খেলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ থাকার হুকুম
الحمد لله والصلاة والسلام علي رسول الله.
অভিভাবকহীন মুসলিম উম্মাহকে যখন কাফের-মুশরিকরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, যখন তারা ওলী(অভিভাবক), নাসীর(সাহায্যকারী) এর জন্য রবের দরবারে বারবার ফরিয়াদ করছে, যখন তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে উম্মাহর মুষ্টিমেয় কিছু লোক নিজেদের সবটুকু কোরবান করে জামাতবদ্ধ হচ্ছে, জিহাদ ও নুসরাতের মাধ্যমে পুনরায় হারানো খিলাফত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনি কিছু ভাই বুঝে, না বুঝে জামাতবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অথচ দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা ও হুকুম কি তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার পায়দা কি তা কাফেররাও ভাল জানে। কিন্তু কিছু ভাই হয়ত বিষয়টি দালিলিকভাবে বুঝতে চান। সে সকল ভাইদের খেদমতে এই ছোট আর্টিকেল। আাশাকরি এর মাধ্যমে আমরা বুঝাতে সক্ষম হব 'দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা' কতটুকু। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।
দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়ার হুকুম কি-- বিষয়টি বুঝার জন্য ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পয়েন্ট বুঝতে হবে। নিম্মে তা প্রদত্ত হল।
= খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ।
= খেলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ।
= জামাতবদ্ধ হওয়া ছাড়া খেলাফত কায়েম সম্ভব না। অতএব খিলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজ।
খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ:
এটা জানা কথা যে ইসলামী খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ। এই ব্যপারে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত ঐক্যমত। কোরআন ও হাদীসে এর অসংখ্য দলিল রয়েছে। বিস্তারিত দলিল উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তথাপি নিয়ম রক্ষার্থে কয়েকটা উল্লেখ করা হলঃ
১- আল্লাহ তালা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ (النساء:59)
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলুল আমর তথা উমারাদের।
২- এক হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« من فارق الجماعة شبرا فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه »
“যে ব্যক্তি জামাত থেকে এক বিঘতও সরে গেল, যেন সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জু খোলে ফেলল।” (আবু দাউদ: ৪৭৬০)
৩- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
قال رسول الله صلي الله عليه وسلمَ:َأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ: السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْجِهَادُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجَمَاعَةُ
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যার নির্দেশ আল্লাহ তা'লা আমাকে দিয়েছেন। তাহল শ্রবণ, আনুগত্য, জিহাদ, হিজরত ও জামাতবদ্ধ থাকা।
৪- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ
من مات وهو مفارق للجماعة فانه يموت ميتة جاهلية.
যে ব্যক্তি জামাআ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসনাদে আহমাদ)
এসকল নূসূস সহ আরো অসংখ্য দলিল প্রমাণ দ্বারা একথাই প্রমানিত যে মুসলিম জামাআ তথা ইসলামী খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ৷ যা পুরো উম্মতের ঐক্যমত৷
উল্লেখ্য, এখানে জামাআ বলতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত জামাআ উদ্দেশ্য।
খিলাফত না থাকলে খিলাফত কায়েম করা ফরজঃ
একথাও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমতে প্রতিষ্ঠিত যে খিলাফত না থাকলে খিলাফত কায়েম করা ফরজ। যা আকলী ও নকলী উভয় দলিল দারা প্রমানিত। আমরা বুঝার জন্য কয়েকটা উল্লেখ করব শুধু।
১- আল্লাহ তা'লা বলেনঃ
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ (سورة الشورى: 13)
তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।
২- সাহাবায়ে কেরামের ইজমা। কেননা সকল সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাপনের উপর খিলাফত কায়েম করাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
৩- খলিফার আনুগত্য করা কোরআন সুন্নাহ দ্বারা ফরজ প্রমনিত। যা খলিফা থাকাকে আবস্যক করে। যদি খলিফাই না থাকে তাহলে কার আনুগত্য করবে!!! আর উসূল হল
ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب
আবস্যকীয় বিষয়ের জন্য যা জরুরি তাও আবস্যক। অতএব খলিফা না থাকলে কায়েম করে নেওয়া আবস্যক।
