শবে বরাতের আমল ও ১৫ শাবানের রোজা
শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই। এই রাতটি একটি বিশেষ রাত; যে রাতে আল্লাহ তাঁর অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন। তাই আল্লাহ তাআলার দিকে অভিমুখী হওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সাধ্যমতো যেকোনো নেক আমল করাই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। নেক আমল বললে আবার বাঙালি শুধু নফল সালাত, জিকির, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি বোঝে। অথচ আমলের পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। যেমন, রিবাত, হিরাসা, রিমায়া, তাদিবুল ফারাস, ইদাদুল কুওয়াহ, ইরহাবুল হারবিয়্যিন ইত্যাদিও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল; তা তো বোধ হয় আমরা ভুলেই গেছি। এই পরিভাষাগুলোই বরং এখন বিলুপ্তির পথে। ক’জন আছে, যারা এই পরিভাষাগুলো শুনলে এর অর্থ বুঝবে!
যাহোক, এই রাতে যদি নফল ইবাদত কেউ না-ও করে, তারপরও সে আল্লাহ তাআলার মাগফিরাত (ক্ষমা) লাভ করতে পারে; যদি সে দুটো দোষ থেকে মুক্ত থাকে। আবার এ রাত্রিতে সারারাত আমল করেও কেউ মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে; যদি সে দুটো দোষে যুক্ত থাকে। কী সেই দুটো দোষ? শবে বরাত-সংক্রান্ত সহিহ হাদিসটির শেষাংশের দিকে নজর দিলেই তা বেরিয়ে আসবে : (১) শিরক, (২) মুসলিম ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ।
আমাদের সমাজের কয়জন মানুষ এমন আছে, যারা এই দুটো দোষ থেকে পবিত্র? সর্বোচ্চ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ পাওয়া যেতে পারে, তা-ও টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খোঁজার পর। শিরক তো বড় সূক্ষ্ম বিষয়। শিরকে আসগার তথা ছোট শিরক না-হয় বাদই দিলাম; বড় শিরক থেকে মুক্ত মানুষের সংখ্যাই বা কয়জন? আজকাল তো মানুষ শিরককে শিরক হিসেবে চেনেই না। কথায় কথায় শিরক ঝরে পড়ে। অবাধে শিরকি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। শিরকি চেতনা, শিরকি সংস্কৃতি, শিরকি রীতিনীতি, শিরকি সভ্যতা, শিরকি রাজনীতি, শিরকি অর্থনীতি, শিরকি বিচারব্যবস্থা, শিরকি শিক্ষাব্যবস্থা, শিরকি পৌরনীতি, শিরকি আচারপ্রথা, শিরকি রসম-রেওয়াজ, শিরকি ইবাদত। এভাবে তালিকা তৈরি করা শুরু করলে তাতে হয়তো কয়েকশ বিষয়ের নাম উঠে আসবে; যেগুলোর সঙ্গে শিরক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ভেবেছেন, এসব শিরক থেকে মুক্ত না হয়ে জাস্ট কিছু নফল আমল করেই সব কুকর্ম থেকে ক্ষমা পেয়ে যাবেন? না, এত সহজ না। আর এক্ষেত্রে শুধু মৌখিক তাওবাও যথেষ্ট নয়। শিরকের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ এবং অতীত কর্মের ব্যাপারে অনুশোচনা ছাড়া স্রেফ মুখের বুলি পাপরাশি মোচনের জন্য কখনোই যথেষ্ট নয়।
মুসলিম ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ নেই কার! দিনশেষে আমরা সবাই বিদ্বেষী। কুফফারের প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ নেই। সব বিদ্বেষ নিজেদের ভাইদের প্রতি। সবার শুধু দোষ আর দোষ। আমি একাই শুধু এ জগতে চিরনিষ্পাপ সত্তা। বিশেষ করে বাংলাদেশের কথা বলি। এখানে তো কেউই কাউকে দেখতে পারে না। কারও বিদ্বেষ মুজাহিদের প্রতি, কারও বিদ্বেষ দীন প্রচারকারীর প্রতি, কারও বিদ্বেষ আলিমের প্রতি, কারও বিদ্বেষ ভিন্ন ঘরানার মুমিনের প্রতি। এসবের পেছনে যে শরয়ি কোনো ওজর আছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা-ও কিন্তু নয়। এক লেখক আরেক লেখককে দেখতে পারে না, এক কবি আরেক কবিকে দেখতে পারে না, এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে দেখতে পারে না, এক বক্তা আরেক বক্তাকে দেখতে পারে না, বড় ছোটর উত্থান সয়ে নেয় না, ছোট বড়র আঁচল টেনে ধরতেও কিছু ভাবে না। এসব ক্ষেত্রে স্রেফ ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রশ্ন বা মতের অমিলই কিন্তু প্রধানত দায়ী। এক সফেদ পোশাকধারীও যে আরেক শুভ্র লেবাসধারীর চরম ক্ষতি করতে কোনো দ্বিধা করে না, এর পেছনে বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা ছাড়া আর কী কার্যকারণ থাকতে পারে?
