মুসলমানদের সাথে কোমল আচরণের গুরুত্ব কতটুকু?
জবাব: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
প্রথম কথা:
আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ধর্ম দুনিয়াতে পাঠানোর মাধ্যমে রিসালাতের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর আর যেহেতু কেয়ামত পর্যন্ত ঐশী কোন ধর্ম আসবে না, তাই ইসলামের বিধি-বিধানগুলো সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও মানব কল্যাণ দ্বারা সাজানো। এর মাঝে ব্যক্তি কল্যাণ থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র ও সর্বোচ্চ পরিসরের কল্যাণের বিবেচনা করা হয়েছে। ইসলামী শরীয়তের এমনই একটি সর্বব্যাপী কল্যাণকর বিধান হলো- মুসলিমদের পারস্পরিক সু-সম্পর্কের বিধান।
এ বিষয়ে ইসলাম অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও জোরালো নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। যেসব কারণে এই সুসম্পর্ক নষ্ট হয় ও ভেঙ্গে যায়, তা হারাম করেছে। মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যই ইসলামী শরীয়তে মুসলিমদের মধ্যকার সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও কোমলতাকে আবশ্যক করা হয়েছে। শাইখ মুহাম্মাদ আলআমীন আশ-শানকীতী রহিমাহুল্লাহু তায়ালা বলেন:
“কুরআনের নির্দেশিত একটি সরল মজবুত ও উত্তম পন্থা হলো কুরআনের এই নির্দেশনা যে, সমাজের সদস্যদের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন তৈরী হবে একমাত্র ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে, এটাই এই আকীদার অনিবার্যতা। ইসলামই এমন এক শক্তি যা সমাজের সব সদস্যকে এমনভাবে একীভূত করে, যেন তারা এক দেহ এক প্রাণ। এখানে যদি একটি অঙ্গ পীড়িত হয়, তাহলে অন্য অঙ্গগুলোও তার ব্যথায় ব্যথিত হয়। একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের সাথে এমনই সম্পর্ক, যেমন হাতের সাথে হাতের কব্জির সম্পর্ক। পায়ের সাথে পায়ের গোছার সম্পর্ক। যেমনটা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إن مثل المؤمنين في تراحمهم وتعاطفهم وتوادهم كمثل الجسد الواحد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمى
অর্থ: “সৌহার্দ সম্প্রীতি ও ভালোবাসায় মুমিনরা একটি দেহের ন্যায়। যখন তার একটি অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন সারা দেহ নির্ঘুম ও জ্বরাক্রান্ত থাকার মাধ্যমে তার সঙ্গ দেয়।”
এই কারণেই আমরা দেখি, কুরআনুল কারীমে মুসলিমদের পারস্পরিক কোন বিষয় আলোচনা করার ক্ষেত্রে “তোমাদের নিজেদের” এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বোঝানো উদ্দেশ্য যে, তোমার মুসলিম ভাই সে অন্য কেউ নয়, যেন তুমি নিজেই। তোমারই একটা অংশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَلاَ تُخْرِجُونَ أَنْفُسَكُمْ مِّن دِيَارِكُمْ
অর্থ: তোমরা নিজেদেরকে তোমাদের ভূখণ্ড থেকে বের করে দিওনা। (সূরা বাকারাহ : ৮৪)
আয়াতের অর্থ হলো, তোমাদের ভাইদেরকে বের করে দিও না। আরেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
لولا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ المؤمنون والمؤمنات بِأَنْفُسِهِمْ خَيْراً
অর্থ: যখন তোমরা তা শুনলে তখন কেন মুমিন নারী ও পুরুষরা নিজেদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করলোনা । (সূরা নূর : ১২)
উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের ভাইদের ব্যাপারে। আরেক জায়গায় এসেছে-
وَلاَ تلمزوا أَنفُسَكُمْ
অর্থ: আর তোমরা নিজেদের সমালোচনা করোনা। (সূরা হুজুরাত : ১১)
মানে তোমাদের ভাইদের সমালোচনা করো না। আরো বলেন-
وَلاَ تأكلوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ
অর্থ: তোমরা পরস্পরে নিজেদের সম্পদ ভক্ষণ করোনা। (সূরা বাকারাহ : ১৮৮)
