ইসলামে দাস প্রথা
পর্ব-৩
পর্ব-৩
পার্থিব লাঞ্ছনার চূড়ান্ত ধাপ দাসত্ব
যদি কাফেরগণ যুদ্ধের আগে জিযিয়া দিতে রাজি না হয়, তাহলে যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের পরে তাদেরকে গ্রেফতার করে হয়ত হত্যা করা হবে অথবা অনুগ্রহ করে গোলাম বানিয়ে রাখা হবে।
তাহলে, তাদের এই হত্যা বা দাসত্ব, কুফরের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ। যেমন আল্লামা সিরাজুদ্দীন ওমর ইবনে ইসহাক ইবনে আহমাদ আলহিন্দী আলহানাফী রহ. (মৃ: ৭৭৩) বলেন:
ولأن الرق أثر الكفر لأنهم لما استنكف الكفار عن عبادة الله تعالى جعلهم عبيد عبيده سبحانه
“যেহেতু দাসত্ব কুফরের চিহ্ন। কারণ কাফেররা যখন মহান আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব করা থেকে অহংকার করল, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তাদেরকে নিজের দাসদের দাস বানিয়ে দিলেন।” (আলগুররাতুল মুনিফাহ ফি তাহকিকি বা’দি মাসায়িলিল হানাফিয়্যাহ: ১/৮৭) অর্থাৎ মুসলমানদের দাস বানিয়ে দিলেন।
এ দাসত্ব যে কুফরের কারণেই তা ফিকহের প্রায় সকল কিতাবেই ইমামগণ উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম আকমালুদ্দীন বাবরতী রহ.(মৃ:৭৮৬)বলেন:
فَإِنْ أَسْلَمُوا سَقَطَ عَنْهُمْ الْقَتْلُ لِأَنَّهُ عُقُوبَةٌ وَجَبَتْ لِلْبَقَاءِ عَلَى الْكُفْرِ، فَإِذَا زَالَ الْكُفْرُ سَقَطَ الْقَتْلُ (وَإِنْ شَاءَ اسْتَرَقَّهُمْ لِأَنَّ فِيهِ دَفْعَ شَرِّهِمْ مَعَ وُفُورِ الْمَنْفَعَةِ لِأَهْلِ الْإِسْلَامِ) فَإِنْ أَسْلَمُوا بَعْدَ ذَلِكَ لَمْ يَسْقُطْ عَنْهُمْ الرِّقُّ لِأَنَّ الرِّقَّ جَزَاءُ الْكُفْرِ الْأَصْلِيِّ عَلَى مَا عُرِفَ، بِخِلَافِ مَا إذَا أَسْلَمُوا قَبْلَ الِاسْتِيلَاءِ حَيْثُ لَا يَجُوزُ الْقَتْلُ وَالِاسْتِرْقَاقُ أَيْضً
“যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তাদের থেকে হত্যা মাফ হবে। কেননা কুফরের উপর বহাল থাকার কারণে শাস্তি হিসাবে হত্যা আবশ্যক হয়েছিল। তাই যখন কুফর দূর হয়ে যাবে, তখন হত্যাও মাফ হয়ে যাবে।
আর (যুদ্ধে বন্দী হলে) চাইলে তাদেরকে দাস বানাতে পারবে। কারণ এর মাধ্যমে তাদের অনিষ্ট দূর করা সম্ভব হয় এবং মুসলমানদেরও প্রভুত উপকার হয়।
যদি এর পরে ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে দাসত্ব রহিত হবে না। কারণ দাসত্ব মূল কুফরের বদলা, যেমনটা প্রসিদ্ধ। তবে যদি তাদের উপর কর্তৃত্ব লাভের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তাদেরকে হত্যা বা দাস বানানো জায়েয হবে না।” (আল-ইনায়াহ শরহুল হিদায়াহ: ৫/৪৭৩)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী আল-হানাফী রহ.ও (মৃ:৮৫৫) একই কথা বলেন:
لأن الله عز وجل أجرى عليه الرق جزاء الكفر، حيث استنكف أن يكون عبداً لله تعالى فجعله الله عبد عبده
“কেননা আল্লাহ তাদের উপর দাসত্ব আরোপ করেছেন কুফরের প্রতিফল স্বরূপ। অর্থাৎ তারা যখন আল্লাহর দাস হতে অহংকার করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে নিজের দাসদের দাস বানিয়ে দিলেন।” (আল-বিনায়াহ শরহুল হিদায়াহ: ৬/৩৬)
আল্লামা ফখরুদ্দীন যাইলায়ী আল-হানাফী রহ. (মৃ:৭৪৩) বলেন:
مَنْ أَسْلَمَ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ فِي دَارِ الْحَرْبِ أَحْرَزَ بِإِسْلَامِهِ نَفْسَهُ وَأَوْلَادَهُ الصِّغَارَ لِوُجُودِ الْعَاصِمِ وَهُوَ الْإِسْلَامُ فَلَا يَجُوزُ قَتْلُهُ وَلَا اسْتِرْقَاقُهُ لِأَنَّهُمَا جَزَاءُ الْكُفْرِ ابْتِدَاءً أَوْ لِدَفْعِ الشَّرِّ
“হারবীদের কেউ যদি দারুল হারবেই ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে সে স্বীয় ইসলামের কারণে নিজের জান ও নিজ শিশু সন্তানদের জান সংরক্ষিত করে ফেলল। যেহেতু সংরক্ষণকারী বিষয় পাওয়া গেছে, যা হচ্ছে ইসলাম। তাই তাকে হত্যা করা বা দাস বানানো জায়েয নেই। কারণ শুরুতে এ দু’টি হল কুফরের প্রতিফল অথবা কুফরের অনিষ্ট দূর করার মাধ্যম। (শুরুতে—অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করার পরও যে দাসত্ব থাকে, তা কুফরের শাস্তি নয়।) (তাবয়ীনুল হাকায়িক: ৩/২৫৩)
তাহলে কুরআন-সুন্নাহ ও উলামায়ে কেরামের বক্তব্যের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে জানা গেল যে, মানুষের উপর দাসত্ব আসে কেবল কুফরের কারণে, কুফরের শাস্তি স্বরূপ। মহান সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব করতে অহংকার করার কারণে, সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে নিজের দাসদের দাস বানিয়ে দেন, যা তাদের উপযুক্ত শাস্তিই বটে।
কিন্তু অপরাধীরাই অপরাধীদের পক্ষপাতিত্ব করে এটাকে জুলুম বলে এবং নিজেদেরকে আল্লাহর আত্মসমর্পণকারী বান্দাদের সমান বানাতে চায়।
মুসলিম দাস
তবে একটি বিষয় থেকে যায়, তা হল: তাহলে গোলাম বাঁদী মুসলিম হয়ে গেলেও তাদের উপর পূর্বের দাসত্ব বলবৎ থাকে কেন??
