আমাদের রাষ্ট্র প্রধানদের অবস্থা ও আমাদের করণীয়
শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিযাহুল্লাহ
শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিযাহুল্লাহ
সুলাইমান দারিমি নামে এক বুযুর্গ ছিলেন। তিনি বলতেন, আমি যখন কাউকে কোন কিছু খাওয়াই তখন সেই জিনিসটা সে খাওয়ার সময় আমি নিজে অন্য রকম একটি স্বাদ অনুভব করি। নিজে খেলে সেই স্বাদটা আমি পাই না।
আসলেই যারা উদার তারা নিজেরা কোন কিছু ভোগ করে যতটুকু তৃপ্তি পায়, অন্যকে ভোগ করিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্তি পায়।
কিন্তু আমাদের মন হয়ে গেছে সংকীর্ণ। আমরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। নিজের সুখ ছাড়া আমরা কিছুই বুঝি না।
এ সব উন্নত গুণগুলো থেকে আমরা এখন একদমই বঞ্চিত হয়ে গেছি। বাস্তবতা হচ্ছে, যে কোন গুণ অর্জন করতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে একটু কষ্ট করতে হয়, কুরবানি দিতে হয়, নিজের মধ্যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হয় তবেই আল্লাহ তাআলা মেহেরবানি করে সেই গুণটি বান্দাকে দান করেন। কেউ যখন নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিতে থাকে, অন্যকে ছাড় দিতে থাকে তখন ধীরে ধীরে তা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়।
বর্তমানে আমরা যখন নিজেদের অবস্থার দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই, একদিকে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই উন্নত গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হয়েছি অপর দিকে নিকৃষ্ট সব স্বভাব আমাদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের দিকে লক্ষ্য করুন। একদিকে তারা নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখার জন্য, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নানা ভাবে মুসলমানদের ওপর জুলুম করছে অপরদিকে কাফেরদের সাথে মিলে মুসলিম উম্মাহর একটা দেহকে পঞ্চান্নটার মতো টুকরা করেছে। আহ! গোটা মুসলিম উম্মাহ একটা দেহ ছিল। ওরা একে টুকরা টুকরা করে পঞ্চান্নটা অংশে ভাগ করে ফেলেছ।
এই যে পাকিস্তান-বাংলাদেশ ভাগ হলো, কীজন্য হল এই ভাগ? ওরা চেয়েছে, রাজত্ব আমরা করবো। ক্ষমতা আমাদের হাতে থাকবে। আর এরা চেয়েছে, না, আমরা করবো। সবাই ক্ষমতা চেয়েছ। এক সাথে দু’জন তো আর ক্ষমতা নিতে পারবে না। তাই একটা দেশকে দুইটা বানিয়ে নিয়েছে। দেশ ভাগ হয়েছে তাতে কী হয়েছে? আমার তো লাভ হয়েছে! আমি এখন প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছি! আমার আমলারা এখন মন্ত্রী হতে পেরেছে! ভাগ না হলে তো আমি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম না। আমার আমলারা মন্ত্রী হতে পারত না। ওরা নিজেদের স্বার্থে বিশাল একটা মুসলিম দেশকে দুই ভাগে ভাগ করেছে।
বর্তমানে চারদিকে শুধু জুলুম আর জুলুম চলছে। দেখুন, বর্তমানে একজন বাংলাদেশি মুসলমান সৌদি আরব, কাতার কিংবা ওমানে গিয়ে নিজের মতো করে যে কোন বৈধ কাজ করতে পারে না। করতে চাইলে ওদের গোলাম হয়ে করতে হয়! ওদের কাফালতের অধীনে করতে হয়। কেন এমন হল? আল্লাহর জমিনে বিচরণ করতে কেন ওদের অনুমতি লাগবে? ওদের অনুমতি ছাড়া ওদের দেশে কেউ গেলে সে হয়ে যাবে অবৈধ!
বর্তমানে কোন মুসলমান দেশের সরকারের অনুমতি ছাড়া নিজের বৈধ সম্পদ দিয়ে অন্য দেশ থেকে মালামাল কিনে নিজের দেশে এনে বিক্রি করতে চাইলে সে হয়ে যায় চোরা কারবারী! অথচ তার সম্পদ বৈধ, ব্যবসার পদ্ধতি বৈধ।
বর্তমানে এক মুসলমানের প্রতি আরেক মুসলমানের কোনও মায়া মমতা নেই। অন্য দেশের হলে তো কথাই নেই। দুশমনরা আমাদের আরাকানি মুসলমান ভাই বোনদেরকে পাখির মতো হত্যা করেছে, ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, নিজেদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আর আমরা তাদেরকে সামান্য চাল ডাল দিয়েই ভাবছি, মুসলমান হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব আদায় করে ফেলেছি। অথচ মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আমাদের কাছে তাদের পাওনা কি শুধু এটুকুই ছিল?
