Announcement

Collapse
No announcement yet.

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষ&#

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষ&#


    মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন

    মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক






    ভূমিকা

    সম্প্রতি আমাদের দেশে কিছু বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে, একদিকে তারা সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু এবং একই দিনে ঈদ ও কুরবানীর বিষয়ে সোচ্চার-তারা একে মনে করেন শরীয়তের ফরজ এবং উম্মাহর একতার অপরিহার্য অনুষঙ্গ- অন্যদিকে তারাই নিজেদের রোযা শুরু করেন স্বদেশবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ঈদও পালন করেন বিচ্ছিন্ন হয়েই। যেন কল্পিত ঐক্যের নামে বাস্তব অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা!

    তাদের কেউ কেউ তো এতই সোচ্চার যে, যথানিয়মে ‘আলিম’ না হয়েও এ বিষয়ে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রস্ত্তত করে ফেলেছেন, তাদের কেউ মেজর, কেউ কেউ ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার আর কেউ হাফেয ইত্যাদি পদবীর অধিকারী।

    দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্ধুরা আমার কাছে ঐসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পাঠাতে থাকেন এবং সেগুলোর পর্যালোচনারও অনুরোধ করেন। মাসিক আলকাউসারের প্রকাশনা আরম্ভ হওয়ার পর থেকে আলকাউসারে এ বিষয়ে লেখার অব্যাহত অনুরোধ রয়েছে। এরপরও বিভিন্ন কারণে বিষয়টি স্থগিত রেখেছিলাম। প্রায় এক বছর আগে আমার এক মুরবিব আমাকে এ বিষয়ে লিখতে বলেছেন, যাঁর আদেশ পালন আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। এদিকে গত বছর, ১৪৩৩ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে, ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’ মক্কা মুকাররমা এ বিষয়ে ‘আলমাজমাউল ফিকহী’-এর একটি অধিবেশন আহবান করেছিল, যাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা পাঠকের সামনে উপস্থিত করা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এসব কারণে আল্লাহর উপর ভরসা করে এ প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা একে উপকারী বানান এবং কবুল ও মকবুল করুন। আমীন।

    এরা আসলে কী বলেন

    একই দিনে রোযা শুরু করা এবং একই দিনে ঈদ করার বিষয়টি আমি বলি না, শরীয়তের দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব বা না-জায়েয। বরং পুরা বিশ্বজুড়ে না হলেও বাস্তবতার নিরিখে যতটুকু এলাকা নিয়ে একই তারিখে রোযা শুরু করা ও ঈদ করা যায়- যদি তা শরীয়তের বিধানগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে নির্ধারিত দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে কিছুসংখ্যক আহলে ইলমের মতে তা জায়েয। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত এবং কতটুকু উপকারী হবে আর তা কতখানি বিশৃঙ্খলামুক্ত হবে সেটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে সামনে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

    কিন্তু আমাদের ঐ গবেষক বন্ধুদের বক্তব্য অন্য কিছু। তারা বলতে চান, সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা এবং একই দিনে ঈদ করা ফরয। অন্যথায়-তাদের মতে- এক দুটি ফরয রোযা ছুটে যাবে, যার কারণে ষাটটি করে রোযা কাফফারা হিসেবে আসবে। কিংবা ঈদের দিন রোযা রাখা হবে, যা হারাম। তদ্রূপ আশুরার রোযা, আরাফার রোযা, কুরবানী সব ভুল হবে। শবে কদর, শবে বরাত ইত্যাদি সব কিছু ভেস্তে যাবে। সবশেষে এ কারণে উম্মাহর ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হবে। তাদের মতে একইদিনে ঈদ করা ছাড়া উম্মাহর ঐক্যের কোনো উপায় নেই।

    তাদের দাবি এই যে, প্রত্যেক অঞ্চলে আলাদা আলাদা হেলাল কমিটি হওয়া এবং প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসী নিজেদের চাঁদ দেখা অনুসারে রমযান ও ঈদের ফয়সালা করা জায়েয নয়। মুসলিম জাহানে যেখানেই এটা হচ্ছে ভুল ও নাজায়েয হচ্ছে। তাই এই গবেষক বন্ধুরা নিজ দেশে আলিম-ওলামা ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরবের চাঁদ দেখার ফয়সালা অনুসারে বা নিজেদের হিসাব অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণ করে রোযা শুরু করেন ও ঈদ করেন। এরপর কোথায় এরা নিজেদের এই বিচ্ছিন্নতার জন্য সংকুচিত হবেন, উল্টো উলামা-মাশায়েখ ও তাঁদের অনুসারীদের উপরই হারামে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন!

    এরা যা বলতে চান, আমার জানা মতে, দুনিয়ার কোনো দায়িত্বশীল বিজ্ঞ আলিম তা বলেননি। আর না শরীয়তের নীতি ও বিধানের বিষয়ে অবগত কেউ তা বলতে পারেন।

    একই দিনে ঈদ ঐক্যের জন্য?

    ঐ বন্ধুরা আরো বলেন, ঈদ একই দিনে না হওয়ার কারণে ঈদ ও রোযার বিষয়ে মুসলমানদের মাঝে ইখতিলাফ দেখা দেয়; একই দিন কেউ রোযাদার, কেউ ঈদ উদযাপনরত; বরং অমুসলিম দেশগুলোতে কখনো কখনো একই শহরের মুসলমানদের মাঝে ঈদ উদযাপনে তিন দিনের পার্থক্যও হয়ে যায়। রোযা ও ঈদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে এ ধরনের ইখতিলাফ কোনো অবস্থাতেই বরদাশত করা যায় না। একই দিনে রোযা ও এসকসাথে ঈদ ছাড়া এই ইখতিলাফ দূর হওয়া অসম্ভব।

    তারা আরও বলেন, এই ইখতিলাফ এজন্যও দূর করা প্রয়োজন যে, এর দ্বারা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয়, পরস্পর ঝগড়া-বিবাদের দরজা খোলে। কখনো কখনো একদল অন্যদলের নিন্দা-সমালোচনায় লিপ্ত হয়, কটাক্ষ-কটূক্তি পর্যন্ত করতে থাকে। এসব বিষয় দ্বারা মুসলমানদের ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় রোযা ও ঈদ একই দিনে করা।

    ঐ সকল বন্ধু (বা তাদের অনেকেই) এ কথাও জোরেশোরে বলেন যে, অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকেরা সারা বিশ্বে নিজেদের উৎসব একই দিনে উদযাপন করেন। কাজেই আমাদেরও কর্তব্য সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ করা।