উত্তর হল:
১. তখন বান্দার হকের কারণে দাসত্ব তুলে দেওয়া সম্ভব হয় না। অর্থাৎ যেহেতু প্রথমে কাফের অবস্থায় দাসত্ব সাব্যস্ত হওয়ার পর সে একজনের মালিকানাধীন সম্পদ হয়ে যায়। মালিক তাকে বিক্রয় করেও অনেক অর্থ লাভ করতে পারত অথবা রেখেও অনেক উপকার নিতে পারত। এখন যদি মুসলমান হওয়ার কারণে হঠাৎ করেই আযাদ হযে যায়, তাহলে হঠাৎ করেই মালিক অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই অপ্রত্যাশিত ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য তথা মালিকের হক রক্ষার জন্য মুসলমান হওয়ার পরও এটা বাকি থাকে। তবে তখন আর শাস্তি স্বরূপ নয়। বরং মালিকের হক রক্ষার জন্য।
আর কুফরের অবশিষ্ট চিহ্ন হিসাবে এটা থেকে যাওয়া তাদের হিসাবে গুরুতর কিছু নয়। কারণ তারা ছিল যুদ্ধবন্দি, তাদেরকে হত্যা করা হত। সেখান থেকে তাদেরকে অনুগ্রহ করা হয়েছে। তাই এখন এটা তাদের পক্ষে কঠিন হবে না।
উপরন্তু এর মাধ্যমে ইসলামের মহত্ব ও কুফরের অভিশাপের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কারণ ইসলাম কাফেরদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলে: যদি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আগেই মুসলমান হয়ে যাও, তাহলে হত্যা-দাসত্ব উভয়টা থেকেই মুক্তি পাবে। আর যদি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরে মুসলমান হও, তাহলে শুধু হত্যা থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে না। তাই এটা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে।
২. যদি মুসলমান হলেই আযাদ হযে যায়, তাহলে কাফেরদেরকে দাস বানানোও কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ তখন এটা একটা আশঙ্কাজনক মাল হয়ে যাবে। কারণ, যেকোন সময় আযাদ হয়ে গেলেই মাল নেই! ফলে কেউ দাস-দাসী ক্রয় করতে চাইবে না। এমনকি রাখতেও চাইবে না। কারণ সব ভরণপোষণ দিয়ে রাখা হবে নিজের উপকারের জন্য। কিন্তু হঠাৎ করে মুসলমান হয়ে গেলেই আযাদ। তখন দাস-দাসী দ্বারা আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি হয়ে যাবে। তাই কেউ রাখতেও চাইবে না। এতে কাফেরদেরকে দাস বানানোর বিধানটাই টিকবে না।
তবে যদিও আইনীভাবে আযাদ করা সম্ভব হচ্ছে না, কিন্তু শরীয়ত এমন গোলামকে আযাদ করার জন্য খুব বেশি বেশি উৎসাহিত করেছে। এত বেশি উৎসাহিত করেছ, যার ফলে বেশিরভাগ গোলামই আযাদ হয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন উছিলায় আযাদ করার নিয়ম করে দিয়েছে। যেমন স্ত্রীর সাথে যেহারের কাফ্ফারা স্বরূপ গোলাম আযাদ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত রোযা ভঙ্গের কাফ্ফারা স্বরূপ গোলাম আযাদের বিধান রাখা হয়েছে। কোন মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করে ফেললে গোলাম আযাদ করার বিবধান রাখা হয়েছে। কসমের কাফ্ফারা স্বরূপ গোলাম আযাদ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আরো দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে কতটা উৎসাহিত করেছেন:
একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান গোলাম আযাদ করবে, আল্লাহ তাআলা সেই গোলামের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আযাদকারীর একেক অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মু্ক্তি দান করবেন। বুখারী:১/৩৪৪
এসব ফযিলত লাভের আশায় অনেক ছাহাবীই গোলাম আযাদ করেছেন যেমন- হযরত আবু বকর রা. এর আযাদকৃত গোলামের সংখ্যা ৬৩, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর ৩০, হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রা. এর ২০০, হযরত আব্বাস রা. এর ৭০, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর ১০০০, হযরত আয়েশা রা. এর ৬৯, হযরত উসমান রা. প্রতি জুমাআয় একজনকে আযাদ করতেন।
Comment