khlf.jpg
[ পেনফিল্ড পাবলিকেশনের সম্পাদক মাহমুদ সিদ্দিকি এর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত ]
ইতিহাস দিয়ে শরীয়াহ মাপা যায় না;
ইতিহাসকে মাপতে হয় শরীয়াহ দিয়ে।
পরিচিত অনলাইন একটিভিস্ট, লেখক আরিফুল ইসলাম সম্প্রতি একটি পোস্ট দিয়েছেন (ফেসবুকে)। পুরো পোস্টে একটি উপসংহার টেনেছেন এবং একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তার লিখিত উপসংহার ও প্রশ্ন-সংক্রান্ত বাক্যদুটি উদ্ধৃত করছি।
১. “খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।” [উপসংহার]
২. “খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট কোনো আয়াত আছে? এটার বিধান ফরজ, ওয়াজিব প্রমাণ করা যায় এমন কোনো আয়াত-হাদীস? কিংবা এর ফযিলত নিয়ে একটা মাত্র হাদীস?” [প্রশ্ন]
ইসলামে খিলাফতের কনসেপ্ট কী, খিলাফত প্রতিষ্ঠার হুকুম কী—এই আলোচনা আমার লেখার পয়েন্ট না; বরং আরিফুল ইসলামের বক্তব্যের সমস্যার ধরন বুঝতে অন্য আলাপ করি।
“খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা”—বক্তব্যটা অর্ধসত্য; আরও রাখঢাক ছাড়া বললে—অসত্য। বাক্যটা হওয়া উচিৎ এমন—“খিলাফত নবীজির শাসন ও নির্দেশনার আলোকে সাহাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।” আবিষ্কার বলা হয়—নতুন কোনোকিছু উদ্ভাবন করা। খিলাফত কি মুসলিমদের উদ্ভাবিত কোনোকিছু? নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক পরিচালিত ও নির্দেশিত শাসনকার্যের বিস্তৃত রূপ?
খিলাফতের সূচনা হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে। খিলাফতে রাশেদার সকল খলিফার মূল কাজ, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি, ইসলামী খিলাফতে বসবাসরত কাফিরদের সম্পর্কিত নীতি—সবকিছুই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি, নির্দেশনা ও কর্মের আলোকে। এজন্যই খিলাফতে রাশেদা হলো খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ—অর্থাৎ, নববী নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত খিলাফত। রাষ্ট্রপরিচালনা সংক্রান্ত নবীজির সকল আমল এখানে মূল বেইজ ও ফাউন্ডেশন। এর ওপর তার নির্দেশনার আলোকে খিলাফতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুতরাং, খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত কোনো ব্যবস্থা না, বরং নববী কর্ম ও নির্দেশনার আলোকে বাস্তবায়িত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
এখন কথা হলো—যে-শাসনব্যবস্থা ‘মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়িত’, তা আমাদের জন্য জরুরি ও প্রয়োজনীয় কেন?
এটা বুঝতে শরীয়ার সহজ তিনটি মূলনীতি মাথায় রাখতে হবে।
১. সাহাবিদের সর্বসম্মত আমল শরীয়ার হুজ্জত বা দলিল। সকল মুসলমানের জন্য তা মানা আবশ্যক।
২. কোনো সাহাবি যদি সকলের সম্মুখে কিছু বলেন বা কোনো আমল করেন বা কোনো বিধান বাস্তবায়ন করেন, এবং অন্য সাহাবিরা এর বিরোধিতা না করে প্রকাশ্য বা মৌন সমর্থন করেন—এর অর্থ হলো—বিষয়টি শরীয়া কর্তৃক সমর্থিত; এবং এই বক্তব্য, কর্ম ও বিধান মানা সকল মুসলমানের জন্য আবশ্যক।
৩. যেসকল বিষয়ে সাহাবিদের নিজেদের মনমতো কিছু বলার বা করার সুযোগ নেই, এমন বিষয়ে যদি কোনোকিছু বলেন বা করেন, তাহলে সেসব কাজ ও বক্তব্যকে নবীজি কর্তৃক নির্দেশিত গণ্য করা আবশ্যক। কারণ, শরীয়ার কোনো বিষয়ে কোনো সাহাবির পক্ষে মনগড়া কথা বলা বা কাজ করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা, বক্তব্য বা আমল পেয়েছেন। সুতরাং তার এই কথা বা কাজও দলিল হিসেবে গণ্য হবে। যা মানা মুসলিমদের জন্য আবশ্যক।
আগ্রহী পাঠকগণ এই তিনটি মূলনীতির আলোচনা উসূলুল ফিকহ ও উসূলুল হাদিসের গ্রন্থাবলিতে সবিস্তারে পেয়ে যাবেন।
এবার আমরা দেখি—
১. খিলাফতকে শারয়ী শাসনব্যবস্থা হিসেবে কি সকল সাহাবি মেনে নিয়েছিলেন? এটি কি সর্বসম্মত আমল?
=> সিরাত ও ইতিহাস সাক্ষী, সকল সাহাবি খিলাফতকে সর্বসম্মতভাবে শারয়ী শাসনব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।
২. খুলাফায়ে রাশিদিন লাখ-লাখ সাহাবির উপস্থিতিতে এই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। কখনো কোনো সাহাবি কি খিলাফতব্যবস্থা নিয়ে আপত্তি করেছিলেন?
=> করেননি। সিরাত ও ইতিহাসের কোথাও এমন কোনো প্রমাণ নেই—যাতে কোনো একজন সাহাবির খিলাফতব্যবস্থার প্রতি আপত্তি, বিরক্তি, উষ্মা কিংবা বিরোধিতা পাওয়া যাবে। বরং কথা ও কাজে সকলেই এর সমর্থন করেছেন।
৩. নবীজির ইন্তেকালের পর শাসনব্যবস্থা কী হবে—এটি কি নববী নির্দেশনা ব্যতীত সাহাবিদের নিজেদের মনমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল?
