কালেকশানের মৌসুম: ব্যথাভরা মনের দু’টি কথা
ইতিমধ্যেই হয়তো আপনারা দেখতে শুরু করেছেন কালেকশানের দৃশ্য।
***
অনেকজন ছাত্র-হুজুর। এলাকার কিছু কিশোর ছেলে। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে।
‘দাঁড়ান ভাই দাঁড়ান। ড্রাইভার সাব একটু থামান।’
দু’পাশ থেকে হ্যান্ডবিল হাতে ছোট ছোট ছাত্ররা ঘিরে ধরেছে। ‘মাদ্রাসার মাহফিল, কিছু দিয়া যান।’
পাশে মাইকে একজন দানের ফজিলত বয়ান করছে সুরে সুরে।
যাত্রীরা সবাই বেজার না হলেও খুশি না। পাঁচ টাকা। দশ টাকা।
কেউ কেউ: ‘গাড়ি আটকায়া আটকায়া কালেকশান করা লাগে!’
গাড়িটি হয়তো থামেনি। একজন দ্বীন-দরদি পাঁচটি টাকা জানালা দিয়ে দিতে চাচ্ছেন।
‘ফালায়ে দেন ভাই ফালায়ে দেন’।
একজন ছাত্র দৌঁড়ে রাস্তা থেকে পাঁচ টাকার নোটটা তুলে নিচ্ছে। তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে।
***
সি এন জি থেকে বাসে উঠেছেন। একজন হুজুর গোছের লোক রশিদ হাতে। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সম্মানীত যাত্রী ভাই ও বোনেরা। আসসালামু আলাইকুম’।
মসজিদ বা এতিম খানার বরাতে তিনি এসেছেন। দানের কিছু হাদিসও শুনাচ্ছেন। দুয়েকটা আয়াতও পারলে বলছেন। রবিউল আওয়াল চান্দের জুমার বার। আরও বিভিন্ন দোহাই।
***
ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছেন। বাড়ির কাছের বাজারে বাস থেকে নামলেন। ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্র। সবার হাতে মাহফিলের হ্যান্ডবিল। একজনের হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কারও হাতে হয়তো রশিদও দেখছেন। এশার পর। রাত আটটা সাড়ে আটটা। পরিচিত দৃশ্য।‘কোন মাদ্রাসা তোমাদের?’
বিশটা টাকা দিলেন। তড়িঘড়ি করে তারা একটা রশিদ আপনাকে দিল।
আজ বাজারের দিন। এরা হাট কালেকশান করেছে। সব দোকানে গেছে। তরকারি মহালও বাদ যায়নি। মাছ মহালেও গেছে হয়তো। দুই টাকা। পাঁচ টাকা। দশ টাকা।
‘হুজুর, আপনাদের জ্বালায় বাঁচি না’।
‘এত্তো দূর তে আয়া কালেকশন করা লাগে’, আমাগো এলাকার মাদ্রাসা নাই?’
‘হুজুর মাফ করেন।’
‘পরে আয়েন’।
***
কথাগুলো ঠাট্টাচ্ছলে বলছি না। ছাত্র-হুজুরদের তুচ্ছ করাও উদ্দেশ্য না। দৃশ্যগুলো দেখে কান্না পায়। ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের আমরা রাস্তায় রাস্তায়, দোকানে দোকানে হাত পাতাচ্ছি। যে তালিবুল ইলমদের সামন নূরের ফেরশতারা পাখা বিছিয়ে দেয়, তাদের আমরা ভিক্ষুক বানিয়েছি। আমাদের কপালে খারাবি থাকা কি আজব কিছু? ***
আরও আশ্চর্য: এই মাসুম বাচ্চারা রাস্তায় রাস্তায়, বাসে বাসে, দোকানে দোকানে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে কয়টা টাকা জোগাড় করলো, বক্তা নামের একজন দ্বীনের সেবক (!!) এক ঘণ্টা সাত পাঁচ বলে বাগিয়ে নেবে দশ হাজার। বিশ হাজার। ত্রিশ হাজার। পঞ্চাশ হাজার।
ওহে দ্বীনের সেবক, চিন্তা করে দেখেছো কি- কত জনের লাথি গুতো খেয়ে, কত রাস্তায় ঘুরে, কত দোকানে হাত পেতে আনা হয়েছিল এই টাকাগুলো? তোমার বুকে একটু বিঁধলো না?