    যারা গোটা দুনিয়ায় একই দিন ঈদ পালনকে ফরয মনে করেন তাদের কেউ কেউ ‘ইখতিলাফুল মাতালি’ (উদয়স্থলের বিভিন্নতা) বিবেচ্য হওয়া, না হওয়ার মুখতালাফ ফীহ (মতভেদপূর্ণ) মাসআলাটি সঠিকভাবে না বোঝার কারণে এমনটা বলেন, তবে তাদের অধিকাংশের নিকটে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার সবচেয়ে বড় ‘দলীল’ দুটি :

    ১. ঈদ উদযাপনে ইখতিলাফ ও পরস্পর বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা যাতে দূর হয়।

    ২. মুসলমানের ঈদ অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উৎসবের মতো হয়।

    ইসলামী ঈদ তথাকথিত ‘উৎসব’ নয়

    প্রথমে তাদের দ্বিতীয় দলীল সম্পর্কে চিন্তা করুন। ইলমে ওহীর আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জানা আছে যে, ইসলামী ঈদ তার স্বরূপ ও মর্যাদা এবং প্রকৃতি ও পদ্ধতি সকল বিষয়ে অন্যান্য জাতির পর্ব-উৎসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের সংস্কৃতি হলো আসসুন্নাতুন নববিয়া, আর তাদের সংস্কৃতি তাদের নিজেদের বা তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্ভাবিত। দুই সংস্কৃতি মূলেই আলাদা। আমাদেরকে তো দুই ঈদ দেয়াই হয়েছে অন্যদের থেকে আলাদা করার জন্য। হাদীসে আছে-

    عن أنس قال : قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة، ولهم يومان يلعبون فيهما، فقال : ما هذان اليومان؟ قالوا : كنا نلعب فيهما في الجاهلية، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن الله قد أبدلكم خيرا منهما : يوم الأضحى ويوم الفطر.

    অর্থ : আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এলেন। সে সময় মদীনার অধিবাসীর দুটি (উৎসবের) দিন ছিল, যাতে তারা আনন্দ-ফূর্তি করত। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ দু’টি দিবস কীসের? তারা বললেন, জাহেলি যুগে আমরা এ দুটি দিনে আনন্দ-ফূর্তি করতাম। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এ দুটি দিনের পরিবর্তে তোমাদেরকে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। সে দিন দুটি হল : ‘ইয়াওমুল আযহা’ ও ‘ইয়াওমুল ফিতর’ (অর্থাৎ ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দুই দিন)।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১১৩৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২০০৬)

    সুতরাং আমাদের ঈদ শুধু ব্যবস্থাপনাগত কোনো বিষয় নয়, যাকে শুধু যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগক্ষেত্র বানিয়ে ফেলা যায়। আর না অন্যান্য জাতির উৎসবের মতো মনগড়া কোনো সংস্কৃতির অংশ, যাতে আনুষ্ঠানিকতা ও বাহ্যিক সাজ-সজ্জাই মূল; বরং এটি একটি খালিস দ্বীনী আমল, যা ইসলামী ইবাদতের অংশ।

    এ কারণে একই দিনে ঈদ উদযাপনের বিষয়টিকেও অন্য সকল বিষয়ের মতো শরীয়তের সূত্র ও দলীলের ভিত্তিতেই সমাধান করতে হবে। দেখতে হবে, পূর্বসূরীদের কর্মপন্থায় কী নির্দেশনা পাওয়া যায়, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উসওয়ায়ে হাসানা এর উপর কী আলোকপাত করে। এখানে অন্যান্য জাতির প্রসঙ্গ তোলাই প্রমাণ করে, ঐ ব্যক্তি না দ্বীনের রুচি-প্রকৃতি গ্রহণ করেছে। আর না সে এ সম্পর্কে অবগত। আসলে অনেক বন্ধুরই-দ্বীনের বিষয়ে প্রজ্ঞাহীনতা ও দ্বীনী পরিবেশ থেকে দূরে থাকার কারণে-ইসলামের শিক্ষা ও বিধানে সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তি অনেক কম। এ কারণে তারা হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে যান এবং নিজেদের মূল্য ও মর্যাদা অন্যান্য জাতির সাদৃশ্য গ্রহণের মাঝেই নিহিত মনে করেন। এটি ইসলামের সৌন্দর্য সম্পর্কে উপলব্ধিহীনতার অনিবার্য ফল।

    মোটকথা, শরীয়তের নীতিমালা ও উসওয়ায়ে হাসানার আলোকে একই দিনে ঈদের যে অবস্থান নির্ধারিত হয়, সেটাই তার প্রকৃত অবস্থান, যার সংক্ষিপ্ত আলোচনা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য জাতির সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ মোটেই বিবেচ্য নয়।

    বিবাদ ও বিভেদ থেকে দূরে থাকাই একতা

    এবার প্রথম দলীল সম্পর্কে চিন্তা করুন। এতে দুটি কথা বলা হয়েছে :

    ক. ইখতিলাফ দূর করার জন্য একই দিনে ঈদ হতে হবে এবং একই দিনে রোযা শুরু হতে হবে।

    খ. রোযা ও ঈদের বিষয়ে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ দূর করার জন্যই এমনটা করতে হবে।

    এই বন্ধুরা মূলত ইখতিলাফ (বিভিন্নতা) ও ইফতিরাক (বিভেদ) কে এক করে ফেলেছেন। অথচ ইফতিরাক বা বিভেদ সম্পূর্ণ নিন্দিত, যা পরিহার করা ফরয। কিন্তু এর জন্য শরীয়ত-অনুমোদিত ইখতিলাফ বা বিভিন্নতা বিলুপ্ত করার প্রয়োজন নেই, আর না ইখতিলাফ বা বিভিন্নতা দূর হলেই ইফতিরাক বা বিভেদ দূর হয়। বিভেদের কারণ তো অসংখ্য। শরীয়ত অনুমোদিত ইখতিলাফ তো বিভেদের কারণই নয়। হ্যাঁ, এ ইখতিলাফকে বরদাশত করতে পারার যোগ্যতা না থাকা অবশ্যই ইফতিরাক ও বিভেদের অনেক বড় কারণ। এর চিকিৎসা তো শরীয়তসম্মত ইখতিলাফ নির্মূলের প্রচেষ্টার মাধ্যমে নয়; বরং শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্দেশিত কর্মপন্থায় চর্চা, অনুশীলন ও বিস্তারের মাধ্যমেই হতে পারে।

    শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে শরীয়তসম্মত কর্মপন্থা কী- এ বিষয়ে পাঠকগণ আলকাউসারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’’ শীর্ষক প্রবন্ধে পাঠ করেছেন এবং সম্প্রতি যা গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছে। যার সারকথা এই যে, যে সকল মাসআলায় ফিকহ- ফতোয়ার ইমামগণের মাঝে শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে ইখতিলাফ হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের কর্তব্য, নিজেদের আলিমদের শরণাপন্ন হওয়া। অতপর আলিমগণ ঐ মতভেদপূর্ণ মাসআলায় যে মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন সে অনুযায়ী আমল করা। এ অবস্থায় অন্য মত অনুসারে আমলকারীদের এদের উপর আপত্তি বা সমালোচনা কিংবা এ কথা বলার অধিকার থাকবে না যে, তোমাদের আমল ও ইবাদত বাতিল বা ভুল। বরং প্রত্যেক দল ধৈর্য্য ও সহনশলীতার পরিচয় দেবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ আলিমের ফতোয়া অনুসারে আমল করলেও অন্যদের আমল সম্পর্কে কটূক্তি বা সমালোচনা করবে না ।

