বাংলাদেশ কি দারুল ইসলাম নাকি দারুল হারব?
দারুল ইসলামের সংজ্ঞা ও পরিচয়
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
‘দারুল ইসলাম এমন ভূমি, যা মুসলমানদের শাসনাধীন। যেখানে ইসলামের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত। যেখানে মুসলমানরা নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করে।’[1] সেই ভূমিরা অধিবাসীরা যদি সকলেই মুসলমান হয়, কিংবা সকলেই ইসলামের শাসনব্যবস্থা মান্যকারী অমুসলিম (জিম্মি) হয় অথবা সেখানে উভয় গোষ্ঠীরই উপস্থিতি থাকে—এসবের বিধান সমানই হবে। উপরিউক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলে সর্বাবস্থায় তা দারুল ইসলাম হিসেবেই পরিগণিত হবে।
ইসলাম আসার আগে তো আর দারুল ইসলাম বলতে কিছু ছিল না। সব ছিল দারুল হারব। তো এই দারুল হারব কীভাবে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়, আসুন, প্রথমে সে বিষয়টা জেনে নিই। ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর আস-সিয়ারুল কাবির এবং সারাখসি রহ. প্রণীত তার ব্যাখ্যাগ্রন্থের আলোকে প্রতিভাত হয়—দারুল হারব তিনভাবে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয় :
১. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের শহরেই অবস্থান করে, তবে তাদের ইসলাম গ্রহণের সময় থেকে তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।[2]
তেমনি যদি মুশরিকরা সেই শহর বিজয় করে নেয়, এরপর মুসলমানরা পুনরায় তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং মুশরিকরাও সেখান থেকে বিতাড়িত হয় আর মুসলমানরাও সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে, তবে তা দারুল ইসলাম হিসেবেই পরিগণিত হবে। কারণ, যখন মুশরিকরা তা দখলে নিয়ে নিয়েছিল, তখন তা দারুল হারব হয়ে গিয়েছিল। এরপর যখন মুসলমানরা তা বিজয় করে নিল এবং সেখানে বসবাসের সংকল্প করল, তখন পুনরায় তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়েছে।[3]
২. দারুল হারবের কোনো ভূমি বিজিত হলে এবং সেখানে ইসলামের আইনকানুন ও বিধিবিধান বাস্তবায়িত হওয়ার ঘোষণা হলেও তা দারুল ইসলাম হিসেবে বিবেচিত হয়। সারাখসি রহ. বলেন :
‘মুসলমানরা যদি শত্রুদের কোনো ভূমি বিজয় করে এবং তা তাদের পূর্ণ দখলে আসে, সেখানে অবস্থিত হারবি অধিবাসীরা পলায়ন করে, তবে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা তা দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।’
আল্লামা হাসকাফি রহ. বলেন :
‘এ বিষয়ে কোনো মতবিরোধ নেই যে, ইসলামের কিছু আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারাই দারুল হারব দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে।’[4]
বোঝা গেল, ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত না হলে শুধু দেশ বিজয়ের দ্বারাই তা দারুল ইসলাম হিসেবে গণ্য হবে না। তেমনি হারবিরা পূর্ণরূপে বিতাড়িত না হলে, তাদের ক্ষমতা-প্রতাপ পুরোপুরি দূর না হলে তা দারুল ইসলাম হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা, ইসলামি ভূমি হওয়ার জন্য প্রথমে কুফরের মূলোৎপাটন জরুরি।[5]
সারাখসি রহ.-এর কথায় ফিরে যাই। এরপর তিনি বলছেন :
‘মুসলমানদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দ্বারা দেশ দারুল ইসলাম হয়ে যাবে। মুশরিকদের ওপর মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ‘জিম্মি’ বলে গণ্য হবে।” (আর হারবি থাকবে না।)।[6]
বোঝা গেল, কোনো দেশ দারুল ইসলাম হতে পারে; যদিও তার সকল নাগরিক অমুসলিম হয়—যদি তাতে ইসলামের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে, নাগরিকরা অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ইসলামি শাসনক্ষমতার অধীন থাকে। তেমনই কোনো দেশ দারুল হারব হতে পারে; যদিও তার অধিকাংশ নাগরিক মুসলিম হয়—যখন তাতে কুফরের শাসন ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকবে, নাগরিকরা মুসলিম হলেও রাষ্ট্র কুফরি শাসনক্ষমতার অধীনতাভুক্ত থাকবে।
এ জন্যই ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
‘যদি মুসলমানদের কোনো সৈন্যদল দারুল হারবে প্রবেশ করে খলিফার পক্ষ থেকে নির্ধারিত কোনো আমিরের তত্ত্বাবধানে থাকে, এরপর তারা দারুল হারবের কোনো শহরে ঢুকে তার অধিবাসীদের সামনে ইসলামের দাওয়াত উপস্থাপন করে, আর তারা ইসলাম গ্রহণ করতে স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানিয়ে দেয়, ফলে মুসলিম সৈন্যদল তাদেরকে জিযয়া প্রদান করার নির্দেশ দেয়, আর তারাও তাদের এ আহ্বান মেনে নেয়… এবং তারা বলে, “তোমরা আমাদেরকে এই অঙ্গীকার দাও যে, আমরা স্থায়ীভাবে এই ভূমিতেই থাকব।” এমনকি এরপর যতক্ষণ মুসলমানরা তাদের সঙ্গে বাস করবে, হারবিদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং হারবিরাও তাদের ওপর কোনোভাবে চড়াও হওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকে, তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই যে, আমির তাদেরকে ‘জিম্মি’ বানিয়ে নেবেন এবং তাদের ওপর একজন আমির নির্ধারণ করে দেবেন, যিনি তাদের ওপর ইসলামের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবেন। তাদের ওপর ইসলামের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার দ্বারাই তারা জিম্মি হিসেবে এবং সেই দেশ দারুল ইসলাম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। …অবস্থা যদি এমন হয় যে, মুসলমানরা জিম্মিদের সহযোগিতা ছাড়া ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হয়, তবে আমির তাদের ‘জিম্মা’ চুক্তি গ্রহণ করবেন না। কেননা যখন জিম্মিদের সাহায্য-সন্তুষ্টি ছাড়া মুসলমানরা ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হবে, তখন আদতে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করছে জিম্মিরা (মুসলমানরা নয়)। অথচ ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করবে একমাত্র মুসলিমরা।’[7]
এর আলোকে বলা যায়, যেসব দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নেই, যদিও তাতে মুসলমানরা ওয়াজ-মাহফিল করতে পারে, ঈদের নামাজ-জামাআতের নামাজ ইত্যাদি আদায় করতে পারে, তা দারুল ইসলাম হিসেবে পরিগণিত হবে না।[8]
৩. ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
যদি জিম্মিরা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় এবং মুসলমানদের পরাজিত করে দারুল ইসলামের দখল নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়, তাহলে সেখানে তাদের শাসন চলতে পারে, যদি মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে সেখানে বসবাস করতে পারে। কেননা এ ক্ষেত্রে তা দারুল হারব হয়ে যায়নি। দেখছ না, মুসলমানরা সেখানে নিরাপদ! এটা আদতে দারুল ইসলামই, যদিও আজ তার এই অবস্থা।[9]
আল্লামা সারাখসি রহ. বলেন :
যেখানে মুসলমানরা নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারে না, তা দারুল হারবের অন্তর্ভুক্ত। কেননা দারুল ইসলাম সেই ভূখণ্ড, যা মুসলমানদের হাতে রয়েছে। আর এর বাহ্যিক আলামাতই হলো মুসলমানদের যথাযোগ্য নিরাপত্তা।[10]
হাকিম শহিদ রহ. বলেন :
‘দারুল ইসলাম তা, যাতে মুসলমানদের শাসকের ক্ষমতা চলে।’[11]
দারুল হারবের পরিচয়
দারুল হারব মানে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বা যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র নয়। অনেকে ভাবেন, দারুল হারব শুধু এমন রাষ্ট্রকেই বলা হয়, যা কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। বাস্তবে বিষয়টা এমন নয়। কোনো ভূখণ্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল ইসলাম বলা হয় আর কোথাও কুফরি এবং শিরকি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল হারব বলা হয়। দারুল হারবকে অন্য শব্দে ‘দারুল কুফর’, ‘দারুশ শিরক’ ইত্যাদিও বলা হয়। এসব পরিভাষার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ফকিহগণ দারুল হারবের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এ জন্যই সারাখসি রহ. বলেন :
‘দারকে আমাদের দিকে বা তাদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’[12]
এ বিষয়টাকেই আল্লামা কাসানি রহ. আরও বিস্তারিত করে এভাবে বলেছেন :
‘কোনো রাষ্ট্রে কুফরের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হলে তা দারুল কুফর হয়ে যায়। …রাষ্ট্র শুধু কুফরের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই দারুল কুফর বলে গণ্য হয়।’[13]
বোঝা গেল, কোনো রাষ্ট্র দারুল হারব (অন্য শব্দে : দারুল কুফর, দারুশ শিরক) হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য লড়াই-যুদ্ধ চলমান থাকা অপরিহার্য নয়। এ জন্যই হাম্বলি ফকিহগণ বলেন : ‘হারবি শব্দটা হারবের দিকে সম্পর্কিত। হারব অর্থ : কিতাল (লড়াই)। তেমনি এর অর্থ দূরত্ব এবং বিদ্বেষও। তো দারুল হারব অর্থ হলো এমন রাষ্ট্র, যার সঙ্গে মুসলমানদের দূরত্ব কিংবা মুসলমানদের প্রতি রয়েছে যার বিদ্বেষ। হারবিকে হারবি এই দ্বিতীয় অর্থ—তথা দূরত্ব এবং বিদ্বেষ—এর বিচারেই বলা হয়। কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা জরুরি নয়।[14]