৪- হুদুদ কায়েম করা, সীমান্ত পাহারা দেওয়া, ইকাদামী জিহাদ পরিচালনা করা এগুলো ফরজ৷ আর এগুলোর কোনটাই খিলাফাত না থাকলে সম্ভব না। অতএব এসব ফরজ আদায়ের জন্য খিলাফত কয়েম করা ফরজ।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় একথাই প্রমানিত হয়েছে যে খিলাফাত না থাকলে খিলাফাত কায়েম করা ফরজ৷ এবার আসি তৃতীয় পয়েন্ট এ।
খিলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজঃ
যখন প্রমাণিত হল খিলাফত এর আনুগত্য করা ফরজ। এও প্রমানিত হল যে খিলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ। আর আমরা পূর্বে জেনেছি জামাতবদ্ধ হওয়া ছাড়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা বা দ্বীন কায়েম সম্ভব না। তাই দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়াও ফরজ। এই বিষয়েও অনেক প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অনেক দলিল আছে। আমরা তার কয়েকটি উল্লেখ করছি, আশাকরি তা পাঠকের বুঝার জন্য যথেষ্ট হবে।
১- সূরা শু'রার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তালা বলেন
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ (سورة الشورى: 13)
তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।
লক্ষকরুন এখানে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দিয়েই সাথে সাথে আল্লাহ তা'লা বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন৷ যা থেকে স্পষ্ট যে দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক।
২- আল্লাহ তা'লা বলেনঃ
قوله تعالى: «وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعاً وَلاَ تَفَرَّقُواْ» (سورة آل عمران: 103)
অর্থ - তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর। আর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।
এখানে حبل الله দ্বারা কি উদ্দেশ্য তা নিয়ে কয়েকটি মত আছে৷ প্রসিদ্ধ মত হল حبل الله বলতে কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। আর হযরত আব্বাস রাঃ বলেন এখানে حبل الله মানে জামাআ।
পরের অংশে আছে "তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়োনা"। এর ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহঃ বলেন امرهم بالجماعة ونهاهم عن الفرقة
অর্থাৎ তাদেরকে জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করা হয়েছে। এই আয়াতেও একেবারে সুস্পষ্ট যে জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক। আর যদি সেটা দ্বীন কায়েমের জন্য হয় তাহলেতো আরো গুরুত্বের দাবি রাখে।
৩- আল্লাহ তা'লা আরো বলেনঃ
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ] (آل عمران:105)
তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা বিচ্ছেদ তৈরি করে এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট দলিল আসার পরেও মতানৈক্য তৈরি করে৷ আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (আলে ইমরান-১০৫)
৪- রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إن الله يرضى لكم ثلاثاً ويكره لكم ثلاثاً فيرضى لكم: أن تعبدوه، ولا تشركوا به شيئا، وأن تعتصموا بحبل الله جميعاً ولا تفرقوا، ويكره لكم: قيل وقال، وكثرة السؤال، وإضاعة المال. (الترمزي)
আল্লাহ তালা তোমাদের জন্য ৩ টি বিষয় পছন্দ করেন এবং ৩ টি বিষয় অপছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন তোমরা তারই এবাদাত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে থাকবে ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবেনা। তিনি তোমাদের জন্য অপছন্দ করেন অনর্থক কথ বলা, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা।
৫- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ
قوله صلى الله عليه وسلم «عليكم بالجماعة وإياكم والفرقة، فإن الشيطان مع الواحد، وهو من الاثنين أبعد، من أراد بحبوحة الجنة فيلزم الجماعة»، (سنن الترمذي: 4 / 465.).
তোমরা জামাতবদ্ধ হয়ে থাক, বিচ্ছিন্ন হয়োনা, কেননা শয়তান একাকি ব্যক্তির সাথে থাকে। সে দুই জন লোক থেকে অনেক দূরে থাকে। যে জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে থাকতে চায় সে যেন জামাআতকে আঁকড়ে ধরে। (তিরমিযী)
৬- হযরত ওমর রাঃ বলেন;
لا اسلام الا بجماعة ولاجماعة الا بامارة ولا امارة الا بطاعة
জামাআ ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব নেই, আবার নেতৃত্ব ছাড়া জামাআ টিকে না, আর আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব টিকে না।
অর্থাৎ খেলাফা কায়েমের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আনুগত্যশীল সঠিক নেতৃত্ব আবস্যক৷
৭- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ
اذا كان ثلاثة في سفر فليؤمروا احدهم. (ابو داود)
যখন তিনজন ব্যক্তি সফরে থাকবে, তখন তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়৷ (আবু দাউদ)
প্রায় কাছাকাছি আরেকটা হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
لا يحل لثلاثة نفر يكونون بفلاة من الارض
الا امروا عليهم احدهم.
