বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম
এখনকার মুসলিম তরুণদেরকে বিয়ের ব্যাপারে খুব উদাসীন দেখা যায়। ফলে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা নিয়েই পড়ে থাকে অনেকে। সমাজে প্রচলিত বিয়ের সাথে যে ইসলামী বিয়ের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে তা অনেকেরই জানার সুযোগ হয় না। এই লেখাটি মূলত তাদের জন্য।
.
বিয়ে কেন করবে?
.
বিয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এমনকি বিয়েকে ‘দ্বীনের অর্ধেক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের মধ্যে হালাল সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা পরিবার গঠনের উপায়, সভ্যতা টিকিয়ে রাখার উপায়, মানবজাতির বংশরক্ষার উপায়। এটি চরিত্র রক্ষার উপায়, নিজের যৌন চাহিদাকে বৈধভাবে মেটানোর উপায়।
.
যুবকরা খুব সহজেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে, গান-বাজনায় সময় কাটায়, অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। প্রেমে পড়া তো একরকম ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হস্তমৈথুনও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এগুলোর প্রতিটিই মারাত্মক গুনাহর কাজ। আর এই গুনাহগুলোর মাত্রা বেড়ে যাবার পেছনে অন্যতম কারণ হলো সময়মতো বিয়ে না করা। যুবকদের বয়সটায় বিয়ের চাহিদা থাকা খুবই স্বাভাবিক, বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। সুতরাং গুনাহ থেকে বাঁচতে চাইলে বিয়ের বিকল্প নেই।
.
তুমি কি বিয়ের উপযুক্ত?
.
আমরা বিয়ের বয়সের ব্যাপারে খুবই ভুল ধারণার মধ্যে আছি। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে, অথচ বিয়ের চিন্তাকে গুরুত্বই দিচ্ছে না- এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। অনেকে লাখ টাকা উপার্জনের আগে বিয়ের কথা ভাবতে পারছে না। পাত্রীর অভিভাবকরা পাত্রের বেতন, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পৈতৃক সম্পত্তি- সব দেখছেন। মোটা অঙ্কের মোহর ধার্য করা হচ্ছে। ফলে বিয়ে হয়ে পড়েছে কঠিন। ইসলামে বিয়ে কি এত কঠিন?
.
না। ইসলামে বিয়ে খুবই সহজ। ইসলাম বিয়ের জন্য এত কঠিন শর্ত দেয়নি। তবে কিছু শর্ত তো অবশ্যই দিয়েছে। সেগুলো নিয়েই আলোচনা করা যাক।
.
প্রথমত, শারীরিক ও যৌন সক্ষমতা। তুমি সেদিনই বালেগ(প্রাপ্তবয়স্ক) হয়েছ, যেদিন তোমার প্রথম স্বপ্নদোষ ঘটেছে। এখন তোমার বিয়ের জন্য ত্রিশ বছর বয়স হওয়ার কোনো দরকার আছে কি? বিশ-বাইশ বছর বয়স থেকেই তোমার বিয়ের চাহিদা অনুভূত হবার কথা। চাহিদা অনুভূত হবার পরও দেরি করা মানে তোমার ওপর কষ্ট চাপিয়ে দেয়া। ইসলামে বিয়ের কোনো ধরাবাঁধা বয়স নেই। তবে হ্যাঁ, স্ত্রীর যৌন অধিকার তাকে দিতে হবে। এটা স্বামীর দায়িত্ব। সুতরাং বয়সটা মূল ব্যাপার নয়, যৌন সুস্থতাই হলো বিয়ের পূর্বশর্ত।
.
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ক্ষমতা। তুমি তোমার ছোটবোনের কথাই চিন্তা কর। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারবে না এমন কোনো ছেলের সাথে তুমি নিশ্চয়ই তাকে বিয়ে দিতে চাইবে না। স্ত্রীর যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। সুতরাং আর্থিক ক্ষমতা থাকাটাও বিয়ের শর্ত।
.
