কভিড-১৯ : প্রেক্ষিত ইসলাম
করোনাভাইরাস কী?
আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার রয়েছে অসংখ্য অগণিত বাহিনী।[১] তন্মধ্যে একটি বাহিনীর নাম হলো করোনাভাইরাস। এই করোনাভাইরাস যখন জালিম কাফিরদেরকে আক্রান্ত করে, তখন তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আজাব। কিন্তু আজাব যেহেতু ব্যাপকভাবে আসলে কিছু মুমিন বান্দাকেও তা আক্রান্ত করে, তাই আল্লাহ অনুগ্রহস্বরূপ একই জিনিসকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দেন।[৩] করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী সকলে কিয়ামতের দিন এক অবস্থায় উঠবে না। সেদিন মুমিনদের হাশর হবে ইমানদারদের কাফেলায় আর কাফির ও মুনাফিকদের হাশর হবে তাগুতের কাফেলায়।[২]
যে অঞ্চলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাবে, সেখানে যারা তাকদিরের ওপর বিশ্বাস রেখে সওয়াব লাভের প্রত্যাশায় ধৈর্যের সঙ্গে অবস্থান করবে, তাদের জন্য রয়েছে শহিদের মর্যাদা।[৩]
তথ্যসূত্র :
[১] সুরা ফাতহ : ৭
وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ
আর আল্লাহ তাআলার অধিকারেই রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সকল বাহিনী।
সুরা আহযাব : ৯
فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا ۚ
তখন তাদের ওপর আমি প্রেরণ করলাম ঝঞ্ছাবায়ু ও এমন সব বাহিনী, যা তোমরা দেখতে পাওনি।
[২] সহিহ বুখারি : ২১১৮
عَنْ نَافِعِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ ، قَالَ : حَدَّثَتْنِي عَائِشَةُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنَ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ “. قَالَتْ : قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ، وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ ؟ قَالَ : ” يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَى نِيَّاتِهِمْ “.
আয়িশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (পরবর্তী যামানায়) একদল সৈন্য কা‘বা (ধ্বংসের উদ্দেশ্যে) অভিযান চালাবে। যখন তারা বায়দা নামক স্থানে পৌঁছাবে তখন তাদের আগের-পিছের সকলকে জমিনে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। আয়িশা রা. বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, তাদের অগ্রবাহিনী ও পশ্চাৎবাহিনী সকলকে কীভাবে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, অথচ তাদের মধ্যে বাজারের (পণ্য-সামগ্রী বহনকারী) লোকও থাকবে এবং এমন লোকও থাকবে যারা তাদের দলভুক্ত নয়, তিনি বললেন, তাদের আগের-পিছের সকলকে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। তারপরে (কিয়ামতের দিবসে) তাদেরকে তাদের নিয়াত অনুযায়ী ওঠানো হবে।
[৩] সহিহ বুখারি : ৬৬১৯
عَنْ يَحْيَى بْنِ يَعْمَرَ ، أَنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَخْبَرَتْهُ، أَنَّهَا سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الطَّاعُونِ، فَقَالَ : ” كَانَ عَذَابًا يَبْعَثُهُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ، فَجَعَلَهُ اللَّهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِينَ، مَا مِنْ عَبْدٍ يَكُونُ فِي بَلَدٍ يَكُونُ فِيهِ وَيَمْكُثُ فِيهِ لَا يَخْرُجُ مِنَ الْبَلَدِ، صَابِرًا مُحْتَسِبًا، يَعْلَمُ أَنَّهُ لَا يُصِيبُهُ إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ، إِلَّا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ شَهِيدٍ “.
আয়িশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, এটা একটা আজাব। আল্লাহ যার ওপর ইচ্ছে, তা পাঠান। আল্লাহ এটা মুমিনদের জন্য (মুনাফিকদের জন্য নয়) রহমত করে দিয়েছেন। প্লেগে আক্রান্ত শহরে কোনো বান্দা যদি ধৈর্য ধরে সওয়াব লাভের প্রত্যাশা নিয়ে অবস্থান করে, সেখান থেকে বের না হয় এবং সে এই ইলম রাখে যে, আল্লাহ তার জন্য যা লিখেছেন, তা ছাড়া অন্য কিছুই তাকে আক্রান্ত করবে না, তবে সে ব্যক্তি শহিদের সমান সাওয়াব পাবে।
ইসলাম কি সংক্রামক ব্যাধির অস্তিত্ব স্বীকার করে?