দারুল হারবের সংজ্ঞা
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
‘দারুল হারব এমন ভূখণ্ড, যেখানে শিরকের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত এবং যার ওপর হারবিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত।’[15]
এ জন্যই তিনি বলেন :
‘দারুল হারবের কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি মুসলমানরা এ মর্মে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, সেখানে তারা ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত করবে না, তবে তা দারুল হারবই থেকে যাবে।’
সারাখসি রহ. এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন :
‘কেননা কোনো ভূখণ্ড দারুল ইসলাম হিসেবে গণ্য হয় সেখানে ইসলামের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রয়োগ করার দ্বারা। উল্লিখিত ভূখণ্ডে তো মুসলমানদের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রয়োগ করা হয়নি। তাই তা দারুল হারব থাকবে।’
তিনি বলেন : ‘দারুল হারব তা-ই, যেখানে কাফিরদের আইনকানুন চলে।’[16]
তিনি আরও বলেন :
‘যে স্থানে মুসলমানরা নিজেদের ব্যাপারে নিরাপদ নয়, তা দারুল হারব। কেননা দারুল ইসলাম তা-ই, যা মুসলমানদের শাসনাধীন। আর এর বাহ্যিক নিদর্শন হচ্ছে, সেখানে মুসলমানরা নিরাপদে বাস করে।’[17]
এ জন্যই অনেক হানাফি ফকিহ এভাবে বলেছেন :
‘দারুল হারব তা, যেখানে কোনো কাফির রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ চলে কিংবা যেখানকার মুসলমানরা কাফিরদের ভয়ে ভীত থাকে।’[18]
হানাফি মাজহাবের ইমামগণই নন; অধিকাংশ ইমামই দারুল হারবের সংজ্ঞা এভাবেই দিয়েছেন। ইমাম মালিক রহ. বলছেন :
‘মক্কা সে সময় দারুল হারব ছিল; কেননা সেখানে তখন জাহিলিয়্যাতের বিধিবিধান কার্যকর ছিল।’[19]
এ মাসআলায় মালেকি, শাফেয়ি, হাম্বলি সবার বক্তব্য প্রায় একই ধরনের।[20]
পরবর্তী আলিমগণের মধ্যে উস্তাদ আব্দুল কাদির আওদা সুন্দর লিখেছেন, :
‘দারুল হারব শব্দটি প্রত্যেক এমন অনৈসলামিক রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মুসলমানদের শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবেশ করেনি, কিংবা যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত নয়। এ রাষ্ট্রগুলো একই সরকারের পরিচালনাধীন থাক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সরকারের অধীন—এ ক্ষেত্রে সবই সমান। তার স্থায়ী নাগরিকদের মধ্যে মুসলমানরা থাক বা না থাক—এসবই সমান। যতদিন তারা ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম থাকবে, ততদিন তা দারুল হারবই থেকে যাবে।’[21]
হারবির পরিচয়
অনেকের ধারণা, হারবি তাকেই বলে, যে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। শব্দ থেকেও অনেকটা এ সংশয় হয়। তবে ফকিহগণের পরিভাষায় হারবি তিন শ্রেণি :
১. যারা বাস্তবে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে যারা পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করার প্রয়াসে সর্বদা তৎপর।
২. যারা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রেখেছে। তাদেরকে হয়রানি করে। জান-মাল-সম্ভ্রম লুট করে। অর্থনৈতিকভাবে মুসলমানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাখে। কিংবা মুসলমানদেরকে তাদের দীন থেকে ফেরানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। অথবা যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত, তাদেরকে সহযোগিতা প্রদান করে।
৩. যারা মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধেও লিপ্ত নয়, যারা যুদ্ধে লিপ্ত তাদেরও সহযোগী নয়; কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে তাদের কোনোপ্রকার চুক্তি নেই।
উপরিউক্ত তিনও শ্রেণিই ফকিহগণের পরিভাষায় হারবি। হারবি হওয়ার জন্য হারবে (যুদ্ধে) লিপ্ত থাকা আবশ্যক নয়।[22]
দারুল ইসলাম কীভাবে দারুল হারবে রূপান্তরিত হয়
ওপরে আমরা আলোচনা করেছি, দারুল হারব কীভাবে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়। সেখানে আমরা বলে এসেছি, কোনো ভূখণ্ডে ইসলামের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারাই তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর এটাই উম্মাহর সর্বসম্মত মত।[23]
এখন আমরা আলোচনা করব, দারুল ইসলাম পুনরায় কীভাবে দারুল হারবে রূপান্তরিত হয়। তার আগে আমরা জেনে নিই, দারুল ইসলামের ওপর আপতিত অবস্থা মৌলিকভাবে তিন ধরনের :
১. হারবিরা কোনো ইসলামি ভূখণ্ড দখল করে সেখানে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২. কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকরা মুরতাদ হয়ে নিজেদের শহরের ওপর দখলারোপ করেছে এবং সেখানে কুফরি-শিরকি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৩. ইসলামি রাষ্ট্রের জিম্মিরা তাদের জিম্মা চুক্তি ভঙ্গ করে কোনো দেশ বা শহরের ওপর নিজেদের প্রভাব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছে।[24]
এবার আমরা উম্মাহর ফকিহগণের বক্তব্য দেখি। তারা এ ক্ষেত্রে কী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
আলোচিত মাসআলায় আমরা উম্মাহর ফকিহগণের দুধরনের বক্তব্য পাই। আরও স্পষ্ট করে বললে, আলোচিত মাসআলায় ইমামগণের দুমাজহাব। প্রথম মাজহাব ইমাম মালিক রহ., ইমাম শাফেয়ি রহ. ও ইমাম আহমদ রহ. এবং ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর। আর দ্বিতীয় মাজহাব শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর। প্রথমে আমরা সবিস্তারে উভয় মাজহাব উল্লেখ করছি।
প্রথম মাজহাব
প্রথম মাজহাব—কোনো ভূখণ্ড তখন দারুল হারব বলে গণ্য হয়, যখন সেখানে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়; চাই তা দারুল হারবের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হোক কিংবা দারুল হারবের সঙ্গে তার প্রতিবেশিত্ব ও সংলগ্নতা না থাক, তার মুসলমান অথবা জিম্মি নাগরিকরা পূর্বের নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত থাক কিংবা না থাক—সর্বাবস্থায় তা দারুল হারব হিসেবে গণ্য হবে।
ওপরে আমরা আল্লামা সারাখসি রহ. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি—‘দারকে মুসলমানদের দিকে অথবা কাফিরদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’ তাই প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে শিরকের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, সেখানে শক্তি ও ক্ষমতা মুশরিকদের হাতে। তাই তা দারুল হারব। আর প্রত্যেক এমন স্থান, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, সেখানে শক্তি ও ক্ষমতা মুসলমানদের হাতে। তাই তা দারুল ইসলাম।[25]
প্রথম মাজহাবের প্রমাণ
১. এই মাসআলাকে মূলত দারুল হারব দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হওয়ার মাসআলার ওপরে কিয়াস করা হয়েছে। যেমনিভাবে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা দারুল হারব দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়; যদিও সেখানে কাফিরদের অবস্থান রয়ে যায় এবং তা ইসলামি রাষ্ট্র সংলগ্ন না হয়—অর্থাৎ তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র দারুল ইসলাম না হয়ে অন্য কোনো দারুল হারব হয়, তবুও সবার মতেই তা দারুল ইসলাম হিসেবেই গণ্য হয়, তেমনিভাবে দারুল ইসলামেও যখন কুফরি বিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সেখানে মুসলমান থাকলেও এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হলেও তা দারুল হারব হিসেবেই গণ্য হবে। (মুজমা‘ আলাইহি মাসআলার ওপর কিয়াস)।[26]
২. আল্লামা কাসানি রহ. বলেন :
‘এর কারণ হলো, আমাদের দারুল ইসলাম এবং দারুল কুফর বলা—এর মানে তো হলো দারকে ইসলাম এবং কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা। আর দারকে ইসলাম এবং কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তাতে ইসলাম কিংবা কুফর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে। যেমন : জান্নাতকে ‘দারুস সালাম’ নামে নামকরণ করা হয়; যেহেতু তাতে ‘সালাম’ (শান্তি) রয়েছে। একইভাবে জাহান্নামকে ‘দারুল বাওয়ার’ নামে অভিহিত করা হয়, যেহেতু তাতে ‘বাওয়ার’ (ধ্বংস) রয়েছে। ইসলাম এবং কুফর প্রতিষ্ঠিত হয় তার আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা। যখন কোনো ভূখণ্ডে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা দারুল কুফর হয়ে যায়। তাই দারকে এভাবে ইসলাম কিংবা কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা সহিহ। এ জন্য ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারাই কোনো ভূখণ্ড দারুল ইসলাম হিসেবে গণ্য হয়। এই একটি মাত্র শর্ত ছাড়া আর কোনো শর্ত নেই। এমনিভাবে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই দারুল ইসলাম দারুল কুফরে রূপান্তরিত হয়।’[27]
তাতাররা যখন ইসলামি ভূখণ্ডের কিছু দেশ দখল করে নেয়, তখন একদল ফকিহ এর আলোকেই ফতোয়া দিয়েছেন। আল্লামা ইবনু নুজাইম রহ. এর বক্তব্য দেখুন :
