পড়ালেখার জন্যে গ্রাম ছেড়েছিলাম, সীমান্ত পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম বহুদূর। আজ প্রায় ১৫টি বছর শেষে ফিরে এলাম সবুজ-শ্যামলে ঢাকা সেই গ্রামে। গ্রামের পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষগুলোও পাল্টেছে। চেহারা না; মন-মস্তিষ্ক, চিন্তাধারা পাল্টেছে। গ্রামের সাদাসিদে অবুঝ কৃষকও আজ পবিত্র কুরআন পড়তে জানে। মসজিদে ঈশার সালাতের পর নিয়মিত পবিত্র কুরআনের পাঠদান শুনে।
আজও ঈশার সালাতের পর মুসল্লিরা নিজ নিজ স্থানেই বসে আছেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের কুরআনের দারস শোনার প্রতীক্ষায় রয়েছেন তারা। মহল্লার অধিকাংশ লোকই আজ মজলিসে হাজির। বিশাল এই মজলিসের এক কোণে আমার ঠাঁই হয়েছে। আমিও মজলিসের প্রান্তসীমার এক কোণে বসে পবিত্র কুরআনের দারসের প্রতীক্ষায় আছি। ইতোমধ্যেই সকলের সালাত শেষে উঠে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব। হামদ ও দরুদের পর পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নাম্বার আয়াত তেলাওয়াত করলেন-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ [٣:١٠٣]
আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার।
ইমাম সাহেবের মুখে পবিত্র কুরআনের পবিত্র বাণীর তেলাওয়াত শুনে হৃদয়ে বাল্যকালের সাইফের স্মৃতি জাগ্রত হয়। বাল্যকালের সেই স্কুলবয় সাইফই যে আজকের মুফতি মুহাম্মাদ সাইফ, তা ভাবতেই আমি অভিভূত হই। আনন্দে দুচোখে অশ্রু আসে।
মসজিদের ইমাম সাহেব মুফতি মুহাম্মাদ সাইফ, আমার বন্ধু। বাল্যকালে একসাথে স্কুলে পড়ালেখা করেছি। তাঁর প্রচেষ্টাতেই এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন। আমাদের এলাকায় পূর্বে তুচ্ছ বিষয় নিয়েই মুসলিমদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেতো, মতপার্থক্যের কারণে একে-অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করতো না। আহলে হাদিস-হানাফী দ্বন্দ্ব ছিলো চরমে। কিন্তু, আজ বন্ধু সাইফের প্রচেষ্টায় এলাকায় শান্তির পরিবেশ। আহলে হাদিস, হানাফী, তাবলিগ, জামাআতে ইসলাম-শিবির, চরমোনাইসহ কোনো দল নিয়েই মুসলিমদের মাঝে আর দলাদলি নেই। ইখতেলাফী মাসআলাগুলোতে সবাই নিজ নিজ মতের উপর থেকেই আমল করছেন, কেউ কারো বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অভিযোগ তুলেন না। এরূপ পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু আমার বন্ধু মুফতি মুহাম্মাদ সাইফের সুনাম-সুখ্যাতি তাই ছড়িয়ে পড়েছে। দূর-দূরান্তেও সবাই মুফতি সাইফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ইতোমধ্যেই কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াতের উপর সংক্ষিপ্ত দারস শেষ হলো। আয়াতের বাংলা অর্থ, শানে নুযুল এবং উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কয়েকজন ফকিহের অভিমত তুলে ধরেই আলোচনা শেষ করেন মুফতি সাইফ। মজলিস শেষে সবাই চলে গেলেও বসে রইলাম আমি। বন্ধু সাইফের সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশায়। কত বছর ধরে তাঁর সাথে যোগাযোগ নেই! তাঁকে তুই, তুমি নাকি আপনি সম্বোধন করতাম, তাও সঠিক মনে নেই! তবে, এখন মনে হচ্ছে আপনি বলেই সম্বোধন করা উচিত!
যাইহোক, সবাই চলে যাওয়ার পর সাইফও মসজিদের কোণে অবস্থিত ইমাম সাহেবের জন্য নির্ধারিত ঘরটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আমি দ্রুত উঠে সাইফের কাছাকাছি গিয়ে সালাম দেই!