হ্যাঁ, আমাদেরও বিদ্বেষ থাকবে; বরং থাকতে হবে। কিন্তু সেটা কার প্রতি? এ শিক্ষাই নিতে হয় ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’র চ্যাপ্টার থেকে। শিক্ষা নিতে হয় মিল্লাতে ইবরাহিম থেকে। কিন্তু এত হাজারো বিদ্বেষনির্ভর ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সেই সুযোগ কোথায়!
————***————
এবার আসি দ্বিতীয় বিষয়ে। ১৫ শাবানের সিয়াম (রোজা) নিয়ে ভীষণ ক্যাচাল শুরু হয়েছে। একদিকে বাড়াবাড়ি, আরেকদিকে ছাড়াছাড়ি। একদিকে উগ্রতা, অন্যদিকে শিথিলতা। আমি ভাই অতশত প্যাঁচ বুঝি না। বিষয়টা সোজাসাপ্টাই বলি।
শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান : শাবানের মধ্যরজনী। ফার্সি ‘শব’ বা আরবি ‘লাইলুন/লাইলাতুন’ অর্থ রাত। হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে এসব নামে নামকরণ করা হয়। সহিহ হাদিসেও এ রাতের ফজিলত এসেছে। এমনকি এ রাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর নিকটতম আসমানে ‘নুজুল’ (শাব্দিকঅর্থ : অবতরণ) করেন। প্রতি রাতের শেষাংশেই আল্লাহ ‘নুজুল’ করেন। কিন্তু এ রাতের বৈশিষ্ট্য হলো, এতে শুধু শেষাংশে নয়; বরং পুরো রাতভরই ‘নুজুল’ করেন এবং বান্দাকে আহ্বান করতে থাকেন। সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী দিনের ভোর উদিত হওয়া পর্যন্ত সময়কে রাত বলে। যখন বাংলা ‘রাত’ শেষ, তখন ফার্সি ‘শব’ ও আরবি ‘লাইলাতুন’ও শেষ। এখন শুরু হয়েছে দিন। এই দিনটি একটি সাধারণ দিন। এর আগের দিনের সঙ্গে এর কোনো তফাৎ নেই। ‘শবে বরাতে’র ব্যাপ্তিও তাকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। আর তা করার সুযোগও নেই। কারণ, ‘শব’ (রাত) কখনো দিনকে পরিব্যাপ্ত করে না।
শবে বরাতের রোজা মানে কী? শব্দটাই তো একটা ভুল শব্দ। শব মানে রাত। রাতে তো রোজা হয় না। রোজা হয় দিনে। কিন্তু দিনে তো আর শব থাকে না। তাহলে এ দুটোর মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সম্ভব? এককথায়, শবে বরাতের রোজা বলতে কোনো রোজা নেই। কোনো সহিহ হাদিস দ্বারা শবে বরাতে সাহরি খেয়ে পরবর্তী দিনে বিশেষ রোজা রাখারও প্রমাণ নেই।
আচ্ছা, তাহলে কি ১৫ তারিখ রোজা রাখা যাবে না? দুই ঈদ ও ১১-১৩ জিলহজের মতো এটিও কি সিয়ামের জন্য নিষিদ্ধ দিনসমূহের অন্তর্ভুক্ত? না রে পাগলা, এমন কিছু নয়। শেষ তিন দিন বাদে পুরো শাবান মাস জুড়েই রোজা রাখা যায়। রাসুলুল্লাহ সা.-ও এ মাসে প্রচুর রোজা রাখতেন। তাছাড়া প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা সুন্নত। আইয়ামে বিজ তথা শুভ্র রজনীগুলোতে এই তিনটি সিয়াম পালন করা উত্তম। সুতরাং কেউ যদি ১৩ থেকে ১৫ শাবান রোজা রাখে, তাহলে সে একটি সুন্নাহর ওপর আমল করল এবং অনেক সওয়াব কামিয়ে নিল। তবে এর সঙ্গে শবে বরাতের কোনো সম্পর্ক নেই। আইয়ামে বিজের রোজা যে তিনটিই পূরণ করতে হবে, এরচে কম হলে যে গোনাহ হয়ে যাবে; তা-ও কিন্তু নয়। যেমন, রমজানের পাশাপাশি কেউ যদি শাওয়ালের ছয় রোজা রাখে, তাহলে সে সারাবছর রোজা রাখার সওয়াব পেয়ে যাবে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, শাওয়ালে রোজা রাখলে ছয়টাই রাখতে হবে; একটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত রাখা যাবে না।