    যদি প্রত্যেক দলের আলিমগণ মানুষকে শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে উপরোক্ত শরয়ী কর্মপন্থা অনুসরণে-যা অনুসরণ প্রত্যেকের জন্য ফরয- উদ্বুদ্ধ করেন এবং প্রত্যেক দ্বীনদার সমঝদার মানুষ এই কর্মপন্থা নিজেও অনুসরণ করেন এবং অন্যদেরও প্রস্ত্তত করেন তাহলে কোনো মতভেদপূর্ণ মাসআলায় মতভেদের কারণে ইনশাআল্লাহ বিভেদ-বিশৃঙ্খলা হবে না। যদি হয় অন্য কোনো কারণে হবে।

    মোটকথা, নিন্দিত ইখতিলাফ তো নিঃসন্দেহে ও বিনা ব্যাখ্যায় বিবাদ-বিসংবাদের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু শরীয়তসম্মত ইখতিলাফ বিবাদ-বিসংবাদ নয়, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতাও নয়। হ্যাঁ, যারা শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রগুলোতে পারস্পরিক আচরণ-উচ্চারণে শরীয়তসম্মত কর্মপন্থা অনুসরণ করেন না তারা শরীয়তসম্মত ইখতিলাফকেও বিবাদ ও বিভেদের কারণ বানিয়ে ফেলেন। এদের উপর ফরয হলো নিজেদের কর্মপন্থা সংশোধন করা।

    আমরা যদি আমাদের কর্মপন্থা সংশোধনের পরিবর্তে শরীয়তসম্মত ইখতিলাফকেই গর্হিত ইখতিলাফে পরিণত করি এবং প্রত্যেক ‘মুখতালাফ ফীহ’ (মতভেদপূর্ণ) বিষয়কে ‘মুজমা আলাইহি’ (সর্বসম্মত ইজমাবিশিষ্ট) এবং ‘মুজতাহাদ ফীহ’ (ইজতিহাদী) বিষয়কে ‘মানসূস’ (কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত) বিষয়ের মর্যাদা দেওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হই তাহলে একেতো শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বৈধই নয়, দ্বিতীয় এটা হবে এক ব্যর্থ চেষ্টা, যার কারণে বিশৃঙ্খলা ও ভেদাভেদ আরো বাড়বে। যেমনটা আমরা দেখি, যারা ‘তাওহীদুল মাযাহিব’-এর (সকল মাযহাবকে এক মাযহাবে পরিণত করার) চেষ্টা করেন তারা কেবল নতুন নতুন অযৌক্তিক মাযহাবই সৃষ্টি করেন।

    তদ্রূপ যারা নামাযের পদ্ধতিগত বিষয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ‘ইখতিলাফে তানাওউ’ ও ‘তাআদ্দুদে সুন্নাহ’ তথা সুন্নাহর বিভিন্নতাকে বাতিল ও অকার্যকর সাব্যস্ত করাকে ভালো কাজ মনে করেন তারা কেবল সমাজে অস্থিরতাই ছড়াচ্ছেন। এ ছাড়া আর কোনো সেবা দানে তারা অক্ষম।

    সারকথা এই যে, রমযান ও দুই ঈদের তারিখের বিষয়ে ইখতিলাফের কারণে যে বিবাদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তার জন্য মূলত ইখতিলাফ দায়ী নয়; বরং ইখতিলাফী (মতভেদপূর্ণ) বিষয়াদিতে শরীয়ত নির্দেশিত আদব ও আচরণবিধি অনুসরণ না করাই দায়ী। এজন্য এ আদব ও আচরণবিধির শিক্ষা ও প্রচার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করাই আসল কাজ। এটা যদি না করা হয় তাহলে শুধু রোযা ও ঈদের তারিখ অভিন্ন হওয়ার দ্বারা অস্থিরতা ও বিবাদ-বিসংবাদ দূর হবে না।

    যেমন যদি মুসল্লীদের মাঝে শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে সবর ও সহনশীলতার মেজাজ তৈরি না হয় তাহলে তারা ঈদ তো করবে-ধরুন-একই দিনে, কিন্তু ঈদের নামাযের তাকবীর-সংখ্যা নিয়ে (ছয় না বারো) ঝগড়া-বিবাদ করতেই থাকবে। তদ্রূপ সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে কি না, গম দ্বারা আদায় করলে আধা সা না এক সা-এসব বিষয়ে বিবাদ করতেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, ঈদ ও সিয়ামের ক্ষেত্রে ‘ঐক্যে’র যে স্থান এই বন্ধুরা দেখছেন তা বাস্তবে যতদূর সম্ভব ততটা কার্যকর করাও জনগণের মাঝে শরীয়তসম্মত মতভেদের ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়, নতুবা এই স্বপ্ন সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্তও বাস্তবরূপ লাভ করতে পারবে না। আগামী আলোচনা থেকে তা পরিষ্কার হবে ইনশআল্লাহ।

    এ কারণে আমাদের বড়রা অন্যান্য মতভেদপূর্ণ ও ইজতিহাদী বিষয়ের মতো রোযার ও ঈদের তারিখ সংক্রান্ত মতভেদের ক্ষেত্রেও শরীয়তসম্মত ইখতিলাফ বরদাশত করে নেওয়ার এবং এর কারণে পরস্পরের একতা ও ভ্রাতৃত্বে ফাটল সৃষ্টি হতে না দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

    এ বিষয়ে তাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মপন্থা সামনে কোথাও উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।

    প্রকৃত ঐক্য কী?

    সুতরাং প্রকৃত ঐক্য এই নয় যে, মুসলমানদের রোযা ও ঈদ একই তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল; বরং প্রকৃত ঐক্য হচ্ছে :

    ১. গোটা উম্মত খালিস তাওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

    ২. গোটা উম্মত আল্লাহর বিধানসমূহ পালন করতে থাকা।

    ৩. গোটা উম্মত সুন্নতে নববীর অনুসরণ ও উসওয়ায়ে হাসানা মোতাবেক জীবন গঠনে সচেষ্ট হওয়া।

    ৪. গোট উম্মত ইজমায়ী বিষয়সমূহে ইজমার উপর অটল অবিচল থাকা এবং ইজতিহাদী ও ইখতিলাফী বিষয়ে নিজের ইমাম, মুফতী বা মুরশিদের নির্দেশিত পন্থায় আমল করা এবং অন্যদের পথ ও পন্থার উপর আপত্তি ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা।

    মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান জালালাবাদীর ভাষায় :

    اپنے مسلك كو چهوڑے نہيں اور دوسرے كے مسلك كو چهيڑے نہيں.

