অগোছালো কিছু কথা-৩
একুশ. জিহাদের ফলে খাওয়ারেজ তৈয়ার হয়। উত্তর: আপনি কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী এড়িয়ে যেতে চান? উম্মতে মুসলিমার মাঝে খাওয়ারেজ নামক ভাইরাসের উৎপত্তি হবে বলে অসংখ্য হাদিসে এসেছে। এটি এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত খাওয়ারেজ তো পয়দা হয়েছিল হযরত উসমান রাদি. এর যামানায়। এসব লোক খলিফায়ে রাশেদ উসমান যুন নুরাইন রাদি.কে শহীদ করে। আলী রাদি.র সাথে তাদের কিতালের ইতিহাস সকলের জানা। অবশেষে এরা আলী রাদি.কেও শহীদ করে। তাহলে কি আপনি খেলাফতে রাশেদার উপর আপত্তি করবেন যে, খেলাফতের কারণে খাওয়ারেজ পয়দা হয় তাই খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না?
আসলে খাওয়ারেজ অন্য সকল অপরাধীগোষ্ঠীর মতোই একটা গোষ্ঠী। অন্য অপরাধীগোষ্ঠীর মতো এদের উৎপত্তিও স্বাভাবিক। এটি খেলাফতেরও কুফল নয় জিহাদেরও কুফল নয়। বরং এসব নাফরমান নির্বোধ অহংকারীকে আল্লাহ তাআলা আহলুস সুন্নাহর খালেস মুজাহিদদের কাতার থেকে বহিষ্কৃত করে জিহাদকে পাক পবিত্র করতে চান।
বাইশ. জিহাদ যদি করতে চাও তাহলে গোপনে কেন? প্রকাশ্যে আস।
উত্তর: এ ধরনের প্রশ্ন শিখদের পক্ষ থেকে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহ.কে করা হয়েছিল। সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহ. যখন শিখদের উপর রাতের অন্ধকারে গুপ্ত হামলা চালিয়ে যেতে থাকলেন যেগুলো শিখরা প্রতিহত করতে পারছিল না তখন তারা সিয়াসি চাল চেলে এ হামলা বন্ধ করতে চেষ্টা করল। তারা বলল, আপনি যদি সুপুরুষ হন তাহলে রাতের অন্ধকারে গোপনে কেন হামলা করেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, জিহাদ আমার কাজ। যতভাবে তোমাদের দমন করা যায় আমি তা করে যাব। তোমাদের কথায় আমি ধোঁকায় পড়বো না।
আফসোস! এ ধরনের প্রশ্ন কাফেরদের তরফ থেকে করা হতো। আজ জাতির রাহবার বলে যারা পরিচিত তারা করছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, الحرب خدعة – যুদ্ধ কৌশলের নাম। প্রকাশ্য-গোপন যত রকমের কৌশল আছে সবই এতে শামিল।
আবু বাসির রাদি. গোপনে গোপনেই জিহাদ দাঁড় করিয়ে মক্কাবাসীর কোমড় ভেঙে দিয়েছিলেন।
কা’ব বিন আশরাফ, ইবনে আবিল হুকাইক, খালেদ ইবনে সুফিয়ান আলহুজালি সবাইকে গোপনেই হত্যা করা হয়েছিল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো যুদ্ধে গমনকালে সাহাবায়ে কেরামকে বলতেনও না যে কোন শত্রু তার উদ্দেশ্য। যেদিকে টার্গেট সরাসরি সেদিকে না গিয়ে অন্য দিকে রওয়ানা করতেন। সাহাবায়ে কেরামের সাথেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটুকু গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন।
মোটকথা, কাফেরদের কোমড় ভেঙে দেয়া হল কথা। এখন প্রকাশ্যে আসবো না গোপনে আসবো সেটা কৌশলের ব্যাপার। যে মারহালায় যেটা মুনাসিব সেটাই করবো। এটাই যুদ্ধনীতি। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
তেইশ. জীবনটা কতয়ি মাহফুজ। সেটা দিতে হলে কতয়ি জায়গা লাগবে।
উত্তর: জিহাদ থেকে ফিরানোর জন্য কথাটা বলা হয়। কথাটার মর্ম: যেকোনো কিছুতে জীবন দিয়ে দেয়া জায়েয নয়। জীবন দিতে হলে এমন ক্ষেত্র লাগবে যেখানে জীবন দেয়া কুরআন সুন্নাহর কতয়ি দলীল অনুযায়ী বৈধ।