সুতরাং কেউ যদি শুধু শাবানের রোজা হিসেবে বা আইয়ামে বিজের একটি রোজা হিসেবে ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করে, তাহলে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে তার নিয়তের ওপর। নিয়ত যদি হয় বাঙালিসমাজে প্রচলিত একটি প্রথা রক্ষা করা ও শবেবরাতের রোজা হিসেবেই এই একদিন উপবাস থাকা, তাহলে এটা তার জন্য ক্ষতিকর হবে। এখন কার কী নিয়ত, তা তো আমাদের জানার সুযোগ নেই। তাছাড়া রোজা গোপন বিষয়। সাধারণত লৌকিকতা প্রদর্শনের জন্য মানুষ এই আমলটি করে না। তাই কাউকে রোজা রাখতে দেখলেই তার ব্যাপারে বিরূপ ধারণা করা কখনোই উচিত নয়।
তবে কেউ আগেপরে না রেখে শুধু ১৫ তারিখ রোজা রাখলে যেহেতু এতে বিভ্রমের আশঙ্কা হয়, তাই এর সঙ্গে যেকোনো দিকে দুই/একটা রোজা মিলিয়ে রাখলে আর কারও কোনো সংশয় থাকবে না। এক্ষেত্রে আইয়ামে বিজ না মিললেও সমস্যা নেই। তবে এটাকে কেউ আবার আশুরার সঙ্গে যাতে না মিলিয়ে ফেলে, সে দিকেও লক্ষ রাখা দরকার। কারণ, আশুরার আগে বা পরে আরেকটি রোজা রাখা হয় ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়ানোর জন্য। কিন্তু এখানে ওরকম কিছু নয়। পার্থক্য হলো, আশুরার রোজা আছে; শবে বরাতের রোজাই নেই। হ্যাঁ, ১৫ তারিখ রোজা রাখা নাজায়িয বা বিদআত নয়। কিন্তু সেই রোজা হবে হয়তো আইয়ামে বিজের বা হবে শাবান মাসের; শবে বরাতের নয়।
অবশ্য এটা তো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, শবে বরাতে যেকোনো নেক আমল করা সৌভাগ্যের বিষয় বলে বিবেচিত হবে। আর সেহরিও একটি নেক আমল। তাই বান্দা এ রাতে অন্যান্য আমলের পাশাপাশি এই নেক আমলটিও পালন করল। এতে তার সওয়াব বৈ গোনাহ হবে না।
উল্লেখ্য, এ বিষয়ক হাদিসটি অত্যন্ত দুর্বল। যা থেকে কোনো বিধান আহরণ করা যায় না। হাদিসের অন্যান্য অংশের পক্ষে সমার্থক বর্ণনা থাকলেও রোজার অংশের ব্যাপারে কোনো সমার্থক বর্ণনা পাওয়া যায় না। ‘ইবনু আবি সাবরা’র ব্যাপারে জাল বর্ণনাকারী হওয়ার অভিযোগ ঠিক না; তবে তিনি অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ফাজায়িলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস গৃহীত হওয়ার যে কথা প্রসিদ্ধ আছে, তা কিছু শর্তসাপেক্ষ; যেগুলো এই বর্ণনায় অনুপস্থিত। তদুপরি এর দ্বারা কোনো ফজিলত গ্রহণ করা হচ্ছে না; একটি বিধান উদঘাটন করা হচ্ছে। আর এমনিও এতে সিয়ামের ফজিলতের কোনো কথা আসেনি; বরং তা পালনের নির্দেশ এসেছে। এই সিয়ামটি যদি অন্য কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত হতো, তাহলে না-হয় এটাকে সমার্থক বর্ণনা হিসেবে পাশে রাখা যেত। কিন্তু কেবলই এর ওপর নির্ভর করে একটি বিধান প্রতিষ্ঠা করা উসুল অনুযায়ী সমর্থিত নয়।
লেখকঃ বিশিষ্ট আলেম ও দাঈ
সংগৃহীত
Comment