    নিজের পথ ছাড়বে না, অন্যের পথকে ‘ছুঁড়বে না’।

    ৫. গোটা উম্মতের মাঝে প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হওয়া এবং ভালো কাজে সহযোগিতা আর জুলুম ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা পরিহারের প্রেরণা জাগ্রত হওয়া।

    এই উম্মতের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাওহীদ ও ঈমান এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

    রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী-এর ‘আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী’ (রাবেতার ফিকহী বোর্ড)-এর ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ ঈ.-এ গৃহীত সিদ্ধান্তের বাক্যগুলো এই :

    لا حاجة إلى توحيد الأهلة والأعياد في العالم الإسلامي، لأن توحيدها لا يكفل وحدتهم، كما يتوهمه كثير من المقترحين لتوحيد الأهلة والأعياد. وأن تترك قضية إثبات الهلال إلى دور الإفتاء والقضاة في الدول الإسلامية، لأن ذلك أولى وأجدر بالمصلحة الإسلامية العامة، وأن الذي يكفل توحيد الأمة وجمع كلمتها، هو اتفاقهم على العمل بكتاب الله وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم في جميع شؤونهم.

    মুসলিম জাহানে চাঁদ ও ঈদ এক করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তা মুসলিমদের ঐক্য নিশ্চিত করবে না যেমনটা চাঁদ ও ঈদ এক করার অনেক প্রস্তাবকের ধারণা। চাঁদ প্রমাণ হওয়ার বিষয়টি ইসলামী দেশগুলোর কাযা ও ফতোয়া বিভাগগুলোর উপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন। কারণ এটিই ইসলামের, সাধারণ কল্যাণ বিবেচনায় অধিকতর উত্তম ও উপযোগী।

    আর যে বিষয়টি উম্মাহর ঐক্য নিশ্চিত করবে তা হচ্ছে, সকল বিষয়ে আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া।’’ (কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৯)

    রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর ‘আলমাজমাউল ফিকহী’’-এর ঐ অধিবেশনে, যাতে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, পুরো বিশ্বের এবং সকল মাযহাবের বড় বড় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্তে যাঁদের সাক্ষর রয়েছে তাঁদের নাম এই :

    ১. عبد العزيز بن عبد الله بن باز

    (আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ বিন বায)

    ২. محمد علي الحركان (نائب رئيس)

    (মুহাম্মাদ আলী আলহারকান (উপপ্রধান)

    ৩. عبد الله بن محمد بن حميد (رئيس)

    (আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হুমাইদ (প্রধান)

    ৪. مصطفى الزرقاء

    (মুস্তফা আযযারকা)

    ৫. محمد محمود الصواف

    (মুহাম্মাদ মাহমুদ আসসাওয়াফ)

    ৬. محمد بن عبد الله بن سبيل

    (মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সুবাইয়্যিল)

    ৭. صالح بن عثيمين

    (সালেহ ইবনে উছাইমিন)

    ৮. مبروك العوادي

    (মাবরুক আলআওয়াদী)

    ৯. محمد الشاذلي النيفر

    (মুহাম্মাদ আশশাযেলী আননাইফার)

    ১০. عبد القدوس الهاشمي

    (আবদুল কুদ্দুস হাশেমী)

    ১১. محمد رشيدي

    (মুহাম্মাদ রশীদী)

    ১২. أبو الحسن علي الندوي

    (আবুল হাসান আলী নদবী (দস্তখতের সময় উপস্থিত ছিলেন না।)

    ১৩. أبو بكر محمد جومي

    (আবু বকর মুহাম্মাদ জুমী)

    ১৪. حسنين محمد مخلوف

    (হাসানাইন মুহাম্মাদ মাখলূফ)

    ১৫. محمد رشيد قباني

    (মুহাম্মাদ রশীদ কববানী)।

    তো একই দিন রোযা ও ঈদ করার উপর উম্মতের ঐক্য নির্ভরশীল মনে করা বা এ ধারণা করা যে, এছাড়া উম্মাহর ঐক্য ও সম্প্রীতি অর্জিত হতেই পারে না-একটি অপরিণত চিন্তা। না এর কোনো দালীলিক ভিত্তি আছে, না সালাফের জীবনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে। এ তো খুব সহজেই বোধগম্য যে, বিষয়টি যদি শরীয়তের মাকাসিদের অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে সালাফে সালেহীন নিজ নিজ যুগের প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নবী-যুগের পর শত শত বছর পর্যন্ত এর কোনো দৃষ্টান্ত ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

    দারুল খিলাফায় (রাজধানীতে) চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার পর এর সংবাদ দূত মারফত মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে পৌঁছানো যেত। ঈদুল আযহা, আশূরা, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো খুব সহজেই তা সম্ভব হত; ঈদুল ফিতরেও সময়ের পরে হলেও রাজধানীর ঈদ সম্পর্কে অবগত করা যেত, যাতে অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরাও প্রকৃত ২৯ রমযান ও প্রকৃত ১ লা শাওয়াল সম্পর্কে অবগত হয় এবং এক দুইটি রোযা কাযা করতে হলে তা তারা জানতে পারেন। কিন্তু খাইরুল কুরূনে বা পরবর্তী কোনো যুগেও কি মুসলিম আমীরগণ বা উলামা ও ইমামগণ এরূপ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন? এ প্রসঙ্গে নির্ভরোযগ্য একটি উদাহরণও কি পেশ করা যাবে?

    ঐ যুগে কেন তাঁরা শুধু নিজ এলাকায় চাঁদ খুঁজতেন। ২৯ শাবান সকালে কি চারদিকে দূত পাঠানো যেত না? যারা চাঁদ দেখত, (চাঁদের শাহাদাত নিয়ে দ্রুত রওয়ানা হত, কেউ হয়তো ইশার পর, কেউবা সুবহে সাদিকের আগে এসে পৌঁছত। কিন্তু সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্ত অন্যান্য অঞ্চলের চাঁদের সংবাদ তো মিলে যেত। এর কোনো দৃষ্টান্ত কি পাওয়া যায় নবী-যুগে, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে? কিংবা খাইরুল কুরূন বা তারপরে ইসলামী খিলাফতের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে?