উদ্দেশ্য, এক ভাই অপরের সম্পদ খেয়ো না। এই জাতীয় আরো অনেক আয়াতে এমন কথা বিবৃত হয়েছে। তাইতো সহীহ হাদিসে এসেছে-
لا يؤمن أحدكم حتى يحب لأخيه ما يحب لنفسه
অর্থ: তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের ব্যাপারে তাই পছন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। (আদওয়াউল বয়ান- ৩/ ১৩০-১৩১)
দ্বিতীয় কথা:
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: মুসলিমদের সাথে এই সু-সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। তাদের আনন্দের উপলক্ষে সঙ্গ দেওয়া। বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানো। এর মাঝে প্রভূত কল্যাণ রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু নিম্নরূপ:
১- এটা পূর্ণাঙ্গ ঈমানের পরিচায়ক।
হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
অর্থ: এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য ভবনের ন্যয়। একটি অংশ অপর অংশকে মজবুত করে। (বুখারী- ৪৬৭, মুসলিম- ২৫৮৫)
ইমাম নববী রহ. তাঁর কিতাবে এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন:
بَاب تَرَاحُمِ الْمُؤْمِنِينَ وَتَعَاطُفِهِمْ وَتَعَاضُدِهِم
অর্থ: মুমিনদের মাঝে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও কোমলতার অধ্যায়।
ইমাম নববী রহ. বলেন-« উপরোক্ত হাদীস এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদীস মুসলিমদের মধ্যকার পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও সু-সম্পর্কের বিষয়ে গুরুত্ব নির্দেশ করে। গুনাহ ও অন্যায় কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহায়তার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে এই হাদীসে। এই বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের ভাষ্য: تداعى لها سائر الجسد- অর্থাৎ এক অংশ অন্য অংশকে ব্যথায় শরিক হবার জন্য বলে। এই অর্থের কারণেই আরবরা তাদের কথায় বলে থাকে: تداعت الحيطان -অর্থাৎ দেয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো। » (ইমাম নববী রহ.- এর উদ্ধৃতি এখানেই শেষ) [শরহে মুসলিম, ১৬/১৩৯-১৪০]
হযরত নুমান ইবনে বশীর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
অর্থ: “মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যয়। যখন একটি অঙ্গ পীড়িত হয়, সারা শরীর তার জন্য নির্ঘুম এবং জরাক্রান্ত হবার মাধ্যমে তার সঙ্গ দেয়।” (বুখারী – ৫৬৬৫, মুসলিম-২৫৮৬)
আল্লামা মুনাভী রহ. বলেন- “ইবনে আবি জামরা রহ. বলেন- হাদিসে বর্ণিত তিনটি শব্দ التراحم , التواد , التعاطف যদিও কাছাকাছি অর্থের কিন্তু তিনটির মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো একে অপরের প্রতি দয়া পরবশ হবে, শুধুমাত্র অন্তরে ঈমানের স্বাদ থাকার কারণে, অন্য কারণে নয়। আর দ্বিতীয়টি: পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝায়, যা দ্বারা ভালোবাসা তৈরী হয়। যেমন একে অপরকে হাদিয়া দেওয়া। আর তৃতীয়টি দ্বারা একে অপরকে সহযোগিতা করা বোঝায়।” (ফাইযুল কাদীর: ৫/৬৫৬)
সহীহ মুসলিমের এক রেওয়ায়েতে এসেছে-
الْمُؤْمِنُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنْ اشْتَكَى رَأْسُهُ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالْحُمَّى وَالسَّهَر .
অর্থ: “মুমিনরা হলো এক দেহের ন্যয়। যদি তার কোন একটি অঙ্গ পীড়িত হয়, সারা শরীর নির্ঘুম এবং জরাক্রান্ত থাকার মাধ্যমে তার সঙ্গ দেয়।”
আরেক বর্ণনায় এসেছে-
الْمُسْلِمُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنْ اشْتَكَى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ وَإِنْ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ.
