সরকারের সাথে আমান প্রসঙ্গ: কার আমান কার উপর বর্তাবে?
কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রশাসনের সাথে আমাদের এক প্রকার আমানের চুক্তি হয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয হবে না, গাদ্দারি হবে।
আপাত দৃষ্টিতে প্রাথমিক তালিবুল ইলম ও সাধারণ মুসলিমদের কাছে এটি একটি সংশয়ের বিষয় হতে পারে। কারণ, ইসলাম আমান রক্ষার তাগিদ দেয়।
তবে একটু চিন্তা করলে এখানে কয়েকটা প্রশ্ন সামনে আসবে:
১. আমানটা কখন হলো এবং কে দিল? আমানের দুই পক্ষ কারা?
২. আমান কি কি শর্ত সাপেক্ষে হয়েছে? আমানের ধারাগুলো কি কি?
৩. আমানের শর্তগুলো কি আমরাই ভাঙছি না প্রশাসনও ভাঙছে? যদি ভেঙে থাকে তাহলে কি বিধান?
এ ধরনের অনেক প্রশ্নই এখানে গোলমেলে।
তাছাড়া এখানে আরও বড় একটা প্রশ্ন আসে, প্রশাসন মুসলিম না কাফের?
মুসলিম হলে তার সাথে আমানের প্রশ্ন কেন? আমান তো হয় এমন লোকদের সাথে সাথে যাদের জান মাল আমি হালাল মনে করি এবং তারাও আমার জান মাল হালাল মনে করে। মুসলিমের জান মাল তো অন্য মুসলিমের জন্য সর্বাবস্থায় হারাম। আমানের চুক্তির কি অর্থ?
হয়তো বলবেন, বাগি-বিদ্রোহি মুসলিমদের সাথে আমান হতে পারে।
কথাটা যদি মেনে নিই, তাহলে প্রশ্ন আসবে, তাহলে বিদ্রোহি কারা? আমরা না প্রশাসন?
যদি বলেন, বিদ্রোহি প্রশাসন, তাহলে আজই আপনাকে জেলে যেতে হবে। এটা আশাকরি কেউ বলবে না।
তাহলে অপশন রইল, দেশের মুসলিম জনসাধারণ সবাই বাগি, বিদ্রোহি।
তাহলে আপনি বলতে চান, এত বড় হারামে দেশের সব মুসলিম যুগের পর যুগ ধরে লিপ্ত?
এরও কোনো সদুত্তর হবে না।
সব মিলিয়ে বিষয়টা গোলমেলে অনেক।
মুসলিমের আমান আরেক মুসলিমের উপর বর্তাবে কখন?
এতো সব এড়িয়ে গিয়ে যদি মেনেও নিই, প্রশাসনের সাথে আমান হয়ে গেছে, তখন আরেকটা মাসআলা সামনে চলে আসবে। তা হলো, অন্যের অধীনস্থ মুসলিমের দেয়া আমান আরেক মুসলিমের উপর বর্তায় না। অতএব, যারা দাবি করেন, সরকারের সাথে তাদের আমান হয়ে গেছে, তাদের আমান তাদের পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, অন্যদের উপর বর্তাবে না।
একটি চমৎকার মাসআলা
কোনো মুসলিম কোনো দারুল হারবে ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো হারবি খ্রিস্টান বা ইয়াহুদি মহিলাকে বিবাহ করলো। কিংবা দারুল হারবে কাফের থেকে মুসলমান হয়েছে এমন কোনো মুসলিম সেখানকার কোনো ইয়াহুদি বা খ্রিস্টান মহিলাকে বিবাহ করলো। কিছুদিন পর মুসলিমরা সে দারুল হারবে হামলা করে তা বিজয় করলো। ঐ মহিলা মুসলিমদের হাতে বন্দী হলো। মাসআলা হলো, ঐ মহিলা মুসলিমদের দাসী হয়ে যাবে।
আপনি হয়তো আশ্চর্য হবেন, একজন মুসলিম ভাইয়ের বিবি কি করে অন্য মুসলিমদের দাসী হয়?