তিনজন ব্যক্তি নির্জন প্রান্তরে থাকলেও তাদের জন্য একজনে আমীর না বানিয়ে থাকা বৈধ নয়।
শরীয়তের একটা উসূল হলঃ
تنبيه الاعلي بالادني
তথা ছোট বিষয়ের মাধ্যমে বড় বিষয়ে সতর্ক করা। দেখুন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের মত সাধারণ বিষয়েও আমীর না বানিয়ে থাকার অনুমতি দেননি, জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তাহলে দ্বীন কায়েমের মত এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শরীয়তের হুকুম কেমন হবে তা সহজে অনুমেয়।
৮- জামাআ খেলাফের কায়েম মাকাম বা প্রতিনিধিঃ
ইসলামের আরেকটি বিধান হল যখন কোন কারণে খেলাফত বা খলিফা থাকবে না, তখন অটোমেটিক জামাআ খেলাফতের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবে৷ খেলাফতের সকল কাজ যেমন হুদুদ কিসাস কায়েম করা, জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি সবকিছু জামাআ আদায় করা আবস্যক হয়ে যাবে৷ তবুও ঐক্যহীন, বিচ্ছিন্ন থাকার অনুমতি ইসলামে নেই। তাতারিরা খেলাফত ধ্বংস করার পর ২ বছরের মত জামাআ ই খেলাফতের দায়ীত্ব পালন করেছে, পরে পুনরায় খেলাফত কায়েম করেছে।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এটাই প্রমানিত হয়েছে দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক।
সারকথা হলঃ
= খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ।
= খেলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ।
= খেলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজ।
الحمد لله والصلاة والسلام علي رسول الله.
অভিভাবকহীন মুসলিম উম্মাহকে যখন কাফের-মুশরিকরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, যখন তারা ওলী(অভিভাবক), নাসীর(সাহায্যকারী) এর জন্য রবের দরবারে বারবার ফরিয়াদ করছে, যখন তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে উম্মাহর মুষ্টিমেয় কিছু লোক নিজেদের সবটুকু কোরবান করে জামাতবদ্ধ হচ্ছে, জিহাদ ও নুসরাতের মাধ্যমে পুনরায় হারানো খিলাফত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনি কিছু ভাই বুঝে, না বুঝে জামাতবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অথচ দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা ও হুকুম কি তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার পায়দা কি তা কাফেররাও ভাল জানে। কিন্তু কিছু ভাই হয়ত বিষয়টি দালিলিকভাবে বুঝতে চান। সে সকল ভাইদের খেদমতে এই ছোট আর্টিকেল। আাশাকরি এর মাধ্যমে আমরা বুঝাতে সক্ষম হব 'দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা' কতটুকু। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।
দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়ার হুকুম কি-- বিষয়টি বুঝার জন্য ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পয়েন্ট বুঝতে হবে। নিম্মে তা প্রদত্ত হল।
= খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ।
= খেলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ।
= জামাতবদ্ধ হওয়া ছাড়া খেলাফত কায়েম সম্ভব না। অতএব খিলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজ।
খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ:
এটা জানা কথা যে ইসলামী খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ। এই ব্যপারে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত ঐক্যমত। কোরআন ও হাদীসে এর অসংখ্য দলিল রয়েছে। বিস্তারিত দলিল উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তথাপি নিয়ম রক্ষার্থে কয়েকটা উল্লেখ করা হলঃ
১- আল্লাহ তালা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ (النساء:59)
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলুল আমর তথা উমারাদের।
২- এক হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« من فارق الجماعة شبرا فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه »
“যে ব্যক্তি জামাত থেকে এক বিঘতও সরে গেল, যেন সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জু খোলে ফেলল।” (আবু দাউদ: ৪৭৬০)
৩- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
قال رسول الله صلي الله عليه وسلمَ:َأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ: السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْجِهَادُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجَمَاعَةُ
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যার নির্দেশ আল্লাহ তা'লা আমাকে দিয়েছেন। তাহল শ্রবণ, আনুগত্য, জিহাদ, হিজরত ও জামাতবদ্ধ থাকা।
৪- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ
من مات وهو مفارق للجماعة فانه يموت ميتة جاهلية.