কোনো রোগের নিজস্ব সংক্রমণ-ক্ষমতা নেই; কিন্তু কিছু রোগের আল্লাহপ্রদত্ত সংক্রমণ-ক্ষমতা রয়েছে। যেসব হাদিসে সংক্রমণকে নাকচ করা হয়েছে, সেগুলোতে প্রথমটিকে নাকচ করা হয়েছে। আর যেসব হাদিস থেকে সংক্রমণের আভাস পাওয়া যায়, সেখানে দ্বিতীয়টিকে স্বীকার করা হয়েছে।
যেকোনো ফলাফল আসার জন্য ‘সাবাব’ (Cause) লাগে। সাবাব দু-প্রকার : (ক) প্রকৃত সাবাব, (খ) বাহ্যিক সাবাব। যা কিছু ঘটে, এ সবকিছুর প্রকৃত সাবাব আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ও নির্ধারণ। কিন্তু সবগুলোর আবার বাহ্যিক সাবাবও থাকে। যেমন, পুড়ে যাওয়ার বাহ্যিক সাবাব অগ্নি, ডুবে যাওয়ার বাহ্যিক সাবাব পানি, কেটে যাওয়ার বাহ্যিক সাবাব ধারালো বস্তু প্রভৃতি। সাধারণভাবে কোনো জিনিসকে যেমনি তার প্রকৃত সাবাবের দিকে সম্বন্ধিত করা যায়, একইভাবে সেটাকে তার বাহ্যিক সাবাবের দিকেও সম্বন্ধিত করা যায়; যদি না সাবাবটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, অধিকাংশের কাছে অবোধগম্য বা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কারণে ইমান নষ্টের আশঙ্কাযুক্ত হয়।
এখন কেউ যদি বাহ্যিক সাবাবের দিকে সম্বন্ধ করতে গিয়ে বলে, বৃষ্টি ফসল উৎপন্ন করেছে, ছুড়ি কেটে ফেলেছে, বসন্ত ফুলে সুবাসিত করেছে, আগুন পুড়িয়ে ফেলেছে তাহলে এতে দোষের কিছু নেই। বরং কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা এর সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা নিজে সুরা বাকারাসহ অন্যান্য সুরায় বাহ্যিক সাবাবের দিকে সম্বন্ধ করে এর অস্তিত্ব জানিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, আশআরিদের মতানুসারে যদিও এটা জায়িয নেই; তবে মাতুরিদিরা তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। আর কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এক্ষেত্রে মাতুরিদিদের অবস্থানই শক্তিশালী।
সুতরাং কেউ যদি বলে, অমুক আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তমুকের করোনাভাইরাস হয়েছে বা অমুক রোগীকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত করেছে; তবে এর দ্বারা তার ইমান যাওয়ার কিছু নেই। আর উসুলের বাইরে গিয়ে সস্তা আবেগের দাম নেই। কোনো বক্তব্যকে যদি কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থন করে, তবে জাহেরিপনা প্রয়োগ করে তা অবৈধ প্রমাণিত করার চেষ্টা বৃথা ও অর্থহীন বৈ কিছু নয়। হ্যাঁ, কারও যদি আকিদার মূলেই সমস্যা থাকে, তবে তাকে প্রকৃত বিষয় সবিস্তারে খুলে বলতে দোষের কিছু নেই।
করোনাভাইরাসের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত ও জাতিগত তাওবা
কুরআনে আল্লাহ বলেন :
وَلَنُذِيقَنَّهُم مِّنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَىٰ دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
আর আমি তাদেরকে বড় শাস্তির আগে ছোট শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাই, যেন তারা ফিরে আসে। [সুরা সাজদা : ২১]
