আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“আকীদাতুল ওয়ালা ওয়াল-বারা” ।।
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
এর থেকে || ১ম পর্ব
========================================
===============
“আকীদাতুল ওয়ালা ওয়াল-বারা” ।।
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
এর থেকে || ১ম পর্ব
========================================
===============
ভূমিকা
ইসলামী ইতিহাসের এ দশকগুলো অবাধ্য-অহংকারী কুফরীশক্তি আর মুসলিম উম্মাহ ও তাদের নেতৃত্বদানকারী বীর মুজাহিদগণের মাঝে চলমান এক প্রচণ্ড যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের দু’টি বরকতময় হামলা এবং পরবর্তীতে ইসলামের বিরুদ্ধে বুশের নব্য ক্রুসেডযুদ্ধ বা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে যা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ইসলামে আল-ওয়ালা ওয়াল-বারার আকীদার গুরুত্ব অনুধাবন করা কতটা প্রয়োজন- তা এ যুদ্ধের বাস্তবতা ও ঘটনাবলি থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে ইসলামী আকীদার এ গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির আমানত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি সম্পর্কেও আমাদের জানা থাকা একান্ত কর্তব্য। আকীদার এ সুদৃঢ় স্তম্ভটির নিদর্শনকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ এবং আল্লাহর সৎ বান্দাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে মুসলিম উম্মাহর সাথে ইসলামের দুশমন ও তাদের অনুসারী-সহযোগীরা যে ব্যাপক প্রতারণা করছে, তাও আমাদের জানতে হবে।
এরাই সেই শত্রু, যারা সামরিক ক্রুসেড আক্রমণের সাথে সাথে (ইসলামের বিরুদ্ধে) এক বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাই আন্তর্জাতিক যায়নবাদী ইয়াহুদী ও ক্রুসেড শক্তির জরাজীর্ণ বাস্তবতাকে ঢেকে রাখার জন্য (মুসলিম উম্মাহর মাঝে) বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা, বিকৃতকরণ ও গোলামিপূর্ণ মানসিকতার অবমাননাকর ধ্যান-ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে এক হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের সরকারগুলোই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এটি সেই আক্রমণ, হক্ব-বাতিলের মধ্যকার সীমারেখা মুছে দেওয়াই যার একান্ত লক্ষ্য। যাতে শত্রু-মিত্র একাকার হয়ে যায় (এবং শত্রুকে মিত্র ভাবা হয়)। এমনকি ক্রমবর্ধমান ইসলামী জিহাদী শক্তিকে প্রতিহত করার অপকৌশল হিসেবে- লাঞ্ছনা, গোলামি, গাইরুল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং মানবরচিত আইনে শাসন করা ইত্যাদি অপকর্মকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা যায়। আর এর পাশাপাশি উম্মাহর বীর মুজাহিদীন, তাঁদের সাহায্যকারী ও তাঁদের পতাকাতলে সমবেত তাওহীদী জনতা ইজ্জত, জিহাদ ও হক্বের দাওয়াতের যে পতাকা উত্তোলন করছেন, সেটাকে বিকৃত করাও তাদের লক্ষ্য।
সত্য, সম্মান ও জিহাদের দাওয়াত যতই শক্তিশালী হচ্ছে, তার মোকাবেলায় বাতিলের চেঁচামেচি, লাঞ্ছনা, কাপুরুষতা ও নিষ্ফল কার্যক্রম ততই বেড়ে চলছে। এমনকি বাতিলপন্থীরা নিজদেরকে সোনালী যুগের সালাফদের আকীদা-বিশ্বাসের রক্ষক বলে অবিরাম চিল্লাচিল্লি করলেও, নিজেরা পূর্বেকার সেই উগ্র মুরজিয়াদের দাওয়াতকে লালন-পালন করতে কোনো দ্বিধাবোধ করে না। নিজেদেরকে শরীয়াহর অতন্দ্র প্রহরী ও প্রতিরক্ষাকারী দাবি করলেও পাপাচারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্লোগান আওড়াতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না। তাই তো তাদের মতে, সে ব্যক্তি ক্ষতিকর নয়; যে সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বিভাগ, গণমাধ্যম বা বিচারক পদে চাকুরি করে সরকারের প্রতিরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে, কুফরী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রতি দাওয়াত দেয়, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে প্রচারণা চালায় এবং তাদের প্রতি আনুগত্য করে। অথচ সে একই সময়ে নামায পড়ে, রোযা রেখে, হাজ্ব করে এবং যাকাত দিয়ে আল্লাহভীরু পরহেজগার মুসলমান হিসেবেও গণ্য হয়!