কিন্তু কথা হলো, আর্থিক ক্ষমতা মানে কী? আর্থিক ক্ষমতা বলতে আমাদের সমাজ বোঝাতে চায় যে, বেশি বেতনের চাকরি করতে হবে, গাড়ি থাকতে হবে, বাড়ি থাকতে হবে ইত্যাদি। ইসলামে আর্থিক ক্ষমতা বলতে সেটা বোঝায় না। তুমি তোমার স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে- এটুকুই যথেষ্ট। সে হিসেবে ছোট-খাটো কোনো চাকরি বা ব্যবসাই আর্থিক ক্ষমতার শর্ত পূরণ করতে পারে। থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; তার জন্য তোমার সামর্থ্যের মধ্যে সাধারণ বাড়িই যথেষ্ট। খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; কিন্তু সে নিশ্চয়ই রাক্ষসের মতো খাবে না। মৌলিক চাহিদা মেটানোই যথেষ্ট। বিলাসিতার সুযোগ নেই।
.
আল্লাহ তাআলা অভাবগ্রস্তদের বিয়ের মাধ্যমে অভাব দূর করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাছাড়া সবার রিযক্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। কেউ তার চেয়ে বেশি পাবে না, কেউ তার চেয়ে কমও পাবে না। যার জন্য যেটুকু নির্ধারিত আছে সেটুকুই সে পাবে। সুতরাং তোমার স্ত্রী এসে তোমার খাবারে ভাগ বসাবে না। তার রিযক্ব তার জন্যই। বিয়ের আগে তাকে যিনি খাবার দিয়েছেন, বিয়ের পরও তিনিই দেবেন। আমাদের উচিত আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।
.
বিয়ের মোহর কম হওয়া ভালো। এতে বিয়েতে বরকত থাকে। সুতরাং পাত্রীপক্ষের উচিত হবে পাত্রপক্ষের সামর্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে কম মোহর চাওয়া। তবে পাত্রীর সম্মান ও অধিকার যেন রক্ষা করা হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। কাজেই সামর্থ্য থাকলে বেশি দিতেও দোষ নেই। ইসলামে মোহরের কোন ঊর্ব্ধসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। আর হ্যাঁ, মোহরের পুরোটাই বিয়ের সময় নগদ পরিশোধ করে ফেলা উচিত, বাকি না রাখাই ভালো।
.
বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচের কথাটাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে যতো রকমের আনুষ্ঠানিকতা করা হচ্ছে তাতে বিয়ে করতে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এসব অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন হাজারো গুনাহর কাজ হয়, অন্যদিকে তেমন অতিরিক্ত খরচ হয়। এসমস্ত বাজে খরচের কোনো দরকার নেই। অনর্থক খরচের কাজগুলো বাদ দিলেই দেখবে, বিয়ে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র ওয়ালিমা করবে। সেখানে সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে।
.
ভরণ-পোষণের জন্য শুধু আর্থিকভাবে সমর্থ হলেই চলবে না, সকল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। যদিও মৌলিক চাহিদা মেটানোর মধ্যেই ব্যাপারটা চলে এসেছে, তবুও একটু বিশেষভাবে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
.
তোমার স্ত্রী যেন ঠিকমতো দ্বীন পালন করতে পারে তা তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তাকে সময়মতো নামায পড়ার সময়-সুযোগ দিতে হবে। সে যেন পরিপূর্ণভাবে পর্দা রক্ষা করে চলতে পারে সে ব্যবস্থাও তোমাকেই করে দিতে হবে। বস্তুত, যৌথ পরিবারে থেকে পর্দা রক্ষা করে চলা খুবই কঠিন। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শ্বশুরবাড়ির মধ্যে শ্বশুর, নানা-শ্বশুর, দাদা-শ্বশুর প্রমুখ ব্যক্তির সাথে দেখা করা ও কথা বলা মেয়েদের জন্য জায়েজ। কিন্তু দেবরের সাথে, ভাশুরের সাথে, ননদের স্বামীর সাথে কিংবা দেবরের ও ননদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সাথে দেখা করা নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনে কথা বলাও নিষিদ্ধ; প্রয়োজনে কথা বলতে হলে পর্দা রক্ষা করে বলতে হবে।]
.