এ আয়াতের আলোকে প্রতিভাত হয়, করোনাভাইরাস-জাতীয় আজাবসমূহ পারলৌকিক আজাবের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র। আল্লাহ তাআলা এজাতীয় আজাবের স্বাদ আস্বাদন করান, যেন বান্দারা তার উদ্দেশে ফিরে আসে। যেহেতু এজাতীয় শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য হলো বান্দাদের আল্লাহর উদ্দেশে প্রত্যাবর্তন, তাই বান্দারা যদি প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তাদের থেকে শাস্তি উঠিয়ে নেবেন। কারণ, কার্য সমাধা হলে ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হলে শাস্তি বহাল না-থাকার বিষয়টিই আয়াতের ইঙ্গিতার্থের আলোকে প্রতিভাত হয়।
‘ফিরে আসা’ বাংলা শব্দ। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘তাওবা’ বা ‘রুজু’। উপরিউক্ত আয়াত ছাড়াও কুরআনের একাধিক আয়াতে শাস্তি প্রেরণের লক্ষ্য হিসেবে ‘রুজু’র কথা উল্লেখিত হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ এ-ও জানিয়েছেন যে :
وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
আর তারা ক্ষমাপ্রার্থনারত থাকলে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন না। [সুরা আনফাল : ৩৩]
বান্দারা আল্লাহর দিকে রুজু করবে কীভাবে? কিসের থেকে রুজু ও তাওবা করলে বান্দা আল্লাহর উদ্দেশে ফিরে এসেছে বলে প্রতিভাত হবে? আজকাল খুব জোরেশোরে তাওবার কথা, রুজুর কথা, ক্ষমাপ্রার্থনার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত তাওবার পাশাপাশি জাতিগত তাওবার কথাও অনেকেই বলছে। কিন্তু কিসের থেকে তাওবা করবে, এ বিষয়টি উল্লেখ করতে গেলে প্রায় সবাইই মূল পয়েন্ট বাদ দিয়ে শাখাগত পয়েন্টের ওপর ফোকাস করছে।
প্রথম কথা হলো, ‘জাতিগত তাওবা’ দ্বারা বাঙালি জাতির তাওবা উদ্দেশ্য নয়; বরং মুসলিম জাতির তাওবা উদ্দেশ্য। সুতরাং মুসলিম জাতি তাওবা করবে এমন কিছু থেকে, যাতে তারা নির্বিশেষে সকলেই লিপ্ত।
দ্বিতীয় কথা হলো, তাওবার প্রাথমিক ধাপসমূহ হলো রিদ্দাহ থেকে তাওবা করা। শিরক থেকে তাওবা করা। নিফাক (ইলহাদ ও জানদাকা) থেকে তাওবা করা। আকিদা ও আমলের বিদআত থেকে তাওবা করা। ফরজ ত্যাগ বা হারামে লিপ্ত হওয়া তথা কবিরা গোনাহ থেকে তাওবা করা; এক্ষেত্রে বিশেষভাবে যেসব কবিরা গোনাহের ব্যাপারে আয়াতে বা হাদিসে আজাব আসার কথা বিবৃত হয়েছে, সেগুলো থেকে তাওবা করা। এরপর অন্যান্য সর্বপ্রকার গোনাহ ও গাফলত থেকে তাওবা করা।
কেউ যদি রিদ্দাহ (পরিপূর্ণ বা আংশিক ইসলাম ত্যাগ), শিরকে আকবার, (এমন শিরক, যার কারণে মানুষ ইসলামের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যায়) নিফাক (ইসলামের শাশ্বত ও সর্বজনবিদিত কোনো বিধানের অপব্যাখ্যা) বা বিদআতে মুকাফফিরায় (এমন বিদআত, যা মানুষকে কাফির বানিয়ে দেয়) লিপ্ত থাকে, তাহলে সে যতই সাধারণ কবিরা ও সগিরা গোনাহ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করুক না কেন; সে একজন রুজুকারী বা তাওবাকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না।
