যেমনটি ইমাম আহমাদ রহ., ইমাম আবুশ শাইখ রহ., ইমাম ইবনে মারদুয়া রহ., ইমাম ইবনে জারির রহ., ইমাম আসবাহানি রহ. প্রমূখের উদ্ধৃতিতে দুররে মানসুর ইত্যাদি গ্রন্থে বর্নিত হয়েছে। ইমাম আসবাহানি রহ.-এর বর্ণনায় আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইসা আ.-এর জন্মদিন হলো আশুরা দিবস; যেমনটি দুররে মানসুরে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে, যাতে পূর্বের এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আশুরা দিবসে হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। যদিও অনেক ইতিহাসবিদ ও বুযুর্গগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেমন ফকিহ আবুল লাইস রহ. তামবিহুল গাফিলিন ও বুসতান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এদের এসব বর্ণনার দ্বারা ধোঁকায় নিপতিত হয়ো না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে শুধু বর্ণনার উল্লেখই যথেষ্ট নয়; বরং এসবের পূর্ণ তদন্তের পরই তা গ্রহণযোগ্য হয়। (আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৫-৯৬, প্রকাশনী : মাকতাবাতুশ শারকিল জাদিদ, বাগদাদ)
উল্লেখ্য যে, নবিদের মধ্যে শুধু মুসা আ.-এর ঘটনাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত। আর আদম আ.-এর তাওবা কবুল, নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়া এবং ইসা আ.-এর জন্মের কথা দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে এ দুর্বলতা অত্যাধিক না হওয়ায় ইতিহাসের ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বাকি অন্যান্য ঘটনার কোনো ভিত্তি নেই।
আজ এতটুকুই। এমনিতেই অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ সঠিকভাবে জেনে আমল করার তাওফিক দান করুন।
প্রথমত আমরা কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর আলোকে মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে আলোচনা করব। যাতে মানুষ এ অনুসারে আকিদা ও আমল ঠিক করে নিতে পারে।
এক :
মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত মাসগুলোর একটি। বান্দার জন্য এ সম্মানিত মাসগুলোর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। এসব মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত করবে এবং গুনাহ থেকে বিশেষভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এ মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহ অন্যান্য মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহর চেয়ে অধিক গুরুত্ব রাখে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন :
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ.
‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস হলো বারটি; আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। অতএব এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত মাস বলে অভিহিত করেছেন। সে চারটি মাস হলো, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الزَّمَانُ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ وَذُو الحِجَّةِ وَالمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ، الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ.
‘আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত, নবি সা. বলেছেন,আল্লাহ যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন,সেদিন থেকে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবেই আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। ধারাবাহিকভাবে রয়েছে তিনটি মাস তথা জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত।’ (সহিহুল বুখারি : ৪/১০৭, হা. নং ৩১৭৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
উপরিউক্ত আয়াত ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদিস থেকে প্রমাণ হলো যে, মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট সম্মানিত একটি মাস। সম্মানিত মাসগুলোতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে গুনাহ করা থেকে বেঁচে থাকতে বিশেষভাবে আদেশ দিয়েছেন। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, এসব মাসে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চাইতে অধিক অপরাধ। আর শরিয়তের মূলনীতি হলো, যেখানে গুনাহ অধিক অপরাধের কারণ সেখানে ইবাদতও অধিক পূণ্যের কারণ।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বলেন :
ثُمَّ اخْتَصَّ مِنْ ذَلِكَ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ فَجَعَلَهُنَّ حَرَامًا وَعَظَّمَ حُرُمَاتِهِنَّ وَجَعَلَ الذَّنْبَ فِيهِنَّ أَعْظَمَ والعمل الصالح والأجر أَعْظَمَ. وَقَالَ قَتَادَةُ فِي قَوْلِهِ: فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ إِنَّ الظُّلْمَ فِي الْأَشْهُرِ الْحُرُمِ أَعْظَمُ خَطِيئَةً وَوِزْرًا مِنَ الظُّلْمِ فِيمَا سِوَاهَا، وَإِنْ كَانَ الظُّلْمُ عَلَى كُلِّ حَالٍ عَظِيمًا وَلَكِنَّ اللَّهَ يُعَظِّمُ مِنْ أَمْرِهِ مَا يَشَاءُ.
‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা এ মাসগুলো থেকে চারটি মাসকে আলাদা করে হারাম করেছেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এ মাসগুলোতে গুনাহকে অধিক জঘণ্য করেছেন এবং সৎকর্ম ও সওয়াবকে বৃদ্ধি করেছেন। কাতাদা রহ. আল্লাহর বাণী “অতএব এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না” এর ব্যাখ্যায় বলেন, নিশ্চয় হারাম মাসগুলোতে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চেয়ে অধিক অপরাধ ও ভয়ঙ্কর। যদিও সর্বাবস্থায়ই গুনাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কোনো বিষয়কে বড় ও গুরুত্ববহ করে দেন।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৪/১৩০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
দুই :
এ মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখবে। কেননা, নফল রোজার জন্য সবচেয়ে উত্তম মাস হলো মুহাররম। যেমন সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ.
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাযের পর সবচেয়ে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮২১, হা. নং ২০২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসির আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এ হাদিস থেকে যখন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, এ মাসে রোজা রাখার সওয়াব অন্যান্য মাসে রোজা রাখার চেয়ে বেশি; তাই এতে অধিক পরিমাণে রোজা রাখা উচিত। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহর রাসুল সা. তো রমজানের পর সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন শাবান মাসে, তাহলে শাবানের চেয়ে মুহাররম মাসের রোজা রাখা উত্তম হয় কী করে? ইমাম নববি রহ. এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন :
لَعَلَّهُ لَمْ يَعْلَمْ فَضْلَ الْمُحَرَّمِ إِلَّا فِي آخِرِ الْحَيَاةِ قَبْلَ التَّمَكُّنِ مِنْ صَوْمِهِ أَوْ لَعَلَّهُ كَانَ يَعْرِضُ فِيهِ أَعْذَارٌ تَمْنَعُ مِنْ إِكْثَارِ الصَّوْمِ فِيهِ كَسَفَرٍ وَمَرَضٍ وَغَيْرِهِمَا.