    তদ্রূপ ২৯ রমযানেও চারদিকে দূত পাঠানো সম্ভব ছিল কিন্তু তা-ও করা হয়নি। হাদীস-সীরাতে যে দৃষ্টান্ত আছে তা হচ্ছে, ৩০ রমযান সন্ধ্যায় ঘটনাক্রমে একটি কাফেলা সফর থেকে ফিরল এবং চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। তখন রোযা ভাঙ্গার এবং পরের দিন ঈদ কাযা করার আদেশ এল কিন্তু কখনো কি এমন চিন্তা করা হয়েছে যে, কাফেলা এসে কেন আমাদের সংবাদ দিবে, আমরাই কেন আগে চারদিকে দূত পাঠাই না কিংবা আগে থেকেই পত্র লিখে অন্যান্য অঞ্চলের দায়িত্বশীল ও গভর্ণরদের জানিয়ে দেই না যে, যেখানেই চাঁদ দেখা যাবে অবশ্যই যেন চারদিকে দূত পাঠিয়ে এ সংবাদ পৌঁছে দেয়া হয়?

    আপনি হয়তো বলবেন, এটা কষ্টসাধ্য ছিল, কিন্তু শুধু কষ্টের কারণে কি সাহাবা-তাবেয়ীন শরীয়তের কোনো কাম্য বিষয় ত্যাগ করতে পারেন? তারা তো সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্ব পালন করতেন। অতপর অসীয়ত করে যেতেন যে, তোমাদের পক্ষে আরো বেশি করা সম্ভব হলে তাতেও কোনো ত্রুটি করবে না। প্রশ্ন এই যে, সালাফের সীরাতে এই ‘পূণ্যকর্মের’ কোনো দৃষ্টান্ত (ঐ যুগে যতদূর সম্ভব ছিল) কেন পাওয়া যায় না?

    ইতিহাসে নবী-যুগ ও খিলাফত আমলের রাজনৈতিক ফরমানসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে। সেগুলো এক এক করে পাঠ করা হোক এবং একটি ফরমানই বের করে আনা হোক, যাতে দারুল খিলাফা বা হরমে মক্কা বা হরমে মদীনার চাঁদ সাব্যস্ত হওয়ার সংবাদ অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য লেখা হয়েছে। যাতে তারা ঐ চাঁদের ভিত্তিতে যথাসময়ে বা সময়ের পরে তাদের করণীয় সম্পন্ন করতে পারেন।

    আমাদের জানামতে, এরূপ একটি দৃষ্টান্তও নেই। এর বিপরীতে এমন ফরমান পাওয়া যাবে, যাতে খলীফাতুল মুসলিমীন অন্য এলাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীস লিখে পাঠিয়েছেন : ‘মাস (কখনো) ঊনত্রিশে হয় তোমরা চাঁদ না দেখে রোযা ছাড়বে না। তবে যদি চাঁদ ঢাকা পড়ে যায় তাহলে তা (ত্রিশটি) হিসাব করে নাও’।- সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩১৫; সুনানে বায়হাকী ৪/২০৪)

    এর অর্থ এ ছাড়া আর কী হতে পারে যে, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবেন।

    এ কারণে এই মত ও চিন্তা অবশ্যই বর্জণীয় যে, ‘তাওহীদুল আহিল্লাহ’ তথা এক চাঁদভিত্তিক রোযা ও ঈদ করা শরীয়তের মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যাবলির অন্তর্ভুক্ত কিংবা উম্মাহর ঐক্য এ ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে। দৃষ্টিভঙ্গির সংশোধনের পর রোযা ও ঈদ একই দিনে করার বিষয়ে নিছক জযবা ও আবেগের পরিবর্তে দলীল ও বাস্তবতার আলোকে চিন্তা করা উচিত যে, প্রকৃতপক্ষেই এর গুরুত্ব কতটুকু আর তা বাস্তবায়নই বা কত দূর সম্ভব?

    মূল বিভ্রান্তি : ইখতিলাফুল মাতালি’ প্রসঙ্গ

    যারা গোটা দুনিয়ায় একই সাথে রোযা শুরু ও একই দিনে ঈদ করাকে শরীয়তের হুকুম এবং ফরয দরজার হুকুম মনে করেন তাদের অনেকেরই ‘ইখতিলাফে মাতালি’ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

    ‘ইখতিলাফুল মাতালি’ একটি প্রসিদ্ধ শিরোণাম, যার সারকথা এই যে, এটা তো এক অকাট্য ও চোখে দেখা বাস্তবতা যে, গোটা পৃথিবীর জন্য চাঁদের মাতলা (উদয়স্থল) অভিন্ন নয়, বিভিন্ন। অর্থাৎ চাঁদ যখন ‘হেলাল’ আকারে প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় তখন সম্ভব নয় যে, একই রাতে তা গোটা পৃথিবীবাসীর দৃষ্টিগোচর হবে। বরং উদাহরণস্বরূপ, কোথাও ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় দৃষ্টিগোচর হবে, কোথাও ৩০ তারিখ সন্ধ্যায়। তাহলে ‘হিলালে’র (নতুন চাঁদের) ‘ মাতলা’ (উদয়স্থল) বা ‘তুলূ’ (উদয়) এক নয়, বিভিন্ন। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, রোযা শুরু করার ও ঈদ করার ক্ষেত্রে এই বিভিন্নতা বিবেচনা করা হবে কি না। বিবেচনা করার অর্থ হবে, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজ নিজ চাঁদ দেখার উপর আমল করবে। ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ একে لكل أهل بلد رؤيتهم শিরোনামে উল্লেখ করেন অর্থাৎ প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য তাদের চাঁদ দেখাই ধর্তব্য। দূর দরাজের কোনো এলাকা থেকে চাঁদ দেখার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তা গ্রহণ করা জরুরি নয় বা গ্রহণ করা দুরস্ত নয়।

    আর উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে বিবেচনা না করার অর্থ এই যে, দূর দূরান্তের কোনো অঞ্চল থেকেও যদি চাঁদ দেখার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তা গ্রহণ করা যায়, বা গ্রহণ করা জরুরি। একে পরবর্তী ফিকহের কিতাবগুলোতে لا عبرة لاختلاف المطالع শিরোনামে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ বিধানের ক্ষেত্রে উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তারা বাস্তবে উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে অস্বীকার করেন। তাদের উদ্দেশ্য, বিধানের ক্ষেত্রে একে বিবেচেনা করা হয় না।

    ফিকহ ও হাদীসের কিতাবে এ বিষয়টির প্রাচীন শিরোণাম হচ্ছে, ‘এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য দলীল কি না’। পরবর্তীগণ একে ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা বিবেচ্য হওয়া, না হওয়া’ শব্দে উল্লেখ করেছেন। বিষয়ের স্বরূপ ও তাতে মতভেদের ধরন হিসেবে পুরানো শিরোনামটিই অধিক সূক্ষ্ম। যদিও এখন দ্বিতীয় শিরোনাম অধিক প্রসিদ্ধ।