মুসলিম জাতি আজ যেসকল জাতীয় পাপে লিপ্ত আছে তন্মধ্যে শীর্ষ হলো, আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাহ (বিশেষত সার্বভৌমত্ব ও বিধান প্রণয়নের অধিকার) এবং তাঁর উলুহিয়্যাহ (জীবনের সবক্ষেত্রে তাঁর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ) এর ক্ষেত্রে শিরক। তাও আবার সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে তো কেবল রয়েছে শিরকের গোনাহ; পক্ষান্তরে জ্ঞানীদের ক্ষেত্রে তো এর পাশাপাশি রয়েছে এসব সত্য আড়াল করার গোনাহও। নবুওয়াতের ক্ষেত্রে শিরকও এই যুগে উল্লেখযোগ্য হারেই চোখে পড়ে। এছাড়াও চারিদিকে চলে ইসলামের মাজলুম ফরজ বিধানের অপব্যাখ্যা, যা নিফাকের অন্তর্ভুক্ত। রয়েছে আরও অনেক তাহরিফ (অপব্যাখ্যা) ও কিতমান (গোপন করা)।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর পবিত্র ‘লাশ’ কবরে রাখার আগে সাহাবিরা যে কর্ম সম্পাদন করেছেন, তা আজ প্রায় শত বছর ধরে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। সর্বোচ্চ তিন দিন পর্যন্ত আমির নিযুক্তিতে বিলম্ব করার অবকাশ দেওয়া হলেও এক শতাব্দীকাল ধরে উম্মাহর আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ (কেন্দ্রীয় বিশেষ ব্যক্তিবর্গ) এই ফরজ তরক করে আছে। ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া উভয় প্রকার কিতালের জানাযা পড়ে ফেলেছে। তাদের হাত ধরেই ইসলাম ও কুফরি তন্ত্রমন্ত্রের সংমিশ্রণে নব্য দীনে ইলাহির গোড়াপত্তন হয়েছে। তথাপি আজকালকার কথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজন, বিশেষ করে শিক্ষিতা মেয়েদের মতাদর্শ ও অভিমত যাচাই করলে দেখা যায়, তাদের প্রায় সবাইই ইসলামের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে রিদ্দাহয় লিপ্ত। ফেমিনিস্ট, ডেমোক্রেটিক, ন্যাশনালিস্ট, ক্যাপিটালিজমের ধ্বজাধারী বা সেক্যুলার সুশীলদের কথা আলাদা করে না হয় নাই বললাম। এছাড়াও রয়েছে বিদআতে মুকাফফিরার ছড়াছড়ি সর্বত্র। তথাপি সকলের ওপর রয়েছে স্বজাতির মাজলুম জনগোষ্ঠী, বিশেষত ধর্ষিতা ও বন্দি নারীদের বদদুয়া, রয়েছে হকপন্থী মাজলুম আলিম দাঈ ও মুজাহিদদের কলজেছেঁড়া বেদনা।
এমতাবস্থায় এসব মূল পয়েন্ট ছেড়ে শাখাগত বিষয়াদি থেকে তাওবা করলেই কি আমরা আজাব থেকে মুক্তি পেয়ে যাব? বাস্তবতা তো হলো, আমরা আমাদের কৃতকর্মের কারণে শুধু করোনাভাইরাস বা পঙ্গপালই নয়; এরচে অনেক বড় আজাবের উপযুক্ত। রাসুলুল্লাহ সা.-এর দুয়া না থাকলে আমাদের পুরো জাতির ওপরই হয়তো আরও বহু আগেই নেমে আসতে মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ধ্বংসের ফায়সালা। নব্য জাহিলিয়াতের ভেতর শতাব্দীকাল ধরে আমাদের বসবাস; যা অনেক ক্ষেত্রে মধ্যযুগের জাহিলিয়াতকেও হার মানায়। এখনো নেই কোনো সচেতনতা। নেই অবস্থা পরিবর্তনের যথাযোগ্য কোনো উদ্যোগ। অথচ আল্লাহ জানিয়েছিলেন :
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۗ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ ۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যাবৎ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অকল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারে না। আর আল্লাহ ছাড়া তাদের কোনো কর্মবিধায়কও নেই।’ [সুরা রাদ : ১১]