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ।” সালামের জবাব দিয়েই পেছনে তাকায় সাইফ। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। দীর্ঘ ১৫টি বছর পর বন্ধুর সাথে বন্ধুর দেখা। চিনতে না পারারই কথা, কিন্তু মসজিদের বাতির আবছা আলোয় আমার দিকে কিছুক্ষণ নজর বুলিয়ে সাইফ জিজ্ঞাসা করে-
“আপনি কি খালিদ?”
“জি হুজুর, আমি খালিদ।” আমার পুরো জবাবের অপেক্ষা না করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে সাইফ। কোলাকুলি করতে করতে বলে,
“এতো বছর পর আমাদের কথা মনে পড়লো! আর আমাকে ‘হুজুর’ ডাকছো কেন? বন্ধু বলো, বন্ধু! ‘আপনি’ নয় ‘তুমি’তেই হবে আমাদের সম্বোধন”
আসলে ‘তুমি’তেই তো মধুর ছিল আমাদের বন্ধুত্ব! তাই, আমিও তাঁকে ‘তুমি’ বলতে দ্বিধা না করে বললাম-
“ঠিক আছে বন্ধু। তো, কেমন আছো তুমি? চাচা-চাচি ভালো আছেন তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সবাই ভালো আছেন। তোমার কি খবর বন্ধু?”
“আলহামদুলিল্লাহ, মহান রব্বুল আলামীন আমাকেও বেশ ভালো রেখেছেন।”
“চলো, ঘরে গিয়ে কথা বলি।” হাত ধরে ইমাম সাহেবের নির্ধারিত ঘরে নিয়ে গেলো সাইফ।
ছোট একটা ঘর। একটি চৌকি ও একটি টেবিল রাখার পর ভালোভাবে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই সেখানে।
“এতটুকু ঘরেই কি তুমি থাকো, সাইফ?”
“না বন্ধু, এখানে খুব জরুরত ছাড়া থাকা হয় না। বাড়িতেই থাকি। বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন। তাছাড়া স্ত্রী-সন্তানও আছে, আলহামদুলিল্লাহ।”— সাইফের অকপটে জবাব।
“ও আচ্ছা! তাহলে বিবাহও করে ফেলেছো!”
“হুম...আলহামদুলিল্লাহ”
“মাশাআল্লাহ! আল্লাহ তোমার পরিবারে বরকত দিন, আমীন। তুমি তো মাশাআল্লাহ সবই গুছিয়ে নিয়েছো; ঘর-পরিবার, এমনকি এই গ্রামটাও!”
“সবই মহান রব্বুল আলামীনের মেহেরবানি। আলহামদুলিল্লাহ।”
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে হাসিমুখে সাইফকে জিজ্ঞাসা করলাম,
“তাহলে বন্ধু, স্কুলে পড়ে মুফতি হলে কীভাবে?!”
“স্কুলে নয়রে ভাই, মাদরাসাতে পড়েই হয়েছি! তুমি যখন লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়েছিলে, আমি ছেড়েছিলাম পড়ালেখা! তারপর, বাবা-মা একরকম জোর করে একটি মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছিলেন। মাদরাসার উস্তাদদের সহানুভূতি, সহপাঠীদের ভালোবাসা সর্বোপরি মাদরাসার পরিবেশটাই পরে আমার আপন হয়ে উঠে। সেখানেই কাটে আমার পরবর্তী ছাত্রজীবন। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ করুণায় দীর্ঘ ১২-১৩ বছর পড়ালেখার পর তোমার বন্ধু আজ মুফতি!”
“মাশাআল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ। তা বন্ধু, এই উশৃঙ্খল গ্রামটিকে কীভাবে পরিবর্তন করলে? গ্রামের আকাশ-বাতাসও যেন আজ শান্তির গান গায়। নদীটাও শান্ত হয়ে বয়ে চলে! গ্রামের মানুষগুলোর তো ব্যাপক পরিবর্তন। আমার গ্রামটা যেন আজ ইসলামী শাসনের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে! এতো পরিবর্তনের পেছনে মূল ভেদ কী, বন্ধু?”