‘সম্ভবত তিনি মুহাররমের এ ফজিলতের কথা জীবনের শেষ দিকে জানতে পেরেছেন, কিন্তু রোজা রাখার আর সুযোগ পাননি। কিংবা এ মাসে তার বিভিন্ন সমস্যা; যথা সফর, অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে অধিক রোজা রাখতে পারেননি।’ (শরহু মুসলিম, নববি : ৮/৩৭, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
তিন:
বিশেষ করে আশুরা দিবস তথা মুহাররমের দশ তারিখে রোজা রাখবে। কেননা, এ রোজা রাখলে বান্দার পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ: رَجُلٌ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ... ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ...وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.
‘আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সা.-এর নিকটে আসল। ...অতঃপর রাসুলুল্লাহ সা. বললেন,... আশুরা দিবসের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকটে আশাবাদী যে, তিনি এদ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮১৮, হা. নং ১১৬২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
চার :
আশুরার রোজা রাখা মুসতাহাব। এটা ফরজ, ওয়াজিব কোনো রোজা নয়। তাই কেউ রোজা রাখতে না চাইলে তার ওপর কোনো চাপাচাপি ও জোরজবরদস্তি নেই। যেমন সুনানে আবু দাঊদের বর্ণনায় এসেছে :
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: «كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تَصُومُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُهُ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، فَلَمَّا قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ،، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ هُوَ الْفَرِيضَةُ، وَتُرِكَ عَاشُورَاءُ، فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ، وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ.
‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ সা. নিজেও জাহিলিয়াতের যুগে এ রোজা রাখতেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সা. যখন মদিনায় আসলেন তখন তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং (সাহাবিদেরকে) রোজা রাখার আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমযানের রোজা ফরজ করা হলো তখন তা আবশ্যক হয়ে গেল এবং আশুরার রোজার আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে গেল। অতএব যার ইচ্ছা সে এ রোজা রাখবে এবং যার ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করবে।’ (সুনানু আবি দাউদ: ২/৩২৬, হা. নং ২৪৪২, প্রকাশনী : আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)
পাঁচ:
আশুরার রোজা শুধু একটি রাখা ঠিক নয়; বরং তার সাথে আগে বা পরে আরেকটি রোজা রাখতে হবে, অন্যথায় তা মাকরুহ হবে। অর্থাৎ মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলে যেকোনো দুটি রোজা রাখা নিয়ম। এর কারণ হলো, ইহুদিরাও ১০ই মুহাররম রোজা রাখত। তাই আমাদের ইবাদতকে তাদের ইবাদতের সাথে অমিল করার জন্য অতিরিক্ত আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ دَاوُدَ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا.
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে রোজা রাখো এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো। তোমরা এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখো।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪/৫২, হা. নং ২১৫৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসে দশ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ যেকোনো একদিন রোজা রাখার কথা বলা হলেও সবচেয়ে উত্তম হলো ৯ তারিখের সাথে মিলিয়ে রাখা। কেননা, রাসুলুল্লাহ সা. নিজেও এদিনে রোজা রাখার ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَبْدَ اللهِ بْنَ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، يَقُولُ: حِينَ صَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ. قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
‘আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. যখন নিজে আশুরা দিবসে রোজা রাখলেন এবং রোজা রাখার আদেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এটা এমন এক দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা নয় তারিখেও রোজা রাখব। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কিন্তু আগামী বছর আসতে না আসতেই রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাত হয়ে যায়।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৭৯৭, হা. নং ১১৩৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
ছয়:
আশুরা দিবস গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এবং এদিনে রোজা রাখার কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়কে এদিন জালিম ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তিদান করেছেন। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ فَرَأَى اليَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ: مَا هَذَا؟، قَالُوا: هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ، فَصَامَهُ مُوسَى، قَالَ: فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ، فَصَامَهُ، وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ.
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আল্লাহর রাসুল সা. মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে,ইহুদিগণ আশুরা দিবসে রোজা রাখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এদিনে রোজা রাখছ কেন?)তারা বলল,এ অতি উত্তম দিন। এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেছেন,ফলে এদিনে মুসা আ. রোজা রেখেছেন। আল্লাহর রাসুল সা. বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিনে রোজা রাখেন এবং (অন্যদেরকেও) রোজা রাখতে নির্দেশ দেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৩/৪৪, হা. নং ২০০৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বিশুদ্ধে সূত্রে প্রমাণিত এতটুকুই হলো আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল। এর বাহিরে আমাদের সমাজে যেসব কিচ্ছা-কাহিনী ও রুসুম-রেওয়াজ আছে, তার অধিকাংশই অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা কিংবা জাল ও মিথ্যা হাদিস। অবশ্য সাহাবি ও তাবিয়িদের থেকে দুয়েকটি বিশুদ্ধ রিওয়ায়াতও পাওয়া যায়। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তাকারে সবগুলো বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
এক :
আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা। বলা হয় যে, এদিনে কেউ নিজ পরিবারে খাবারের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা অবলম্বন করলে আল্লাহ সারা বছর তার রিজিকের মধ্যে প্রশস্ততা দান করবেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ فِي يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَوْسَعَ اللَّهُ عَلَيْهِ سَنَتَهُ كُلَّهَا.