    তো এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের লোকদের জন্য বিবেচ্য কি না এটা তো মতভেদপূর্ণ ও ইজতিহাদ-নির্ভর বিষয়। কোন দিকে রায় বেশি এবং কোন মতটি দলীলের বিচারে অধিক শক্তিশালী এর বাস্তবজ্ঞান তো কম মানুষেরই আছে, তবে এ কথাটি মুখে মুখে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে যে, শাফেয়ী মাযহাব ছাড়া অন্য সকল মাযহাবের সিদ্ধান্ত, কোনো এক স্থানে চাঁদ দেখা গেলে যেখানে যেখানে এর প্রমাণ পৌঁছবে সেখানে ঐ চাঁদ দেখা অনুযায়ী আমল করা ফরয হয়ে যাবে।

    তো অনেকে এই কথাটি নিয়েই ছুটলেন এবং ফতোয়া দিতে লাগলেন যে, সৌদীতে চাঁদ দেখার খবর রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হলে সকল অঞ্চলের মুসলমানের নিজ উদ্যোগেই সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি। তাদের দেশে নির্ভরযোগ্য ও সরকারী কোনো হেলাল কমিটি থাকলেও। এভাবে পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চল থেকে চাঁদ দেখার কোনো সংবাদ প্রচারিত হলে সকল অঞ্চলে সে অনুসারে আমল করা জরুরি। অথচ যে ফকীহগণ বলেছিলেন, এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্যও প্রযোজ্য তাদের কথার অর্থ এই ছিল যে, এলাকার ভিন্নতা চাঁদ দেখার সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না। বাকি এক এলাকারর চাঁদ দেখা অন্য এলাকায় আমলযোগ্য হওয়ার জন্য কী কী শর্ত আছে, এবং তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী-এটা আলাদা প্রসঙ্গ, যা ফিকহের কিতাবে আলাদা শিরোনামে আলোচিত হয়ে থাকে। যার সারকথা হল, ‘তরীকে মূজিব’ দ্বারা চাঁদ দেখা প্রমাণিত হতে হবে। (অর্থাৎ এমন পদ্ধতিতে খবর বা সাক্ষ্যগুলো আসতে হবে যেভাবে এলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য এবং সে অনুযায়ী আমল অপরিহার্য হয়। এরপর তা সংশ্লিষ্ট অথরিটি (শাসক বা তার প্রতিনিধি)-এর পক্ষ হতে কার্যকর হতে হবে। অন্যথায় তা ‘ওয়াজিবুল আমল’ (অবশ্য অনুসরণীয়) হয় না। এটা ঐ আলিমদের নিকটেও, যারা উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে অগ্রাহ্য করেন।

    ‘তরীকে মূজিব’-এর অনুসন্ধান ছেড়ে এবং সংশ্লিষ্ট অথরিটির পক্ষ হতে কার্যকর হওয়ার অপেক্ষা না করেই ‘কোথাও চাঁদ দেখার সংবাদ যে কোনোভাবে প্রচারিত হলেই সে অনুসারে আমল করা ফরয হবে’ এটা ঐ ভাইদের অপরিণত চিন্তা, যার সাথে ঐ সকল ইমাম বা আলিমগণের চিন্তার দূরতম সম্পর্কও নেই; যারা বলেছিলেন, এক এলাকায় চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্যও গ্রহণযোগ্য। তাদের উদ্দেশ্য শুধু এটুকু ছিল যে, অঞ্চলের বিভিন্নতা চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ নয়। তবে সে চাঁদ দেখা অন্য এলাকায় কখন কীভাবে আমলযোগ্য হবে তা এক আলাদা প্রসঙ্গ। এ তো সুস্পষ্ট যে, সেটা শরীয়তসম্মত পন্থায় হতে হবে। এর কোনো নীতি ও বিধান নেই, তা ঐ ইমামরা বলেননি। তো আমরা যদি ঐ ইমামদের মাযহাব অনুসরণ করতে চাই এবং এক এলাকার চাঁদ দেখা অনুসারে অন্য এলাকায় আমল করতে চাই তাহলে আমাদের এ সংক্রান্ত বিধিবিধান এবং সংশ্লিষ্ট নীতি ও ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হবে। (সামনে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে।)

    দ্বিতীয় কথা এই যে, ঐ ইমামগণ যদিও বলেছেন, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলে ‘তরীকে মূজিব’ অনুযায়ী প্রমাণিত হলে সে অনুসারে (যথানিয়মে) আমল করা জরুরি হয়ে পড়ে, কিন্তু তাদের একজনও কি বলেছেন, এক এলাকার চাঁদ দেখার সংবাদ অন্য এলাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রাপ্ত খবর ও সাক্ষ্যগুলো যাচাই করে আন্তর্জাতিকভাবে তা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া ফরয? বলাবাহুল্য, এমন কথা না কোনো ইমাম বলেছেন, না কোনো আলিম; আর না কারো এমন কথা বলার অধিকার আছে। কারণ এ ধরনের ব্যবস্থা ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নত হওয়ার বিষয়ে শরীয়তের কোনো দলীল নেই, প্রথম থেকে ইমামগণের মাঝে যে মতভেদ চলে আসছে তা এই যে, যদি অন্য এলাকা থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ ‘তরীকে মুজিবে’র সূত্রে পাওয়া যায় তবে তা গ্রহণ করা হবে কি না, কিন্তু এ বিষয়ে সকল ইমাম একমত যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখার সংবাদ সংগ্রহ করা কখনো জরুরি নয়। আর শরীয়তের কোনো আদেশ ছাড়া তা জরুরিই বা হয় কীভাবে? হাদীসে এটা তো আছে যে, মদীনার বাইরে থেকে কেউ চাঁদের শাহাদাত দিলে শর্ত পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের জানামতে, এটা তো কোনো হাদীসেই নেই যে, ২৯ শাবানের সন্ধ্যায় বা পরদিন সকালে, তদ্রূপ ২৯ রমযানের সন্ধ্যায় বা পরদিন সকালে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর পরে কোনো খলীফায়ে রাশিদ মদীনার বাইরে দশ/বিশ মাইল দূরেও কাউকে চাঁদ দেখার জন্য বা চাঁদের শাহাদত সংগ্রহ করার জন্য পাঠিয়েছেন। তো যখন বাইরে থেকে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য তলব করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরি নয় তাহলে কীভাবে বলা যায়, সকল অঞ্চলে অবশ্যই এক চাঁদ দেখা অনুসারে আমল হওয়া শরীয়তের অভিপ্রায়?