=> ছিল না। বরং এর পিছনে নবীজির সামগ্রিক নির্দেশনা প্রয়োজন ছিল। যা খলিফা নির্ধারণের ঘটনায় হযরত উমর, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সহ অন্য সাহাবিদের কার্যক্রম ও মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়। শাসনব্যবস্থা খিলাফত হবে—এটুকু নিয়ে সাহাবিদের কোনো কথা ছিল না। খলিফা কে হবেন—পরামর্শটা এ নিয়েই হয়েছিল। সকলে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মেনে নেওয়ার অন্যতম কারণও এটা ছিল—তিনি নবীজির সবচেয়ে কাছের মানুষ। নবীজির কথা, কাজ, চিন্তা, দর্শন ও নির্দেশনার আলোকে খিলাফত পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি।
উপরোক্ত মূলনীতি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়—খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়; বরং নবীজির শাসন পরিচালনা ও নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা হলো—খিলাফতব্যবস্থা। অর্থাৎ, শরীয়া কর্তৃক নির্দেশিত এবং ‘মানুষ’ কর্তৃক বাস্তবায়িত শাসনব্যবস্থা হলো খিলাফত।
এবার আসুন দেখি, খিলাফত 'আবিষ্কারকারী' এবং প্রকৃতপক্ষে খিলাফত বাস্তবায়নকারী এই মানুষগুলো কারা? তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের বক্তব্য কী?
* কুরআন বলেছে—“তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” [সূরা তাওবাহ : ১০০]
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—“আমি আমার সাহাবাদের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। যখন আমি চলে যাব, তখন আমার সাহাবিদের ওপর প্রতিশ্রুত ফিতনা ও বিপদাপদের আগমন ঘটবে। আমার সাহাবিরা আমার উম্মাতের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। যখন আমার সাহাবিদের প্রস্থান ঘটবে, তখন আমার উম্মাতের ওপর প্রতিশ্রুত ফিতনা ও বিপদাপদের আগমন ঘটবে।” [সহিহ মুসলিম : ২৫৩১]
* “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম প্রজন্ম হলো আমার প্রজন্ম।” [সহিহ বুখারী : ২৬৫১]
* মুক্তিপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে নবীজি বলেছেন—“মুক্তিপ্রাপ্ত দল হলো তারা—যারা আমার ও আমার সাহাবিদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করবে।” [সুনানুত তিরমিযী : ২৬৪১]
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে—খিলাফতব্যবস্থা বাস্তবায়নকারীগণ শুধু ‘মানুষ’ বলে জেনারেলাইজেশন করার মতো সাধারণ ক্যাটাগরির মানুষ নন; বরং তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক পৃথিবীতে দ্বীন ও শরীয়া বাস্তবায়নের জন্য সার্টিফাইড মানুষ। মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলার অর্থ হলো—খিলাফতকে শরীয়া থেকে আলাদা করে দেওয়া। অথচ, খিলাফতব্যবস্থা শরীয়ার শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত অংশ।
এবার আসি এই কথার সম্পূরক অংশে— খিলাফত পুনরুদ্ধার বা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ও চিন্তা কি আমাদের জন্য আবশ্যক?
উত্তর হলো—হ্যাঁ, আবশ্যক। তিন কারণে।
১. খিলাফত শরীয়ার অংশ।
২. খুলাফায়ে রাশিদিনকে অনুসরণ করা দ্বীনের অংশ।
৩. কোনো ফরজ বিধান বাস্তবায়ন যার ওপর নির্ভরশীল, তাও ফরজ।
প্রথম কারণের ব্যাখ্যা ওপরের মূলনীতিগুলোর অধীনে চলে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, যথাযথভাবে দ্বীন পালনের জন্য সাহাবিদেরকে অনুসরণ করা আবশ্যক। দ্বীন পালনের প্রায়োগিক উদাহরণ হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের মধ্যে বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদিনকে অনুসরণ করা দ্বীনেরই অংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—“তোমরা আমার আদর্শ ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ অনুসরণ করো। এই দুই আদর্শকে তোমরা দাঁত কামড়ে আঁকড়ে ধরো।” [সুনানু আবি দাউদ : ৪৬০৭; সুনানুত তিরমিযী : ২৬৭৬]
এই হাদিসের আলোকে স্পষ্ট যে—অনুসরণের বিচারে রাসূলের আদর্শের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ সমান গুরুত্ব পাবে। বলাবাহুল্য—খুলাফায়ে রাশিদিনের প্রথম আদর্শই হলো খিলাফতব্যবস্থা। এই হাদিসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি নবীজি বলে দিয়েছেন—খিলাফতব্যবস্থা ও শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত যে-কোনো বিষয়ে খিলাফতে রাশেদা হবে মূল সোর্স ও অনুসরণীয় দলিল। এই সংক্রান্ত যে-কোনো বিষয়ে তাদের অনুসরণ করা ফরজ।
তৃতীয়ত, শরীয়ার মূলনীতি হলো—কোনো বিধান পালন/বাস্তবায়ন যার ওপর নির্ভরশীল, তাও ফরজ। যেমন, নামাজের জন্য ওজু আবশ্যক; তাই ওজুও ফরজ। হুদুদ-কিসাস সহ কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য বহু বিধান বাস্তবায়নের জন্য খিলাফত আবশ্যক। এজন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠা করাও ফরজের অন্তর্ভুক্ত।
এই তিন পয়েন্টের আলোকে বোঝা যায়, খিলাফত প্রতিষ্ঠা, পুনরুদ্ধার, বাস্তবায়ন—যে-শব্দেই বলা হোক—ফরজ। ফরজে আইন নাকি ফরজে কিফায়া, কতটুকু হলে ফরজে কিফায়া আদায় হবে না হবে—এসব প্রসঙ্গ আলাদা আলোচ্যবিষয়।
এবার আসি আরিফুল ইসলামের প্রশ্নের প্রসঙ্গে।
তার প্রশ্ন—“খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট কোনো আয়াত আছে? এটার বিধান ফরজ, ওয়াজিব প্রমাণ করা যায় এমন কোনো আয়াত-হাদীস? কিংবা এর ফযিলত নিয়ে একটা মাত্র হাদীস?”