স্ত্রীর অধিকারের প্রতি ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তার যেন কোনো সমস্যা না হয় তা তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে। তার দায়িত্বের অতিরিক্ত কিছু তার ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কোনোভাবে তার প্রতি যুলম করা যাবে না। পরিবারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তার অধিকারের লঙ্ঘন করা যাবে না। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি কী কী দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে তা আলিমদের কাছে জেনে নেবে।
.
বিয়ের জন্য আরেকটা যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। তা হলো কর্তৃত্ব। তোমার স্ত্রীর অভিভাবক তুমি। তার পাপের জন্য তোমাকেও দায়ী থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ নারীদের অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, তার জন্য জান্নাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং তোমার স্ত্রীর পর্দাহীনতাসহ যেকোনো পাপ কাজের ব্যাপারে তোমাকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
আর্থিকভাবে যতই সামর্থ্য থাকুক, দ্বীন পালনের এই সুযোগগুলো যতদিন তুমি দিতে না পারছ, ততদিন তোমার জন্য বিয়ে না করাই ভালো।
.
কেমন পাত্রী পছন্দ করবে?
.
অবশ্যই দ্বীনদার পাত্রী। যেকোনো বাধা অতিক্রম করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করতে যে মেয়ে সচেষ্ট, তাকেই বিয়ে করবে। এর বাইরে সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদা কিংবা সম্পদ দেখতে চাইলে তার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু প্রাধান্য দিতে হবে দ্বীনদারিকেই। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। দ্বীন ঠিকমতো পেলে প্রয়োজনে অন্যগুলোতে ছাড় দিতে হবে।
.
সামর্থ্য হবার পর বিয়েতে দেরি করলে কি সমস্যা আছে?
.
তোমার গুনাহর আশঙ্কা না থাকলে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু গুনাহর আশঙ্কা থাকলে সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এই ফিতনার যুগে গুনাহর আশঙ্কা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তুমি যতবার কোনো (গায়রে মাহরাম) মেয়ের দিকে তাকাবে, ততবার চোখের ব্যভিচার হবে। যতবার তার সাথে কথা বলবে, ততবার জিহ্বার ব্যভিচার হবে। গার্লফ্রেন্ড থাকলে তো সমস্যাটা আরো মারাত্মক। এসবের কোনো একটার আশঙ্কা থাকলেই বুঝতে হবে, সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এছাড়াও পর্নোগ্রাফি, হস্তমৈথুন কিংবা ব্যভিচারের আশঙ্কা থাকলেও বিয়ে করা আবশ্যক।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। বিয়ে করামাত্র ম্যাজিকের মতো সব গুনাহ ছেড়ে দিতে পারবে এমনটা ভাববে না। বরং তোমাকে এখন থেকেই গুনাহ ছেড়ে দেবার সঙ্কল্প করতে হবে। বিয়ের আগেও কোনো গুনাহর কাজ করা যাবে না, বিয়ের পরও করা যাবে না। বিয়ের উপকারিতা কেবল এতটুকু যে, বিয়ের মাধ্যমে গুনাহ ছেড়ে দেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তুমি যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে বিয়ে তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তুমি গুনাহ ছেড়ে দেবার ব্যাপারে দৃঢ় সঙ্কল্প না করলে বিয়ের সুফল পাবে না।
.
এখন তুমি কী করবে?
.
মা-বাবাকে সাধ্যমতো বিয়ের গুরুত্ব বোঝাও। ধৈর্য ধর। নিজের ফরজ-ওয়াজিবগুলো ঠিকমতো পালন কর। নিজে গুনাহ থেকে বেঁচে থাক। তাহাজ্জুদ পড়। নফল সাওম পালন করুন। আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করতে থাক। স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে এবং দ্বীন পালনের সুযোগ দিতে যেন পার সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু কর। বিয়ের ব্যাপারে আলিমদের লেখা বইপত্র পড় এবং তাদের কাছে পরামর্শ নাও। সর্বোপরি, আল্লাহর কাছে সবসময় দুআ করতে থাক এবং সাহায্য চাইতে থাক।
.