অর্থ: “মুসলমানরা হলো একটি দেহের ন্যয়, যদি তার চোখ আক্রান্ত হয়, সারা শরীর আক্রান্ত হয়ে যায়; যদি তার মাথা আক্রান্ত হয়, সারা শরীর আক্রান্ত হয়ে যায়।”
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন-
এই কারণেই একজন মুসলিমের বৈশিষ্ট এমন হবে যে, যে কাজে সব মুসলিমের সুখ হবে, সে কাজে সেও সুখী হবে। যে কাজে অন্যরা কষ্ট পাবে, সে কাজে সে নিজেও কষ্ট পাবে। যে এমন হবে না, সে প্রকৃত পক্ষেই তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। মুমিনদের মধ্যকার এই ঐক্য এটা সত্তাগত ঐক্য নয়, এমনও নয় যে, তারা সবাই একে অপরের মাঝে একাকার হয়ে গেছে; বরং এই ঐক্য হলো ঈমানের কারণে। তাদের মধ্যকার ভালোবাসা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার একটি শাখা; এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা ভালোবাসেন, তারাও তাই ভালোবাসে। (মাজমুউল ফাতাওয়া, ২/২৭৩-২৭৪)
হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন-
উক্ত হাদীস বর্ণনার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতে প্রবেশ করিয়েছেন। এটা এমনিতেই করেননি। বরং বিষয়টি চাক্ষুষ উদাহরণের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করলেন। কারণ যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কটাকে ভবনের সাথে তুলনা করলেন, তো এটা ছিল মৌখিক সাদৃশ্য, এরপর এই সাদৃশ্যকে একটি বাহিক্য উদাহরণের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করলেন। যাতে উক্ত বিষয়টি তদের সামনে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরেকটি ফায়দা হলো- মুমিনদের মধ্যকার সম্পর্কটা হবে, আঙ্গুলের পারস্পরিক সম্পর্কের ন্যয়। হাতের আঙ্গুলগুলো যেমন একাধিক এবং ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবগুলোর মূল এক জায়গায়; সবগুলো একই ব্যক্তির আঙ্গুল, তেমনিভাবে মুমিনগণ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাদের মূল এক, তারা আদম ও নূহের সন্তান, সবাই এক পিতার সন্তান ভাই-ভাই। তাদেরকে একত্রিত করেছে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব।
২- মুমিনদের মধ্যকার সুসম্পর্কের আরেকটি দিক হলো, জাহেলি সমাজ ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ মুসলিমদের মাঝে যে বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে, মুমিনরা সেই প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের মাঝে ভাষা, বর্ণ, জাতি ও অঞ্চল ভেদে কোন বিভেদ থাকবে না।
শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ. বলেন-
কোন সন্দেহ নেই যে, জাতীয়তার আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সীমালঙ্ঘন এবং অহমিকার প্রতি আহ্বান। কারণ জাতীয়তাবাদের চেতনা কোন আসমানী দ্বীনে ছিল না। এটাতো মূলত জাহেলী চিন্তা-দর্শন থেকে সৃষ্ট। এই চিন্তা তার ধারকদের মাঝে অহংবোধ, আত্মঅহমিকা ও আত্ম-প্রবঞ্চনাবোধ তৈরী করে। স্বজাতির সাপোর্ট করতে শেখায় যদিও সে জালেম হয়। আর অপরের বিরুদ্ধাচরণ শেখায় যদিও সে মাজলুম হয়। এটা পরিপূর্ণই আসমানী শিক্ষার বিপরীত। এতটুকু নিয়ে ভাবলেই জাতীয়তাবাদের অসারতা ও নষ্টামি সকলের সামনে ফুটে উঠবে। এই বিষয়ে আরো যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن الله قد أذهب عنكم عصبية الجاهلية وفخرها بالآباء ، إنما هو مؤمن تقي أو فاجر شقي ، الناس بنو آدم ، وآدم خلق من تراب ، ولا فضل لعربي على عجمي إلا بالتقوى