‘তাতারদের ব্যাপক ফিতনার পরে এই যে জায়গাগুলো, যেগুলো দখলে নিয়ে তারা সেখানে তাদের বিধিবিধান প্রয়োগ করেছে—যেমন : খুওয়ারিজম, মা-ওয়ারাউন নাহর, খোরাসান প্রভৃতি—‘জাহিরুর রিওয়ায়াত’ অনুযায়ী এসব ভূখণ্ড দারুল হারবে পরিণত হয়েছে।’[28]
দ্বিতীয় মাজহাব
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ‘জাহিরুর রিওয়াহ’র অন্যতম কিতাব আয-যিয়াদাতে ইমামে আজম আবু হানিফা রহ.-এর অভিমত বর্ণনা করেন :
‘তিনটি শর্ত সম্মিলিতভাবে পাওয়া গেলেই দারুল ইসলাম দারুল হারবে রূপান্তরিত হবে। শর্ত তিনটি হলো :
১. এসব দেশে প্রচার-প্রসিদ্ধির সঙ্গে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তা এভাবে হবে যে, শাসক কাফিরদের সংবিধান-নীতির আলোকে দেশ শাসন করবে, (ইসলামের নির্দেশনা জেনে বাস্তবায়ন করার জন্য) মুসলিম বিচারকদের কাছে ধর্ণা দেবে না। মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের বিধানানুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবে না। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইনকানুন হবে অনৈসলামিক আইনকানুন। মুসলমানদের ওপর আরোপিত বিধিবিধান হবে ইসলামের নির্দেশিত বিধিবিধানের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক। যেমন : ইসলাম সুদকে করেছে হারাম, চাপিয়ে দেওয়া আইন তা বৈধ করে দেবে। কুরআন মাজিদ ব্যভিচারকে করেছে হারাম, আর আরোপিত সংবিধান তার বৈধতা দিয়ে দেবে। তেমনি মদ, শূকর, জুয়া—ইসলাম এগুলোকে করেছে হারাম, আর কার্যকর আইনের আলোকে এগুলো সবই পেয়ে যাবে বৈধতার সনদ।
এর আলোকে অনুমিত হয়, দেশে যদি একই সঙ্গে ইসলামি বিধান এবং কুফরি বিধান জারি করা হয়, তবে দারুল ইসলাম দারুল হারব হিসেবে গণ্য হবে না; যেমনটা আল্লামা ইবনে আবিদিন শামি রহ.-ও বলেছেন।
২. দেশটি দারুল হারব সংলগ্ন, তার সাথে লাগোয়া এবং তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র হতে হবে। তার মধ্যে এবং দারুল হারবের মধ্যে কোনো ইসলামি ভূখণ্ড অন্তরায় হতে পারবে না, যেখান থেকে মুসলমানদের সাহায্য আসতে পারে। কোনো দেশকে যদি চারিদিক থেকে ইসলামি রাষ্ট্র ঘিরে রাখে, আর তার ওপর কারও ক্ষমতা না-ও থাকে, তখনো তা অনৈসলামিক ভূখণ্ড হিসেবে গণ্য হবে না।
আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি রহ. বলেন :
‘এর আলোকে তো প্রতিভাত হয় যে, সমুদ্র কোনো অন্তরায় নয়। এরপর তিনি দুদল ফকিহের অভিমত নকল করেন। প্রথম দল বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের হুকুম দারুল হারবের হুকুমে। অপর দল বলছেন, সমুদ্র কোনো গোষ্ঠীরই নয়; যেহেতু তার ওপর কারও ক্ষমতাই কার্যকর নয়।’
শামি রহ. আরও বলেন :
‘এর মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ‘বিলাদুশ শামের’ অধীনে যে ‘জাবালু তাইমিল্লাহ’, যার অপর নাম ‘জাবালে দারুজু’ এবং তার অনুগামী আরও কিছু শহর—এগুলো সব দারুল ইসলাম। কেননা, যদিও এসব শহরের শাসক দারুজ বা নাসারা এবং তাদের ধর্মীয় বিচারকও রয়েছে, যারা তাদের ধর্মের বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে, তাদের কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে গালমন্দ-কটূক্তি করে; কিন্তু তারা সকলেই আমাদের মুসলিম শাসকদের ফায়সালার অধীনস্থ। দারুল ইসলাম চতুর্দিক থেকে তাদের এলাকাগুলোকে বেষ্টন করে রেখেছে। মুসলমান শাসকগণ যখনই তাদের মধ্যে আমাদের বিধান বাস্তবয়িত করতে চাবেন, তখন তা করতে পারবেন।’
৩. সেখানে কোনো মুসলিম কিংবা কোনো জিম্মি মুসলিম শাসক-প্রদত্ত পূর্বের আমান (নিরাপত্তা)-এর মাধ্যমে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত থাকবে না। অর্থাৎ কাফিরদের আক্রমণের পূর্বে মুসলমান তার ইসলামের কারণে এবং জিম্মি তার জিম্মা চুক্তির কারণে মুসলিম সরকারের পক্ষ থেকে যে আমান (নিরাপত্তা) লাভ করেছিল, তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। এখন তারা যদি নিরাপত্তাপ্রাপ্তও থাকে, তবে তা মুশরিকদের তরফ থেকে প্রদত্ত নিরাপত্তা; মুসলমানদের পক্ষ থেকে নয়।
আরও স্পষ্ট করে বলা হলে, মুসলমান কিংবা জিম্মিরা এখন এই ভূখণ্ডে অবস্থান করা এবং নিরাপত্তা লাভ করাটা তারা ইসলামের অনুসারী এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নয়; বরং তাদের অবস্থানের বৈধতা ও নিরাপত্তা এই অঞ্চলের নতুন হারবি শাসকের সঙ্গে কৃত চুক্তির মাধ্যমে। ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়ে তারা এখন অনৈসলামিক শক্তির অধীনে।[29]
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দলিল
১. হুকুম যখন কোনো কারণের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়, তো যতক্ষণ কারণের কিছু অংশও বাকি থাকে, ততক্ষণ হুকুমও বাকি থাকে। তাই যেহেতু কোনো ভূখণ্ড ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা দারুল ইসলাম হিসেবে গণ্য হয়, তো যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের কিছু বিধান এবং কিছু নির্দেশনা জারি থাকবে, সেই পর্যন্ত তা দারুল ইসলাম হিসেবেই গণ্য হবে।[30]
২. আল্লামা কাসানি রহ. বলেন :
‘ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর বক্তব্যের কারণ হলো, দার (ভূখণ্ড)-কে ইসলাম এবং কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করার দ্বারা আসলে তো ইসলাম কিংবা কুফরের হাকিকত উদ্দেশ্য নয়। (ভূখণ্ড তো আর মুসলমান বা কাফির হয় না)। উদ্দেশ্য হলো আমান (নিরাপত্তা) এবং খাওফ (ভীতি)।
এর অর্থ হলো, যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য আমান (নিরাপত্তা) থাকে, আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে খাওফ (ভীতি) থাকে (পূর্ণ নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য আলাদা চুক্তি করতে হয়), তাহলে তা দারুল ইসলাম। আর যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য খাওফ (ভীতি) থাকে আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে থাকে আমান (নিরাপত্তা), তাহলে তা দারুল কুফর। হুকুমের ভিত্তি হলো আমান এবং খাওফ (নিরাপত্তা এবং ভীতি)-এর ওপর; বাস্তবিক ইসলাম এবং কুফরের ওপরের নয়। তাই আমান এবং খাওফকেই বিবেচনায় নেওয়াটা উত্তম। তো যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করতে হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণভাবে আমান রয়েছে ধরা হবে। তাই তা দারুল কুফরে পরিণত হবে না।
তেমনিভাবে সাধারণ নিরাপত্তা তখনই বিনষ্ট হওয়া সম্ভব, যখন সে অঞ্চলটা দারুল হারব সংলগ্ন হবে। তাহলে দারুল ইসলাম দারুল হারবে পরিণত হওয়ার জন্য দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল : আমান (নিরাপত্তা) নষ্ট হওয়া এবং দারুল হারবের সংলগ্ন অঞ্চল হওয়া।
‘দার’কে ইসলামের দিকে নিসবত করার হেতু (Cause) সেটাও হতে পারে, যা সাহিবাইন বলেছেন, আর তা-ও হতে পারে যা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষে আমরা বলছি। অর্থাৎ সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত থাকা। কাফিরদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য আলাদা ‘জিম্মা চুক্তি’ কিংবা ‘ইসতিমান (ভিসা) চুক্তি’ প্রয়োজন।
দারকে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত করার হেতু যদি তা হয়, যা সাহিবাইন বলেছেন, তাহলে কোনো অঞ্চল দারুল কুফর হিসেবে গণ্য হবে সে কারণেই, যা তারা উল্লেখ করেছেন। আর যদি এই সম্পর্কিতকরণের হেতু তা হয়, যা আমরা বলেছি, তাহলে দেশ তখনই দারুল হারব হিসেবে গণ্য হবে, যখন আমাদের বর্ণিত শর্তগুলো পাওয়া যাবে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত দারুল ইসলাম শুধু সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে দারুল কুফরে পরিণত হবে না। কারণ, এ মূলনীতি স্বীকৃত যে, “যা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, তা সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে বিদূরীত হয় না।”[31]
তবে দারুল কুফরের বিষয়টা ভিন্ন। সেখানে ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই তা দারুল ইসলাম হয়ে যাবে। কেননা সেখানে ইসলামের প্রাধান্য। (যদিও বাহ্যত মনে হয়, সেখানে সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয়ের মাধ্যমে সুনিশ্চিত বিষয়কে রহিত করা হয়েছে, কিন্তু) হাদিসের কারণে সেখানে সন্দেহ-সম্ভাবনা গণ্য হবে না। (আর সুনিশ্চিত বিষয়ের মাধ্যমে আরেকটা সুনিশ্চিত বিষয় দূর হতে পারে।) হাদিসটি হলো :
الإسلام يعلو ولا يعلى عليه
ইসলাম উন্নীত থাকে। তার ওপর অন্য কিছু উন্নীত হয় না।[32]
এরপর আল্লামা কাসানি রহ. বলেন :
‘নিসবত যদি ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিবেচনায়ও হয় (যেমনটা সাহিবাইনের অভিমত), তবুও কুফরি বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য উপরিউক্ত দুটো শর্ত প্রয়োজন—অর্থাৎ দারুল হারবের সংলগ্ন হওয়া এবং পূর্বের আমান (নিরাপত্তা) নষ্ট হয়ে যাওয়া। কেননা কুফরি বিধান প্রতিষ্ঠিত হবে কেবল প্রতিরক্ষাবাহিনীর মাধ্যমে। আর প্রতিরক্ষাশক্তি সেই দুশর্তের মাধ্যমেই অস্তিত্ব লাভ করে।[33]
দুই মাজহাবের মধ্যে পার্থক্য কী?