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সময়মতো দ্বীনদার স্ত্রী দান করুন, তাদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দিন এবং আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কগুলোকে জান্নাত পর্যন্ত স্থায়ী করে দিন। আমীন।
(সংগৃহিত)
এখনকার মুসলিম তরুণদেরকে বিয়ের ব্যাপারে খুব উদাসীন দেখা যায়। ফলে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা নিয়েই পড়ে থাকে অনেকে। সমাজে প্রচলিত বিয়ের সাথে যে ইসলামী বিয়ের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে তা অনেকেরই জানার সুযোগ হয় না। এই লেখাটি মূলত তাদের জন্য।
.
বিয়ে কেন করবে?
.
বিয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এমনকি বিয়েকে ‘দ্বীনের অর্ধেক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের মধ্যে হালাল সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা পরিবার গঠনের উপায়, সভ্যতা টিকিয়ে রাখার উপায়, মানবজাতির বংশরক্ষার উপায়। এটি চরিত্র রক্ষার উপায়, নিজের যৌন চাহিদাকে বৈধভাবে মেটানোর উপায়।
.
যুবকরা খুব সহজেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে, গান-বাজনায় সময় কাটায়, অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। প্রেমে পড়া তো একরকম ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হস্তমৈথুনও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এগুলোর প্রতিটিই মারাত্মক গুনাহর কাজ। আর এই গুনাহগুলোর মাত্রা বেড়ে যাবার পেছনে অন্যতম কারণ হলো সময়মতো বিয়ে না করা। যুবকদের বয়সটায় বিয়ের চাহিদা থাকা খুবই স্বাভাবিক, বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। সুতরাং গুনাহ থেকে বাঁচতে চাইলে বিয়ের বিকল্প নেই।
.
তুমি কি বিয়ের উপযুক্ত?
.
আমরা বিয়ের বয়সের ব্যাপারে খুবই ভুল ধারণার মধ্যে আছি। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে, অথচ বিয়ের চিন্তাকে গুরুত্বই দিচ্ছে না- এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। অনেকে লাখ টাকা উপার্জনের আগে বিয়ের কথা ভাবতে পারছে না। পাত্রীর অভিভাবকরা পাত্রের বেতন, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পৈতৃক সম্পত্তি- সব দেখছেন। মোটা অঙ্কের মোহর ধার্য করা হচ্ছে। ফলে বিয়ে হয়ে পড়েছে কঠিন। ইসলামে বিয়ে কি এত কঠিন?
.
না। ইসলামে বিয়ে খুবই সহজ। ইসলাম বিয়ের জন্য এত কঠিন শর্ত দেয়নি। তবে কিছু শর্ত তো অবশ্যই দিয়েছে। সেগুলো নিয়েই আলোচনা করা যাক।
.
প্রথমত, শারীরিক ও যৌন সক্ষমতা। তুমি সেদিনই বালেগ(প্রাপ্তবয়স্ক) হয়েছ, যেদিন তোমার প্রথম স্বপ্নদোষ ঘটেছে। এখন তোমার বিয়ের জন্য ত্রিশ বছর বয়স হওয়ার কোনো দরকার আছে কি? বিশ-বাইশ বছর বয়স থেকেই তোমার বিয়ের চাহিদা অনুভূত হবার কথা। চাহিদা অনুভূত হবার পরও দেরি করা মানে তোমার ওপর কষ্ট চাপিয়ে দেয়া। ইসলামে বিয়ের কোনো ধরাবাঁধা বয়স নেই। তবে হ্যাঁ, স্ত্রীর যৌন অধিকার তাকে দিতে হবে। এটা স্বামীর দায়িত্ব। সুতরাং বয়সটা মূল ব্যাপার নয়, যৌন সুস্থতাই হলো বিয়ের পূর্বশর্ত।
.
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ক্ষমতা। তুমি তোমার ছোটবোনের কথাই চিন্তা কর। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারবে না এমন কোনো ছেলের সাথে তুমি নিশ্চয়ই তাকে বিয়ে দিতে চাইবে না। স্ত্রীর যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। সুতরাং আর্থিক ক্ষমতা থাকাটাও বিয়ের শর্ত।
.