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে জানতে হবে—কুরআন-হাদিসের টেক্সটগুলো অনেক ধরনের হয়। আম, খাস, নস, যাহির, মুফাসসার, মুবাইয়ান, খফি, মুজমাল, মুতাশাবিহ, মুশকিল, সরিহ, কিনায়া, ইত্যাদি। নসের দলিল আবার হয় নানা ধরনের। কোনোটা সরাসরি, কোনোটা প্রাসঙ্গিক, কোনোটা সংক্ষিপ্ত, কোনোটা সামগ্রিক। মূলত কুরআন-সুন্নাহতে শরীয়ার সকল দলিল ও বিবরণ বিস্তারিত থাকে না; অধিকাংশই থাকে ইজমালী ও উসূলী—মৌলিক ও সামগ্রিক আঙ্গিকে। কুরআন-হাদিসের কোনো টেক্সটেই কোনো আমলকে ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নাত বলা নেই। “নামাজ ফরজ”—এভাবে কুরআন-হাদিসের টেক্সট হয় না। কুরআন-হাদিসের টেক্সট বলবে—“নামাজ পড়ো/নামাজ কায়েম করো।” উসূলুল ফিকহ, উসূলুল হাদিস ও উলূমুল কুরআনের নীতিমালার আলোকে এসব টেক্সটের শব্দের মান ও নির্দেশের আবশ্যকতা-অনাবশ্যকতা, বাধ্যবাধকতা-শিথিলতা, ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়। এক্ষেত্রে নবীজি ও সাহাবিদের আমল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং কুরআন-হাদিসের কোনো টেক্সট কখনো একথা বলবে না—খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরজ, ওয়াজিব নাকি মুবাহ? কারণ, এভাবে বলা ইজমালী ও উসূলি তথা মৌলিক ও সামগ্রিক নীতির পরিপন্থি।
তাহলে কুরআন-সুন্নাহ কী বলবে?
কুরআন-সুন্নাহ বলবে—“হুকম বিমা আনযালাল্লাহ বা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” কুরআনে অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। এর বিপরীতে আল্লাহর আইন ভিন্ন অন্য আইন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি সংক্রান্তও একাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে। আয়াত-হাদিসের ফিরিস্তি দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানো থেকে বিরত রইলাম। আজকাল একটু কষ্ট করে গুগল করলেই এই সংক্রান্ত সবগুলো আয়াত-হাদিস পাওয়া যায়। হাদিসের কিতাবগুলোর “কিতাবুল ইমারাহ” পড়লেও অনেক মৌলিক কথাবার্তা পাওয়া যায়। খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরজ নাকি ওয়াজিব, কার জন্য কখন ফরজ, কখন ফরজ নয়—এসব বিধান সংশ্লিষ্ট আয়াত-হাদিস ও সাহাবিদের আমল থেকে শাস্ত্রীয় নীতিমালার আলোকে ফকিহ ও স্কলারগণ উদঘাটন করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো—‘হুকম বিমা আনযালাল্লাহ’ সংক্রান্ত আয়াত-হাদিস থেকে খিলাফত কি প্রমাণিত হয়?
শরীয়াতের যে-কোনো বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে দেখতে হয়—নবী ও সাহাবি-যুগে কীভাবে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এতক্ষণের আলোচনা ও সিরাত-ইতিহাসের আলোকে আমি একটু প্রশ্ন রাখি—সাহাবি-যুগে ‘হুকম বিমা আনযালাল্লাহ’ বা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? খিলাফতব্যবস্থা নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে?
সাহাবিদের প্রয়োগকৃত পদ্ধতি ও তাদের সম্পর্কে নবীজির অগ্রিম সনদ থেকে প্রমাণিত হয়—হুকম বিমা আনযালাল্লাহর প্রকৃত রূপ ও পদ্ধতি হলো—খিলাফতব্যবস্থা।
প্রসঙ্গত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে রাখি,
শুধু খিলাফতব্যবস্থাই নয়; শরীয়ার বহু বিধানের ক্ষেত্রেই ‘তাআমুল’ মুতাওয়াতির পর্যায়ের দলিল হতে পারে। তাআমুল মানে হলো—কোনো বিষয়ে কুরআন-হাদিসের সরাসরি টেক্সটের পাশাপাশি তো বটেই, কখনো-কখনো সরাসরি টেক্সট না থাকলেও নবীজি ও সাহাবি-যুগ থেকে, অথবা শুধু সাহাবি-যুগ থেকে কোনো একটি আমলের পরম্পরা জারি থাকা। সাহাবিদের অনাপত্তির শর্তে এই তাআমুল শরীয়ার দলিল হওয়ার উপযুক্ত। এর অর্থ হলো—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে এই আমলের নির্দেশনা বা ধারাবাহিকতা শিখে তারা বাস্তবায়ন করছেন।
খিলাফতব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই মূলনীতি প্রযোজ্য। আল্লাহর জমিনে নবীজি কর্তৃক আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের প্রায়োগিক রূপ ও নির্দেশনা মোতাবেক খিলাফতে রাশেদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে এই খেলাফতের তাআমুল বা আমলের ধারাবাহিকতা চালু থাকে। খিলাফতে রাশেদা একমাত্র খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ, অন্যগুলো নয়—এই আলাপ ভিন্ন প্রসঙ্গ। সময় যত গড়িয়েছে, নববী নির্দেশনা থেকে দূরত্ব বেড়েছে; কিন্তু, শত দুর্বলতা ও নীতিভঙ্গ সহকারেও সুদীর্ঘকাল ইসলামী খিলাফতের তাআমুল বা ধারাবাহিকতা চলমান থেকেছে। এজন্য সর্বকালে সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যক হলো—শাসনব্যবস্থাকে খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ বা নববী নির্দেশনার আলোকে গড়ে তোলা। দূরত্ব থাকলে, যতটা সম্ভব এই দূরত্ব কমিয়ে খিলাফতে রাশেদার নিকটবর্তী করা।
শেষ করি।
আরিফুল ইসলাম ইতিহাস থেকে বেশকিছু অগোছালো প্রসঙ্গকে গুছিয়ে দলিল বানানোর চেষ্টা করেছেন। স্মরণ রাখা জরুরি—ইতিহাস দিয়ে শরীয়া মাপা যায় না; ইতিহাসকে মাপতে হয় শরীয়া দিয়ে। ইতিহাস এমন এক বিস্তৃত ও উন্মুক্ত জায়গা, যেখানে চাইলে যে-কোনো বিষয়ের পক্ষে দলিল বের করা সম্ভব। এজন্য ইতিহাস কখনো শরীয়ার দলিল হয় না। ইতিহাস বলে—সময়ের সাথে-সাথে ইসলামী খিলাফতগুলোতেও নববী নির্দেশনা থেকে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বে বিভিন্ন রকম পাওয়ার ডায়নামিকস তৈরি হয়েছে। ফলে, এই দূরত্ব তৈরি হওয়া ইসলামী খিলাফতগুলোকে সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্কলারদের পক্ষ থেকে ইসলামী শাসন সম্পর্কে নানা প্রস্তাবনা ও বক্তব্য এসেছে, লিটারেচার তৈরি হয়েছে। মোটাদাগে বড় অংশের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটিই—মিনহাজিন নুবুওয়াহ থেকে চলমান শাসনের দূরত্ব কতটা ঘুচানো যায়। পেনফিল্ড পাবলিকেশন থেকে ঐতিহাসিক মুসলিম স্কলারদের রাজনৈতিক ও শাসন-ভাবনা ও ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ সংক্রান্ত একটি বইয়ের কাজও পরিকল্পনা চলছে। এই আলোচনা-পর্যালোচনা থাকবে; এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো—প্রকৃত খিলাফতব্যবস্থার কাছাকাছি যাওয়া। খিলাফতকে প্রত্যাখ্যান করা নয়।
এখন প্রশ্ন হলো—স্কলারদের মধ্যে এই মতপার্থক্য কেন?