হয়তো বলবেন: এটা তো হাদিয়া। স্বেচ্ছায় দিয়েছে।
আমার প্রশ্ন: আমাকে হাদিয়া দেয়ার জন্য দশজনকে ভিক্ষায় নামানো কি আমার জন্য জায়েয?
কিংবা কাউকে হাদিয়া দেয়ার জন্য ভিক্ষায় নামা কি আমার জন্য জায়েয?
***
আমরা কি এমনই নিঃস্ব জাতি যে, জাতির সন্তানদের রাস্তায় রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করতে হবে?
যদি ভিক্ষা করতেই হয়, তাহলে কেন তালিবুল ইলমরা করবে? আমরা নিজেরা কেন ভিক্ষা করে তালিবুল ইলমদের অর্থ যোগাই না?
আপনার সন্তানের খরচ আপনি কেন দেন না? কেন আপনার সন্তানকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে হয়। সব গার্ডিয়ান যদি সন্তানের খরচ দিতো তাহলে বাপ থাকতে, ভাই থাকতে এই মাসুম বাচ্চাদের হাত পাততে হতো কি?
কিন্তু মাদ্রাসায় দেয়া মানে লিল্লাহ! স্কুল পড়ুয়াটার মাসে পাঁচ হাজার দিতে সমস্যা নাই। দ্বীনের এমনই মুহাব্বাত (!!)।
***
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! ‘জিহাদ’ ও ‘ইলমে দ্বীন’- এ দু’টি দ্বীনের বুনিয়াদ। জিহাদ যেমন সমষ্টিগতভাবে উম্মাহর উপর ফরয, ইলমে দ্বীনও সমষ্টিগতভাবে উম্মাহর উপর ফরয। ফরযে কিফায়া। এ দায়িত্ব প্রতিটি মুসলিমের।
যাদের আল্লাহ মেধা দিয়েছেন, জযবা ও ইনহিমাক দিয়েছেন, তারা পড়াশুনা করবে। গবেষণা করবে। তাদের যাবতীয় খরচ ও প্রয়োজন মিটাবে উম্মাহর বাকিরা। এটি নফল বা ঐচ্ছিক কোনো দায়িত্ব নয়। এটি ফরয।
মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা; ইমাম, মুআযযিন, মুআল্লিম ও তুলাবাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় আসবাব সরবরাহ করা উম্মাহর বাকিদের ফরয দায়িত্ব।
আজ আমরা কালেকশানের টেবিলে পাঁচ টাকার একটা কয়েন রেখে মনে করি জান্নাত খরিদ করে ফেলেছি। আসলে তুমি তোমার ফরয দায়িত্বের এক হাজার ভাগের এক ভাগও আদায় করোনি। নফলের তো কোনো প্রশ্নই আসে না। মাদ্রাসার তালিবুল ইলমরা, মসজিদের ইমাম-মুআযযিনরা ভিক্ষা করে ডাল-ভাত যোগাচ্ছে, আর তুমি পাঁচ টাকা দিয়ে মনে করেছো দ্বীনের সবটুকু খেদমত করে ফেলেছো?
***
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা, জিহাদ আর ইলমে দ্বীনের হুকুম সমান। এ উভয় পথে অর্থ-শ্রম ব্যয় করা উম্মাহর উপর ফরয। যদি উলামা তুলাবাকে হাত পাততে হয়, তাহলে আমরা আমাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। যাকাত না দিয়ে সম্পদ জমা করার মতোই এটি হারাম। যতক্ষণ উলামা তুলাবাদের হাত পাততে হবে, মনে রাখবেন, জাতির কপাল খারাপ।
আপনি কি জানেন, আফগানিরা কিভাবে দু’টি সুপার পারওয়ারকে ভেঙে দিয়েছে?
উলামা তুলাবারা আফগানিদের কাছে সবচেয়ে সম্মানী। তাদের জন্য তারা জীবন দেয়, রাস্তায় নামায় না, হাত পাতায় না।
আমরা যত দিন নিজেদের পরিবর্তন করতে না পারছি, আমাদের লাঞ্ছনা গুছবে না। আল্লাহ মাফ করুন।
Comment