আশ্চর্যের কিছু নেই। ঐ মুসলিম ভাই কাফেরদের অধীনস্থ। তিনি যদি কাউকে আমান দেন তাহলে সে আমান তার নিজের পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, অন্য মুসলিমদের উপর বর্তাবে না। এ কারণে তার বিবাহিত স্ত্রী অন্য মুসলিমদের থেকে আমান পাবে না। অন্য মুসলিমদের সাথে যখন তার আমান নেই, তাদের জন্য তাকে বন্দী করা জায়েয। আর বন্দী করার দ্বারা সে মুসলিমদের দাসীতে পরিণত হবে। (দেখুন শারহুস সিয়ারিল কাবির, পৃষ্ঠা ২২০৮-২২০৯)[1]
এক মুসলিমের আমান তো অন্য মুসলিমের উপর বর্তানোর কথা ছিল, কিন্তু বর্তালো না? কারণ, ঐ মুসলিম ভাইয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো রাষ্ট্র নেই, বরং তিনি অন্যের অধীনস্থ। এ ধরনের হালতে মুসলিম তার নিজের উপর কর্তৃত্ব রাখে, অন্যের উপর তার কোনো প্রভাব নেই। তাই তার আমান অন্য কারও উপর বর্তাবে না।
মারগিনানি রহ. বলেন,
" ولا يجوز أمان ذمي " لأنه متهم بهم وكذا لا ولاية له على المسلمين قال " ولا أسير ولا تاجر يدخل عليهم " لأنهما مقهوران تحت أيديهم فلا يخافونهما والأمان يختص بمحل الخوف ولأنهما يجبران عليه فيعرى الأمان عن المصلحة ولأنهم كلما اشتد الأمر عليهم يجدون أسيرا أو تاجرا فيتخلصون بأمانه فلا ينفتح لنا باب الفتح ومن أسلم في دار الحرب ولم يهاجر إلينا لا يصح أمانه لما بينا. –الهداية في شرح بداية المبتدي (2/ 383)
“কাফের দেশে ব্যবসা করতে যাওয়া মুসলিম বা কাফেরদের হাতে বন্দী মুসলিমের আমান (নিজের ক্ষেত্রে সহীহ হলেও অন্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে) সহীহ নয়। কারণ, তারা কাফেরদের নিয়ন্ত্রণাধীন। কাফেররা তাদেরকে ভয় করতে হয় না। আর আমান তো হয়ে থাকে যাদের থেকে আশঙ্কা আছে তাদের সাথে।
তাছাড়া কাফেররা তাদেরকে আমান দিতে বাধ্য করতে পারে। এতে করে সে আমানে মুসলিমদের কোনো মাসলাহাত আর থাকবে না।
আরেকটি কারণ হলো, যখনই তারা (মুসলিমদের থেকে) কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, কোনো ব্যবসায়ী বা বন্দী মুসলিমকে ধরে তার থেকে আমান নিয়ে ফসকে যাবে। এতে আমাদের সামনে দারুল হারব বিজয়ের আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।
একই কারণে যে ব্যক্তি দারুল হারবে মুসলিম হয়েছে কিন্তু হিজরত করে আমাদের কাছে (দারুল ইসলামে আসেনি) তার আমানও (অন্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে) সহীহ নয়।” -হিদায়া ২/৩৮৩
মুসলিম যদি দারুল ইসলামে থাকাবস্থায় গোটা একটা কাফের রাষ্ট্রকেও আমান দিয়ে দেয়, তাহলে তার আমান সহীহ। কোনো মুসলিম সে রাষ্ট্রে হামলা করতে পারবে না। ইমামুল মুসলিমিন যদি হামলা করতে চান, আগে কাফেরদের জানিয়ে দিতে হবে, আমরা আমান ভেঙে দিচ্ছি, তোমরা সতর্ক হয়ে যাও। এরপর চাইলে হামলা করতে পারবেন।
ঠিক সেই মুসলিমই যদি দারুল হারবে ব্যবসা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যান আর কাফেরদের আমান দেন, তাহলে তার আমান সহীহ না। মুসলিমরা সে রাষ্ট্রে হামলা করতে পারবে। কারণ, যেমনটা মারগিনানি রহ. বলেছেন, তার আমানে মুসলিমদের কোনো মাসলাহাত নেই। বরং কাফেররা নিজেদের স্বার্থে যখনই দরকার একটা জবরদস্তিমূলক পরিস্থিতি তৈরি করে তাদের থেকে আমান নিয়ে নিবে।