ইসলামের সকল বিধানের মতোই, খিলাফতব্যবস্থার কিছু অংশ কুরআন-সুন্নাহর টেক্সটের আলোকে অকাট্য, আর কিছু অংশ ইজতিহাদ-নির্ভর। খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে—এটুকু কথা মৌলিক ও মীমাংসিত। তবে, এর প্রায়োগিক যেসব রূপ ও সমাধান সাহাবা-যুগে পাওয়া যায় না, সেগুলোর অধিকাংশই ইজতিহাদ-নির্ভর। এই ইজতিহাদ-নির্ভর অংশে মতপার্থক্য ও ইখতিলাফের সুযোগ ইসলামই রেখে দিয়েছে। মৌলিক অংশে দ্বিমত নেই।
লেখার মূলকথা দুটি।
১. পৃথিবীতে 'হুকম বিমা আনযালাল্লাহ' করা ফরজ।
২. 'হুকম বিমা আনযালাল্লাহ'র প্র্যাকটিকেল রূপ হলো খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ। যার মডেল নববী নির্দেশনার আলোকে খুলাফায়ে রাশিদিন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
চলমান আলোচনায় যারা রূপরেখা নিয়ে কনসার্ন দেখাচ্ছেন, তারাও খিলাফত প্রতিষ্ঠার আবশ্যকীয়তা নিয়ে দ্বিমত রাখার কথা না; অথবা এভাবে বলা যায়—এখানে দ্বিমতের সুযোগ নেই।
খিলাফতের রূপরেখা কী হবে—এটা বুঝতে হবে খিলাফতে রাশেদার কর্মপ্রক্রিয়া দেখে। হুকম বিমা আনযালাল্লাহর আয়াত, কুতুবুল হাদিস থেকে কিতাবুল ইমারাহর হাদিস, খিলাফতে রাশেদার প্র্যাকটিকেল আমল—এর আলোকে ফকিহগণ রূপরেখা নির্ধারণ করবেন। করেছেনও। যেহেতু রূপরেখার সকল অংশ কতয়ী বা অকাট্য টেক্সট না, বরং উল্লেখযোগ্য অংশ ইজতিহাদি—সেহেতু বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইখতিলাফ থাকবে। অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। যেখানেই ইজতিহাদের সুযোগ আছে, সেখানেই ইখতিলাফ থাকবে। এজন্যই খিলাফতের রূপরেখা সংক্রান্ত বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইমামদের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
রূপরেখার বিভিন্নতার দোহাই দিয়ে খিলাফতকেই অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা ও আলোচনাগুলো দুঃখজনক। আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিল রূপরেখা কী হবে, এ নিয়ে। সালাফদের প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্তগুলো কী ছিল, ইতিহাসের মুসলিম সালতানাতগুলো কতটুকু কী করেছে, বর্তমানে এই ইজতিহাদি রূপরেখা ও প্রস্তাবনাগুলোর কত শতাংশ ফিজিবল, কত শতাংশ ইজতিহাদের নতুন করে তাতবিক দেওয়ার প্রয়োজন আছে, কীভাবে আমরা মিনহাজিন নুবুওয়ার নিকটবর্তী হতে পারি—এ নিয়ে। কিন্তু, রূপরেখার আশ্রয় করে আলোচনা হচ্ছে—খিলাফত প্রয়োজন আছে কি না, প্রাসঙ্গিক কি না, আদৌ খিলাফত ছিল কি না—এ নিয়ে।
আবারও বলি, রূপরেখার সকল অংশ অকাট্য নস না; বরং বিভিন্ন নুসুসের আলোকে ইজতিহাদি অংশের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। আলোচনা হওয়া উচিৎ এসব নিয়ে। যদিও এই আলোচনার জন্য ফেইসবুক পোস্ট বা ছোট-ছোট লেখা যথেষ্ট না। স্বতন্ত্র বই প্রয়োজন। যোগ্য আলিমরা আশা করি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন।
রূপরেখা নিয়ে দালিলিক ও যৌক্তিক উপায়ে দ্বিমত করুন, সমস্যা নেই। অন্তত মূল পয়েন্টটাতে একমত হোন—খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়ার মাধ্যমে হুকম বিমা আনযালাল্লাহ বাস্তবায়ন করা ফরজ।
[ পেনফিল্ড পাবলিকেশনের সম্পাদক মাহমুদ সিদ্দিকি এর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত ]
ইতিহাস দিয়ে শরীয়াহ মাপা যায় না;
ইতিহাসকে মাপতে হয় শরীয়াহ দিয়ে।
পরিচিত অনলাইন একটিভিস্ট, লেখক আরিফুল ইসলাম সম্প্রতি একটি পোস্ট দিয়েছেন (ফেসবুকে)। পুরো পোস্টে একটি উপসংহার টেনেছেন এবং একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তার লিখিত উপসংহার ও প্রশ্ন-সংক্রান্ত বাক্যদুটি উদ্ধৃত করছি।
১. “খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।” [উপসংহার]
২. “খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট কোনো আয়াত আছে? এটার বিধান ফরজ, ওয়াজিব প্রমাণ করা যায় এমন কোনো আয়াত-হাদীস? কিংবা এর ফযিলত নিয়ে একটা মাত্র হাদীস?” [প্রশ্ন]