উপরিউক্ত আলোচনা স্পষ্টভাবে বুঝলে এ বিষয়টাকে আলাদা করে আর বলার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করার জন্য আমরা এ শিরোনামে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে পারি।
ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং অন্য সকল ইমামই কোনো ভূখণ্ডের ওপর বিধানারোপ করার ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে শক্তি এবং প্রাধান্যতাকে বিবেচনায় নিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে যে বিষয়ে এসে মতভিন্নতা হয়ে গেছে, আল্লামা সারাখসি রহ. এর ভাষায় তা হলো :
‘কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ. বিবেচনায় নিয়েছেন বল এবং শক্তির পূর্ণতা। কেননা এই শহর ইতিপূর্বে মুসলমানদের রক্ষণকারী হিসেবে দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন সেই ইহরাজ (রক্ষণশক্তি) মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমেই বিদূরিত হওয়া সম্ভব। আর তা এই তিন শর্ত সম্মিলিতভাবে পাওয়া গেলেই সম্ভব। কেননা যখন তা দারুশ শিরক সংলগ্ন না হবে, তখন চারিদিক থেকে মুসলমানদের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে তার অধিবাসীরা পরাভূত থাকবে। তেমনি সেখানে মুসলমান এবং জিম্মি যদি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনেই) নিরাপদ থাকে, তবে তা মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ না থাকার প্রমাণ। এর দৃষ্টান্ত হলো সেই মাসআলা—হারবিরা যদি দারুল ইসলামে অবস্থানরত কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তবে তাদের নিজেদের দেশে সংরক্ষণ করার পূর্ব পর্যন্ত তারা সেই সম্পদের মালিক হয় না; যেহেতু পূর্ণ প্রতাপ নেই।
এরপর যতক্ষণ মূলের নিদর্শনসমূহের কোনো একটাও বাকি থাকে, তখন হুকুম তার ওপরই হয়, আপতিত বিষয়ের ওপর নয়। যেমন কোনো মহল্লা, যতক্ষণ তার মধ্যে একজন বাড়িওয়ালাও থাকবে, ততক্ষণ হুকুম তার ওপরই হবে। সে পর্যন্ত সেখানে নতুন আবাসগ্রহণকারী এবং ক্রেতাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। এই ভূখণ্ড তো মূলত দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তো যতক্ষণ তাতে কোনো মুসলিম কিংবা জিম্মি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনে নিরাপদ) থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মূলের নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে একটি নিদর্শন তো বাকি থাকবে। সুতরাং সেই হুকুম (অর্থাৎ দারুল ইসলাম থাকা এবং দারুল হারবে পরিণত না হওয়া) বাকি থাকবে। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর একটি উসুল।
তেমনই প্রত্যেক জায়গার হুকুমের ক্ষেত্রে তার আশপাশের জায়গার অবস্থা বিবেচ্য। সুতরাং যখন এই ভূখণ্ডের চারিদিকে দারুল ইসলাম, তখন এই ভূখণ্ডের ওপর দারুল হারবের বিধান আরোপিত হবে না। যেমনিভাবে সেখানে শিরকি বিধান প্রতিষ্ঠিত না হলে তা আরোপ করা হতো না। মুরতাদরা এর ওপর দিনের কিছু সময়ের জন্য দখল নিয়েছে মাত্র।’ (ফুঁ দিলেই আবার উড়ে যাবে।)[34]
তাতাররা যখন ইসলামি ভূখণ্ডের ওপর তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে, তখন ফকিহগণের ফতোয়া দুরকমই ছিল। ওপরে আমরা আল্লামা ইবনু নুজায়ম রহ. এর ফতোয়া উদ্ধৃত করেছি। তিনি সাহিবাইনের অভিমতের আলোকে তখন তাতারদের পদানত রাষ্ট্রগুলোকে দারুল হারব বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। এবার আমরা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর অভিমতের আলোকে প্রদত্ত ফতোয়ার নমুনা দেখব।
ইমাম ইবনুল বাযযায কারদারি ইমাম আবু শুজা রহ.-এর ফতোয়া উল্লেখ করেন :
‘আজ (হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে) যেসব ভূখণ্ড কাফিরদের হাতে, সন্দেহ নেই যে, এ জায়গাগুলো দারুল ইসলাম। যেহেতু তা দারুল হারবের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এবং তাতে কুফরি বিধানও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বিচারকরা মুসলমান। এবং শাসকরা—জরুরতের কারণে যাদের তারা আনুগত্য করে, তারা মুসলমান আর জরুরত ছাড়া যাদের আনুগত্য করে, তাদের আনুগত্য ‘মুওয়াদাআ’। যেসব অঞ্চলের ওপর তাদের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত মুসলমান গভর্নর রয়েছে, সেখানে জুমআ-ঈদ কায়িম করা, খারাজ উশুল করা এবং বিচারকদের তাকলিদ করা বৈধ। …তার কাফিরদের আনুগত্য করাটা ‘মুওয়াদাআ’ বা ‘মুখাদাআ’। …আর এ উসুল তো স্থির হয়েছে যে, কারণের কিছু অংশ বাকি থাকার দ্বারাও হুকুম বাকি থেকে যায়। আর আমরা সবাই তো কোনো ইখতিলাফ ছাড়াই হুকুম আরোপ করেছি যে, তাতারদের দখলদারিত্বের পূর্বে এই অঞ্চলগুলো দারুল ইসলামের অন্তর্গত ছিল। আর তাদের দখলদারিত্বের পর আজান দেওয়া, জুমআ-জামাআত আদায় তাদের শাসকদের তরফ থেকে কোনো প্রকার আপত্তি ছাড়াই চলছে। তাই এসব অঞ্চলের ওপর দারুল হারবের বিধান আরোপ করার কোনো কারণ নেই।’[35]
এরপর তিনি হানাফিদের শায়খ শামসুল আয়িম্মাহ আব্দুল আজিজ আল-হালওয়ানি রহ.-এর ফতোয়া উল্লেখ করেন :
‘কোনো ভূখণ্ড দারুল হারব হয়, যখন সেখানে কুফরের বিধান জারি করা হয়, সেখানে কোনো ফায়সালা ইসলামের বিধানের আলোকে করা না হয় এবং তা দারুল হারব সংলগ্ন হয়। আর সেখানে কোনো মুসলিম কিংবা কোনো জিম্মি পূর্বের নিরাপত্তার অধীনে নিরাপদ না থাকে। যখন এই সবগুলো শর্ত পাওয়া যায়, তখন কোনো দেশ দারুল হারব হয়। যখন দলিল এবং শর্তের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, তখন দেশ যা ছিল, তা-ই থাকবে। অথবা সতর্কতার দাবি হিসেবে ইসলামের দিকটাই প্রাধান্য পাবে। তুমি দেখছ না যে, শুধু ইসলামের বিধান জারি করার দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে দারুল হারব দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়।’[36]
প্রসঙ্গ : দারুল আমান
আমরা ওপরে সবিস্তারে আলোচনা করে এসেছি, যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিধান-সংবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা-ই দারুল ইসলাম। এর ব্যাপকতার মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত হয় :
১. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের শহরেই অবস্থান করে, তবে তাদের ইসলাম গ্রহণের সময় থেকে তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
২. দারুল হারবের কোনো ভূমি বিজয় এবং তার ওপর ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়নের ঘোষণার মাধ্যমেও দেশ দারুল ইসলাম হয়। সারাখসি রহ. বলেন : ‘মুসলমানরা যদি শত্রুদের কোনো ভূমি বিজয় করে এবং তাদের পূর্ণ দখলে আসে, হারবি অধিবাসীরা পলায়ন করে, তবে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা তা দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।’[37]
৩. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে ‘জিম্মা চুক্তি’ করে এবং মুসলমানরা তাদের অঞ্চলে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তা-ও দারুল ইসলাম।
৪. সন্ধির মাধ্যমে কোনো দেশ বিজিত হলে তার ভূমি থাকবে মুসলমানদের মালিকানায় এবং হারবি অধিবাসীরা খারাজ প্রদান করে সেখানে অবস্থান করতে পারবে—এটাও দারুল ইসলাম হিসেবেই গণ্য হবে।
এই চার প্রকারের বাইরে যা কিছু আছে, সবই দারুল হারব, অন্য শব্দে—দারুল কুফর, দারুশ শিরক। ওপরে আমরা পূর্ববর্তী ইমাম ও ফকিহগণের বক্তব্য উল্লেখের পাশাপাশি উস্তাদ আব্দুল কাদির আওদার ভাষায় দারুল হারবের সুন্দর সংজ্ঞা উদ্ধৃত করেছি। তিনি বলেন :