উচ্ছসিত হয়ে সাইফের তড়িৎ জবাব,
“তাওহীদ ও ‘আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআ’র শিক্ষা, বন্ধু। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা। আল্লাহর একত্ববাদ ও ‘আল-ওয়ালা’র শিক্ষা ও সমাজজীবনে এর বাস্তবায়নেই এই গ্রামের মানুষের মাঝে আজ এতো পরিবর্তন। সকল দলাদলি ভুলে এ গ্রামের মানুষ আজ ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই’ নীতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নিজেকে কেবল আল্লাহরই গোলাম মনে করতে শিখেছে, আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিতে সক্ষম হয়েছে। কাফেরের প্রতি কঠোরতা এবং মুমিনের প্রতি সহানুভূতির যে শিক্ষা আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে দিয়েছেন, তা এই গ্রামের মানুষ আজ রপ্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আর এসকল শিক্ষার প্রতিফলনই এই গ্রামে দেখতে পাচ্ছো, বন্ধু।”
“মাশাআল্লাহ! কিন্তু, এই শিক্ষা অটোমেটিক কাজ করেনি নিশ্চয়?”
“না বন্ধু। আল্লাহর অনুগ্রহে একরকম অটোমেটিকই কাজ করেছে। শিক্ষার সংজ্ঞাটা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে!”
“হ্যাঁ, সেই চতুর্থ শ্রেণিতে আব্দুর রহমান স্যারের দেওয়া শিক্ষার সংজ্ঞাটি এখনো মনে পড়ে। স্যার সেদিন বলেছিলেন, ‘আচরণের কাঙ্ক্ষিত এবং মার্জিত পরিবর্তনকেই শিক্ষা বলে।’ সেদিন কিন্তু শিক্ষার সংজ্ঞাটা তুমি আর আমি ছাড়া অন্য কেউ পারেনি!”
সাইফ হেসে বলে,
“হুম... ঠিক বলেছো! তাহলে বুঝেছো তো, শিক্ষা কীভাবে অটোমেটিক কাজ করে? অর্থাৎ, মানুষের আচরণের মার্জিত পরিবর্তন ঘটলেই কিন্তু সেটাকে শিক্ষা বলা হবে।”
“কীভাবে বন্ধু?”
“এই যেমন, এ গ্রামের মানুষ একসময় ‘মাজহাব’ নিয়ে ঝগড়া করতো। মুমিনের গায়ে মুমিন হাত তুলতো, গালি দিতো। এখন কিন্তু এগুলো নেই। কেন? কারণ হলো, এই এলাকার মানুষ প্রথমে বুঝতে শিখেছে যে, তাওহীদের ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে আমরা মুসলিম হয়েছি। মুসলিম হিসেবে অপর একজন মুসলিম তো আমার ভাই। হোক সে হানাফী বা আহলে হাদিস।”
বলে চলেছে সাইফ। আর অপলক নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি আমি, শুনছি নিজ গ্রামের পরিবর্তনের কাহিনী। আজ কিন্তু হাজার মাইল সফরের পর বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ পাইনি। এতো লম্বা সফরের পরও আজ একটু ক্লান্তি আসছে না যে! সাইফের কথার বরকত নিশ্চয়! ছোট্ট ঘরের কোণে একটি জানালা, এর পাশেই আছে বাশবাগান। আর বাশবাগানে রাতের আঁধারকে আলোতে রহস্যময় করে তুলেছে ঝোনাকির ঝাঁক, তারাও হয়তো আমার সাথে কান পেতে শুনছে মুফতি মুহাম্মাদ সাইফের কথা।
“একজন মুসলিম অপর একজন মুসলিমের সাথে কী রকম আচরণ করবে?” আমার জবাবের অপেক্ষা না করে সাইফ নিজেই বলছে,
“এ বিষয়ে সাহাবীদের গুণ বর্ণনা করে আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল-ফাতহের ২৯ নাম্বার আয়াতে বলেন,
وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُم
তাঁর (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) সহচরগণ, কাফেরদের প্রতি কঠোর আর নিজেদের মধ্যে পরস্পরে সহানুভূতিশীল।
তাছাড়াও, সূরা মা’য়িদার ৫৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় দল সম্পর্কে ৬টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। সেখানের ৬টি বৈশিষ্ট্যের একটিও হলো-
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ, তারা মুমিনদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে।
এতোটুকু বুঝেছো বন্ধু?”