এমনকি আমরা দেখি- সবচেয়ে অভিজাত রাজপরিবারটিও আমেরিকার স্বার্থরক্ষায় সদা ব্যস্ত থাকে; অথচ নিজদেরকে তারা তাওহীদের রক্ষক বলে দাবি করে। আমরা দেখি- সে সব কুফরের নেতাকে, যারা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পালন করতে বাধ্য করে, মানবরচিত আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করে এবং পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত- ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে; অথচ তারাই আবার হিজাব নিষিদ্ধ করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আমরা দেখি- সে সব জল্লাদ শাসককে, যারা মুসলমানদেরকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি প্রদান করে; অথচ তারাই আবার মহাআড়ম্বরে হাজ্ব-উমরাও পালন করে। আমরা দেখি- আফগানিস্তানের একদল ডাকাতকে, যারা আমেরিকা থেকে বেতন গ্রহণ করে, আর আমেরিকা তাদেরকে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সামনের সারিতে ঠেলে দেয়। তারপর তারা তাদের কথিত সেই শহীদ ভাইদের কাপড়-চোপড় ও তাঁদের কবরের মাটি থেকে বরকত হাসিল করে!
যেমন তাতারদের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন, এমনকি মানুষ তাদেরকে ভূমিদখল এবং সম্পদলুট করতে দেখে। তারা কোনো মানুষকে বশে এনে তার কাছ থেকে ফায়দা লুটে নেয়, তার সব কাপড়-চোপড় ছিনিয়ে নেয় এবং তার স্ত্রীকে গালিগালাজ করে (সম্মান হরণ করে)। তাকে এমন সব শাস্তি প্রদান করে, যা একমাত্র নিকৃষ্টতর জালিম এবং পাপাচারী ব্যক্তিদের দ্বারাই সম্ভব। সেই (জুলুমবাজিকে) আবার শরীয়াহ কর্তৃক বৈধতাও দেয়, যেন দ্বীনের বিরোধিতার কারণেই তারা শাস্তি প্রদান করে থাকে। দ্বীনের দোহাই দিয়ে তাদেরকে আবার বিরোধীদের বশে আনার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তারা দাবি করে, তারাই দ্বীনের সবচেয়ে অনুগত। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ব্যাপারে কী আর বলার থাকে?
এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। এটাই তো বাতিলের সেই ফেনাতুল্য অস্ত্র, যার মাধ্যমে তারা সর্বশক্তি এক করে আমাদের বুকের উপর অধোমুখী ফাসাদ নিরন্তর চালু রাখতে চায় এবং উম্মাহর পবিত্র ভূমির উপর প্রতিনিয়ত দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখতে চায়। বিশেষত, পবিত্রতম তিনটি ভূখণ্ড- মক্কা, মদীনা ও বাইতুল মুকাদ্দাস এর উপর।
প্রত্যেক চিন্তাশীল ও বিবেকবান মানুষের কাছে এটিই তাদের দাওয়াতের সার কথা। শরীয়াহ বহির্ভূত বিশৃঙ্খল আইন-কানুন দেশে অব্যাহত রাখা এবং নব্য ক্রুসেডারদের জন্য আমাদের ভূমিগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়াই তাদের বক্তৃতা-ভাষণ ও প্রকাশিত-সম্প্রচারিত প্রতিটি শব্দের অভিষ্ট লক্ষ্য।
এরাই সেই সম্প্রদায়- কুরআনে কারীম যাদের পূর্বপুরুষদেরকে অপদস্থ করেছে এবং তাদের মুখোশ উন্মোচন করে বর্ণনা করে দিয়েছে যে, মুসলমানদের মাঝে এরাই ফেতনা অন্বেষণ করে। এরাই ফেতনাকে দ্রুততম সময়ে লুফে নেয়। এরাই পার্থিব হীনস্বার্থ আর ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَٰكِن كَرِهَ اللَّهُ انبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ ﴿التوبة: ٤٦﴾ لَوْ خَرَجُوا فِيكُم مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ ﴿التوبة: ٤٧﴾