কথাটা সুন্দর, মতলব খারাপ। এ কথার প্রবক্তারা মূলত একথা বলতে চান যে, জিহাদিরা যত্রতত্র জীবন দিয়ে হারাম করে যাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি এভাবে বললে আবার কোন্ বিপদ এসে পড়ে বিধায় একটু ইস্ত্রি করে বলেছে। ইলমী পরিভাষা ব্যবহার করেছে। যেন মনে করা হয় যে, তিনি কুরআন সুন্নাহর দলীলমাফিক কথাটা বলেছেন। নিজেকে বাঁচিয়ে চলার এটা একটা পলিসি।
জিহাদিরা কোথায় জীবন দিচ্ছে তা তো পরিষ্কার। আল্লাহর প্রেরিত শত সহস্র নবী রাসূল এবং তাদের অনুসারিরা যেসব তাগুতের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে গেছেন, বিশ্ব নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবায়ে কেরাম যে পথে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন আমরা সে পথেই জীবন দিচ্ছি। যত্রতত্র দিচ্ছি না। এখানে আপত্তির তো কিছুই ছিল না। কিন্তু যাদের নজরিয়া ও ফিকির কুরআন সুন্নাহ থেকে ভিন্ন মোড় ধরেছে তাদের কাছে জিহাদ মানেই নাজায়েয একটা কিছু।
চব্বিশ. জিহাদ করে লাভ নেই। শেষে মুজাহিদরা নিজেরাই মারামারিতে লেগে যায়। রাশিয়ার পতনের পর আফগান মুজাহিদরা নিজেরা মারামারি করেছে।
উত্তর: মারামারি বনি আদমের তবিয়ত। আদম আলাইহিস সালামকে দেখে ফেরেশতারা আঁচ করতে পেরেছিল যে, এরা দুনিয়াতে গিয়ে মারামারি করবে। এজন্যই বলেছিল, ‘আপনি কি এমন কাউকে প্রতিনিধি করে পাঠাবেন যারা সেখানে গিয়ে ফিতনা ফাসাদ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে’? যেহেতু মারামারি বনি আদমের তবিয়ত তাই একে নির্মূল করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মারামারি চলে আসছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত চলবে।
দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলার অমোঘ ফায়াসালা, এ উম্মত নিজেরা মারামারি করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেছিলেন যেন উম্মত নিজেরা মারামারি না করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, হে নবি, আপনার উম্মত মারামারি করবে এটাই আমার ফায়াসালা। আমি আপনার এ আবেদন মঞ্জুর করছি না।
যখন বনি আদমের তবিয়ত মারামারি এবং আল্লাহ তাআলার অমোঘ ফায়সালা যে এ উম্মত মারামারি করবে তখন মারামারি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে আমার দায়িত্ব হল, হকের পক্ষে মারামারি করা। মারামারির ভয়ে হকের পক্ষ ত্যাগ করার অর্থ রিয়া এসে যাওয়ার ভয়ে নামায ছেড়ে দেয়া।
তৃতীয়ত মুজাহিদদের নিজেদের মারামারি আজ নতুন কিছু নয়। এ মারামারি স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। আর তারাই আমাদের আদর্শ। উসমান রাদি.র শাহাদাতকে কেন্দ্র করে হযরত আলী রাদি. এবং মুআবিয়া রাদি.র মাঝে মারামারি হয়েছে। যার পরিণতিতে উভয় পক্ষের মিলে খাইরুল কুরুনের আশি হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছেন। সুদীর্ঘ পাঁচ বছর এ মারামারি চলেছিল।
জুমহুর উলামায়ে কেরামের মত হল আলী রাদি. হকের উপর ছিলেন আর মুআবিয়া রাদি. ভুলের উপর ছিলেন। যদিও ভুলের উপর ছিলেন তথাপি তিনি দুনিয়ার লোভে যুদ্ধ করেননি। যা হক মনে করেছেন তা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন। এজন্য ভুলের উপর থাকার পরও তার সমালোচনা নাজায়েয। যারা তার সমালোচনা করবে তারা আহলুস সুন্নাহ থেকে বহিষ্কৃত।
আলী রাদি. যিনি হকের উপর ছিলেন, তার যে বাহিনি এতদিন মুআবিয়া রাদি.র বিরুদ্ধে *যুদ্ধ করেছে তাদের থেকে বার হাজার খাওয়ারেজ তার বিরুদ্ধে চলে যায়। অবশেষে তিনি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করেন। এমনভাবে নির্মূল করে ছাড়েন যে, এদের দশটা লোকও মুক্তি পায়নি।