ইসলামে খিলাফতের কনসেপ্ট কী, খিলাফত প্রতিষ্ঠার হুকুম কী—এই আলোচনা আমার লেখার পয়েন্ট না; বরং আরিফুল ইসলামের বক্তব্যের সমস্যার ধরন বুঝতে অন্য আলাপ করি।
“খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা”—বক্তব্যটা অর্ধসত্য; আরও রাখঢাক ছাড়া বললে—অসত্য। বাক্যটা হওয়া উচিৎ এমন—“খিলাফত নবীজির শাসন ও নির্দেশনার আলোকে সাহাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।” আবিষ্কার বলা হয়—নতুন কোনোকিছু উদ্ভাবন করা। খিলাফত কি মুসলিমদের উদ্ভাবিত কোনোকিছু? নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক পরিচালিত ও নির্দেশিত শাসনকার্যের বিস্তৃত রূপ?
খিলাফতের সূচনা হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে। খিলাফতে রাশেদার সকল খলিফার মূল কাজ, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি, ইসলামী খিলাফতে বসবাসরত কাফিরদের সম্পর্কিত নীতি—সবকিছুই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি, নির্দেশনা ও কর্মের আলোকে। এজন্যই খিলাফতে রাশেদা হলো খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ—অর্থাৎ, নববী নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত খিলাফত। রাষ্ট্রপরিচালনা সংক্রান্ত নবীজির সকল আমল এখানে মূল বেইজ ও ফাউন্ডেশন। এর ওপর তার নির্দেশনার আলোকে খিলাফতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুতরাং, খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত কোনো ব্যবস্থা না, বরং নববী কর্ম ও নির্দেশনার আলোকে বাস্তবায়িত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
এখন কথা হলো—যে-শাসনব্যবস্থা ‘মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়িত’, তা আমাদের জন্য জরুরি ও প্রয়োজনীয় কেন?
এটা বুঝতে শরীয়ার সহজ তিনটি মূলনীতি মাথায় রাখতে হবে।
১. সাহাবিদের সর্বসম্মত আমল শরীয়ার হুজ্জত বা দলিল। সকল মুসলমানের জন্য তা মানা আবশ্যক।
২. কোনো সাহাবি যদি সকলের সম্মুখে কিছু বলেন বা কোনো আমল করেন বা কোনো বিধান বাস্তবায়ন করেন, এবং অন্য সাহাবিরা এর বিরোধিতা না করে প্রকাশ্য বা মৌন সমর্থন করেন—এর অর্থ হলো—বিষয়টি শরীয়া কর্তৃক সমর্থিত; এবং এই বক্তব্য, কর্ম ও বিধান মানা সকল মুসলমানের জন্য আবশ্যক।
৩. যেসকল বিষয়ে সাহাবিদের নিজেদের মনমতো কিছু বলার বা করার সুযোগ নেই, এমন বিষয়ে যদি কোনোকিছু বলেন বা করেন, তাহলে সেসব কাজ ও বক্তব্যকে নবীজি কর্তৃক নির্দেশিত গণ্য করা আবশ্যক। কারণ, শরীয়ার কোনো বিষয়ে কোনো সাহাবির পক্ষে মনগড়া কথা বলা বা কাজ করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা, বক্তব্য বা আমল পেয়েছেন। সুতরাং তার এই কথা বা কাজও দলিল হিসেবে গণ্য হবে। যা মানা মুসলিমদের জন্য আবশ্যক।
আগ্রহী পাঠকগণ এই তিনটি মূলনীতির আলোচনা উসূলুল ফিকহ ও উসূলুল হাদিসের গ্রন্থাবলিতে সবিস্তারে পেয়ে যাবেন।
এবার আমরা দেখি—
১. খিলাফতকে শারয়ী শাসনব্যবস্থা হিসেবে কি সকল সাহাবি মেনে নিয়েছিলেন? এটি কি সর্বসম্মত আমল?
=> সিরাত ও ইতিহাস সাক্ষী, সকল সাহাবি খিলাফতকে সর্বসম্মতভাবে শারয়ী শাসনব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।
২. খুলাফায়ে রাশিদিন লাখ-লাখ সাহাবির উপস্থিতিতে এই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। কখনো কোনো সাহাবি কি খিলাফতব্যবস্থা নিয়ে আপত্তি করেছিলেন?
=> করেননি। সিরাত ও ইতিহাসের কোথাও এমন কোনো প্রমাণ নেই—যাতে কোনো একজন সাহাবির খিলাফতব্যবস্থার প্রতি আপত্তি, বিরক্তি, উষ্মা কিংবা বিরোধিতা পাওয়া যাবে। বরং কথা ও কাজে সকলেই এর সমর্থন করেছেন।
৩. নবীজির ইন্তেকালের পর শাসনব্যবস্থা কী হবে—এটি কি নববী নির্দেশনা ব্যতীত সাহাবিদের নিজেদের মনমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল?