আমাদের রাষ্ট্র প্রধানদের অবস্থা
দেখুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খারিজিদের ব্যাপারে বলেছেন :
يقتلون أهل الإسلام ويدعون أهل الأوثان لئن أدركتهم لأقتلنهم قتل عاد
তারা মুসলমানদেরকে হত্যা করবে এবং মুশরিকদেরকে ছেড়ে দেবে। আমি এদেরকে পেলে আ’দ জাতিকে ধ্বংস করার মতো ধ্বংস করতাম।
(সুনানে আবু দাউদ ৪৭৬৪; সুনানে নাসায়ী ৪১১২; হাদীসটি সহীহ)
বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধান, সেনাবাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইত্যাদি নামে যত বাহিনী আছে তাদের কর্মকান্ডগুলো দেখুন, তাদের পরিষ্কার ঘোষণা, আমরা ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে, ইসলামি জঙ্গিদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছি। তাদের ব্যাপারে কোনও কিছু সহ্য করা হবে না! তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে গ্রেফতার করা হবে, জেলে বন্দি করা হবে। প্রয়োজনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করা হবে।
অথচ কোরআনে কারীমে এ নির্দেশ কাফের মুশরেকদের ব্যাপারে দেয়া হয়েছে,
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ
তোমরা মুশরেকদেরকে যেখানে পাও হত্যা করো। সূরা তাওবা (৯) : ৫
কাফের মুশরেকদের ব্যাপারে দেয়া নির্দেশটা ওরা কীভাবে বাস্তবায়ন করছে? তারা মুজাহিদদের গ্রেফতার করছে। গুম করছে। ক্রস ফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা করছে। এ ব্যাপারে কারো কোন আপত্তি নেই। এখানে কোন মানবতাবাদীর চিৎকার শোনা যায় না। ইসলামপন্থীরা যেন জীব জন্তুর পর্যায়েরও না! পশু পাখির মতোও না।
এত হল মুসলমানদের সাথে তাদের আচরণ। অপরদিকে কাফের-মুশরিকদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো। কাফের মুশরেকরা তাদের বন্ধু। সারা পৃথিবীতে কাফেরদের মধ্যে কেউ তাদের শত্রু নেই। তারা গর্বের সাথে বলে বেড়ায়, সবাই আমাদের বন্ধু! আমরা অসাম্প্রদায়িক। আমরা কারো সাথে বিবাদে জড়াতে চাই না। তাদের এসব কথাগুলো কেবল কাফেরদের বেলাই হয়। মুসলমানদের বেলায় তাদের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা নিজেদের স্বার্থে কাফের প্রভুদের সাথে মিলে মুসলিম উম্মাহকে পঞ্চান্নটা টুকরা করে ফেলল, তারপরও বলছে, আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা অসাম্প্রদায়িক নীতি বাস্তবায়ন করছি! অসাম্প্রদায়িক মানে, মুসলিম উম্মাহ পঞ্চান্ন ভাগে বিভক্ত হলে হোক, কাফেরদের সাথে তো আমরা মিলে আছি! কাফেরদেরকে আমরা ভিন্ন সম্প্রদায় মনে করি না- এই হিসেবেই আমরা অসাম্প্রদায়িক!! চিন্তা করে দেখুন, কী ভয়ংকর মানসিকতা তাদের!
অথচ কোরআনে কারীমে প্রকৃত মুমিনদের ব্যাপারে বলা হয়েছে,
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
তারা মু’মিনদের ব্যাপারে হবে সহনশীল আর কাফেরদের ব্যাপারে হবে কঠোর।
সূরা মায়িদা (৫) : ৫৪
মুমিনদের প্রতি সহনশীল হওয়ার গুণটি যাদের মধ্যে যতবেশি হবে, কাফেরদের প্রতি কঠোরতার পরিমাণও তাদের মধ্যে তত বেশি হবে। তারা মুমিনদের প্রতি এ কারণেই সহনশীল, যেহেতু তারা আল্লাহর অনুগত বান্দা। আল্লাহর সাথে তাদের ঈমান ও আনুগত্যের সম্পর্ক আছে।
মনে রাখবেন, যার অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা যে পরিমাণ থাকবে আল্লাহর ভালোবাসার পাত্রদের প্রতিও তার অন্তরে সে পরিমাণ ভালোবাসাই থাকবে।
কারো অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা কী পরিমাণ আছে তা বুঝার উপায় হল, মুসলমানদের প্রতি তার অন্তরে কী পরিমাণ ভালোবাসা আছে আর কাফেরদের প্রতি তার অন্তরে কী পরিমাণ ঘৃণা আছে, কী পরিমাণ বিদ্বেষ আছে? এ সব দেখেই বুঝা যাবে, কে আল্লাহকে কতটুকু ভালোবাসে?
এ ক্ষেত্রে মূলনীতিটা মনে রাখবেন, এটি বলেই এখনকার মতো কথা শেষ করছি, আল্লাহর বন্ধুদের সাথে যার ঘনিষ্টতা যত বেশি আল্লাহর সাথেও তার ঘনিষ্টতা তত বেশি। এর বিপরীত, যে আল্লাহর শত্রুদের কাছে যে পরিমাণ প্রিয়পাত্র, আল্লাহর কাছে সে ঠিক সেই পরিমাণ ঘৃণার পাত্র। যে তাদের যত কাছের সে আল্লাহ থেকে ঠিক সেই পরিমাণ দূরের। আজ কথা এখানেই শেষ করছি। যে কথাগুলো বলা হল আল্লাহ
তা’য়ালা আমাদের সবাইকে এর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين
وآخردعوانا ان الحمد لله رب العالمين
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين
وآخردعوانا ان الحمد لله رب العالمين
Comment