‘দারুল হারব শব্দটি প্রত্যেক এমন অনৈসলামিক রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মুসলমানদের শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবেশ করেনি, কিংবা যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত নয়। এ রাষ্ট্রগুলো একই সরকারের পরিচালনাধীন থাক কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সরকারের—বিধানের ক্ষেত্রে সবই সমান। তার স্থায়ী নাগরিকদের মধ্যে মুসলমানরা থাক বা না থাক—এগুলোও সমান। যতদিন তারা ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম থাকবে, ততদিন তা দারুল হারবই থাকবে।’[38]
আমরা আরও আলোচনা করে এসেছি, দারুল হারব মানে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বা যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র নয়। অনেকে ভাবেন, দারুল হারব শুধু এমন রাষ্ট্রকেই বলা হয়, যা কোনো মুসলিম ভূখণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। বাস্তবতা এমন নয়। কোনো ভূখণ্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল ইসলাম বলা হয়। আর কোথাও কুফরি এবং শিরকি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল হারব বলা হয়। দারুল হারবকে অন্য শব্দে—দারুল কুফর, দারুশ শিরক ইত্যাদিও বলা হয়। এসব পরিভাষার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ফকিহগণ দারুল হারবের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এ জন্যই সারাখসি রহ. বলেন :
‘দারকে আমাদের দিকে বা তাদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’[39]
এ বিষয়টাকেই আল্লামা কাসানি রহ. আরও বিস্তারিত করে এভাবে বলেছেন :
‘কোনো রাষ্ট্রে কুফরের আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হলে তা দারুল কুফর হয়ে যায়। …রাষ্ট্র শুধু কুফরের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই দারুল কুফর হিসেবে গণ্য হয়।’[40]
বোঝা গেল, কোনো রাষ্ট্র দারুল হারব (অন্য শব্দে—দারুল কুফর, দারুশ শিরক) হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য লড়াই-যুদ্ধ চলমান থাকা অপরিহার্য নয়। এ জন্যই হাম্বলি ফকিহগণ বলেন :
‘হারবি শব্দটা হারবের দিকে সম্পর্কিত। হারব অর্থ : কিতাল (লড়াই)। তেমনি এর অর্থ দূরত্ব এবং বিদ্বেষও। তো দারুল হারব অর্থ হলো এমন রাষ্ট্র, যার সঙ্গে মুসলমানদের দূরত্ব কিংবা মুসলমানদের প্রতি রয়েছে যার বিদ্বেষ। হারবিকে হারবি এই দ্বিতীয় অর্থ—তথা দূরত্ব এবং বিদ্বেষ-এর বিচারেই বলা হয়। কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা জরুরি নয়।[41]
উম্মাহর ফকিহগণের আলোচনা থেকে তো স্পষ্ট অনুমিত হয়, দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বাইরে আর কোনো বিভক্তি তাদের দৃষ্টিতে ছিল না। দু-চারজন এ ব্যাপারে ফতোয়া দেওয়ার চেষ্টা করলেও উম্মাহর কাছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন ফতোয়া হিসেবেই অভিহিত হয়েছে। বাস্তবতা হলো সমগ্র পৃথিবী দুভাগে বিভক্ত; একভাগের নাম দারুল ইসলাম, আরেক ভাগের নামের দারুল হারব। তৃতীয় আর কিছু নেই। এ ব্যাপারে উম্মাহর বিদগ্ধ ফকিহণের ঐকমত্য রয়েছে। এখানে আমরা দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকজনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
কাজি আবু ইয়ালা রহ. বলেন :
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে বিজয় কুফরের নয়, ইসলামের বিধান-সংবিধানের, তা দারুল ইসলাম। আর প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে বিজয় ইসলামের নয়, কুফরের বিধান-সংবিধানের, তা দারুল কুফর। ব্যতিক্রম হলো গোমরাহ কাদারিয়্যাদের বক্তব্য। তারা বলে, যে ভূখণ্ডে পাপিষ্ঠদের প্রাধান্য, কাফির বা মুসলিমদের নয়, তা দারুল কুফর নয়, দারুল ইসলামও নয়; তা হলো দারুল ফিস্*ক। এ বক্তব্যের ভিত্তি হলো, তাদের সেই মূলনীতি—‘মানযিলাতুন বাইনাল মানযিলাতাইন’ (ইসলাম এবং কুফরের মাঝামাঝি আরেকটি স্তর)। আমাদের দলিল ইমানের অধ্যায়ে বিগত হয়েছে। শরিয়তের মুকাল্লাফ যারা, তাদের তো দুটো অবস্থাই হতে পারে :
১. কাফির
২. মুমিন—পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী বা ত্রুটিপূর্ণ ইমানের অধিকারী।
তো সকল মানুষ হয়তো মুমিন, কিংবা কাফির। এমন তো হতে পারে না যে, কোনো শরিয়তের মুকাল্লাফ ব্যক্তি মুমিনও নয়, আবার কাফিরও নয়। (উল্লেখ্য, মুনাফিক আলাদা কিছু নয়। তারা হলো কাফিরদের সর্বনিম্ন শ্রেণি। চিরস্থায়ী জাহান্নামী। জাহান্নামের সবচে নিম্নস্তরে হবে তাদের বসবাস।) তেমনিভাবে ‘দার’ও দুই অবস্থা থেকে মুক্ত হবে না। হয়তো তা দারুল কুফর হবে, কিংবা তা দারুল ইসলাম হবে।[42] আল্লামা ইবনু মুফলিহ রহ. বলতেন :
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা দারুল ইসলাম। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা দারুল কুফর। এ দুয়ের বাইরে আর কোনো দার নেই।’[43]
হ্যাঁ, তৃতীয় আরেকটি দারের অস্তিত্বের বর্ণনা আমরা পাই ইউরোপীয় ও প্রাচ্যবিদ গবেষকদের কাছে। তারা এটাকে ‘দারুল আহ্*দ’ নামে, কেউ ‘দারুল আমান’ নামে, কেউ ‘দারুল মুওয়াদায়াহ’ নামে উল্লেখ করেন।[44]
সর্বপ্রথম আমরা এই বন্টন দেখতে পাই ‘দায়িরাতুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া’র (Islamic Encyclopedia) লেখকদের কাছে। এরপর বিদগ্ধ গবেষকদের মধ্যে এই আলোচনার সূত্রপাত করেন ড. নজিব।[45] তারপর একে আরও শক্তিশালী করেন শায়খ আবু জুহরা।[46] একই চিন্তা লালন করেন ড. ওয়াহবা জুহায়লি, ড. মুহাম্মাদ দাসুকি, ড. আব্দুল হামিদ আলহাজ, ড. মাজিদ, উস্তাদ আল্লাল আল-ফাসি আল-মাগরিবি।[47]
আমাদের ইমামগণের মতে দারুল হারব দুই প্রকার :
১. এমন দারুল হারব, যার সঙ্গে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই। এটা হলো দারুল খাওফ। অর্থাৎ ভয়ের শহর; যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়।
২. এমন দারুল হারব, যার অধিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। এটাকে আমরা দারুল আমান, দারুল আহদ বা দারুল মুওয়াদাআহ বলতে পারি। এই রাষ্ট্র যদিও ইসলামি রাষ্ট্র নয়, কিন্তু সেখানে চুক্তির কারণে মুসলমানরা নিরাপদ। যেমন ছিল রাসুলের যুগে নাজাশির রাষ্ট্র হাবাশাহ (ইথিওপিয়া)।
দ্বিতীয় প্রকারটিকেও আমাদের মহান ইমামগণ দারুল হারবের মধ্যেই গণ্য করেছেন। তারা এটাকে স্বতন্ত্র কোনো ‘দার’ নয়; বরং দারুল হারব গণ্য করেই এর ভিত্তিতে অনেক মাসআলা এবং ফতোয়া প্রদান করেছেন।
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
‘দারুল হারবের দেশসমূহের মধ্য থেকে কোনো দেশের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তারা প্রতি বছর মুসলমানদের খারাজ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্য কোনো কর প্রদান করবে এই শর্তে যে, মুসলমানরা তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করবে না, এবং তারা জিম্মিও হয়ে যাবে না— এরপর তাদের কেউ এই চুক্তির ভিত্তিতে অনেক ধনসম্পদ নিয়ে দারুল ইসলামের উদ্দেশে বের হয়, তাহলে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত।’
ইমাম সারাখসি রহ. এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
‘যে লোকটি দারুল ইসলামের উদ্দেশে বেরিয়েছে, সে তার অবস্থানুযায়ী হারবি ও জিম্মি নয়; তবে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত। কেননা চুক্তিবদ্ধ নাগরিকদের ওপর ইসলামের বিধান প্রয়োগ হয় না।… এই চুক্তির দ্বারা তাদের দেশ দারুল ইসলাম হয়ে যায়নি, যেহেতু সেখানে ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হয়নি। তা দারুল হারবই থেকে যাবে।’[48]
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আরও বলেন :