    যাই হোক, আমি আরজ করছিলাম, এই যে ভেবে নেয়া হয়েছে, যে ইমামগণ উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে গ্রাহ্য করেন না তারা সবাই একথাও বলেন যে, ‘অন্য জায়গার সংবাদ কোনো বিধিবিধান বা কোনো নীতি ব্যবস্থা ছাড়াই গ্রহণ করা হবে’ কিংবা তাঁরা এ কথার প্রবক্তা যে, ‘সর্বত্র একই দিনে রোযা-ঈদ হওয়া জরুরি’ সম্পূর্ণ ভুল। জ্ঞান ও গবেষণার সাথে এসব চিন্তার দূরতম সম্পর্কও নেই।

    এই প্রয়োজনীয় ভূমিকার পর এখন আমরা দেখব, বাস্তবেই কি অধিকাংশ ফকীহের সিদ্ধান্ত এই যে, একই চাঁদ দেখা সকল জায়গার জন্য ‘ওয়াজিবুল আমল’ অবশ্য অনুসরণীয়, না বিষয়টি এর বিপরীত।

    নিজ নিজ এলাকার চাঁদ

    না সকল এলাকার জন্য এক চাঁদ

    প্রথমে জানা জরুরি যে, শরীয়তের মাসাইল দুই প্রকারের : ১. মানসূস আলাইহি ২. মুজতাহাদ ফীহ।

    ‘‘মানসূস আলাইহি’’ বলা হয়, যাতে কুরআন কারীম বা সুন্নতে নববিয়াহ্র কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন ‘নস’ বিদ্যমান থাকে। এ ধরনের মাসাইল ‘কতয়ী’ (অকাট্য ও সংশয়হীন) হয়ে থাকে এবং অবশ্যই তা ‘মুজমা আলাইহি’’ (সর্বসম্মত)ও হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কোনো ইমাম, ফকীহ, বা আলিমের কোনো মতভেদ থাকে না। যদি কেউ জেনে শুনে দ্বিমত করে তবে তিনি আলিমই গণ্য হবেন না; বরং তার সাথে ‘ফাসিক’ বিশেষণ যুক্ত হবে।

    আর ‘‘মুজতাহাদ ফীহ’’ বলা হয়, যাতে হয়তো কোনো নস নেই বা থাকলেও তা হয়তো এমন স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নয়, যাতে একাধিক মর্মের সম্ভাবনা নেই, কিংবা তা প্রামাণিকতার দিক থেকে এমন অকাট্য ও শক্তিশালী নয়, যার ছূবূত ও প্রামাণিকতা হাদীস-বিচারকগণের কাছে সর্বসম্মত। এ ধরনের বিষয়ে ফিকহ-ফতোয়ার ইমামগণ ইজতিহাদের ভিত্তিতে ফয়সালা করেন। এই ফয়সালায় তারা সবাই একমত থাকলে বিষয়টি ‘মুজতাহাদ ফীহ’ (ইজতিহাদী) হওয়া সত্ত্বেও ‘মুজমা আলাইহি’ গণ্য হবে। আর তাদের মাঝে মতানৈক্য হলে বিষয়টি হবে ‘মুজতাহাদ ফীহ’’ এবং ‘মুখতালাফ ফীহ’’।

    ‘‘কোথাও চাঁদ দৃষ্টিগোচর হলে যতদূরের অঞ্চলে তা ‘তরীকে মূজিবে’র দ্বারা প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হবে সংশ্লিষ্ট অথরিটির জন্য এই ‘চাঁদ দেখা’ গ্রহণ করা এবং সে অনুসারে ফয়সালা করা জরুরি কি না’’ এ বিষয়টি কোন্ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত তা দেখতে হবে।

    কেউ কেউ এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, বিষয়টি ‘মানসূস আলাইহি’ এবং মোটামুটি ‘মুজমা আলাইহি’। এক ভাই তো এ পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন যে, শাফেয়ী মাযহাবের একজন আলিম ছাড়া এতে কারো দ্বিমত নেই। সবাই এ বিষয়ে একমত যে, কোথাও চাঁদ দেখা গেলে তা সব জায়গার জন্য ‘ওয়াজিবুল আমল’ তথা অবশ্য অনুসরণীয়।

    অথচ বাস্তবতা এই যে, এ বিষয়টি ‘‘মুজতাহাদ ফীহ’’ হওয়ার পাশাপাশি মুখতালাফ ফীহ-ও বটে। আর এক এলাকার চাঁদ দেখা দূর দূরান্তের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় না হওয়াই ফকীহগণের অনেক বড় জামাআতের সিদ্ধান্ত। হানাফী মাযহাবেরও বড় বড় অনেক ফকীহ এই নীতি গ্রহণ করেছেন। আর শাফেয়ী মাযহাবে তো এটিই ‘মুফতা বিহী’’ (ফতোয়া)। তো প্রসঙ্গটি একটু বিস্তারিত বর্ণনা করা সমীচীন মনে হচ্ছে।

    এ বিষয়টি ‘মুজতাহাদ ফীহ’

    আলোচিত বিষয়টি যে, ‘‘মুজতাহাদ ফীহ’’ তা ইলমে উসূলে ফিকহে পারদর্শী ব্যক্তিদের কাছে স্পষ্ট, এরপরও আরো স্পষ্ট করার জন্য সৌদী আরবের ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’র (সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ) একটি সিদ্ধান্ত বর্ণনা করছি। ১৩ শাবান ১৩৯২ হিজরীর অধিবেশনে দীর্ঘ চিন্তাভাবনা ও আলোচনা-পর্যালোচনার পর ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তার ভূমিকা তাদেরই ভাষায় নিম্নরূপ :

    أولا : اختلاف مطالع الأهلة من الأمور التي علمت بالضرورة حِسّاً وعقلا، ولم يختلف فيها أحد، وإنما وقع الاختلاف بين علماء المسلمين في اعتبار اختلاف المطالع من عدمه.

    ثانيا : مسألة اعتبار اختلاف المطالع من عدمه من المسائل النظرية التي للاجتهاد فيها مجال، والاختلاف فيها وفي أمثالها واقع ممن لهم الشأن في العلم والدين، وهو من الخلاف السائغ الذي يؤجر فيه المصيب أجرين : أجر الاجتهاد وأجر الإصابة، ويؤجر فيه المخطئ أجر الاجتهاد.

    وقد اختلف أهل العلم في هذه المسألة على قولين، فمنهم من رأى اعتبار اختلاف المطالع، ومنهم من لم ير اعتباره، واستدل كل فريق بأدلته من الكتاب والسنة، وربما استدل الفريقان بالنص الواحد، كاشتراكهما في الاستدلال بقوله تعالى : فمن شهد منكم الشهر فليصمه

    وبقوله صلى الله عليه وسلم : صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته.

    وذلك لاختلاف الفهم في النص وسلوك كل منهما طريقا في الاستدلال به.