=> ছিল না। বরং এর পিছনে নবীজির সামগ্রিক নির্দেশনা প্রয়োজন ছিল। যা খলিফা নির্ধারণের ঘটনায় হযরত উমর, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সহ অন্য সাহাবিদের কার্যক্রম ও মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়। শাসনব্যবস্থা খিলাফত হবে—এটুকু নিয়ে সাহাবিদের কোনো কথা ছিল না। খলিফা কে হবেন—পরামর্শটা এ নিয়েই হয়েছিল। সকলে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মেনে নেওয়ার অন্যতম কারণও এটা ছিল—তিনি নবীজির সবচেয়ে কাছের মানুষ। নবীজির কথা, কাজ, চিন্তা, দর্শন ও নির্দেশনার আলোকে খিলাফত পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি।
উপরোক্ত মূলনীতি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়—খিলাফত মানুষের আবিষ্কৃত কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়; বরং নবীজির শাসন পরিচালনা ও নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা হলো—খিলাফতব্যবস্থা। অর্থাৎ, শরীয়া কর্তৃক নির্দেশিত এবং ‘মানুষ’ কর্তৃক বাস্তবায়িত শাসনব্যবস্থা হলো খিলাফত।
এবার আসুন দেখি, খিলাফত 'আবিষ্কারকারী' এবং প্রকৃতপক্ষে খিলাফত বাস্তবায়নকারী এই মানুষগুলো কারা? তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের বক্তব্য কী?
* কুরআন বলেছে—“তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” [সূরা তাওবাহ : ১০০]
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—“আমি আমার সাহাবাদের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। যখন আমি চলে যাব, তখন আমার সাহাবিদের ওপর প্রতিশ্রুত ফিতনা ও বিপদাপদের আগমন ঘটবে। আমার সাহাবিরা আমার উম্মাতের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। যখন আমার সাহাবিদের প্রস্থান ঘটবে, তখন আমার উম্মাতের ওপর প্রতিশ্রুত ফিতনা ও বিপদাপদের আগমন ঘটবে।” [সহিহ মুসলিম : ২৫৩১]
* “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম প্রজন্ম হলো আমার প্রজন্ম।” [সহিহ বুখারী : ২৬৫১]
* মুক্তিপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে নবীজি বলেছেন—“মুক্তিপ্রাপ্ত দল হলো তারা—যারা আমার ও আমার সাহাবিদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করবে।” [সুনানুত তিরমিযী : ২৬৪১]
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে—খিলাফতব্যবস্থা বাস্তবায়নকারীগণ শুধু ‘মানুষ’ বলে জেনারেলাইজেশন করার মতো সাধারণ ক্যাটাগরির মানুষ নন; বরং তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক পৃথিবীতে দ্বীন ও শরীয়া বাস্তবায়নের জন্য সার্টিফাইড মানুষ। মানুষের আবিষ্কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলার অর্থ হলো—খিলাফতকে শরীয়া থেকে আলাদা করে দেওয়া। অথচ, খিলাফতব্যবস্থা শরীয়ার শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত অংশ।
এবার আসি এই কথার সম্পূরক অংশে— খিলাফত পুনরুদ্ধার বা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ও চিন্তা কি আমাদের জন্য আবশ্যক?
উত্তর হলো—হ্যাঁ, আবশ্যক। তিন কারণে।
১. খিলাফত শরীয়ার অংশ।
২. খুলাফায়ে রাশিদিনকে অনুসরণ করা দ্বীনের অংশ।
৩. কোনো ফরজ বিধান বাস্তবায়ন যার ওপর নির্ভরশীল, তাও ফরজ।
প্রথম কারণের ব্যাখ্যা ওপরের মূলনীতিগুলোর অধীনে চলে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, যথাযথভাবে দ্বীন পালনের জন্য সাহাবিদেরকে অনুসরণ করা আবশ্যক। দ্বীন পালনের প্রায়োগিক উদাহরণ হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের মধ্যে বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদিনকে অনুসরণ করা দ্বীনেরই অংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—“তোমরা আমার আদর্শ ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ অনুসরণ করো। এই দুই আদর্শকে তোমরা দাঁত কামড়ে আঁকড়ে ধরো।” [সুনানু আবি দাউদ : ৪৬০৭; সুনানুত তিরমিযী : ২৬৭৬]
এই হাদিসের আলোকে স্পষ্ট যে—অনুসরণের বিচারে রাসূলের আদর্শের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ সমান গুরুত্ব পাবে। বলাবাহুল্য—খুলাফায়ে রাশিদিনের প্রথম আদর্শই হলো খিলাফতব্যবস্থা। এই হাদিসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি নবীজি বলে দিয়েছেন—খিলাফতব্যবস্থা ও শাসন পরিচালনা সংক্রান্ত যে-কোনো বিষয়ে খিলাফতে রাশেদা হবে মূল সোর্স ও অনুসরণীয় দলিল। এই সংক্রান্ত যে-কোনো বিষয়ে তাদের অনুসরণ করা ফরজ।
তৃতীয়ত, শরীয়ার মূলনীতি হলো—কোনো বিধান পালন/বাস্তবায়ন যার ওপর নির্ভরশীল, তাও ফরজ। যেমন, নামাজের জন্য ওজু আবশ্যক; তাই ওজুও ফরজ। হুদুদ-কিসাস সহ কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য বহু বিধান বাস্তবায়নের জন্য খিলাফত আবশ্যক। এজন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠা করাও ফরজের অন্তর্ভুক্ত।
এই তিন পয়েন্টের আলোকে বোঝা যায়, খিলাফত প্রতিষ্ঠা, পুনরুদ্ধার, বাস্তবায়ন—যে-শব্দেই বলা হোক—ফরজ। ফরজে আইন নাকি ফরজে কিফায়া, কতটুকু হলে ফরজে কিফায়া আদায় হবে না হবে—এসব প্রসঙ্গ আলাদা আলোচ্যবিষয়।
এবার আসি আরিফুল ইসলামের প্রশ্নের প্রসঙ্গে।
তার প্রশ্ন—“খিলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট কোনো আয়াত আছে? এটার বিধান ফরজ, ওয়াজিব প্রমাণ করা যায় এমন কোনো আয়াত-হাদীস? কিংবা এর ফযিলত নিয়ে একটা মাত্র হাদীস?”