‘আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ তাআলা সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।’ (আল মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৯/১২১, হা. নং ৯৩০২, প্রকাশনী : দারুল হারামাইন, কায়রো- আল মুজামুল কাবির : ১০/৭৭, হা. নং ১০০০৭, প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, কায়রো- মুজামু ইবনিল আরাবি : ১/১৪০, হা. নং ২২৫, প্রকাশনী : দারু ইবনে জাওজি, সৌদিআরব- শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩১, হা. নং ৩৫১২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ- ফাজায়িলুল আওকাত : পৃ. নং ৪৫২, হা. নং ২৪৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মানার, মক্কা)
এ হাদিসটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের একাধিক মত পাওয়া যায়। কারও মতে হাদিসটি মুনকার (প্রত্যাখ্যাত)। আর কারও মতে হাদিসটি দুর্বল হলেও একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ায় হাসান লি-গাইরিহি, যা আমলযোগ্য হাদিস। যেমন ইমাম বাইহাকি রহ. একাধিক সনদে অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করে বলেন :
هَذِهِ الْأَسَانِيدُ وَإِنْ كَانَتْ ضَعِيفَةً فَهِيَ إِذَا ضُمَّ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ أَخَذَتْ قُوَّةً، وَاللهُ أَعْلَمُ "
‘এ সনদগুলো যদিও সব দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে। আল্লাহই ভালো জানেন।’ (শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩৩, হা. নং ৩৫১৫, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
হাফিজ সুয়ুতি রহ. বলেন :
"مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ" لا يثبت، إنما هو من كلام محمد بن المنتشر. قلت: كلا بل هو ثابت صحيح، أخرجه البيهقي في الشعب من حديث أبي سعيد الخدري وأبي هريرة وابن مسعود وجابر، وقال: أسانيده كلها ضعيفة، ولكن إذا ضمّ بعضها إلى بعض أفاده قوة.
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।’ এটা সুসাব্যস্ত হাদিস নয়; বরং এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী। আমি বলব, কক্ষনো নয়; বরং এটা সুসাব্যস্ত এবং বিশুদ্ধ। হাদিসটি ইমাম বাইহাকি রহ. শুআবুল ঈমানে আবু সাইদ খুদরি রা., আবু হুরাইরা রা., ইবনে মাসউদ রা. ও জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। শেষে বলেছেন, “এ সনদগুলোর সবই দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে।”’ (আদ দুরারুল মানসুরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা : পৃ. নং ১৮৬, হা. নং ৩৯৭, প্রকাশনী : ইমাদাতু শুউনিল মাকতাবাত, জামিআ মালিক সাউদ, রিয়াদ)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন :
وَلَوْلَا الرَّجُلُ الْمُبْهَمُ لَكَانَ إِسْنَادُهُ جَيْدًا لَكِنَّهُ يَقْوَى بِالَّذِي قَبْلَهُ.
‘যদি (এতে) অস্পষ্ট রাবিটি না থাকত তাহলে এর সনদটি ভালো বলে বিবেচিত হত। তথাপি পূর্বের রিওয়ায়াতের ভিত্তিতে এটা শক্তিশালী হয়ে যায়।’ (আল-আমালিল মুতলাকা : পৃ. নং ২৮, প্রকাশনী : আল মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত)
হাফিজ সাখাবি রহ. তার আল মাকাসিদুল হাসানা গ্রন্থে হাফিজ ইরাকি রহ.-এর বক্তব্য নকল করতে গিয়ে বলেন :
قال العراقي في أماليه: لحديث أبي هريرة طرق، صحح بعضها ابن ناصر الحافظ.... قال: وله طريق عن جابر على شرط مسلم، أخرجها ابن عبد البر في الاستذكار من رواية أبي الزبير عنه، وهي أصح طرقه، ورواه هو والدارقطني في الأفراد بسند جيد، عن عمر موقوفا عليه.
‘ইরাকি রহ. স্বীয় আমালিতে বলেছেন, আবু হুরাইরা রা.-এর হাদিসের অনেক সনদ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু সনদকে হাফিজ ইবনে নাসির রহ. বিশুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ....তিনি আরও বলেন, হাদিসটি আরেকটি সনদে জাবির রা. থেকে সহিহ মুসলিমের (বিশুদ্ধতার) শর্তানুযায়ী বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি ইমাম ইবনে আ. বার রহ. আল ইসতিজকার গ্রন্থে আবুজ জুবাইর রহ. সূত্রে জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদ। এছাড়াও তিনি এবং ইমাম দারা কুতনি রহ. আল-আফরাদে উমর রা.-এর বাণী হিসাবে উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন।’ (আল মাকাসিদুল হাসানা : পৃ. নং ৬৭৪, হা. নং ১১৯৩, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এর বিপরীত আরেকদল মুহাদ্দিসের নিকটে হাদিসটি বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। যেমন হাফিজ ইবনে কাইয়িম রহ. বলেন :
وَمِنْهَا أَحَادِيثُ الاكْتِحَالِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَالتَّزَيُّنِ وَالتَّوْسِعَةِ وَالصَّلاةِ فِيهِ وَغَيْرِ ذَلِكَ مِنْ فَضَائِلَ لا يَصِحُّ مِنْهَا شَيْءٌ وَلا حَدِيثٌ وَاحِدٌ وَلا يَثْبُتُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيهِ شَيْءٌ غَيْرُ أَحَادِيثِ صِيَامِهِ وَمَا عَدَاهَا فَبَاطِلٌ.
‘আরেকটি হলো, আশুরা দিবসে সুরমা লাগানো, সাজসজ্জা করা, খাবারের মান উন্নত করা, বিশেষ নামাজ পড়াসহ বিভিন্ন যেসব ফজিলতের কথা পাওয়া যায় তার একটা বর্ণনাও বিশুদ্ধ নয়। রাসুলুল্লাহ সা. থেকে এদিনে রোজা রাখা ছাড়া অন্য কিছু প্রমাণিত নয়। রোজা রাখার হাদিস ছাড়া সকল বর্ণনা বাতিল।’ (আল-মানারুল মুনিফ : পৃ. নং ১১১, হা. নং ২২২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যা, হালব)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আশুরা দিবসের বিভিন্ন রুসুম-রেওয়াজের আলোচনা করে বলেন :
فَهَذَا مِنْ الْبِدَعِ الْمُنْكَرَةِ الَّتِي لَمْ يَسُنُّهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا خُلَفَاؤُهُ الرَّاشِدُونَ..... وَإِنْ كَانَ بَعْضُ الْمُتَأَخِّرِينَ مِنْ أَتْبَاعِ الْأَئِمَّةِ قَدْ كَانُوا يَأْمُرُونَ بِبَعْضِ ذَلِكَ وَيَرْوُونَ فِي ذَلِكَ أَحَادِيثَ وَآثَارًا وَيَقُولُونَ: " إنَّ بَعْضَ ذَلِكَ صَحِيحٌ فَهُمْ مُخْطِئُونَ غَالَطُونِ بِلَا رَيْبٍ عِنْدَ أَهْلِ الْمَعْرِفَةِ بِحَقَائِقِ الْأُمُورِ. وَقَدْ قَالَ حَرْبٌ الكرماني فِي مَسَائِلِهِ: سُئِلَ أَحْمَد بْنُ حَنْبَلٍ عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ: {مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ} فِلْم يَرَهُ شَيْئًا.