‘চুক্তিকারীদের কোনো নাগরিক তাদের দেশে (দারুল মুওয়াদাআহ’তে) অপর কোনো নাগরিককে হত্যা করলে তার ওপর কিসাস কার্যকর হবে না। আর যদি আমাদের রাষ্ট্রে (দারুল ইসলামে) কোনো মুসতামিন (ভিসাধারী) অপর কোনো মুসতামিনকে হত্যা করে, তবে তার ওপর কিসাস অপরিহার্য হবে।’
ইমাম সারাখসি রহ. এর কারণ বর্ণনা করেন :
‘কেননা চুক্তিকারীরা ইসলামের বিধিবিধান নিজেদের ওপর অপরিহার্য করে নেয়নি। কেননা তারা চুক্তিই করেছে এই মর্মে যে, তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হবে না। তাই তাদের রাষ্ট্র পূর্বের মতো দারুল হারবই থাকবে।’[49]
তিনি আরও বলেন :
‘কেননা যখন তারা ইসলামের বিধানের সামনে নতি স্বীকার করেনি, তখন চুক্তি করার দ্বারা চুক্তিকারী হলেও তারা ‘হারবি’র কাতার থেকে বেরিয়ে যায়নি। তুমি দেখছ না, কৃত চুক্তির মেয়াদ গত হলেই তো পুনরায় তারা (কাট্টা) হারবিই হয়ে যাবে।’[50]
আধুনিক বিশ্লেষকদের বক্তব্যের সারকথা
এবার আমরা বর্তমান বিশ্লেষকদের বক্তব্যের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবার বক্তব্য উদ্ধৃত করা তো সম্ভব নয়। তাই সূত্রগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। কেউ চাইলে সেখান থেকে দেখে নিতে পারবে। তবে সংক্ষেপে তাদের বক্তব্যগুলোর মৌলিক কয়েকটি পয়েন্টের পর্যালোচনা উল্লেখ করার প্রয়াস পাবো।
১. তৃতীয় কোনো ‘দার’-এর অস্তিত্ব গণ্য করা মহান ইমাম এবং ফকিহণের ঐকমত্যের বিপরীত। সন্ধিকারীরা ইসলামের বিধিবিধানের অনুগত হলে তাদের রাষ্ট্র ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবেই গণ্য হবে—তাতে মুসলমানের সংখ্যা যত কমই হোক কিংবা মোটেও তাদের অস্তিত্ব না থাক। আর যদি তারা ইসলামের বিধান-সংবিধান এবং ইসলামি শাসনক্ষমতার সাথে একমত না হয়, তাহলে তা দারুল হারব। এর বাইরে আর কোনো অবস্থা নেই।
২. কেউ কেউ ইমাম শাফেয়ি এবং তার শাগরিদদের বক্তব্য দ্বারা এই তৃতীয় ‘দার’-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান। ইমাম শাফেয়ি তো এ ক্ষেত্রে বড়ই মাজলুম। একশ্রেণির অথর্ব তো ইমাম শাফেয়ির বক্তব্য বিকৃত করে পুরো দুনিয়াকে এক ‘দার’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তারা দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বিভক্তিকেই স্বীকার করে না। এই আরেক শ্রেণি তার বক্তব্যকে অপাত্রে প্রয়োগ করে, পুরো দুনিয়াকে তিন ‘দার’ বানাতে চায়। তবে মজার বিষয়, তারা তার বক্তব্যকে হুবহু উদ্ধৃত করে না। এই অভিমতকে শুধু তার দিকে সম্পৃক্ত করেই ক্ষান্ত হয়। আল্লাহ জানেন, সামনে কে এসে কীভাবে আরও বিকৃত করে।
৩. কেউ কেউ তো ইমাম মুহাম্মাদ এবং কাজি আবু ইয়ালা রহ.-এর দিকেও এই সারহীন অভিমতকে নিসবত করে। ওপরে তো আমরা তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য উল্লেখ করেই এসেছি। কাজি আবু ইয়ালা রহ. তো পরিষ্কার ভাষায় তৃতীয় ‘দার’-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন।
৪. কেউ ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর একটি ফতোয়াকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। কিন্তু খোদ তা-ই ছিল বিচ্ছিন্ন ফতোয়া। আর স্পষ্ট যে, কারও বিচ্ছিন্ন মত গ্রহণ করা অনুমোদিত নয়।
৫. কেউ মাওয়ারদি রহ.-এর একটি বক্তব্যকে ভুল বুঝে বা অপাত্রে প্রয়োগ করেও এই উদ্দেশ্য অর্জন করার চেষ্টা করেছেন। তবে এই তৃতীয় ‘দার’-এর অস্তিত্বের প্রথম ঘোষক প্রাচ্যবিদ মহোদয়গণ এতোটা বে-ইনসাফ হননি। তারা পর্যন্ত মাওয়ারদি রহ. এর বক্তব্য দ্বারা যে তৃতীয় কোনো ‘দার’-এর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না— স্বীকার করেছেন।
৬. হাবাশাকে তৃতীয় ‘দার’-এর পক্ষে প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা ইলমি অগভীরতার প্রমাণ বহন করে। কেননা হাবাশায় ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত ছিল না, তাই তা দারুল হারব। হ্যাঁ, সেখানে মুসলমানদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। এর কারণে তা দারুল হারব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমরা ওপরে বলে এসেছি, দারুল হারব দুধরনের : দারুল খাওফ (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়) এবং দারুল আহদ, দারুল মুওয়াদাআহ বা দারুল আমান (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ)।
বাংলাদেশ কেন দারুল হারব?
শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. তার ঐতিহাসিক ফতোয়ায় লেখেন :
‘কোনো রাষ্ট্রকে কেবল এ হিসেবেই দারুল ইসলাম বলে দেওয়া হবে না যে, তাতে মুসলমানরা বসবাস করে কিংবা কাফিরদের অনুমতিক্রমে শাআয়িরে দীন[51] পালন করতে পারে। কোনো (কাফির রাষ্ট্র দারুল ইসলাম গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে উক্ত) রাষ্ট্রে শুধু মুসলমানদের বসবাস করতে পারা কিংবা কাফেরদের অনুমতিক্রমে শাআয়েরে দীন পালন করতে পারার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
তদ্রুপ (ইসলামি শাসনাধীন) কোন রাষ্ট্রে কাফিরদের বসবাস করা কিংবা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে বা তাদের গাফলতির সুযোগে সেখানে শাআয়েরে কুফর জাহির করার কারণে তা দারুল ইসলাম হওয়ার মধ্যে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।
কেননা এ উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় ওই সব লোকের নয়। আর (দারুল ইসলাম বা দারুল হারব হওয়ার) ভিত্তি তো হচ্ছে বিজয়ের ওপর। শুধু বসবাস বা (শাআয়েরে দীন) জাহির করার ওপর নয়।
এ কারণেই তো জিম্মি কাফিররা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে দারুল ইসলামে বসবাস করে এবং তাদের শাআয়িরগুলো পালনও করে । কিন্তু দারুল ইসলাম তার আপন অবস্থায় দারুল ইসলামই থেকে যায়।
তদ্রুপ মুসলমানরা দারুল কুফরে যায় এবং তাদের শাআয়েরগুলো পালনও করে। কিন্তু শুধু এতটুকুর কারণে ওই রাষ্ট্র দারুল হারব হওয়া থেকে বের হয়ে যায় না।
তোমরা কি দেখো না, মক্কা বিজয়ের পূর্বে যখন মক্কা মুকাররামা দারুল হরব ছিল তখন ফখরে আলম ﷺ উমরাতুল কাজার সময় এক বিশাল বাহিনীসহ মক্কা মুয়াজ্জমায় উপস্থিত হয়েছিলেন। জামায়াত, নামাজ, উমরা ও অন্যান্য শাআয়ির ঘোষণা দিয়ে পালন করেছিলেন। তার সাথে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, তিনি চাইলেই কাফিরদেরকে পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কেননা উমরাতুল কাজার পূর্বে হুদায়বিয়ার সময় ওই পরিমাণ বাহিনী নিয়ে মক্কা মুয়াজ্জামার ওপর চড়াও হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু খোঁজ-খবর নেওয়ার পর যখন হযরত উসমান রা.-এর হত্যার ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন উক্ত প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করা হয়।
মোটকথা রাসুল ﷺ-এর সঙ্গে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, তিনি কাফিরদের পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কিন্তু মক্কায় প্রবেশ এবং শাআয়ির আদায় যেহেতু কাফিরদের অনুমতিক্রমে হয়েছিল, এ কারণে মক্কা মুয়াজ্জমাকে উক্ত তিন দিনের জন্য দারুল ইসলাম গণ্য করা হয়নি; বরং পূর্বের মতো দারুল হারব হিসেবেই বহাল ছিল। কেননা মক্কায় প্রবেশ এবং ইসলাম জাহির করা (কাফিরদের) অনুমতির ভিত্তিতে ছিল, বিজয়ের ভিত্তিতে ছিল না।’
শাইখুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. বলেন :
‘পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা একটি ইউরোপীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা; যাতে অধিবাসী হিসেবে মুসলিম ও অমুসলিম সকলেই অংশীদার। সেটাকে ইসলামি রাষ্ট্র বলা ভুল।’[52]
