ঈদুল আযহা: ইবাদাত, উৎসব, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
বছর ঘুরে আবারো আমাদের সামনে উপস্থিত ঈদুল আযহা। মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় বৃহত্তর উৎসবের দিন হল ঈদুল আযহা। মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন উপলক্ষ্য দিয়ে অন্য রকম এক আমেজ সৃষ্টি করেন।
ঈদুল ফিতরের সময় পুরো এক মাস রমাদ্বানের সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর এক আমেজ তৈরি হয়। আর ঈদুল আজহার সময় জিলহজ্ব মাসের প্রথম দিনের শ্রেষ্ঠত্ব, হজ্ব ও কুরবানির মাধ্যমে মুসলিমবিশ্বে তৈরি হয় আনন্দের এক আবহ।
মুসলিমদের জন্য এসব উৎসব কেবলই আনন্দ - ফূর্তি নয়, বরং তাদের এই উৎযাপনও মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত। মুসলিমরা যদি এসব উৎসব আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার আনুগত্য করে অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকে পালন করে, তাহলে এই উৎসব দুনিয়াতেও তাদেরকে প্রশান্তি দিবে। আবার আখিরাতেও তাদের জন্য মহা আনন্দের কারণ হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঈদুল আযহার বিশেষ কিছু তাৎপর্য ও শিক্ষা রয়েছে। আছে সাংস্কৃতিক বিশেষ গুরুত্ব।
১। উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের কুরবানির প্রধান বস্তু হল গরু। কিন্তু এক সময় এই অঞ্চলে মুসলিমদের গরু জবাইয়ের অধিকার ছিল না। হি ন্দ ত্ব বাদী ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সন্ত্রাসী জমিদার আর রাজা গরু জবাইকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। হি ন্দু ত্ব বাদী রাজা গৌর গবিন্দ আর মজলুম মুসলিম শেখ বুরহানুদ্দীনের ইতিহাস আজও আমাদের এই বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। বহুত ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে রক্ত ঝড়িয়ে মুসলিমরা গরু জবাইয়ের অধিকার ও স্বাধীনতা আদায় করে।
কিন্তু উপমহাদেশে নতুন করে আবার গেরুয়া সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতে গরুর গোশত ভক্ষণ ও জবাইকে কেন্দ্র করে এই পর্যন্ত গেরুয়া সন্ত্রাসীদের হাতে অনেক মুসলিম নির্যাতিত হয়েছে। তাদের প্রেতাত্মারা মুসলিম বাংলার জমিনেও গরু জবাই নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে। অনেক জায়গায় তারা পরোক্ষভাবে গরুর গোশত নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
২। নির্দিষ্টভাবে গরু জবাই ছাড়াও সামগ্রিকভাবে পশুহত্যার জিগির তুলে একদল পশুপ্রেমী সেকুলার ঈদুল আযহায় কুরবানির বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রচারণা চালায়। এই সমস্ত কীটপতঙ্গ সারা বছর নানা জাতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ ভক্ষণ করে উদরপূর্তি করে। বিভিন্ন অনর্থক ও অন্যায় ভোগ বিলাসে মত্ত থেকে পশুপ্রেম আর মানবিকতা শেখাতে আসে। এরা হল ভণ্ড। এরাই প্রকৃত উগ্রবাদী ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি চরমবিদ্বেষী।
এমতাবস্থায় গরু ও অন্যান্য পশু জবাইকে উৎযাপন করা এবং প্রচারণার মাধ্যমে এদের অন্তরে জ্বালাতন সৃষ্টি করা সাংস্কৃতিক লড়াই ও সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩। ঈদুল আযহা ও কুরবানির বিভিন্ন আমল ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পরিবারবর্গের সাথে ঐতিহাসিকভাবে সংশ্লিষ্টতা রাখে। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মাঝে আমরা মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি আদর্শ দেখতে পাই। একটি হল, আলহুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বুগযু ফিল্লাহ’,-আল্লাহর জন্যই ভালবাসা স্থাপন, আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ পোষণ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِیْۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ الَّذِیْنَ مَعَهٗ، اِذْ قَالُوْا لِقَوْمِهِمْ اِنَّا بُرَءٰؤُا مِنْكُمْ وَ مِمَّا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَ بَدَا بَیْنَنَا وَ بَیْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَ الْبَغْضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی تُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَحْدَهٗۤ.
তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকীদা-বিশ্বাস) অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে। যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। -সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ৪
সমস্ত কুফুর, শিরক ও এর পৃষ্ঠপোষকদের থেকে তিনি সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঈদুল আযহা আজও আমাদেরকে সেই ইব্রাহিমী চেতনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রচলিত মানবরচিত সকল জাহেলি, শিরকি মতবাদ থেকে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়া ঈদুল আযহার একটি মৌলিক আবেদন।
ভালবাসা ও বিদ্বেষ পোষণের মানদণ্ড হল ঈমান। এর মাধ্যমেই ঈমান পূর্ণতা পায়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ أَحَبّ لِله، وَأَبْغَضَ لِلهِ، وَأَعْطَى لِلهِ، وَمَنَعَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
যে আল্লাহর জন্য (অন্যকে) ভালোবাসে, আল্লাহর জন্যই (কারো সাথে) বিদ্বেষ পোষণ করে, (কাউকে কিছু দিলে) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই দেয়, আর কাউকে কোনো কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকলে সেটাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করে, সে স্বীয় ঈমানকে পূর্ণ করল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৮১
আরেকটি হল, আল্লাহর বিধান ও নির্দেশের সামনে নি:শর্ত আত্মসমর্পণ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
اِذْ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗ اَسْلِمْ قَالَ اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
(স্মরণ করুন,) যখন ইবরাহীমের রব তাকে বললেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। -সূরা বাকারা (২) : ১৩১
নিজের খাহেশাত, ইচ্ছা, স্বার্থ, ক্ষমতা, সংস্থা, ত্রুটিপূর্ণ বিবেকের বিপরীতে গিয়ে আল্লাহর শরীয়তকে মেনে নেয়ার নামই ঈমান। আর ঈদুল আহযার অন্যতম একটি শিক্ষাই হল নি:শর্ত আত্মসমর্পণ বিশিষ্ট ঈমানের।
৪। ঈদুল আযহার মৌসুমে অন্যতম একটি আমল হল, তাকবিরে তাশরিক পাঠ। আইয়্যামে তাশরিকের দিনগুলোতে সাহাবাদের সমাজে হাঁটেবাজারে সর্বত্র আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা আর তাকবিরের ধ্বনি তোলা হত।
হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলো তো তাঁর তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন।
এই তাকবিরের প্রতি আজও ইসলামবিদ্বেষীদের আতংক কাজ করে৷ তারা এই তাকবিরকে বাংলার মুসলিমদের জমিন থেকে গায়েব করে দিতে চায়। মুসলিম বাংলার জমিনে এই তাকবিরের ধ্বনি ও মর্মকে উচ্চারণ করতে হবে নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে। এই বার্তাকে মুসলিমদের জমিনে প্রোথিত করে দিতে হবে যে, আল্লাহ মহান। জমিন, আসমান সর্বত্র তাঁরই ক্ষমতা আর বিধান চলবে। জাতিসংঘ, ন্যাটো, চীন রাশিয়া দুনিয়ার কোন পরাশক্তি ও সংস্থার আধিপত্য আল্লাহর ক্ষমতা আর বিধানের সামনে চলবে না। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি। তিনিই মহান, তিনিই চূড়ান্ত।
সবশেষে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করুন। সন্তান ও প্রজন্মকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিন। গরীব ও অসহায়দের ঘরে ঈদের আনন্দ পৌঁছে দিন। গেরুয়া সন্ত্রাসী আর পশুপ্রেমীদের জ্বলনে পুড়িয়ে কুরবানির গোশত আহার করুন আর আল্লাহর মেহমানদারি কবুল করুন।
সংগৃহীত পোস্ট