অগোছালো কিছু কথা
কিছু প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। সঠিক জওয়াব না পাওয়ায় মনে মনে সংশয় থেকে যায়। আবার কিছু প্রশ্ন আছে উত্তর পেলে মনটা শান্ত হতো। এ ধরনের অনেক বিষয় থাকে। এমন কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের লিখাটি। সবগুলো এক শিরোনামে আনা সম্ভব না। তাই অগোছালোই রাখলাম। এক. অনেকে বলেন, ইসলাম একটা পিঁপড়াকেও কষ্ট দেয় না।
উত্তর: পিঁপড়া না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু ইসলাম তো সাপ মারতে বলে। সাপ মারলে সওয়াব পাওয়া যায়। আর কাফের মুরতাদরা সাপের চেয়েও ভয়ংকর এবং নিকৃষ্ট। আল্লাহর সৃষ্টিতে এরা সবচে’ নিকৃষ্ট। এজন্য এদের মারলে সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে আল্লাহর দেয়া সীমারেখা মেনে চলতে হবে অবশ্যই।
অধিকন্তু পিঁপড়া কামড় দিলে আপনিও ছাড়বেন না, যেমন মশা ছাড়েন না। আপনার বিবি সাহেবা যখন আপনার মাথা থেকে উকুন মারেন তখন কিন্তু কিছু বলেন না।
দুই. হুজুর! তলবে ইলম, দরস-তাদরিস, খানকা এগুলো ভাল কাজ। সবাই তো ভাল কাজই করছে। তাহলে শুধু জিহাদ না করার কারণে সমালোচনা করেন কেন?
উত্তর: যেসব ছাত্র, যেসব মুরীদ ঠিকমতো নামায পড়ে না তাদের বকাঝকা করেন কেন? ফরয জিহাদ ছাড়লেও এমনই।
তিন. আপনারা বড় বড় হুজুরের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এটা কি বেয়াদবি না? উনারা কি কম বুঝেন?
উত্তর: আমরা বড় হুজুরদের সম্মান বজায় রেখেই কথা বলি। বরং উনাদের গবেষণাগুলো থেকে আমরা মুজাহিদরাই প্রকৃতপক্ষে বেশি উপকৃত হই। তবে যেসব বিষয়ে উনারা জেনে না জেনে শরীয়াহ পরিপন্থী কথা বলেন, সেগুলোতে চুপ থাকতে পারি না। এখানে চুপ থাকা শয়তানি।
আর উনারা কম বুঝেন কি’না- এ ব্যাপারে কথা হলো, যেসব বিষয় উনারা কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক গবেষণা করেন সেগুলোতে উনারা অনেক ভাল বুঝেন। আমরা সেসব বিষয় উনাদের থেকেই গ্রহণ করি। কিন্তু শরীয়ত এক ব্যাপক জগত। এখানে সবাই একসাথে সব বুঝবে এমন না। নীতি হল, الاجتهاد يقبل التجزي – তথা কিছু বিষয়ে কারো ভাল বুঝ থাকতে পারে আর কিছু বিষয়ে একেবারেই ইলম না থাকতে পারে। বড় মুজতাহিদের বেলায়ও একই কথা যে, কোনো কোনো মাসআলা না জানা থাকতে পারে। একারণে আইম্মায়ে কেরাম অনেক প্রশ্নের উত্তরেই বলতেন, লা আদরি- আমি জানি না। তখন অবশ্য শাগরিদ ও মুস্তাফতি প্রশ্ন করতো, আপনি এত বড় হুজুর, আপনি জানেন না? তখন তারা অকপটে স্বীকার করতেন, জী! এ বিষয়ে আমার জানা শুনা নেই। অন্যকে জিজ্ঞেস কর।
আমাদের সমস্যাটা হলো, আমরা একজনকে সব বিষয়ে আলেম মনে করে সব বিষয় উনার কাছে জিজ্ঞেস করি। আর বড়দের সমস্যা হলো, উনারা বড়ত্ব ঠিক রাখতে সব বিষয়ে কিছু একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। লা আদরি বলতে লজ্জা পান। এ সমস্যাই আমাদের সর্বনাশ করছে।
চার. হুজুর, জিহাদের আয়াত কি তাবলিগে লাগানো যাবে না?