মোটকথা, মুসলিম যখন দারুল ইসলামের বাসিন্দা এবং ইমামুল মুসলিমিনের অধীন, তখন মুসলিম বাহিনির শক্তিতে সে শক্তিমান। এ শক্তিবলে যখন সে আমান দেবে, তার আমান ঐ দারুল ইসলামের সকল মুসলিমের উপর বর্তাবে। পক্ষান্তরে মুসলিম যখন কাফেরদের নিয়ন্ত্রণাধীন, তখন সে শক্তিহীন। তার আমান তখন মুসলিমের স্বার্থে না হয়ে তার ব্যক্তি স্বার্থে হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই তার এ আমান ধর্তব্য নয়।
এবার আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি।
আমরা মুসলিমরা আজ বিচ্ছিন্ন। আমাদের কোনো জামাত নেই, কোনো বাহিনি নেই। আমরা ইমামের অধীন নই। আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই সঙ্কটে। আমাদের ভয়ে কেউ ভীত নয়, আমরা তাদের ভয়ে ভীত। এমতাবস্থায় আমি শুধু নিজের কর্তৃত্ব রাখি, অন্য মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করি না। এমনকি পরিস্থিতি তো এখন এমন হয়ে গেছে, আমার সন্তানকে শাসন করতেও ভয়ে থাকতে হয়, শিশু নির্যাতনের মামলায় জড়িয়ে যাই কি’না। আমার মেয়েকেও আমি তাদের বেঁধে দেয়া সময়ের আগে বিবাহ দিতে পারি না। আমার মেয়ে আমার অমতে কাউকে বিবাহ করে নিলে আমি বাধা দিতে পারি না। যেখানে আমার ছেলে মেয়ের উপরও আমার কর্তৃত্ব নেই, সেখানে গোটা মুসলিম জাতির প্রতিনিধিত্বের তো কোনো প্রশ্নই নেই।
এমতাবস্থায় আমি আমার জান মাল ইজ্জত আব্রু রক্ষায় যদি সরকার থেকে আমান নিই বা দিই, তাহলে এটা শুধু আমার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, অন্য কেউ এ আমান মানতে বাধ্য নয়।
অতএব, যদি কেউ দাবি করে সরকারের সাথে তার আমান হয়ে গেছে, তাহলে তিনি নিজ আমান পালন করে যান, অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা না করুন। যারা মনে করেন ‘আমাদের সাথে সরকারের কোনো আমান নেই’ তারা স্বাধীন। তারা প্রশাসনের উপর আঘাত হানার অধিকার রাখেন। আমি আমার পরাধীনতার জিঞ্জির অন্যের গলায় পরাতে চেষ্টা না করি।
[1]
ولو أن المسلم أو الذمي وجد المسلمون معه امرأة في دار الحرب فسألوه عنها فقال: هذه امرأتي تزوجتها في دار الحرب، وصدقته المرأة في ذلك فهي امرأته؛ لأنهما تصادقا على النكاح، والنكاح يثبت بالتصادق، والمرأة فيء صدقته على النكاح أو كذبته. لأن تزويجه لو كان ظاهرا عيانا لم يخلصها من السبي، فإذا لم يكن ظاهرا أولى. قال: ولا يكون تزويجه إياها أمانا لها؛ لأنه تزوجها في دار الحرب، ولو أفصح لها بالأمان في دار الحرب لم يجز أمانه على المسلمين، كذا ها هنا لا تصير بالتزويج آمنة في حق المسلمين أولى. -شرح السير الكبير (ص: 2208-2209)
ولو أن المسلم أو الذمي وجد المسلمون معه امرأة في دار الحرب فسألوه عنها فقال: هذه امرأتي تزوجتها في دار الحرب، وصدقته المرأة في ذلك فهي امرأته؛ لأنهما تصادقا على النكاح، والنكاح يثبت بالتصادق، والمرأة فيء صدقته على النكاح أو كذبته. لأن تزويجه لو كان ظاهرا عيانا لم يخلصها من السبي، فإذا لم يكن ظاهرا أولى. قال: ولا يكون تزويجه إياها أمانا لها؛ لأنه تزوجها في دار الحرب، ولو أفصح لها بالأمان في دار الحرب لم يجز أمانه على المسلمين، كذا ها هنا لا تصير بالتزويج آمنة في حق المسلمين أولى. -شرح السير الكبير (ص: 2208-2209)
Comment