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে জানতে হবে—কুরআন-হাদিসের টেক্সটগুলো অনেক ধরনের হয়। আম, খাস, নস, যাহির, মুফাসসার, মুবাইয়ান, খফি, মুজমাল, মুতাশাবিহ, মুশকিল, সরিহ, কিনায়া, ইত্যাদি। নসের দলিল আবার হয় নানা ধরনের। কোনোটা সরাসরি, কোনোটা প্রাসঙ্গিক, কোনোটা সংক্ষিপ্ত, কোনোটা সামগ্রিক। মূলত কুরআন-সুন্নাহতে শরীয়ার সকল দলিল ও বিবরণ বিস্তারিত থাকে না; অধিকাংশই থাকে ইজমালী ও উসূলী—মৌলিক ও সামগ্রিক আঙ্গিকে। কুরআন-হাদিসের কোনো টেক্সটেই কোনো আমলকে ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নাত বলা নেই। “নামাজ ফরজ”—এভাবে কুরআন-হাদিসের টেক্সট হয় না। কুরআন-হাদিসের টেক্সট বলবে—“নামাজ পড়ো/নামাজ কায়েম করো।” উসূলুল ফিকহ, উসূলুল হাদিস ও উলূমুল কুরআনের নীতিমালার আলোকে এসব টেক্সটের শব্দের মান ও নির্দেশের আবশ্যকতা-অনাবশ্যকতা, বাধ্যবাধকতা-শিথিলতা, ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়। এক্ষেত্রে নবীজি ও সাহাবিদের আমল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং কুরআন-হাদিসের কোনো টেক্সট কখনো একথা বলবে না—খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরজ, ওয়াজিব নাকি মুবাহ? কারণ, এভাবে বলা ইজমালী ও উসূলি তথা মৌলিক ও সামগ্রিক নীতির পরিপন্থি।
তাহলে কুরআন-সুন্নাহ কী বলবে?
কুরআন-সুন্নাহ বলবে—“হুকম বিমা আনযালাল্লাহ বা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” কুরআনে অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। এর বিপরীতে আল্লাহর আইন ভিন্ন অন্য আইন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি সংক্রান্তও একাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে। আয়াত-হাদিসের ফিরিস্তি দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানো থেকে বিরত রইলাম। আজকাল একটু কষ্ট করে গুগল করলেই এই সংক্রান্ত সবগুলো আয়াত-হাদিস পাওয়া যায়। হাদিসের কিতাবগুলোর “কিতাবুল ইমারাহ” পড়লেও অনেক মৌলিক কথাবার্তা পাওয়া যায়। খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরজ নাকি ওয়াজিব, কার জন্য কখন ফরজ, কখন ফরজ নয়—এসব বিধান সংশ্লিষ্ট আয়াত-হাদিস ও সাহাবিদের আমল থেকে শাস্ত্রীয় নীতিমালার আলোকে ফকিহ ও স্কলারগণ উদঘাটন করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো—‘হুকম বিমা আনযালাল্লাহ’ সংক্রান্ত আয়াত-হাদিস থেকে খিলাফত কি প্রমাণিত হয়?
শরীয়াতের যে-কোনো বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে দেখতে হয়—নবী ও সাহাবি-যুগে কীভাবে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এতক্ষণের আলোচনা ও সিরাত-ইতিহাসের আলোকে আমি একটু প্রশ্ন রাখি—সাহাবি-যুগে ‘হুকম বিমা আনযালাল্লাহ’ বা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? খিলাফতব্যবস্থা নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে?
সাহাবিদের প্রয়োগকৃত পদ্ধতি ও তাদের সম্পর্কে নবীজির অগ্রিম সনদ থেকে প্রমাণিত হয়—হুকম বিমা আনযালাল্লাহর প্রকৃত রূপ ও পদ্ধতি হলো—খিলাফতব্যবস্থা।
প্রসঙ্গত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে রাখি,
শুধু খিলাফতব্যবস্থাই নয়; শরীয়ার বহু বিধানের ক্ষেত্রেই ‘তাআমুল’ মুতাওয়াতির পর্যায়ের দলিল হতে পারে। তাআমুল মানে হলো—কোনো বিষয়ে কুরআন-হাদিসের সরাসরি টেক্সটের পাশাপাশি তো বটেই, কখনো-কখনো সরাসরি টেক্সট না থাকলেও নবীজি ও সাহাবি-যুগ থেকে, অথবা শুধু সাহাবি-যুগ থেকে কোনো একটি আমলের পরম্পরা জারি থাকা। সাহাবিদের অনাপত্তির শর্তে এই তাআমুল শরীয়ার দলিল হওয়ার উপযুক্ত। এর অর্থ হলো—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে এই আমলের নির্দেশনা বা ধারাবাহিকতা শিখে তারা বাস্তবায়ন করছেন।
খিলাফতব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই মূলনীতি প্রযোজ্য। আল্লাহর জমিনে নবীজি কর্তৃক আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের প্রায়োগিক রূপ ও নির্দেশনা মোতাবেক খিলাফতে রাশেদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে এই খেলাফতের তাআমুল বা আমলের ধারাবাহিকতা চালু থাকে। খিলাফতে রাশেদা একমাত্র খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ, অন্যগুলো নয়—এই আলাপ ভিন্ন প্রসঙ্গ। সময় যত গড়িয়েছে, নববী নির্দেশনা থেকে দূরত্ব বেড়েছে; কিন্তু, শত দুর্বলতা ও নীতিভঙ্গ সহকারেও সুদীর্ঘকাল ইসলামী খিলাফতের তাআমুল বা ধারাবাহিকতা চলমান থেকেছে। এজন্য সর্বকালে সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যক হলো—শাসনব্যবস্থাকে খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ বা নববী নির্দেশনার আলোকে গড়ে তোলা। দূরত্ব থাকলে, যতটা সম্ভব এই দূরত্ব কমিয়ে খিলাফতে রাশেদার নিকটবর্তী করা।