উত্তর: তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, জিহাদ এক জিনিস আর তাবলিগ আরেক জিনিস। তাবলিগ জিহাদ নয়।
আরো স্বীকার করছেন, শরীয়তে জিহাদের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক আয়াত হাদিস এসেছে। তাবলিগের ব্যাপারে এমন কিছু নেই। তাই জিহাদেরগুলো ধার করে তাবলিগে লাগাতে চাচ্ছেন।
যদি এ দুই কথা স্বীকার করেন তাহলে বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে জিহাদের আয়াত তাবলিগে লাগানো যাবে কি’না। সহজ প্রশ্ন হল, রোযার ফজিলত তাবলিগে লাগানো যাবে কি’না? সবাই বলবে, যাবে না। জিহাদেরগুলোতেও একই কথা। তাবলিগ সহীহ পথে হয়ে থাকলে দ্বীনের কাজের সওয়াব পাবে, জিহাদের সওয়াব পাবে না; যেমন রোযা না রেখে তাবলিগ করলে রোযার সওয়াব পাবে না।
পাঁচ. শুনেছি মুজাহিদদের হামলায় অনেক সময় সাধারণ মুসলমান মারা যায়।
উত্তর: সাধারণ মুসলমান কেনো, অনেক সময় মুজাহিদের হামলায় অন্য মুজাহিদও মারা যায়। অনেক সময় মুজাহিদ নিজেও মারা যান। এভাবে অনিচ্ছায় মারা গেলে গুনাহ হবে না। সর্বোচ্চ সতর্কতার পরও যদি কোনো মুসলমান মারা যায় এর দায়ভার মুজাহিদদের উপর আসবে না, কোনো গুনাহও হবে না।
এক যুদ্ধে এক সাহাবি এত জোরো তরবারি মারেন যে, তরবারি ঘুরে নিজের পায়ে এসে লাগে। সাহাবি মারা যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ সাহাবি সাধারণ মুজাহিদদের চেয়ে বেশি মর্যাদা পাবে।
সাহাবায়ে কেরাম অনেক সময় অকস্মাৎ হামলা করতেন, যার ফলে কাফেরদের নারী-শিশুরাও মারা যেতো যাদেরকে হত্যা করা নিষেধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সমস্যা নেই। ইচ্ছা করে মেরো না।
মুসলমানদের ব্যাপারেও একই কথা। আর সাধারণ মুসলমানদের উচিৎ হলো, কাফের মুরতাদের থেকে দূরে থাকা। যাতে মুজাহিদদের হাতে আল্লাহ তাআলা কাফের মুরতাদদের যে আযাব দেন, তারাও যেন এ আযাবে পড়ে না যান।
ছয়. মুজাহিদরা অনেক জায়গায় হদ কায়েম করেন না, অন্য শাস্তি দেন। এটা কি হুকুম বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ না?
আচ্ছা ভাই প্রশ্ন করি, আমাদের সমাজে তো অনেক যিনা হচ্ছে, চুরি হচ্ছে, ডাকাতি হচ্ছে। কাউকে কি আপনি শাস্তি দিয়েছেন? উত্তরে বলবেন, আমাদের তো শক্তি নেই।
আপনি যদি মা’জুর হন, মুজাহিদদেরও মা’জুর মনে করেন। আপনি কোনো কিছু না করেও যদি মাফ পেয়ে যাবেন আশা করছেন তাহলে মুজাহিদরা যতটুকু পারছেন শাস্তি দিচ্ছেন, তাহলে তারা কেনো মাফ পাবেন না? হদ কায়েমের জন্য যতটুকু শক্তি দরকার ততটুকু হাসিল হলে অবশ্যই হদ কায়েম করবেন। যাদের হাসিল হয়েছে তারা করছেনও। যেমন সোমালিয়া। তখন ভিন্ন শাস্তি দিলে হুকুম বি গাইরি মা আনযাল্লাহ হবে। তখন দেখতে হবে সেটা কোন পর্যায়ের: ফিসক না কুফর?