যে ব্যক্তি জামাআ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসনাদে আহমাদ)
এসকল নূসূস সহ আরো অসংখ্য দলিল প্রমাণ দ্বারা একথাই প্রমানিত যে মুসলিম জামাআ তথা ইসলামী খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ৷ যা পুরো উম্মতের ঐক্যমত৷
উল্লেখ্য, এখানে জামাআ বলতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত জামাআ উদ্দেশ্য।
খিলাফত না থাকলে খিলাফত কায়েম করা ফরজঃ
একথাও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমতে প্রতিষ্ঠিত যে খিলাফত না থাকলে খিলাফত কায়েম করা ফরজ। যা আকলী ও নকলী উভয় দলিল দারা প্রমানিত। আমরা বুঝার জন্য কয়েকটা উল্লেখ করব শুধু।
১- আল্লাহ তা'লা বলেনঃ
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ (سورة الشورى: 13)
তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।
২- সাহাবায়ে কেরামের ইজমা। কেননা সকল সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাপনের উপর খিলাফত কায়েম করাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
৩- খলিফার আনুগত্য করা কোরআন সুন্নাহ দ্বারা ফরজ প্রমনিত। যা খলিফা থাকাকে আবস্যক করে। যদি খলিফাই না থাকে তাহলে কার আনুগত্য করবে!!! আর উসূল হল
ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب
আবস্যকীয় বিষয়ের জন্য যা জরুরি তাও আবস্যক। অতএব খলিফা না থাকলে কায়েম করে নেওয়া আবস্যক।
৪- হুদুদ কায়েম করা, সীমান্ত পাহারা দেওয়া, ইকাদামী জিহাদ পরিচালনা করা এগুলো ফরজ৷ আর এগুলোর কোনটাই খিলাফাত না থাকলে সম্ভব না। অতএব এসব ফরজ আদায়ের জন্য খিলাফত কয়েম করা ফরজ।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় একথাই প্রমানিত হয়েছে যে খিলাফাত না থাকলে খিলাফাত কায়েম করা ফরজ৷ এবার আসি তৃতীয় পয়েন্ট এ।
খিলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজঃ
যখন প্রমাণিত হল খিলাফত এর আনুগত্য করা ফরজ। এও প্রমানিত হল যে খিলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ। আর আমরা পূর্বে জেনেছি জামাতবদ্ধ হওয়া ছাড়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা বা দ্বীন কায়েম সম্ভব না। তাই দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়াও ফরজ। এই বিষয়েও অনেক প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অনেক দলিল আছে। আমরা তার কয়েকটি উল্লেখ করছি, আশাকরি তা পাঠকের বুঝার জন্য যথেষ্ট হবে।
১- সূরা শু'রার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তালা বলেন
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ (سورة الشورى: 13)
তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।
লক্ষকরুন এখানে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দিয়েই সাথে সাথে আল্লাহ তা'লা বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন৷ যা থেকে স্পষ্ট যে দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক।
২- আল্লাহ তা'লা বলেনঃ
قوله تعالى: «وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعاً وَلاَ تَفَرَّقُواْ» (سورة آل عمران: 103)
অর্থ - তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর। আর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।
এখানে حبل الله দ্বারা কি উদ্দেশ্য তা নিয়ে কয়েকটি মত আছে৷ প্রসিদ্ধ মত হল حبل الله বলতে কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। আর হযরত আব্বাস রাঃ বলেন এখানে حبل الله মানে জামাআ।
পরের অংশে আছে "তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়োনা"। এর ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহঃ বলেন امرهم بالجماعة ونهاهم عن الفرقة
অর্থাৎ তাদেরকে জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করা হয়েছে। এই আয়াতেও একেবারে সুস্পষ্ট যে জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক। আর যদি সেটা দ্বীন কায়েমের জন্য হয় তাহলেতো আরো গুরুত্বের দাবি রাখে।
৩- আল্লাহ তা'লা আরো বলেনঃ
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ] (آل عمران:105)
তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা বিচ্ছেদ তৈরি করে এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট দলিল আসার পরেও মতানৈক্য তৈরি করে৷ আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (আলে ইমরান-১০৫)
৪- রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إن الله يرضى لكم ثلاثاً ويكره لكم ثلاثاً فيرضى لكم: أن تعبدوه، ولا تشركوا به شيئا، وأن تعتصموا بحبل الله جميعاً ولا تفرقوا، ويكره لكم: قيل وقال، وكثرة السؤال، وإضاعة المال. (الترمزي)
আল্লাহ তালা তোমাদের জন্য ৩ টি বিষয় পছন্দ করেন এবং ৩ টি বিষয় অপছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন তোমরা তারই এবাদাত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে থাকবে ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবেনা। তিনি তোমাদের জন্য অপছন্দ করেন অনর্থক কথ বলা, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা।
৫- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ
قوله صلى الله عليه وسلم «عليكم بالجماعة وإياكم والفرقة، فإن الشيطان مع الواحد، وهو من الاثنين أبعد، من أراد بحبوحة الجنة فيلزم الجماعة»، (سنن الترمذي: 4 / 465.).