মুমিন এক গর্তে দুবার দংশিত হয় না। কিন্তু আমরা এক গর্তে শতসহস্রবার দংশিত হই। এরপরও আমাদের ঘুম ভাঙে না। এক শতাব্দীর ব্যর্থতার গ্লানি মুছে, প্রকৃত মুমিনদের সফলতার আখ্যান ভুলে এখনো আমরা পড়ে থাকি সিস্টেমের ভেতর ঢুকে সিস্টেম পরিবর্তন করার দিবাস্বপ্ন নিয়ে।
করোনাভাইরাসে মসজিদ বন্ধের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
এক বিষয়ের দলিল ভিন্ন বিষয়ে প্রয়োগ করা উচিত নয়। করোনাভাইরাসের কারণে সতর্কতাবশত কেউ যদি মসজিদে জামাআতের সঙ্গে সালাত আদায় না করে ঘরে একাকী সালাত আদায় করে, তাহলে এটা তার জন্য বৈধ হবে। শরিয়াহ এসব ক্ষেত্রে রুখসত (ছাড়) গ্রহণের অবকাশ রেখেছে। এমনকি যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা আশঙ্কিত, তাদেরকে শরিয়াহ মসজিদে আসতেই নিষেধ করবে। যদি তারা এই নিষেধাজ্ঞা না মেনে চলে আসে, তাহলে এর দায়ভার তাদেরকেই বহন করতে হবে। তাদের দ্বারা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিঃসন্দেহে তারা পাপী বলে বিবেচিত হবে।
ব্যক্তির জন্য বিশেষ সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে জামাআতে অংশগ্রহণ না-করার অনুমতি-সংবলিত দলিলাদি প্রয়োগ করে মসজিদ শাটডাউন করার ফাতওয়া প্রদান করা যথার্থ নয়। মসজিদ মহান ইবাদতখানা, আল্লাহর ঘর। আল্লাহর ইবাদতকারী বান্দাদের জন্য তা সদা উন্মুক্ত। দুখু মিয়া বড় সুন্দর বলেছেন :
‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়,
কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে,
চালা হাতুড়ি-শাবল চালা।’
আপনার ভেতরে ভয় জাগলে, আশঙ্কা লাগলে বা সতর্কতার অংশ হিসেবে আপনি মসজিদে না যেতে চাইলে না যান। কিন্তু তাই বলে ইবাদতকারীদের জন্য মসজিদের দুয়ার রুদ্ধ করার কোনো অধিকার আপনার নেই। আল্লাহর যেই বান্দারা সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে মসজিদে যেতে চায়, তাদেরকে বরং সহযোগিতা করুন। তাদের জন্য মসজিদের পরিবেশ ও অভ্যন্তর নিরাপদ করার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে মানুষকে মসজিদে জনসমাগমের লাভ-ক্ষতি বা ইতিবাচকতা-নেতিবাচকতা বোঝান। ফরজ সালাত আদায়ের সময় ছাড়া অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ অবস্থান বা অন্যদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক মেলামেশার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করুন। এরপর সিদ্ধান্ত তাদের কাঁধেই ছেড়ে দিন। হ্যাঁ, যারা অন্যদের জন্য নিশ্চিত ঝুঁকির কারণ বা যাদের ব্যাপারে প্রবল আশঙ্কা আছে, তাদেরকে মসজিদ থেকে ফেরাতে পারেন। কিন্তু ঢালাওভাবে আইন করে এই আস্পর্ধা প্রদর্শনের সুযোগ কারও জন্য রাখা হয়নি।
মহামারি (যদি এটাকে মহামারি বলা হয়) ইসলামি ইতিহাসে এটাই প্রথম নয়। সালাফের পথেই আমাদের মুক্তি। সুতরাং মুক্তি চাইলে মুক্তির পথে হাঁটুন। আসল সমস্যা এড়িয়ে অনেক পরের কোনো বিষয় নিয়ে পড়ে থাকা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম ও দাঈ
সংগৃহীত
Comment