সাত. জিহাদিরা উগ্র।
উত্তর: ভাই, কিছু জযবা না থাকলে দ্বীনের কাজ করা যায় না। আবু বকর রাদি. তো একেবারে নরম মানুষ ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أرحم أمتي بأمتي ابو بكر তথা উম্মতের মধ্যে উম্মতের প্রতি সবচে’ রহম দিল মানুষ হলেন আবু বকর। সেই আবু বকর কি সিংহের গর্জন দিয়েছিলেন মনে আছে? ‘আল্লাহর কসম! ছাগলের একটা রশি দিতে অস্বীকার করলেও আমি এদের বিরুদ্ধে কিতাল করবো’। বাব্বা! কি হুংকার।
জিহাদিরা সেই আবু বকরের উত্তরসুরি তো তাই একটু জযবাতি। তবে অতি জযবা অবশ্যই নিন্দনীয়। কেউ কেউ জযবার সীমা লংঘন করেন। এটা অস্বীকার করা যায় না। এটা শুধু মুজাহিদদের দোষ না, সবাই এমন করেন। বদনাম শুধু মুজাহিদদের হয় আরকি।
আট. মুজাহিদরা ভাসা ভাসা বুঝে।
উত্তর: মুজাহিদরা সরীহ কুরআন সুন্নাহ আর সালাফে সালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কথা বলেন তো তাই একটু ভাসা ভাসা মনে হয়। সালাফও এমন ছিলেন। প্যাঁচ পছন্দ করতেন না। কথায় আছে, العلم نقطة كثرها الجهلاء ইলম ছিল একটা বিন্দু। জাহেলরা আজগুবি বহস করে করে পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে।
নয়. জিহাদ করতে গেলে সমাজের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হয়ে বিশৃংখলা দেখা দেবে।
কুফরি সমাজের শৃংখলা নষ্ট করা আল্লাহ তাআলার সুন্নত। আদ সামূদ যেসব জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করেছেন এরা তো অনেক সুখেই ছিল। আল্লাহ তাআলা এদের শান্তি হারাম করে দিলেন। এদের ধ্বংস করে তার মুমিন বান্দাদের হাতে যমিনের ক্ষমতা দিলেন। আমাদেরও করণীয় তাই। কুফরি সমাজ ধ্বংস করে শরীয়াহর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তবে মুমিনের জান-মাল সুরক্ষিত। যতটুকু পারা যায় চেষ্টা করতে হবে যেন মুমিনের জান মালের ক্ষতি না হয়। যতটুকু না পারা যায় ততটুকুর জন্য মুজাহিদরা দায়ি না। বরং যারা জিহাদ না করে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আরামে চলে আসছিলেন তাদের বরবাদির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। আল্লাহর পথে এত দিন জান মাল বিসর্জন যখন দেননি, অনিচ্ছায় হলেও এর সাজা পেতে হবে। মুজাহিদদের করার কিছু নাই।
দশ. মুজাহিদদের কারণে বড়দের প্রতি আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
বড়দের প্রতি আস্থা নষ্ট করাই তো নবী রাসূলদের সুন্নত। লোকজন বড়দের পূজা করে আসছিল। নবী রাসূলগণ এসে তা হারাম ঘোষণা দিলেন। দ্বন্ধ লেগে গেল। সন্তান ঈমান আনলো বাপ কাফের রইল। পিতা-সন্তানে আস্থা নষ্ট হল। এভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে, বন্ধুতে বন্ধুতে একেবারে সব জায়গায় আস্থা নষ্ট হয়ে গেল। বড়দের কথা আর মানছে না ছোটরা। রাসূলদের দাওয়াতের কারণে আস্থা উঠে গেছে বড়দের প্রতি।
এটিই নবী রাসূলদের সুন্নত। তবে বড়রা যদি কুরআন সুন্নাহ এবং সালাফের তরিকামতো কথা বলেন তাহলেই আর আস্থা নষ্ট হবে না। ব্যতিক্রম হলেই আস্থা নষ্ট। এর জন্য উনারা নিজেরাই দায়ী।
আজ এ দশটাই। অন্য মজলিসে ইনশাআল্লাহ….।
Comment