‘এসব রুসুম-রেওয়াজ সব বর্জনযোগ্য বিদআত, যা রাসুলুল্লাহ সা. ও খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ নয়। .....যদিও পরবর্তী কিছু ইমাম এগুলোর কিছু করার অনুমোদন দেন এবং এ ব্যাপারে হাদিস ও আসার বর্ণনা করে বলেন, এর কিছু বর্ণনা সহিহ; কিন্তু আমি বলব, বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে অবগত বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে তারা নিঃসন্দেহে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ইমাম হারব কিরমানি রহ. তার ‘আল মাসায়িল’-এ বলেন, আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-কে আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করার হাদিসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এটাকে কোনো হাদিস বলে গণ্যই করলেন না।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/৩১২-৩১৩, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
শাইখ আলবানি রহ. বলেন :
وللحديث طرق أخرى كلها ضعيفة ولكن إذا ضم بعضها إلى بعض ازدادت قوة كما قال السخاوي. قلت: هذا رأي السخاوي ولا نراه صوابا لأن شرط تقوي الحديث بكثرة الطرق وهو خلوها من متروك أو متهم لم يتحقق في هذا الحديث.
‘হাদিসটি আরও অনেক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার সবগুলোই দুর্বল। তবে দুর্বল সনদ সব মিলে শক্তিশালী হয়ে যায়; যেমনটি বলেছেন হাফিজ সাখাবি রহ.। আমি বলব, এটা হাফিজ সাখাবি রহ.-এর সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমি এটাকে সঠিক মনে করি না। কেননা, একাধিক দুর্বল সনদে হাদিস শক্তিশালী হওয়ার জন্য সনদে মাতরুক (পরিত্যাক্ত) ও মুত্তাহাম (মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত) রাবি না থাকা শর্ত, যা এ হাদিসে অনুপস্থিত।’ (তামামুল মিন্নাহ : পৃ. নং ৪১০, প্রকাশনী : দারুর রায়া, কায়রো)
তিনি প্রত্যেকটি সনদের দুর্বলতাগুলো বিশদভাবে আলোচনা করেছেন তার ‘আস-সিলসিলাতুজ জইফা’ গ্রন্থে। বিস্তারিত জানার জন্য গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে। (আস সিলসিলাতুজ জইফা : ১৪/৭৩৮, হা. নং ৬৮২৪, প্রকাশনী : দারুল মাআরিফ, রিয়াদ)
ইমাম ইবনে জাওজি রহ. আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করা সংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম উকাইলি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন :
قَالَ العقيلى: وَسليمَان مَجْهُول والحَدِيث غير مَحْفُوظ وَلا يثبت عَنْ رَسُول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَدِيث مُسْند.
‘ইমাম উকাইলি রহ. বলেন, সালমান নামক রাবিটি অজ্ঞাত। আর হাদিসটি মাহফুজ (সংরক্ষিত) নয়। (ইবনে জাওজি রহ. বলেন,) আর এসংক্রান্ত কোনো মুসনাদ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে কিছু বর্ণিত হয়নি।’ (আল-মওজুআত: ২/২০৩, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)
মুল্লা আলি কারি রহ. হাফিজ জারকাশি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন :
قَالَ الزَّرْكَشِيُّ لَا يَثْبُتُ إِنَّمَا هُوَ مِنْ كَلَامِ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْتَشِرِ.
‘হাফিজ জারাকাশি রহ. বলেন, এ হাদিস (রাসুলুল্লাহ সা. থেকে) সুসাব্যস্ত নয়। এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী মাত্র।’ (আল-আসরারুল মারফুআ : পৃ. নং ৩৬০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসটির ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে আরও অনেক মন্তব্য রয়েছে। কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সব এখানে উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি না। সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে, সেটা হলো, হাদিসটি রাসুলুল্লাহ সা.-এর বাণী হিসাবে শক্তিশালী সূত্রে প্রমাণিত নয়; বরং সনদের বিবেচনায় অত্যাধিক দুর্বল বলেই সাব্যস্ত হয়। অবশ্য কিছু সাহাবি ও তাবিয়ি থেকে এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এ ব্যাপারে আমার মত হলো, এ নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কেউ করতে চাইলে কিছু উলামায়ে কিরামের মতের দিকে তাকিয়ে করার অনুমতি দিলেও দেওয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু এটা বিদআত হওয়ার কথাও অনেক উলামায়ে কিরাম লিখেছেন, তাই এ থেকে পারতপক্ষে বিরত থাকাই নিরাপদ ও শ্রেয়; বরং মূলনীতি অনুসারে আবশ্যক হয়ে যায়। কেননা, যখন কোনো আমল সুন্নাত বা বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে তখন উক্ত আমলকে পরিত্যাগ করাটা আবশ্যক।
ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. বলেন :
مَا تَرَدَّدَ بَيْنَ الْوَاجِبِ وَالْبِدْعَةِ يَأْتِي بِهِ احْتِيَاطًا، وَمَا تَرَدَّدَ بَيْنَ الْبِدْعَةِ وَالسُّنَّةِ تَرَكَهُ لِأَنَّ تَرْكَ الْبِدْعَةِ لَازِمٌ وَأَدَاءَ السُّنَّةِ غَيْرُ لَازِمٍ.