তাহলে আমরা এখানে খেলাফতে রাশেদায় মুজাহিদদের দুই শ্রেণীর মারামারি পেলাম,
এক. আলী-মুআবিয়া; যাদের কারও সমালোচনা জায়েয নেই।
দুই. আলী-খাওয়ারেজ। এখানে খাওয়ারেজরা পথভ্রষ্ট গোমরাহ। এদের সমালোচনা জরুরী এবং এদের বিরুদ্ধে কিতাল জরুরী।
যারা মারামারির কারণে জিহাদ বন্ধ করার পক্ষপাতি তাদের বলবো, আপনারা একটু খবর নিয়ে দেখুন যে মুজাহিদদের মারামারিগুলো কোন শ্রেণীর। উপরোক্ত দুই শ্রেণীর কোনো এক শ্রেণীর হয়ে থাকলে আপনি এ অজুহাতে জিহাদ বন্ধ করার কথা বলতে পারবেন না।
আর বাস্তবেই যদি এমন হয় যে, কেবল ক্ষমতার লোভে মুজাহিদরা মারামারি করেছেন তাহলেও এ অজুহাতে আপনি জিহাদ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলতে পারবেন না। কারণ, এ ধরনের মারামারিও আজ নতুন নয়। খায়রুল কুরুন থেকেই তা চলে আসছে। কিন্তু কেউই এ কারণে জিহাদ বন্ধ করতে বলেননি। ইসলামের ইতিহাসে উমাইয়া আব্বাসী এবং পরবর্তী মামলুক ও উসমানীসহ আরো যত সুলতান যত মারামারি নিজেরা করেছেন সেগুলোর অনেকগুলোই, বরং বলতে গেলে অধিকাংশই ক্ষমতার জন্য। কিন্তু কোনো আলেম ফতোয়া দেননি যে, এরা ক্ষমতার জন্য মারামারি করে বলে এদের সাথে মিলে জিহাদ করা যাবে না বা এরা যে জিহাদ করে তা বন্ধ করে দিতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে আপনারাই সর্বপ্রথম এ বিদআত আবিষ্কার করলেন।
বরং আহলুস সুন্নাহর মুত্তাফাক আলাইহি আকিদা হলো, সুলতান জালেম হলেও, ক্ষমতালোভী হলেও যতদিন তিনি ইসলামের পক্ষে জিহাদ করে যাবেন সকলে তার সাথে মিলে জিহাদ করে যাবে। এটা আহলুস সুন্নাহর সর্বসম্মত আকিদা। তার জুলুমে তাকে সহায়তা করা যাবে না, কিন্তু তিনি যখন জিহাদ করেন তখন পিছিয়ে থাকা যাবে না। যারা পিছিয়ে থাকবে তারা হয়তো মুনাফিক নয়তো বিদআতি বা স্বল্পজ্ঞানী। আকিদার প্রত্যেকটি কিতাবে এ মাসআলা পরিষ্কার লিখা আছে।
অতএব, *মুজাহিদরা যদি নিজেরা মারামারি করে তাহলে দেখতে হবে কোন দল হক আর কোন দল বাতিল। বাতিলের বিপক্ষে হকের পক্ষ নিতে হবে। আর যদি উভয় দলই বাতিল হয় তাহলে এ মারামারিতে কোনো দলের পক্ষ নেয়া যাবে না। তবে তারা যখন কাফের মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন তখন সকলে এক হয়ে জিহাদ করতে হবে। এখানে যারা পিছিয়ে থাকবে তারা বিদআতি। এটিই আহলুস সুন্নাহর আকিদা। এটিই কুরআন সুন্নাহর নির্দেশ। খেলাফতে রাশেদার পর ইসলামের অধিকাংশ জিহাদ এভাবেই হয়েছে। কাজেই মারামারির অজুহাতে যারা জিহাদ বন্ধ করে দিতে চায় তাদের মতলব খারাপ নয়তো স্বল্পজ্ঞানী।
আর আফগান মুজাহিদদের মারামারির কথা যেটা বলেছেন সেটাও আপনার বদ মতলব বা অন্তত আপনার স্বল্পজ্ঞানের পরিচায়ক। রাশিয়া চলে যাওয়ার পর তালেবানরা ঐসব মুনাফিক ও মুরতাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল যারা এতদিন নিজেদের নিফাক গোপন রেখেছিল। যারা ইসলাম ছেড়ে রাশিয়া ও আমেরিকার সাথে আঁতাত করে কুফরি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তালেবানরা এদের সাথে লড়াই করেছিল। এটা মূলত ঈমান কুফরের লড়াই ছিল। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আবু বকর রাদি. মুরতাদদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এ কারণে তৎকালীন হক্কানী উলামায়ে কেরাম তালেবানদের পক্ষ নিয়েছিলেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ...)
Comment