তোমরা জামাতবদ্ধ হয়ে থাক, বিচ্ছিন্ন হয়োনা, কেননা শয়তান একাকি ব্যক্তির সাথে থাকে। সে দুই জন লোক থেকে অনেক দূরে থাকে। যে জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে থাকতে চায় সে যেন জামাআতকে আঁকড়ে ধরে। (তিরমিযী)
৬- হযরত ওমর রাঃ বলেন;
لا اسلام الا بجماعة ولاجماعة الا بامارة ولا امارة الا بطاعة
জামাআ ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব নেই, আবার নেতৃত্ব ছাড়া জামাআ টিকে না, আর আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব টিকে না।
অর্থাৎ খেলাফা কায়েমের জন্য একটি সুশৃঙ্খল আনুগত্যশীল সঠিক নেতৃত্ব আবস্যক৷
৭- রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ
اذا كان ثلاثة في سفر فليؤمروا احدهم. (ابو داود)
যখন তিনজন ব্যক্তি সফরে থাকবে, তখন তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়৷ (আবু দাউদ)
প্রায় কাছাকাছি আরেকটা হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
لا يحل لثلاثة نفر يكونون بفلاة من الارض
الا امروا عليهم احدهم.
তিনজন ব্যক্তি নির্জন প্রান্তরে থাকলেও তাদের জন্য একজনে আমীর না বানিয়ে থাকা বৈধ নয়।
শরীয়তের একটা উসূল হলঃ
تنبيه الاعلي بالادني
তথা ছোট বিষয়ের মাধ্যমে বড় বিষয়ে সতর্ক করা। দেখুন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের মত সাধারণ বিষয়েও আমীর না বানিয়ে থাকার অনুমতি দেননি, জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তাহলে দ্বীন কায়েমের মত এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শরীয়তের হুকুম কেমন হবে তা সহজে অনুমেয়।
৮- জামাআ খেলাফের কায়েম মাকাম বা প্রতিনিধিঃ
ইসলামের আরেকটি বিধান হল যখন কোন কারণে খেলাফত বা খলিফা থাকবে না, তখন অটোমেটিক জামাআ খেলাফতের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবে৷ খেলাফতের সকল কাজ যেমন হুদুদ কিসাস কায়েম করা, জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি সবকিছু জামাআ আদায় করা আবস্যক হয়ে যাবে৷ তবুও ঐক্যহীন, বিচ্ছিন্ন থাকার অনুমতি ইসলামে নেই। তাতারিরা খেলাফত ধ্বংস করার পর ২ বছরের মত জামাআ ই খেলাফতের দায়ীত্ব পালন করেছে, পরে পুনরায় খেলাফত কায়েম করেছে।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এটাই প্রমানিত হয়েছে দ্বীন কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ থাকা আবস্যক।
সারকথা হলঃ
= খেলাফতের আনুগত্য করা ফরজ।
= খেলাফত না থাকলে কায়েম করা ফরজ।
= খেলাফত কায়েমের জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া ফরজ।
اللهم ارنا الحق حقا وارزقنا اتباعا، وارنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابا. وصلي الله تعالي علي خير البرية.
Comment