‘কোনো কাজ ওয়াজিব ও বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে সতর্কতামূলক তা পালন করবে। আর বিদআত ও সুন্নাত হওয়া নিয়ে কোনো কাজে সংশয় সৃষ্টি হলে তা পরিত্যাগ করবে। কেননা, বিদআত পরিত্যাগ করা আবশ্যক, কিন্তু সুন্নাত আদায় করা (সে পর্যায়ের) আবশ্যক নয়।’ (ফাতহুল কাদির : ১/৫২১, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
নির্ভরযোগ্য কোনো ইমামের মতেই আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়; এমনকি সুন্নাতও নয়; বরং কতিপয় উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে এটা জায়িজ বা সর্বোচ্চ মুসতাহাব একটি আমল। সুতরাং আমলটি অন্যান্য উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে বিদআত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমাদের এমন আমল থেকে বিরত থাকা উচিত।
দুই:
আশুরার রাতে বিশেষ নামাজ। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নুরের মিম্বর তৈরি করবেন। যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি।’
এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫০, তালখিসুল মওজুআত, জাহাবি : ১/১৮৪
তিন.
আশুরা দিবসের বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসি, এগারোবার সুরা ইখলাস, পাঁচবার করে সুরা ফালাক ও নাস পড়বে, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর আল্লাহর নিকট সত্তরবার ইসতিগফার করবে আল্লাহ তাআলা জান্নাতুল ফিরদাউসে তাকে একটি শ্বেত অট্টলিকা দান করবেন, যার মাঝে সবুজ জামরাদ পাথরের তৈরি একটি ঘর থাকবে, যার আয়তন হবে তিন পৃথিবীর সমপরিমাণ।’
এটা ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৪৭, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : ১/৪৭৪, আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ,, লাখনৌবি : ১/৯০, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৪৬, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/৮৯
চার:
সালাতুল খাসমা নামে বিশেষ এক নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘সালাতুল খাসমা, যা আশুরা দিবসে চার রাকআত নামাজকে বলে।’
এটা ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : ১/১১১, কিতাবুল কাসসাস ও মুজাক্কিরিন, ইবনুল জাওজি : ১/৩১২
পাঁচ :
বিশেষ প্রার্থনার নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরা দিবসের নামাজ ছয় রাকআত। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর সুরা শামস, দ্বিতীয় রাকআতে সুরা কদর, তৃতীয় রাকআতে সুরা জিলজাল, চতুর্থ রাকআতে সুরা ইখলাস, পঞ্চম রাকআতে সুরা ফালাক, ষষ্ঠ রাকআতে সুরা নাস। সালামের পর সিজদা দেবে এবং সাতবার সুরা কাফিরুন পড়ে আল্লাহর নিকট প্রয়োজন পূরণের দুআ করবে।’
ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ, লাখনৌবি : ১/১১০
ছয় :
আশুরার বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘ইশরাকের সময় দুই রাকআত নামাজ পড়বে। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি এবং দ্বিতীয় রাকআতে ‘লাউ আনজালনা হাজাল কুরআনা’ থেকে সুরা হাশরের শেষ পর্যন্ত পড়বে। সালামের পর বলবে, ইয়া আউয়ালাল আউওয়ালিন, ইয়া আখিরাল আখিরিন, লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতা আউয়ালা মা খালাকতা ফী হাজাল ইয়াউমি ওয়া তাখলুকু আখিরা মা তাখলুকু ফি হাজাল ইয়াউমি, আ’তিনি ফিহি খাইরা মা আ’তাইতা ফিহি আম্বিয়াআকা ওয়া আসফিয়াআকা মিন সাওয়াবিল বালায়া ওয়া আসহিম লানা মা আ’তাইতাহুম ফিহি মিনাল কারামাতি বিহাক্কি মুহাম্মাদিন আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।’
ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
সাত :
আশুরার শেষ রাতের নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরার শেষ রাতের নামাজ হলো, চার রাকআত নামাজ, যার প্রত্যেক রাকআতে ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি তিনবার, সুরা ইখলাস এগরোবার এবং নামাজ শেষে সুরা ইখলাস একশবার।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
আট :
আরেকটি বিশেষ নামাজ। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরার রাতের নামাজ হলো একশ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহার পর তিনবার করে সুরা ইখলাস পড়বে।
ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন- প্রাগুক্ত)
নয় :
আশুরার রোজায় দশ হাজার শহিদের সওয়াব। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৪, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
দশ :
আশুরার রোজায় দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৬, আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯২, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
এগারো :
আশুরার রোজায় ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব লিখে দেবেন।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি: ২/২০২, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: পৃ. নং ৪০২, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৮, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
বারো :
আশুরার রোজার আরও ফজিলত। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসের রোজা রাখবে তাকে হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে তাকে সাত আসমান ও তাতে অবস্থানরত সকল ফেরেশতাদের সওয়াব দেওয়া হবে। আশুরা দিবসে যার নিকট বসে কোনো মুমিন ইফতার করবে তার কাছে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকলেই ইফতার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো ক্ষুধার্তকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে সে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকল দরিদ্রের পেট ভরিয়ে দিল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো এতিমের মাথার হাত বুলিয়ে দিল তার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে জান্নাতে তার একটি করে মর্যাদা সমুন্নত করা হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান: ১/২৬৫, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯২, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯
তেরো :
বনের পশুরাও আশুরা দিবসে রোজা রাখে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘নিশ্চয় বন্য জন্তু-জানোয়ারেরাও আশুরা দিবসে রোজা রাখে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- তাজকিরাতুল মওজুআত, ইবনে তাহের পাটনি : পৃ. নং ১১৮, আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৪, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫৬
চোদ্দো :
পাখিদের মধ্যে কাঠঠোকরা সর্বপ্রথম আশুরার রোজা রেখেছে। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘নিশ্চয় পাখিদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাঠঠোকরা আশুরার রোজা রেখেছে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস : ২/৫৫৫, আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫৬, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৪১৫