মাথা নাড়িয়ে জানালাম বুঝেছি। আমার সাড়া পেয়ে সাইফ আবার বলতে শুরু করলো-
“এখন চিন্তা করো, যে মুসলিম এই গুণটি তথা অপর মুসলিমের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষাটি অর্জন করবে, সে কি মতভিন্নতার কারণে অপর মুসলিমের গায়ে হাত তুলতে পারবে? গালি দিবে? না বন্ধু, দিতে পারবে না। দিতে পারার কথা নয়। তার আচরণে যদি এরূপ পরিবর্তন ঘটে, তাহলেই বুঝা যাবে সে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করেছে। আর যদি এমন হয় যে, কোন মুসলিম এই শিক্ষাটি অর্জন করেও অপর মুসলিমের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেনি। তাহলে বুঝা যাবে, তার শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, যে শিক্ষা আচরণের মার্জিত পরিবর্তন করতে পারেনি সেটি শিক্ষার সংজ্ঞানুযায়ী পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা হতে পারে না।”
“মাশাআল্লাহ। বুঝলাম বন্ধু।” একটু থেমে বিস্ময়ের সুরে বললাম,
“আমাদের গ্রামের সবাই একসাথে এই শিক্ষাটি কীভাবে অর্জন করলো বন্ধু!?”
মুচকি হেসে সাইফ বললো-
“এটা তো এক-দুদিনে হয়নি বন্ধু! মাসের পর মাস গ্রামের মুসলিমদেরকে এই শিক্ষা দিতে চেষ্টা করতে হয়েছে। তবে, এই শিক্ষা অর্জনে একটি প্রক্রিয়া বেশ কাজে এসেছে। সেটি হলো- একপক্ষ চুপ থেকে অপরপক্ষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলে, তাওহীদবাদী বিপরীত পক্ষ একসময় সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য। যেমন ধরো, গ্রামের হানাফী ভাইয়েরা চুপ থেকে আহলে হাদিস ভাইদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলো, তারপরও আহলে হাদিস ভাইয়েরা মাজহাবী ভাইদের নিয়ে গালাগালি করবেন? না, সামান্য মনুষ্যত্ববোধ থাকলেও করবেন না। আল্লাহর মেহেরবানিতে আমাদের গ্রামের আহলে হাদিস ভাইয়েরাও করেননি। তারাও ধীরে ধীরে সহানুভূতিশীল হয়েছেন।”
“আলহামদুলিল্লাহ। জাযাকাল্লাহু খাইরান বন্ধু। বুঝলাম বিষয়টি। কিন্তু, এখন তো অনেক জায়গায় শুনি একপক্ষ আরেকপক্ষকে কেবল ইখতেলাফী মাসআলার কারণেও কাফের বলে ফেলে!”
“হুম... এ কারণেই তারা একে-অপরের সাথে সহানুভূতির আচরণ করে না, বরং কঠোরতা দেখায়। মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা যদিও তাদের জানা থাকে, কিন্তু অপরপক্ষের সাথে আচরণ করে কাফেরের মতো। নাভীর নিচে হাত যারা বাঁধেন, তারা নাভীর উপরে হাত বাধনেওয়ালাদেরকে ঘৃণা করেন। আবার, নাভীর উপরে হাত বাধনেওয়ালারা নাভীর নিচে হাত বাধনেওয়ালাদের প্রতি কটুবাক্য ব্যবহার করেন। এগুলো কেবল বাড়াবাড়িই নয়, চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি। ইখতেলাফী মাসআলায় মতভিন্নতার কারণে কারো সাথে কাফেরের মতো আচরণ করা যায় নাকি? যায় না। এটা সবার বুঝা উচিত। আমাদের গ্রামের মুসলিমরা এটা বুঝেছেন বলেই ‘মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীলতা’র শিক্ষাটি তারা সহজে আত্মস্থ করতে পেরেছেন, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পেরেছেন।
আর এসকল বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন আলেমগণ। আহলে হাদিস আলেমগণ আহলে হাদিস মতানুসারীদেরকে অন্য মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে পারেন। আবার, হানাফী উলামাগণও ভিন্ন মাসলাকের মুসলিমদের প্রতি হানাফী মুসলিমদেরকে সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে পারেন। দ্বীনের শাখাগত ইখতেলাফী মাসআলায় যে এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর নিজের মত চাপিয়ে দিতে পারে না, সেটি উলামাগণই তাঁদের অনুসারীদের বুঝাতে পারেন। যেসকল উলামাগণ বাস্তবেই ঐক্য চান, তাঁদের উচিত এ দিকটাতে মনোযোগ দেওয়া।
আর, এখন তো শাখাগত ইখতেলাফী মাসআলার পেছনে পড়ে থাকারই সময় নেই। বরং, তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। কাফেরদের মোকাবেলায় সীসাঢালা প্রাচীরের মতো এক উম্মাহ এক দেহ হয়ে প্রতিরোধ গড়া প্রয়োজন। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পর ইখতেলাফী মাসআলাগুলো নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যাবে, খলিফাতুল মুসলিমীন নিজেই এ বিষয়ে চিন্তা করবেন। কিন্তু আগে তো ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়া চাই, তাগুতী শাসনের মূলোৎপাটন করা চাই। আফসোস! মুসলিমরা আজ এদিকে মনোযোগ দিচ্ছে কম, ইখতেলাফী মাসআলা নিয়ে পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত। আল্লাহ এ ফেতনা থেকে আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।”
“ছুম্মা আমীন। আমাদের গ্রামের মুসলিমেরা তো এখন এ ধরণের বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত, আলহামদুলিল্লাহ।”
“হুম... আলহামদুলিল্লাহ।”
প্রথম দিনেই অনেক কথা হলো। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের কুড়ানো মণিমুক্তা আমাকে দিতে চাচ্ছে প্রিয় বন্ধু সাইফ। আমারও অনেক জানার ছিলো। কিন্তু, এরই মধ্যে বাড়ি থেকে খবর এলো। রাতও অনেক হয়েছে। বাড়িতে যেতে হবে। দীর্ঘ সফর শেষে আজ সন্ধ্যার পরই বাড়িতে এসেছি। পরিবারেও সময় দেওয়া হয়নি এখনো। মা-সহ পরিবারের অন্যরা হয়তো অপেক্ষা করছেন। কিন্তু, মুফতি মুহাম্মাদ সাইফের সান্নিধ্য যে এক মুহূর্তের জন্যও ত্যাগ করতে ইচ্ছা করছে না! বাল্যকালের স্কুলবয় সাইফের চেয়েও যে মুফতি মুহাম্মাদ সাইফকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছি! কী করি? তাঁকে একটা প্রস্তাব দিয়ে দেখা যাক-
“আচ্ছা বন্ধু, আজ সন্ধ্যার পরই বাড়িতে এসেছি তো। পরিবারে সময় দেওয়া হয়নি এখনো। বাড়িতে সবাই অপেক্ষায় আছেন। চলো বন্ধু, আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে চলো!”
“আজ না বন্ধু, অন্যদিন যাবো ইনশাআল্লাহ। আমার জন্যও ওদিকে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানেরা অপেক্ষা করছে হয়তো।”
সাইফের সুস্পষ্ট জবাব। কী আর করার! সাইফের সান্নিধ্য পাওয়ার অপেক্ষায় থেকে আজ বিদায় নিতেই হবে!
“ঠিক আছে বন্ধু। ফজরে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। এখন তাহলে বাড়ি যাই।”
“আচ্ছা বন্ধু। দোয়া চাই। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।”
চলবে ইনশাআল্লাহ... কিন্তু অত্যন্ত ধীর গতিতে...
[কচি ও কাচা হাতে লেখা এই গল্পে ভুল থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। এই ভুল হতে পারে সাহিত্য-ছন্দে, তত্ত্বে, বানানে। অনুগ্রহপূর্বক এরকম যেকোনো ধরণের ভুল ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলে এবং শুধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো, ইনশাআল্লাহ।]
Comment