কিন্তু কথা হলো, আর্থিক ক্ষমতা মানে কী? আর্থিক ক্ষমতা বলতে আমাদের সমাজ বোঝাতে চায় যে, বেশি বেতনের চাকরি করতে হবে, গাড়ি থাকতে হবে, বাড়ি থাকতে হবে ইত্যাদি। ইসলামে আর্থিক ক্ষমতা বলতে সেটা বোঝায় না। তুমি তোমার স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে- এটুকুই যথেষ্ট। সে হিসেবে ছোট-খাটো কোনো চাকরি বা ব্যবসাই আর্থিক ক্ষমতার শর্ত পূরণ করতে পারে। থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; তার জন্য তোমার সামর্থ্যের মধ্যে সাধারণ বাড়িই যথেষ্ট। খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে; কিন্তু সে নিশ্চয়ই রাক্ষসের মতো খাবে না। মৌলিক চাহিদা মেটানোই যথেষ্ট। বিলাসিতার সুযোগ নেই।
.
আল্লাহ তাআলা অভাবগ্রস্তদের বিয়ের মাধ্যমে অভাব দূর করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাছাড়া সবার রিযক্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। কেউ তার চেয়ে বেশি পাবে না, কেউ তার চেয়ে কমও পাবে না। যার জন্য যেটুকু নির্ধারিত আছে সেটুকুই সে পাবে। সুতরাং তোমার স্ত্রী এসে তোমার খাবারে ভাগ বসাবে না। তার রিযক্ব তার জন্যই। বিয়ের আগে তাকে যিনি খাবার দিয়েছেন, বিয়ের পরও তিনিই দেবেন। আমাদের উচিত আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।
.
বিয়ের মোহর কম হওয়া ভালো। এতে বিয়েতে বরকত থাকে। সুতরাং পাত্রীপক্ষের উচিত হবে পাত্রপক্ষের সামর্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে কম মোহর চাওয়া। তবে পাত্রীর সম্মান ও অধিকার যেন রক্ষা করা হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। কাজেই সামর্থ্য থাকলে বেশি দিতেও দোষ নেই। ইসলামে মোহরের কোন ঊর্ব্ধসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। আর হ্যাঁ, মোহরের পুরোটাই বিয়ের সময় নগদ পরিশোধ করে ফেলা উচিত, বাকি না রাখাই ভালো।
.
বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচের কথাটাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে যতো রকমের আনুষ্ঠানিকতা করা হচ্ছে তাতে বিয়ে করতে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এসব অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন হাজারো গুনাহর কাজ হয়, অন্যদিকে তেমন অতিরিক্ত খরচ হয়। এসমস্ত বাজে খরচের কোনো দরকার নেই। অনর্থক খরচের কাজগুলো বাদ দিলেই দেখবে, বিয়ে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র ওয়ালিমা করবে। সেখানে সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে।
.
ভরণ-পোষণের জন্য শুধু আর্থিকভাবে সমর্থ হলেই চলবে না, সকল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। যদিও মৌলিক চাহিদা মেটানোর মধ্যেই ব্যাপারটা চলে এসেছে, তবুও একটু বিশেষভাবে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
.
তোমার স্ত্রী যেন ঠিকমতো দ্বীন পালন করতে পারে তা তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তাকে সময়মতো নামায পড়ার সময়-সুযোগ দিতে হবে। সে যেন পরিপূর্ণভাবে পর্দা রক্ষা করে চলতে পারে সে ব্যবস্থাও তোমাকেই করে দিতে হবে। বস্তুত, যৌথ পরিবারে থেকে পর্দা রক্ষা করে চলা খুবই কঠিন। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শ্বশুরবাড়ির মধ্যে শ্বশুর, নানা-শ্বশুর, দাদা-শ্বশুর প্রমুখ ব্যক্তির সাথে দেখা করা ও কথা বলা মেয়েদের জন্য জায়েজ। কিন্তু দেবরের সাথে, ভাশুরের সাথে, ননদের স্বামীর সাথে কিংবা দেবরের ও ননদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সাথে দেখা করা নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনে কথা বলাও নিষিদ্ধ; প্রয়োজনে কথা বলতে হলে পর্দা রক্ষা করে বলতে হবে।]
.
স্ত্রীর অধিকারের প্রতি ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তার যেন কোনো সমস্যা না হয় তা তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে। তার দায়িত্বের অতিরিক্ত কিছু তার ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কোনোভাবে তার প্রতি যুলম করা যাবে না। পরিবারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তার অধিকারের লঙ্ঘন করা যাবে না। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি কী কী দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে তা আলিমদের কাছে জেনে নেবে।
.