পনেরো :
আশুরা দিবসে গোসল করলে কোনো রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
ষোলো :
আশুরা দিবসে মিসকিনদের পরিবারকে খানা খাওয়ালে পুলসিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হওয়া যাবে। যেমন বর্নিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে দরিদ্র লোকদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবে সে বিদ্যুতের ন্যায় পুলসিরাত অতিক্রম করবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
সতেরো :
আশুরা দিবসে রোগীর দেখাশোনা করলে সমগ্র মানবজাতির শুশ্রূষার সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল সে যেন আদম সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন-আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৫১
আঠারো :
আশুরা দিবসে সুরমা ব্যবহার করলে প্রদাহজনিত রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে তার চোখ সারাবছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস, আজালুনি : ২/৩০৬, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৩৩২, আত-তাজকিরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা, জারকাশি : ১/১৫৯
ঊনিশ :
আশুরা দিবসে হুসাইন রা.-এর শাহাদাতে কান্না করলে কিয়ামতের দিন সে শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘কোনো বান্দা হুসাইন রা.-এর শাহাদতের দিন তথা আশুরা দিবসে কান্না করলে সে কিয়ামতের দিন অবশ্যই শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৪৪০, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/৩৯, লিসানুল মিজান, ইবনে হাজার : ২/৪৫১
বিশ :
আশুরা দিবসে আল্লাহ অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন নবিদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে কলম সৃষ্টি করেছেন, লাওহে মাহফূজ সৃষ্টি করেছেন, জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, অন্যান্য সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করেছেন, আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহিম আ. জন্মগ্রহন করেছেন, তাঁকে আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ইসমাইল আ.-কে জবেহ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ফিরআউনকে নিমজ্জিত করেছেন, ইদরিস আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন, দাউদ আ.-এর ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন, নবি সা. জন্মগ্রহণ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন হয়েছেন এবং কিয়ামতও এদিনেই সংঘটিত হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান : ১/২৬৬, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৯, আল-মওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৫
একুশ :
আশুরা দিবসে আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন বর্নিত হয়েছে-
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন আশুরা দিবসে সৃষ্টি করেছেন।”
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল মানারুল মুনীফ, ইবনে কাইয়িম জাওজি: ১/৫২, কাশফুল খাফা ওয়া মুযীলুল ইলবাস, আজালূনী: ২/৫৫৭, আল আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: পৃ. নং ৪২৭, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩, আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি : ২/১১৪
বাইশ :
আশুরা দিবসে বিভিন্ন নবিদের মুক্তি ও স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘আশুরা দিবসে আদম আ.-এর তাওবা কবুল হয়েছে, নূহ আ.-এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়েছে, ইয়াকুব আ.-এর নিকট ইউসুফ আ.-কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ইবরাহিম আ.-কে আগুন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- আল মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/৩০০, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৯, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি : ২/১৪৮
তেইশ :
দীর্ঘ ছয়মাস পানিতে ভাসার পর আশুরা দিবসে নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে গিয়ে থামে। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
‘রজবের প্রথম তারিখে নুহ আ. নৌকায় আরোহন করেন। অতঃপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা সবাই রোজা রাখেন। তাদেরকে নিয়ে নৌকা ছয়মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। মুহাররম মাসে গিয়ে এর চলা বন্ধ হয় এবং আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা স্থির হয়। অতঃপর নুহ আ. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা রাখলেন এবং তার সাথে থাকা সকল মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারকেও রোজা রাখতে আদেশ করলেন।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন- মিজানুল ইতিদাল, জাহাবি : ৫/৬২, আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৯
ইবনে জাওজি রহ.-এর মওজুআত’-এর বর্ণনায় একসাথে অনেকগুলো ভিত্তিহীন বিষয় বর্নিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ افْتَرَضَ عَلَى بَنِي إِسْرَائِيل صَوْمَ يَوْمٍ فِي السَّنَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهُوَ الْيَوْمُ الْعَاشِرُ مِنَ الْمُحَرَّمِ، فَصُومُوهُ وَوَسِّعُوا عَلَى أَهْلِيكُمْ فِيهِ، فَإِنَّهُ مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ مِنْ مِالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وُسِّعَ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ، فَصُومُوهُ فَإِنَّهُ الْيَوْمُ الَّذِي تَابَ اللَّهُ فِيهِ عَلَى آدَمَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي رَفَعَ اللَّهُ فِيهِ إِدْرِيسَ مَكَانًا عَلِيًّا، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي نَجَّى فِيهِ إِبْرَاهِيمَ مِنَ النَّارِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ فِيهِ نُوحًا مِنَ السَّفِينَةِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ التَّوْرَاةَ عَلَى مُوسَى، وَفِيهِ فَدَى اللَّهُ إِسْمَاعِيلَ مِنَ الذَّبْحِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ اللَّهُ يُوسُفَ مِنَ السِّجْنِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي رَدَّ اللَّهُ عَلَى يَعْقُوبَ بَصَرَهُ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي كَشَفَ اللَّهُ فِيهِ عَنْ أَيُّوبَ الْبَلاءَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي أَخْرَجَ اللَّهُ فِيهِ يُونُسَ مِنْ بَطْنِ الْحُوتِ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي فَلَقَ اللَّهُ فِيهِ الْبَحْرَ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ، وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِي غَفَرَ اللَّهُ لِمُحَمَّدٍ ذَنْبَهُ مَا تَقَدَّمَ وَمَا تَأَخَّرَ، وَفِي هَذَا الْيَوْمِ عَبَرَ مُوسَى الْبَحْرَ، وَفِي هَذَا الْيَوْمِ أَنْزَلَ اللَّه تَعَالَى التَّوْبَةَ عَلَى قَوْمِ يُونُسَ، فَمَنْ صَامَ هَذَا الْيَوْمِ كَانَتْ لَهُ كَفَّارَةُ أَرْبَعِينَ سَنَةً، وَأَوَّلُ يَوْمٍ خَلَقَ اللَّهُ مِنَ الدُّنْيَا يَوْمُ عَاشُورَاءَ، وَأَوَّلُ مَطَرٍ نَزَلَ مِنَ السَّمَاءِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَأَوَّلُ رَحْمَةٍ نَزَلَتْ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا صَامَ الدَّهْرَ كُلَّهُ، وَهُوَ صَوْمُ الأَنْبِيَاءِ، وَمَنْ أَحْيَا لَيْلَة عَاشُورَاء فَكَأَنَّمَا عبد الله تَعَالَى مِثْلَ عِبَادَةِ أَهْلِ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ، وَمَنْ صَلَّى أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ يَقْرَأُ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ الْحَمْدَ مَرَّةً وَخَمْسِينَ مَرَّةً قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ غَفَرَ اللَّهُ خَمْسِينَ عَاما مَاض وَخمسين عَاما مُسْتَقْبل وَبَنَى لَهُ فِي الْمَلأِ الأَعْلَى أَلْفَ أَلْفِ مِنْبَرٍ مِنْ نُورٍ، وَمَنْ سَقَى شَرْبَةً مِنْ مَاءٍ فَكَأَنَّمَا لَمْ يَعْصِ اللَّهَ طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَمَنْ أَشْبَعَ أَهْلَ بَيْتٍ مَسَاكِين يَوْمَ عَاشُورَاءَ، مَرَّ عَلَى الصِّرَاطِ كَالْبَرْقِ الْخَاطِفِ. وَمَنْ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا لَمْ يَرُدَّ سَائِلا قَطُّ، وَمَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَمْرَضْ مَرَضًا إِلا مَرَضَ الْمَوْتِ، وَمَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُورَاء لم ترمد عَيْنَيْهِ تِلْكَ السَّنَةَ كُلَّهَا، وَمَنْ أَمَرَّ يَدَهُ عَلَى رَأْسِ يَتِيمٍ فَكَأَنَّمَا بَرَّ يَتَامَى وَلَدِ آدَمَ كُلَّهُمَ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَاب عشرَة ألف مَلَكٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَابَ أَلْفِ حَاجٍّ وَمُعْتَمِرٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ أُعْطِيَ ثَوَابَ أَلْفِ شَهِيدٍ، وَمَنْ صَامَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ سبع سموات وفين خلق الله السَّمَوَات والارضين وَالْجِبَالَ وَالْبِحَارَ، وَخَلَقَ الْعَرْشَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَلَقَ الْقَلَمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخلق اللوج يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَلَقَ جِبْرِيلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَرَفَعَ عِيسَى يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَأَعْطَى سُلَيْمَانَ الْمُلْكَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَيَوْمُ الْقِيَامَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَمَنْ عَادَ مَرِيضًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَكَأَنَّمَا عَادَ مَرْضَى وَلَدِ آدَمِ كُلَّهُمْ.
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের ওপর বছরে একদিন শুধুমাত্র আশুরা দিবসের রোজা আবশ্যক করেছিলেন। আর আশুরা হলো মুহাররমের দশ তারিখ। অতএব তোমরা এদিনে রোজা রাখো এবং তোমাদের পরিবারের জন্য খরচে প্রশস্ততা অবলম্বন করো। কেননা, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে স্বীয় সম্পদ থেকে নিজ পরিবারের খরচে প্রশস্ততা করবে তার সারা বছরে প্রশস্ততা দান করা হবে। অতএব তোমরা এ দিবসে রোজা রাখো। কেননা, এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইদরিস আ.-কে উচ্চ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ.-কে (নমরুদের) আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা নুহ আ.-কে জাহাজ থেকে বের করে এনেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইসমাইল আ.-কে জবেহ হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইউসুফ আ.-কে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইয়াকুব আ.-এর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আইয়ুব আ.-কে বিপদমুক্ত করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-কে মাছের পেট থেকে বের করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পথ করে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সা.-এর আগে-পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এদিনেই মুসা আ. সমুদ্র অতিক্রম করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-এর সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি এদিনে রোজা রাখবে তার জন্য এটা চল্লিশ বছরের গুনাহের কাফফারা হবে। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর জন্য দিন সৃষ্টি করেছেন। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। আশুরা দিবসেই সর্বপ্রথম রহমত অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে সে যেন সারাবছরই রোজা রাখল। এটা সকল নবিদের রোজা। যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত নামাজ পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নুরের মিম্বর তৈরি করবেন। যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি। আর যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে মিসকিনদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে সে পুলসিরাত বিদ্যুতের ন্যায় অতিক্রম করবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সদকা করবে সে যেন কখনও কোনো ভিক্ষুক ও প্রার্থীকে খালী হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে তার চোখ সারাবছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না। যে ব্যক্তি কোনো এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সে যেন মানবজাতির সকল এতিমের সাথে সদ্ব্যবহার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে এক হাজার হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তাকে এক হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তার জন্য সাত আসমান সমপরিমাণ পূণ্য লেখা হবে। এদিনেই আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন, পাহাড়, সাগর সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই আরশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই কলম সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই ইসা আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি আশুরা দিবসেই সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন। আশুরা দিবসেই কিয়ামত হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল সে যেন আদম সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল।’ (আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি : ২/২০০-২০১, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)
হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম ইবনে জাওজি রহ. বলেন :
هَذَا حَدِيث لَا يشك عَاقل فِي وَضعه.