    (ফয়সালার ভূমিকা)

    ১. নতুন চাঁদের উদয়স্থল বিভিন্ন হওয়া এমন একটি বিষয়, যা সাধারণ বুদ্ধি ও প্রত্যক্ষ দর্শন দ্বারা প্রমাণিত। এতে কারো দ্বিমত নেই। মুসলিম আলিমদের মাঝে যে মতভেদ তা এ বিষয়ে যে, উদয়স্থলের এই বিভিন্নতা (আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে শরীয়তের দৃষ্টিতে) ধর্তব্য কি না।

    ২. উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য কি না, তা ঐ সকল নযরী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যাতে ইজতিহাদের দখল আছে। ইলম ও দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাকামের অধিকারী ব্যক্তিত্বদের মাঝে এ ধরনের বিষয়ে মতভেদ হয়ে থাকে। আর তা শরীয়তসম্মত মতভেদ, যাতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীতের জন্য রয়েছে দুই পুরস্কার : ইজতিহাদের পুরস্কার ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পুরস্কার। আর যিনি বাস্তবে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি তার জন্য রয়েছে ইজতিহাদের পুরস্কার।

    আলোচিত বিষয়ে আহলে ইলমের মাঝে দুই মত রয়েছে : কারো মত এই যে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য, আর কারো মতে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়। প্রত্যেকে দল (প্রত্যেক মতের অধিকারীরা) কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করেন; বরং কখনো তো উভয় মতের অনুসারীরা একই ‘নস’ দ্বারা দলীল দিয়েছেন। যেমন উভয় পক্ষ আল্লাহ তাআলার বাণী -

    فمن شهد منكم الشهر فليصمه

    এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী-

    صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته.

    দ্বারা দলীল দিয়েছেন।

    কারণ এই বাণীগুলোর মর্ম অনুধাবন ও দাবী-প্রমাণের পন্থায় তাঁদের মাঝে মতভেদ হয়েছে।’’

    এই ভূমিকার পর হাইআতু কিবারিল উলামা তাদের ফয়সালা নিম্নোক্ত ভাষায় প্রকাশ করেছেন :

    وعند بحث هذه المسألة في مجلس الهيئة، ونظر الاعتبارات قدرتها الهيئة، ولأن هذا الخلاف في مسألة اعتبار اختلاف المطالع من عدمه ليس له آثار تخشى عواقبها، وقد مضى على ظهور هذا الدين مدة أربعة عشر قرنا لا نعلم منها فترة جرى فيها توحيد الأمة الإسلامية على رؤية واحدة، فإن أعضاء الهيئة يرون بقاء الأمر على ما كان عليه وعدم إثارة هذا الموضوع، وأن يكون لكل دولة إسلامية حق اختيار ما تراه بواسطة علمائها من الرأيين المشار إليهما في المسألة، إذ لكل منهما أدلته ومستنداته.

    ‘‘অর্থাৎ হাইআ’র অধিবেশনে (দলীল-প্রমাণের) পর্যালোচনার পর বিভিন্ন দিক সামনে রেখে এবং এই বিবেচনাতেও যে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হওয়া না হওয়ার বিষয়ে (ইমামগণের মাঝে সৃষ্ট) মতভেদ এমন নয়, যাতে কোনো অশুভ পরিণামের আশঙ্কা আছে। এই দ্বীন প্রকাশিত হওয়ার পর চৌদ্দশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমাদের জানা নেই, এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে কখনো গোটা মুসলিম উম্মাহকে এক চাঁদে ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে।

    এই সকল বিষয় সামনে রেখে ‘হাইআ’র সকল সদস্যের ফয়সালা এই যে, এ বিষয়টি আলোচনায় আনা হবে না; বরং একে নিজ অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হবে এবং প্রত্যেক ইসলামী ভূ-খন্ডের এই অধিকার থাকবে যে, উপরোক্ত দুই মতের যে কোনোটি ইচ্ছা গ্রহণ করবে, নিজ নিজ আলিমের মাধ্যমে। কারণ উভয় মতেরই নিজ নিজ দলীল ও সনদ রয়েছে।’’

    (মাজাল্লাতুল বুহূছিল ইসলামিয়্যাহ, কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, রিয়াদ, সংখ্যা : ২৮, পৃষ্ঠা : ৩২০)

    এই ফয়সালায় শায়খ ইবনে বায রাহ., শায়খ আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ, শায়খ মুহাম্মাদ আমীন আশশানকীতী ও শায়খ আবদুর রাযযাক আফীফীসহ ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’র ঐ সময়ের অন্যান্য সদস্যের দস্তখত বিদ্যমান আছে।

    আপাতত এই সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য, এই দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা যে, আমাদের আলোচ্য বিষয়টি ‘‘মুজতাহাদ ফীহ’’, এতে এমন কোনো ‘নস’ নেই যা এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন, যার ভিত্তিতে ফকীহগণের মাঝে ইজমা (ঐকমত্য) সম্পন্ন হতে পারে। এ কারণে এ বিষয়ে যে ভূ-খন্ড নিজের আলিমগণের পরামর্শক্রমে এ পন্থা গ্রহণ করবে যে, তারা অন্য কোনো ভূ-খন্ডের চাঁদ দেখার ফয়সালা গ্রহণ করে নিজ দেশে চাঁদ দেখার বিধান কার্যকর করবে তাদেরকেও ভৎর্সনার পাত্র বানানো যায় না। তদ্রূপ যে ভূ-খন্ড নিজেদের আলিমগণের পরামর্শে এ পদ্ধতি গ্রহণ করবে যে, নিজ দেশের সীমানায় চাঁদ দেখার পর চাঁদ দেখার ফয়সালা কার্যকর করবে তাদেরও তিরস্কার করা যায় না। কারণ দু পক্ষের কোনো পক্ষই কুরআন, হাদীস বা ইজমার বিরোধিতা করেননি, আর না নিজের ইচ্ছার অনুসরণ করেছেন; বরং প্রত্যেকে এমন একটি মাযহাবের উপর আমল করেছেন, যার পক্ষে দলীল আছে এবং যা বড় বড় ফকীহ ইমামগণের মাযহাব।

    তিরস্কারযোগ্য তারা, যারা নিজেদের স্বদেশবাসী মুসলিম ভাইদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোযা ও ঈদ করতে চান এবং ঐক্যের নামে প্রকাশ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এটা আমার নিজের কথা নয়, ঐ আলিমদের কথা, যারা এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য ধর্তব্য মনে করেন। তাদের বক্তব্য এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত উলুল আমরের (দায়িত্বশীল) পক্ষ থেকে এর ব্যবস্থা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো দেশের নাগরিকের জন্য স্বদেশবাসী মুসলিম ভাইদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বৈধ নয়। সামনের আলোচনায় তাঁদের এই ফতোয়া তাঁদেরই ভাষায় দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।



    (চলবে ইনশাআল্লাহ)

  • #2
    মাশাআল্লাহ,,,জাযাকাল্লাহ,,,।
    অনেক সুন্দর আলোচনা ভাই!
    প্রিয় ভাই চালিয়ে যান ইনশাআল্লাহ....
    ’’হয়তো শরিয়াহ, নয়তো শাহাদাহ,,

    Comment

    Working...
    X