মাওলানা ইদরিস কান্ধলবি রহ. বলেন :
‘যে রাষ্ট্র আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্ব এবং শরিয়তের বিধিবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতাকে গ্রহণ করে না; বরং এ কথা বলে যে, রাষ্ট্র হলো জনসাধারণ ও শ্রমিকদের এবং রাষ্ট্রের আইন তা-ই হবে, যা জনসাধারণ ও শ্রমিকরা মিলে তৈরি করবে, তো এ ধরনের রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে কাফির রাষ্ট্র।’[53]
মুফতিয়ে আজম বাংলাদেশ মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামি (হাফিজাহুল্লাহ) বলেন :
‘ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচয় হলো, সে রাষ্ট্রে ইসলামি আইন-কানুন তথা কুরআন-হাদিসের বিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে। রাষ্ট্রের শাসকবর্গ থেকে শুরু করে প্রজাবর্গ পর্যন্ত সবাই উক্ত আইনের পাবন্দি করবে। এ সবকিছুর পর সেই রাষ্ট্র ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত হবে এবং সেই রাষ্ট্রের শাসকবর্গ মুসলমানদের শাসনকর্তা এবং সেখানকার প্রজা মুসলিম প্রজা হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত হবে।
যদি মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে মুসলিম দেশে ইসলামি আইন জারি না করা হয়, বরং কুফর ও খোদাদ্রোহী আইন প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং একে আরও উন্নতি প্রদান করা হয়, তখন সেই দেশসমূহ ইসলামি দেশ হিসেবে কখনো গণ্য হওয়ার উপযুক্ত নয়, বরং সেগুলোকে অমুসলিম দেশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে। কারণ, ইসলামি দেশের পরিচয় ইসলামি আইন প্রয়োগের দ্বারা হয়।
উদাহরণস্বরূপ কাফিরদের দেশসমূহ দেখা যেতে পারে। যে দেশে সাম্যবাদ প্রচলিত সে দেশকে ‘কমিউনিস্ট দেশ’ বলা হয়। কারণ, কমিউনিজম হলো রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক নিয়ম প্রচলিত থাকে। এ কারণে সেটাকে ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ বলা হয়। যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিদ্যমান, সেটাকে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশ’ বলে।
সুতরাং কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের শাসকবর্গ যদি ইসলামি আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা না করে, তবে সে দেশ আর ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করার উপযুক্ত থাকে না। এভাবে কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের অধিবাসীরা যদি এমন হয় যে, তারা না ইসলামি আইন চায়, না সে আইনের প্রতি সন্তুষ্ট, বরং তারা অনৈসলামিক আইনের বাস্তবায়ন চায় এবং সে আইনের প্রতি খুশি, তাহলে এদের মুসলমান বলে অভিহিত হওয়ার যোগ্যতা নেই। বরং এমন লোক কাফির উপাধী পাওয়ার উপযুক্ত।’[54]
‘যেসব ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বিধিবিধান জারি করে না অথবা এটাকে আমলযোগ্য বলে বিবেচনা করে না কিংবা এটাকে অসম্পূর্ণ গণ্য করে, এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলে, যে কারণেই হোক ইচ্ছাধীন থাকা অবস্থায় শরয়ি বিধান জারি করে না, এসব লোক কাফির; যদিও তারা মুসলিম নাম ধারণ করে। তাদের বিধান কাফিরের মতো। কাফিরের সাথে যেমন আচার-ব্যবহার করা হয়, তদ্রুপ তাদের সাথেও একই আচরণ করা হবে।’[55]
এখন আমরা দেখব, বাংলাদেশে কি ইসলামি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, নাকি কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের আদালত বৃটিশ আইনে পরিচালিত হয়ে আসছে, এটা তো একটা স্পষ্ট বিষয়। ব্যভিচার, সুদ ও মদের বৈধতা থেকে শুরু করে ফতোয়াকে সেরেফ ধর্মীয় বিষয়াদির সঙ্গে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া, তা-ও আবার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার অধিকার প্রদানসহ মৌলিক ও শাখাগত অজস্র বিষয়ে শরিয়তের বিপরীতে সুস্পষ্ট অবস্থান আইনে বিধিবদ্ধ রয়েছে। যে সকল আইন বাহ্যত শরিয়তবিরোধী মনে হয় না, সেগুলোকেও এ জন্য গ্রহণ করা হয়নি যে, তা শরিয়তসম্মত। বরং এ জন্য করা হয়েছে যে, তা গণতন্ত্র ধর্মের বিপরীত নয়।
এ ছাড়াও সংবিধানে রয়েছে অসংখ্য সুস্পষ্ট কুফরি ধারা ও মূলনীতি। উদাহরণস্বরূপ :
ক. আইন প্রণয়নের অধিকার মানুষের হাতে
‘ধারা : ৭. (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।[56]
খ. চারটি কুফরি মতবাদ রাষ্ট্র পরিচালনার মহান আদর্শ ও মূলনীতি
‘আমরা অঙ্গীরা করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলো—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’[57]
ধারা : ৮ (১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।[58]
গ. রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বিয়োজিত
ধারা : ১২ ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য—
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।[59]
ঘ. ঐক্য ও একক সত্তার ভিত্তি ইসলাম নয়; বরং ভাষা ও সংস্কৃতি
ধারা : ৯ ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙলাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।[60]
ঙ. ইসলাম ও সকল কুফরি ধর্ম সমমর্যাদার
ধারা : ২ (ক) প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।[61]
চ. মুরতাদ হওয়া ও কুফর প্রচার অনুমোদিত
ধারা : ৪১ (১) ক. প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।[62]
আর সংবিধানের ভাষ্য অনুযায়ী উপরিউক্ত ধারা ও মূলনীতিগুলো (অর্থাৎ প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগের বিধানাবলি সর্বদা অপরিবর্তিত ও সংশোধনের অযোগ্য।[63]
এই কুফরি সংবিধান সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি বা বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য—প্রত্যেকের শপথ বাক্যে আছে :
‘…আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব।’[64]
সুতরাং ওপরে যাদের নাম উল্লেখিত হলো, তারা দলগতভাবে সকলেই মুরতাদ। আর ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি হলো, কোনো কাফির মুসলমানদের শাসনকর্তা হতে পারে না। এসব কারণে মুসলমানদের ওপর জোর করে চেপে থাকা এ সকল তাগুতগোষ্ঠীর শাসনক্ষমতা কার্যকর নয় এবং মুসলমানদের জন্য তাদের আইনকানুন-বিধিবিধান মান্য করা মোটেও জরুরি নয়। বরং মুসলমানদের ওপর কর্তব্য হলো, এই তাগুত গোষ্ঠীকে অপসারিত করা এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এখানে একটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখ্য, উপরিউক্ত ব্যক্তিরা দলগতভাবে মুরতাদ হলেও তাদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি বিশেষের ব্যাপারে কুফরের ফতোয়া জারি করতে হলে প্রথমে হুজ্জাত কায়েম করে নিতে হবে এবং তাকফিরের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। তবে দলগতভাবে তারা যে মুরতাদ এবং তাগুত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ পোষণ করার অবকাশ নেই।
আমাদের দেশসহ কথিত মুসলিম বিশ্ব—কুরআন-সুন্নাহর বিপরীতে মানবরচিত আইন গ্রহণ বা প্রণয়ন করা হয়েছে, আল্লাহর দেওয়া শরিয়তের সঙ্গে বিদ্রোহ করে তাগুতের আইনে সংবিধান তৈরি করা হয়েছে, শরয়ি বিধানমতে ফায়সালা দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার করা আবশ্যকীয় মনে করা তো দূরের কথা; বরং তার বিপরীতে মানবরচিত আইনে ফায়সালা করাকে বিচারকরা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের অন্যথা করারও সুযোগ নেই—তো ফিকহের আলোকে এসব দেশকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করার সুযোগ কোথায়?
শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. ভারত উপমহাদেশকে যখন দারুল হারব হিসেবে ফতোয়া দেন, তখনো এখানকার রাষ্ট্রপ্রধান নামধারী মুসলিম ছিল। এরপরও রাষ্ট্র থেকে ইসলামি আইনকানুন ও বিধিবিধান অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি একে দারুল হারব হিসেবে ফতোয়া দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য আলিমগণও তার ফতোয়ার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। তার সেই ফতোয়ার পর পুনরায় তো আর এসব অঞ্চল দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়নি। দারুল হারব কীভাবে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়, সে আলোচনা তো আমরা ওপরে করে এসেছি। তা তো এরপর কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
জুমহুর ইমামগণের মাজহাবের আলোকে এসব অঞ্চলকে দারুল কুফর মানতে তো কোনোই দ্বিধা জাগার কথা নয়। ইমাম আবু হানিফা রহ. যে তিনটি শর্ত আরোপ করেছিলেন, সেগুলোর আলোকে বিবেচনা করলেও এ অঞ্চলগুলোকে নির্দ্বিধায় দারুল হারব বলতে হয়। শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. তৎকালীন ভারত উপমহাদেশকে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর তিন শর্তের আলোকেই দারুল হারব বলেছিলেন। প্রথমে আমরা দেখি, তিনি কীভাবে ভারত উপমহাদেশকে দারুল হারব হিসেবে ফতোয়া দিয়েছিলেন। এরপর দেখি, তার সঙ্গে আমাদের বর্তমান অবস্থার সামঞ্জস্যতা কতটুকু।
তিনি তার সেই ঐতিহাসিক ফতোয়ায় লেখেন :
‘যখন মূলনীতিগত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো, তখন হিন্দুস্তানের হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখো (কোনো দারুল ইসলাম দারুল হারব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে সেগুলো কত জোরালোভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে)।
(প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে, দেখো।) এখানে খ্রিষ্টান কাফিরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সঙ্গে চলছে! যদি সাধারণ কোনো কালেক্টরও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবে না’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারও এ সাধ্য নেই যে, তাতে জামাআত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরিয়তের আরও কিছু বুনিয়াদি বিষয়ের ওপর আমল, যা এখানে হচ্ছে, তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।’
(দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে, দেখো।) মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে নিরাপত্তা এখানকার বাসিন্দাদের ছিল, এখন তার কোনো নাম-নিশানাও নেই। কোনো বিবেকবান বলতে পারবে, মোঘল বাদশাহ শাহ আলম যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন, আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করছি? বরং বাস্তবতা হলো, কাফিরদের থেকে নতুন নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। খ্রিষ্টানদের দেওয়া এ নিরাপত্তার মাধ্যমেই হিন্দুস্তানের সকল প্রজা এখানে বসবাস করছে।
আর (তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সঙ্গে মিলিত থাকা’-এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে,) দারুল হারবের সঙ্গে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন (ছোট) এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে (দারুল ইসলাম থেকে) সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, ‘রোম (অর্থাৎ তুরস্ক) বা কাবুলের (অর্থাৎ আফগানিস্তানের) শাসকের পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে কাফিরদেরকে হিন্দুস্তান থেকে হটানো সম্ভব, তাহলে আল্লাহর পানাহ! এ ধরনের মন্তব্য কোনোক্রমেই সঠিক নয়। হিন্দুস্তান থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোটকথা হিন্দুস্তানে কাফিরদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোনো সময় কোনো দারুল হারবে কাফিরদের এর চেয়ে বেশি দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসলামি শাআয়ির, যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে, তা কেবল তাদের (কাফিরদের) অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। শাসনক্ষমতায় হিন্দুদেরও তো কিছুটা প্রভাব আছে; কিন্তু মুসলমানদের তা-ও নেই।
তবে হ্যাঁ, টুংক, রামপুর, ভূপাল এবং অন্যান্য রাজ্য, যেখানকার শাসকরা কাফিরদের দ্বারা পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের বিধিবিধান (অর্থাৎ ইসলামি বিধিবিধান) জারি রাখতে পারছে, সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা আদ-দুররুল মুখতার ও অন্যান্য কিতাবের বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে।’
এবার আমরা হজরতের ফতোয়াটির আলোকে আমাদের দেশকে মূল্যায়ন করি :
‘যখন মূলনীতিগত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো, তখন বাংলাদেশের হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখো (কোনো দারুল ইসলাম দারুল হারব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে সেগুলো কত জোরালোভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে)।
(প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে, দেখো।) এখানে মুরতাদ কাফিরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সঙ্গে চলছে! যদি সরকারি দলের সাধারণ কোনো নেতাও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবে না’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারও এ সাধ্য নেই যে, তাতে জামাআত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরিয়তের আরও কিছু বুনিয়াদি বিষয়ের ওপর আমল, যা এখানে হচ্ছে, তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।’
(দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে, দেখো।) মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে নিরাপত্তা এখানকার বাসিন্দাদের ছিল, এখন তার কোনো নাম-নিশানাও নেই। কোনো বিবেকবান বলতে পারবে, উসমানি খলিফাগণ কিংবা অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন, আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করছি? বরং বাস্তবতা হলো, মুরতাদদের থেকে নতুন নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। মুরতাদদের দেওয়া এ নিরাপত্তার মাধ্যমেই হিন্দুস্তানের সকল প্রজা এখানে বসবাস করছে।
আর (তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সঙ্গে মিলিত থাকা’-এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে,) দারুল হারবের সঙ্গে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন (ছোট) এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে (দারুল ইসলাম থেকে) সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, ‘আমিরুল মুমিনিন হিবাতুল্লাহ আখন্দজাদা এবং শাইখ আইমান জাওয়াহিরির পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে মুরতাদদেরকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে হটানো সম্ভব, তাহলে আল্লাহর পানাহ! এ ধরনের মন্তব্য কোনোক্রমেই সঠিক নয়। হিন্দুস্তান থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোটকথা বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মুরতাদদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোনো সময় কোনো দারুল হারবে কাফিরদের এর চেয়ে বেশি দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসলামি শাআয়ির, যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে, তা কেবল তাদের (মুরতাদদের) অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। শাসনক্ষমতায় নাস্তিক, শিয়া, ও হিন্দুদেরও তো কিছুটা প্রভাব আছে; কিন্তু মুসলমানদের তা-ও নেই।
তবে হ্যাঁ, আফগান, সোমালিয়া, ইয়ামান, শাম, ইরাক ও অন্যান্য ভূখন্ডের যেসব অংশ কাফির-মুরতাদদের থেকে উদ্ধার করে ইসলামি বিধিবিধান জারি রাখা যাচ্ছে, সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা আদ-দুররুল মুখতার ও অন্যান্য কিতাবের বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে।’
আমাদের করণীয়
মুসলমানদের জন্য ইমান আনার পর জাতিগতভাবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা। তাই আমাদের জন্য অপরিহার্য হলো, আমরা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ইসলামি রাষ্ট্রকে পুনরুদ্ধার করব। দখলদারদের বিতাড়িত করে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করব। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেন :
‘প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ—যার মাধ্যমে আগ্রাসী শত্রুদের (মুসলিমদের ভূমি থেকে) বের করে দেওয়া—জিহাদের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ একটি জিহাদ। সর্বজনস্বীকৃত যে, দীন এবং নিজেদের সম্মান রক্ষা করা হচ্ছে একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। ইমান আনার পর প্রথম বাধ্যতামূলক দায়িত্ব হলো আগ্রাসী শত্রুদের পার্থিব ও দীনের ওপর আগ্রাসনকে প্রতিহত করা। এ ক্ষেত্রে কোনো ওজর-আপত্তি করার সুযোগ নেই। যেমন : সরবরাহ অথবা পরিবহন। বরং যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়েই জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে।’
৯/১১-এর পর আমেরিকা ইসলামি রাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়, তখন বিখ্যাত দেওবন্দি আলিম মুফতি নিজামুদ্দিন শামজায়ি রহ. ফতোয়া জারি করেন :
আমেরিকা ইমারাতে ইসলামি আফগানিস্তানের ওপর হামলা করেছে। এখন মুসলমানদের উপর নিম্নবর্ণিত শরয়ি বিধানগুলো বর্তাবে :
(১) সমস্ত মুসলমানদের ওপর জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে। কেননা আফগানিস্তানের আশপাশের মুসলমানরা আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম নয়। এবং ইহুদি ও আমেরিকার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইমারাতে ইসলামি আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে দেওয়া। দারুল ইসলামের প্রতিরক্ষা বর্তমানে সকল মুসলমানের ওপর শরয়ি ফরজ।
(২) যেকোনো মুসলমান—সে যে দেশেরই হোক না কেন, সরকারি অথবা বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃকই থাকুক না কেন—যদি কোনোভাবে এই ক্রুসেড যুদ্ধে আফগান মুসলমানদের বিরুদ্ধে অথবা ইমারাতে ইসলামি আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করে, তবে সে মুসলমান থাকবে না।
(৩) আল্লাহর বিধিবিধানের খেলাফ যদি যেকোনো মুসলিম সরকার হুকুম দেয় অথবা অধীনস্থ লোকদের ইসলামি হুকুমত ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করতে চায়, তবে অধীনস্থ মুসলমানদের এই ধরনের হুকুম মান্য করা জায়িয হবে না। বরং এই সমস্ত শাসকদের হুকুম লঙ্ঘন করা জরুরি।
(৪) ইসলামি দেশসমূহের যে সকল শাসক এই ক্রুসেড যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গ দিচ্ছে, নিজের ভূমি, খবরাখবর এবং বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে তাদেরকে সংগঠিত করছে, তারা মুসলমানদের ওপর শাসন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। সমস্ত মুসলমানের ওপর কর্তব্য হচ্ছে, এই সমস্ত শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করা; সেটা যেভাবেই হোক না কেন।
(৫) আফগানিস্তানের মুসলিম মুজাহিদদেরকে জান-মাল এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করা মুসলমানদের ওপর ফরজ। এ জন্য যাদের দ্বারা আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের পাশাপাশি লড়াই করা সম্ভব, তারা যেন সেখানে গিয়ে অংশ নেয়। আর যারা সম্পদ দিয়ে সহায়তা করতে পারে, তারা যেন সম্পদ দ্বারা সহায়তা করে। মসিবতের এই সময় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সাহায্যকারী হন।
এই ফতোয়াকে বেশি থেকে বেশি প্রচার করে অপর মুসলমানের নিকট পৌঁছে দিন।
ওয়াসসালাম
মুফতি নিজামুদ্দীন শামজায়ি
(সিলমোহর)
এ কথা শুধু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেই নয়; বরং প্রতিটি দারুল ইসলাম, যাকে কিনা পরবর্তীতে দারুল হারবে পরিণত করে ফেলা হয়েছে কিংবা সে লক্ষ্যে কুফফার গোষ্ঠী যাতে আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়েছে, মুসলমানদের জন্য তার প্রতিরক্ষা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ফরজ।
টীকা
--------------------------------------------
বি:দ্র: টীকাগুলো প্রথম কমেন্টে দেখুন দয়া করে। শুকরান
সংগ্রহীত পোষ্ট
Comment