বিয়ের জন্য আরেকটা যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। তা হলো কর্তৃত্ব। তোমার স্ত্রীর অভিভাবক তুমি। তার পাপের জন্য তোমাকেও দায়ী থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ নারীদের অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, তার জন্য জান্নাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং তোমার স্ত্রীর পর্দাহীনতাসহ যেকোনো পাপ কাজের ব্যাপারে তোমাকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
আর্থিকভাবে যতই সামর্থ্য থাকুক, দ্বীন পালনের এই সুযোগগুলো যতদিন তুমি দিতে না পারছ, ততদিন তোমার জন্য বিয়ে না করাই ভালো।
.
কেমন পাত্রী পছন্দ করবে?
.
অবশ্যই দ্বীনদার পাত্রী। যেকোনো বাধা অতিক্রম করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করতে যে মেয়ে সচেষ্ট, তাকেই বিয়ে করবে। এর বাইরে সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদা কিংবা সম্পদ দেখতে চাইলে তার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু প্রাধান্য দিতে হবে দ্বীনদারিকেই। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। দ্বীন ঠিকমতো পেলে প্রয়োজনে অন্যগুলোতে ছাড় দিতে হবে।
.
সামর্থ্য হবার পর বিয়েতে দেরি করলে কি সমস্যা আছে?
.
তোমার গুনাহর আশঙ্কা না থাকলে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু গুনাহর আশঙ্কা থাকলে সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এই ফিতনার যুগে গুনাহর আশঙ্কা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তুমি যতবার কোনো (গায়রে মাহরাম) মেয়ের দিকে তাকাবে, ততবার চোখের ব্যভিচার হবে। যতবার তার সাথে কথা বলবে, ততবার জিহ্বার ব্যভিচার হবে। গার্লফ্রেন্ড থাকলে তো সমস্যাটা আরো মারাত্মক। এসবের কোনো একটার আশঙ্কা থাকলেই বুঝতে হবে, সামর্থ্য হওয়ামাত্র বিয়ে করা আবশ্যক। এছাড়াও পর্নোগ্রাফি, হস্তমৈথুন কিংবা ব্যভিচারের আশঙ্কা থাকলেও বিয়ে করা আবশ্যক।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। বিয়ে করামাত্র ম্যাজিকের মতো সব গুনাহ ছেড়ে দিতে পারবে এমনটা ভাববে না। বরং তোমাকে এখন থেকেই গুনাহ ছেড়ে দেবার সঙ্কল্প করতে হবে। বিয়ের আগেও কোনো গুনাহর কাজ করা যাবে না, বিয়ের পরও করা যাবে না। বিয়ের উপকারিতা কেবল এতটুকু যে, বিয়ের মাধ্যমে গুনাহ ছেড়ে দেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তুমি যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে বিয়ে তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তুমি গুনাহ ছেড়ে দেবার ব্যাপারে দৃঢ় সঙ্কল্প না করলে বিয়ের সুফল পাবে না।
.
এখন তুমি কী করবে?
.
মা-বাবাকে সাধ্যমতো বিয়ের গুরুত্ব বোঝাও। ধৈর্য ধর। নিজের ফরজ-ওয়াজিবগুলো ঠিকমতো পালন কর। নিজে গুনাহ থেকে বেঁচে থাক। তাহাজ্জুদ পড়। নফল সাওম পালন করুন। আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করতে থাক। স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে এবং দ্বীন পালনের সুযোগ দিতে যেন পার সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু কর। বিয়ের ব্যাপারে আলিমদের লেখা বইপত্র পড় এবং তাদের কাছে পরামর্শ নাও। সর্বোপরি, আল্লাহর কাছে সবসময় দুআ করতে থাক এবং সাহায্য চাইতে থাক।
.
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সময়মতো দ্বীনদার স্ত্রী দান করুন, তাদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দিন এবং আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কগুলোকে জান্নাত পর্যন্ত স্থায়ী করে দিন। আমীন।
(সংগৃহিত)
Comment