শেষ করি।
আরিফুল ইসলাম ইতিহাস থেকে বেশকিছু অগোছালো প্রসঙ্গকে গুছিয়ে দলিল বানানোর চেষ্টা করেছেন। স্মরণ রাখা জরুরি—ইতিহাস দিয়ে শরীয়া মাপা যায় না; ইতিহাসকে মাপতে হয় শরীয়া দিয়ে। ইতিহাস এমন এক বিস্তৃত ও উন্মুক্ত জায়গা, যেখানে চাইলে যে-কোনো বিষয়ের পক্ষে দলিল বের করা সম্ভব। এজন্য ইতিহাস কখনো শরীয়ার দলিল হয় না। ইতিহাস বলে—সময়ের সাথে-সাথে ইসলামী খিলাফতগুলোতেও নববী নির্দেশনা থেকে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বে বিভিন্ন রকম পাওয়ার ডায়নামিকস তৈরি হয়েছে। ফলে, এই দূরত্ব তৈরি হওয়া ইসলামী খিলাফতগুলোকে সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্কলারদের পক্ষ থেকে ইসলামী শাসন সম্পর্কে নানা প্রস্তাবনা ও বক্তব্য এসেছে, লিটারেচার তৈরি হয়েছে। মোটাদাগে বড় অংশের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটিই—মিনহাজিন নুবুওয়াহ থেকে চলমান শাসনের দূরত্ব কতটা ঘুচানো যায়। পেনফিল্ড পাবলিকেশন থেকে ঐতিহাসিক মুসলিম স্কলারদের রাজনৈতিক ও শাসন-ভাবনা ও ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ সংক্রান্ত একটি বইয়ের কাজও পরিকল্পনা চলছে। এই আলোচনা-পর্যালোচনা থাকবে; এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো—প্রকৃত খিলাফতব্যবস্থার কাছাকাছি যাওয়া। খিলাফতকে প্রত্যাখ্যান করা নয়।
এখন প্রশ্ন হলো—স্কলারদের মধ্যে এই মতপার্থক্য কেন?
ইসলামের সকল বিধানের মতোই, খিলাফতব্যবস্থার কিছু অংশ কুরআন-সুন্নাহর টেক্সটের আলোকে অকাট্য, আর কিছু অংশ ইজতিহাদ-নির্ভর। খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে—এটুকু কথা মৌলিক ও মীমাংসিত। তবে, এর প্রায়োগিক যেসব রূপ ও সমাধান সাহাবা-যুগে পাওয়া যায় না, সেগুলোর অধিকাংশই ইজতিহাদ-নির্ভর। এই ইজতিহাদ-নির্ভর অংশে মতপার্থক্য ও ইখতিলাফের সুযোগ ইসলামই রেখে দিয়েছে। মৌলিক অংশে দ্বিমত নেই।
লেখার মূলকথা দুটি।
১. পৃথিবীতে 'হুকম বিমা আনযালাল্লাহ' করা ফরজ।
২. 'হুকম বিমা আনযালাল্লাহ'র প্র্যাকটিকেল রূপ হলো খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ। যার মডেল নববী নির্দেশনার আলোকে খুলাফায়ে রাশিদিন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
চলমান আলোচনায় যারা রূপরেখা নিয়ে কনসার্ন দেখাচ্ছেন, তারাও খিলাফত প্রতিষ্ঠার আবশ্যকীয়তা নিয়ে দ্বিমত রাখার কথা না; অথবা এভাবে বলা যায়—এখানে দ্বিমতের সুযোগ নেই।
খিলাফতের রূপরেখা কী হবে—এটা বুঝতে হবে খিলাফতে রাশেদার কর্মপ্রক্রিয়া দেখে। হুকম বিমা আনযালাল্লাহর আয়াত, কুতুবুল হাদিস থেকে কিতাবুল ইমারাহর হাদিস, খিলাফতে রাশেদার প্র্যাকটিকেল আমল—এর আলোকে ফকিহগণ রূপরেখা নির্ধারণ করবেন। করেছেনও। যেহেতু রূপরেখার সকল অংশ কতয়ী বা অকাট্য টেক্সট না, বরং উল্লেখযোগ্য অংশ ইজতিহাদি—সেহেতু বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইখতিলাফ থাকবে। অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। যেখানেই ইজতিহাদের সুযোগ আছে, সেখানেই ইখতিলাফ থাকবে। এজন্যই খিলাফতের রূপরেখা সংক্রান্ত বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইমামদের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
রূপরেখার বিভিন্নতার দোহাই দিয়ে খিলাফতকেই অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা ও আলোচনাগুলো দুঃখজনক। আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিল রূপরেখা কী হবে, এ নিয়ে। সালাফদের প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্তগুলো কী ছিল, ইতিহাসের মুসলিম সালতানাতগুলো কতটুকু কী করেছে, বর্তমানে এই ইজতিহাদি রূপরেখা ও প্রস্তাবনাগুলোর কত শতাংশ ফিজিবল, কত শতাংশ ইজতিহাদের নতুন করে তাতবিক দেওয়ার প্রয়োজন আছে, কীভাবে আমরা মিনহাজিন নুবুওয়ার নিকটবর্তী হতে পারি—এ নিয়ে। কিন্তু, রূপরেখার আশ্রয় করে আলোচনা হচ্ছে—খিলাফত প্রয়োজন আছে কি না, প্রাসঙ্গিক কি না, আদৌ খিলাফত ছিল কি না—এ নিয়ে।
আবারও বলি, রূপরেখার সকল অংশ অকাট্য নস না; বরং বিভিন্ন নুসুসের আলোকে ইজতিহাদি অংশের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। আলোচনা হওয়া উচিৎ এসব নিয়ে। যদিও এই আলোচনার জন্য ফেইসবুক পোস্ট বা ছোট-ছোট লেখা যথেষ্ট না। স্বতন্ত্র বই প্রয়োজন। যোগ্য আলিমরা আশা করি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন।
রূপরেখা নিয়ে দালিলিক ও যৌক্তিক উপায়ে দ্বিমত করুন, সমস্যা নেই। অন্তত মূল পয়েন্টটাতে একমত হোন—খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়ার মাধ্যমে হুকম বিমা আনযালাল্লাহ বাস্তবায়ন করা ফরজ।
Comment