‘এ হাদিসটি মওজু হওয়ার ব্যাপারে কোনো বিবেকবান সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।’ (প্রাগুক্ত)
বি. দ্র. : এ হাদিসের অধিকাংশই মওজু হলেও দুয়েকটি অংশ ঠিক আছে। যেমন মুসা আ.-এর জন্য সাগরে রাস্তা করে দেওয়া এবং এদিনে ফেরআউন সাগরে নিমজ্জিত হওয়া। এটা অন্যান্য সহিহ হাদিসের সাথে মিল আছে। আর কিছু কথা অন্যান্য দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আদম আ.-এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা, নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হওয়ার কথা এবং ইসা আ.-এর জন্মগ্রহণের কথা। এছাড়া বাকি সব কথা ভিত্তিহীন, দুর্বল ও মিথ্যা।
এ ব্যাপারে আল্লামা আ. হাই লাখনৌবি রহ. বলেন :
قلت الَّذِي ثَبت بالأحاديث الصَّحِيحَة المروية فِي الصِّحَاح السِّتَّة وَغَيرهَا أَن الله تَعَالَى نجى مُوسَى على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام من يَد فِرْعَوْن وَجُنُوده وغرق فِرْعَوْن وَمن مَعَه يَوْم عَاشُورَاء وَمن ثُمَّ كَانَت الْيَهُود يَصُومُونَ يَوْم عَاشُورَاء ويتخذونه عيدا وَقد صَامَ النَّبِي حِين دخل الْمَدِينَة وَرَأى الْيَهُود يصومونه وَأمر أَصْحَابه بصيامه وَقَالَ نَحن أَحَق بمُوسَى مِنْكُم وَنهى عَن اتِّخَاذه عيدا وَأمر بِصَوْم يَوْم قبله أَو بعده حذرا من مُوَافقَة الْيَهُود والتشبه بهم فِي إِفْرَاد صَوْم عَاشُورَاء وَثَبت بروايات أخر فِي لطائف المعارف لِابْنِ رَجَب وَغَيره أَن الله قبل تَوْبَة آدم على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام وَثَبت بِرِوَايَة أُخْرَى أَن نوحًا على نَبينَا وَعَلِيهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام اسْتَوَت سفينته على الجودي يَوْم عَاشُورَاء كَمَا فِي الدّرّ المنثور وَغَيره معزوا إِلَى أَحْمد وَأبي الشَّيْخ وَابْن مرْدَوَيْه وَابْن جرير والأصبهاني وَغَيرهم وَفِي رِوَايَة للأصبهاني فِي كتاب التَّرْغِيب والترهيب أَن يَوْم ولادَة عِيسَى يَوْم عَاشُورَاء كَمَا فِي الدّرّ المنثور أَيْضا وَأما هَذِه الْأَحَادِيث الطوَال الَّتِي ذكر فِيهَا كثير من الوقائع الْعَظِيمَة الْمَاضِيَة والمستقبلة أَنَّهَا فِي يَوْم عَاشُورَاء فَلَا أصل لَهَا وَإِن ذكرهَا كثير من أَرْبَاب السلوك والتاريخ فِي تواليفهم وَمِنْهُم الْفَقِيه أَبُو اللَّيْث ذكر فِي تَنْبِيه الغافلين حَدِيثا طَويلا فِي ذَلِكَ وَكَذَا ذكر فِي بستانه فَلَا تغتر بِذكر هَؤُلَاءِ فَإِن الْعبْرَة فِي هَذَا الْبَاب لنقد الرِّجَال لَا لمُجَرّد ذكر الرِّجَال.
‘আমি বলব, সিহাহ সিত্তা এবং অন্যান্য সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে যতটুকু বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে তা হলো, আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে মুসা আ.-কে ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরআউন ও তার সঙ্গীসাথীরা নিমজ্জিত হয়ে মারা গিয়েছে। এ কারণেই ইহুদিরা এদিনে রোজা রাখত এবং এটাকে তারা তাদের ইদ ও উৎসবের দিবসে পরিণত করেছিল। রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় আসার পর ইহুদিদের রোজা রাখতে দেখে তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে আদেশ দিলেন; একথা বলে যে, আমরা তোমাদের (ইহুদিদের) চেয়ে মুসা আ.-এর অধিক নিকটতর। অবশ্য এদিনে ইদ উৎসব করতে নিষেধ করলেন। ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্যতা থেকে বাঁচার জন্য আশুরার আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখার আদেশ দিলেন। এছাড়াও ইবনে রজব রহ.-এর লাতাইফুল মাআরিফ ও অন্যান্য আরও বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ তাআলা এদিনে আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। অন্য আরেকটি বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নুহ আ.-এর নৌকা আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়; যেমনটি ইমাম আহমাদ রহ., ইমাম আবুশ শাইখ রহ., ইমাম ইবনে মারদুয়া রহ., ইমাম ইবনে জারির রহ., ইমাম আসবাহানি রহ. প্রমূখের উদ্ধৃতিতে দুররে মানসুর ইত্যাদি গ্রন্থে বর্নিত হয়েছে। ইমাম আসবাহানি রহ.-এর বর্ণনায় আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইসা আ.-এর জন্মদিন হলো আশুরা দিবস; যেমনটি দুররে মানসুরে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে, যাতে পূর্বের এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আশুরা দিবসে হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। যদিও অনেক ইতিহাসবিদ ও বুযুর্গগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেমন ফকিহ আবুল লাইস রহ. তামবিহুল গাফিলিন ও বুসতান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এদের এসব বর্ণনার দ্বারা ধোঁকায় নিপতিত হয়ো না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে শুধু বর্ণনার উল্লেখই যথেষ্ট নয়; বরং এসবের পূর্ণ তদন্তের পরই তা গ্রহণযোগ্য হয়। (আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৫-৯৬, প্রকাশনী : মাকতাবাতুশ শারকিল জাদিদ, বাগদাদ)
উল্লেখ্য যে, নবিদের মধ্যে শুধু মুসা আ.-এর ঘটনাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত। আর আদম আ.-এর তাওবা কবুল, নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়া এবং ইসা আ.-এর জন্মের কথা দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে এ দুর্বলতা অত্যাধিক না হওয়ায় ইতিহাসের ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বাকি অন্যান্য ঘটনার কোনো ভিত্তি নেই।
আজ এতটুকুই। এমনিতেই অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ সঠিকভাবে জেনে আমল করার তাওফিক দান করুন।
Comment