অর্থ: “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের থেকে জাহিলি আসাবিয়াতকে তুলে দিয়েছেন এবং পিতৃপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথা তুলে দিয়েছেন। মানুষ দুই ধরনের, হয়তো মুত্তাকি ঈমানদার কিংবা হতভাগা পাপী। মানুষ সকলেই আদম সন্তান, আর আদম মাটি দিয়ে তৈরী। কোন আরবের আজমের উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই— তাকওয়া ছাড়া। » এই হাদীসটি এই আয়াতকে সমর্থন করে- আল্লাহ তায়ালা বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: “হে মানবসকল! আমি তোমাদেরকে পুরুষ এবং নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন দল ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সে, যে বেশি তাকওয়াবান। »
আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বললেন, মানুষকে বিভিন্ন দলে ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন, শুধু পরিচিতির জন্য। পরস্পরে গর্ব করা বা একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্য এটা করেননি। আর তাদের মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত ঘোষণা দিয়েছেন ওই ব্যক্তিকে, যে বেশি তাকওয়াবান। পবিত্র হাদীস শরীফেও এই জাতীয় বিষয় বর্ণিত হয়েছে। পূর্বসূরীদের নিয়ে গর্ব ও অহংকার করা, বংশ নিয়ে গর্ব করা ইত্যাদি জাহেলী প্রথা ইসলাম উঠিয়ে দিয়েছে। ইসলাম শিখিয়েছে বিনয়, তাকওয়া, আল্লাহর জন্য একে অপররকে ভালোবাসা, সব মুসলিম এক আদমের সন্তান, এক দেহ, এক ভিত্তি, একে অপরের সহযোগী, একে অপরের ব্যথায় ব্যথিত। (ফাতাওয়া শাইখ বিন বায রহ., ১/ ২৯০-২৯১)
৩- সৌহার্দ্য সম্প্রীতির অন্তর্ভুক্ত আরেকটি বিষয় হলো: দুর্বল, অক্ষম ও মিসকীনদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের গুরুত্ব দেওয়া ও দায়িত্ব নেওয়া।
ফাতাওয়া আললাজনাতুদ দায়েমায় (২০/৩৪৮) এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, ইসলামের নির্দেশ হলো, এতিম, মিসকীন, উপার্জনে অক্ষম, পিতৃপরিচয়হীন, এই জাতীয় মানুষের দায়িত্ব নেওয়া, তারবিয়ত করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহের হাত বাড়ানো। যাতে সমাজে কোন অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষ না থাকে। কারণ এতে উম্মাহর মাঝে তারবিয়তবিহীন একটি জামাত তৈরী হবে, যারা দেশ ও জাতির জন্য হুমকি হবে। তারা সমাজের মানুষও তাদের সাথে কঠোরতা করবে। এতে সমাজের ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতাবোধ ব্যাহত হবে।
৪- আরেকটি বিষয় হলো, সকল স্থানের মাজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো। যথাসম্ভব তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। যেমন- অন্যায়কারী জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের পক্ষ নিয়ে কিতাল করা। তাকে আর্থিক সাহায্য করা। আর যদি এটা করতে অক্ষম হয়, তাহলে দোয়ার মাধ্যমে সাহায্য করা।
সকল ওলামায়ে কেরাম একটি ফাতাওয়া দিয়েছেন যে, যদি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে একজন মুসলিম নারী কাফের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত সকল মুসলিমের উপর তার সাহায্য করা আবশ্যক হয়ে যায়। কিন্তু যদি হত্যা, দেশান্তর, জুলুম, সীমালঙ্ঘন, বন্দিদশা, সম্ভ্রমহানী ইত্যাদি চলতে থাকে, তাহলে কী করা আবশ্যক হবে?! অথচ প্রতিনিয়ত শত সহস্র নয়, লক্ষ লক্ষ মুসলিম মা বোন কাফের হায়েনাদের হাতে ভয়ংকর সব নির্যাতনের শিকার, কিন্তু এর জন্য কোন ভাই দাঁড়াচ্ছে না, কারো মনে কোন উত্তাপ তৈরী হচ্ছে না, কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না— ইল্লা মাশা আল্লাহ। (ফাতাওয়া বিন বায রহ., ২/১৬৩-১৬৫)
৫- আরেকটি বিষয় হলো- মুসলিমদের ব্যাপারে কাফেরদের কু-লালসার অবসান ঘটানো।
যদি কাফেররা জানতে পারে যে, মুসলিমরা সকলে মিলে এক হাত। আনন্দ বেদনায় তারা এক। দুঃখে কষ্টে তারা এক। একটি রাষ্ট্র কিংবা জনপদ দূরের কথা, মা বোনদের সম্ভ্রমহানি দূরের কথা, বরং যখনই কোন পাপিষ্ঠ কাফের কোন একজন সাধারণ মুসলিমের উপর আক্রমণ করবে, তখনই সকল মুসলিম এক হাত হয়ে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই পীড়িত মুসলিম ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে।
শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ. বলেন-
« এইসব হাদীস এবং এই অর্থে অন্য যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাতে মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, কোমলতা, সহিঞ্চুতা, একে অপরকে সহযোগিতা এবং একে অপরের সুরক্ষা হওয়াকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করে। এবং এক্ষেত্রে তাদেরকে একটি ভবনের সাথে তুলনা করার দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, তারা শত্রুর প্রতিরোধে সবাই এক হাত। ঐকের মাধ্যমেই তারা শত্রুর আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পারবে। (ফাতাওয়া শাইখ বিন বায রহ., ২/২০০-২০১)
তৃতীয় কথা:
পারস্পরিক কোমলতা এবং সহমর্মিতার ক্ষেত্রে সাহাবিগণ সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।
১- হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
قَدِمَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ ، فَآخَى النَّبيُّ صلى الله عليه وسلم بَيْنَهُ وَبَيْنَ سَعْدِ بْنِ الرَّبِيعِ الأَنْصَارِىِّ ، فَعَرَضَ عَلَيْهِ أَنْ يُنَاصِفَهُ أَهْلَهُ وَمَالَهُ ، فَقَالَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ : بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِي أَهْلِكَ وَمَالِكَ ، دُلَّنِي عَلَى السُّوقِ
“আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযি. হিজরত করে মদীনায় এসেছেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাঝে ও সাদ বিন রবী’ এর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরী করে দিয়েছেন। তখন তিনি তাঁর সামনে তাঁর সম্পদ ও পরিবার আধাআধি করে ভাগ করে নেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন আব্দুর রহমান রাযি. তাকে বলেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। (অর্থাৎ সেখান থেকে আমার কিছু লাগবে না) আমাকে বরং বাজার দেখিয়ে দাও।” (সহীহ বুখারী- ৩৯৩৭)
এ ঘটনায় আমরা জানি না, কার ভূমিকা অধিক আশ্চর্যজনক। সাদ বিন রাবি রাযি.-এর উদারতা ও বদান্যতা, নাকি আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযি.-এর অমুখাপেক্ষিতা?
২- হযরত আনাস রাযি. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ الْمُهَاجِرُونَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا رَأَيْنَا مِثْلَ قَوْمٍ قَدِمْنَا عَلَيْهِمْ أَحْسَنَ مُوَاسَاةً فِي قَلِيلٍ وَلَا أَحْسَنَ بَذْلًا فِي كَثِيرٍ ، لَقَدْ كَفَوْنَا الْمَئُونَةَ ، وَأَشْرَكُونَا فِي الْمَهْنَإِ ، حَتَّى لَقَدْ حَسِبْنَا أَنْ يَذْهَبُوا بِالْأَجْرِ كُلِّهِ ، قَالَ : ( لَا ، مَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِمْ ، وَدَعَوْتُمْ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ
“মুহাজিরগণ একবার বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যেই জাতির কাছে হিজরত করে এসেছি, তাদের মত এমন জাতি আর হয় না। যারা অল্প থেকেও এত বেশি বদান্যতা দেখায়, আর বেশি থেকে বেশী অকাতরে বিলায়। তারা ব্যয়ের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, আর ফসলে আমাদেরকে শরীক করেছে। আমাদের তো ধারণা সব প্রতিদান তারাই নিয়ে নিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, না না, তোমরাও প্রতিদান পাবে, যদি তোমরা তাদের প্রশংসা করো এবং তাদের জন্য দোয়া করো।” (মুসনাদে আহমদ – ১২৬৬২ , তিরমিযী- ২৪৮৭ মেশকাতুল মাসাবিহ –(২/১৮৫) গ্রন্থে শাইখ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীস থেকে সহীহ বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ!!
— সংগৃহীত
Comment