“আর যদি তারা বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো। কিন্তু তাদের উত্থান আল্লাহর পছন্দ নয়, তাই তাদের নিবৃত রাখলেন এবং আদেশ হল বসা লোকদের সাথে তোমরা বসে থাক। যদি তোমাদের সাথে তারা বের হত, তবে তোমাদের অনিষ্ট ছাড়া আর কিছু বৃদ্ধি করতো না, আর অশ্ব ছুটাতো তোমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশে। আর তোমাদের মাঝে রয়েছে তাদের গুপ্তচর। বস্তুতঃ আল্লাহ যালিমদের ভালভাবেই জানেন।” (সূরা তাওবা: ৪৬-৪৭)
وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا غُرُورًا ﴿الأحزاب: ١٢﴾ وَإِذْ قَالَت طَّائِفَةٌ مِّنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوا وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِن يُرِيدُونَ إِلَّا فِرَارًا ﴿الأحزاب: ١٣﴾ وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَيْهِم مِّنْ أَقْطَارِهَا ثُمَّ سُئِلُوا الْفِتْنَةَ لَآتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوا بِهَا إِلَّا يَسِيرًا ﴿الأحزاب: ١٤﴾
“এবং যখন মুনাফিক ও যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা বলছিল, আমাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহ ও রসূলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা বৈ নয়। এবং যখন তাদের একদল বলেছিল, হে ইয়াসরেববাসী, এটা টিকবার মত জায়গা নয়, তোমরা ফিরে চল। তাদেরই একদল নবীর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলেছিল, আমাদের বাড়ী-ঘর খালি, অথচ সেগুলো খালি ছিল না, পলায়ন করাই ছিল তাদের ইচ্ছা। যদি শত্রুপক্ষ চতুর্দিক থেকে নগরে প্রবেশ করে তাদের সাথে মিলিত হত, অতঃপর বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করত, তবে তারা অবশ্যই বিদ্রোহ করত এবং তারা মোটেই বিলম্ব করত না।” (সূরা আহযাব: ১২-১৪)
অতএব, আমরা মনে করি, তাওহীদ ও ইসলামী আকীদার জন্য মারাত্মক হুমকি এবং এ যুগের সবচেয়ে বড় ফেতনা হলো, আল-ওয়ালা ওয়াল-বারার আকীদা থেকে সরে যাওয়া। অর্থাৎ মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ এবং কাফেরদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করার নীতি থেকে সরে যাওয়ার ফেতনা। তাই মুসলিম উম্মাহর প্রতি ইয়াহুদী জায়নবাদী ও মার্কিন ক্রুসেড আক্রমণের মোকাবেলায়, আল্লাহর ইচ্ছায় যে সাহায্যপ্রাপ্ত জিহাদ ও বরকতময় প্রতিরোধ আন্দোলন চলছে, সে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে এ কয়েক পৃষ্ঠা লেখার মনস্থ করেছি।
আর বিষয়টিকে আমরা দু’টি অনুচ্ছেদ ও একটি উপসংহারে বিন্যস্ত করেছি।
প্রথম অনুচ্ছেদ: ইসলামে আল-ওয়ালা ওয়াল-বারার রোকনসমূহ।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ: আল-ওয়ালা ওয়াল-বারার আকীদা থেকে সরে যাওয়ার ধরনসমূহ।
উপসংহার: যেসব বিষয়ে আমরা গুরুত্বারোপ করতে চাই।
এ আলোচনায় যা কিছু কল্যাণকর, তা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার তাওফীকেই হয়েছে। আর যা কিছু এর বিপরীত, তা আমাদের ও শয়তানের পক্ষ থেকে হয়েছে।
وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ ﴿هود: ٨٨﴾
“আল্লাহর মদদ দ্বারাই কিন্তু কাজ হয়ে থাকে, আমি তাঁর উপরই নির্ভর করি এবং তাঁরই প্রতি ফিরে যাই।” (সূরা হুদ: ৮৮)
------------------------------------------------------
আবু মুহাম্মাদ আইমান আয-যাওয়াহিরী
শাওয়াল ১৪২৩
শাওয়াল ১৪২৩
Comment