ইখলাসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনিয়তা
---------
إن الحمد لله , نحمده ونستعينه ونستغفره, ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا , من يهده الله فلا مضل له , ومن يضلل فلا هادي له, وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له , وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله
আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুল হওয়ার জন্য ২টি শর্ত, প্রতিটি আমলে ইখলাস থাকা এবং আমলটি নববী পন্থায় করা। দুটির কোন একটি অনুপস্থিত থাকলে, সেই আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহনযোগ্য হবেনা।
ইবাদতের প্রাণ হচ্ছে ইখলাস, ইখলাস ব্যতিত সমস্ত ইবাদত মূল্যহিন, ইখলাস ব্যতিত কোন বান্দার ইমানও আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুল হবেন। তাই প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে, ইখলাসের প্রতি গুরুত্ব দেয়া, প্রতিটি আমলে ইখলাস যাচাই করা, আমলের চেয়ে ইখলাসের দিকে গুরুত্ব বেশি দেয়া।
ইখলাসের পরিচয়: প্রতিটি আমল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য করা, দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য না করা।
একজন ইমানদারের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, তার প্রতিটি মূহুর্ত রবের সন্তুষ্টির জন্য হবে। আমরা তখন সফল ও কামিয়াব হব, যখন আমাদের জীবন, মরণ ও সব কিছু আল্লাহ তায়ালার জন্য করতে পারব।
ইখলাস ঈমান গ্রহনযোগ্য হওয়ার অন্যতম শর্ত: আমরা তো মনে করি, জবানে কোন রকম কালিমা পড়লেই মুক্তি পেয়ে যাব, আমার কালিমা, আমার ঈমান তখনি কাজে আসবে, রবের নিকট কবুল হবে, যখন আমাদের জবান থেকে ইখলাসের সাথে কালিমা উচ্চারিত হবে। আল্লাহ তায়ালা কুরানের অনেক স্থানে দ্বীন ও ঈমান খাটি করার আদেশ দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন :فَادْعُوا اللَّـهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
তোমরা দ্বিনকে খাটি করে তাকে ডাক, যদিও কাফেররা এটা অপছন্দ করে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন: أخلص دينك يكفك العمل القليل
তোমার দ্বীন ও ঈমান খাটি কর, তাহলে অল্প আমলই যথেষ্ট হবে।
আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন :
من قال: لا إله إلا الله صدقًا من قلبه دخل
الجنة وفي رواية خالصًا من قلبه
যে ইখলাসের সাথে কালিমা বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। উল্লেখিত আয়াতে কারিমা ও হাদিসদ্বয় থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, ইখলাসবিহিন বান্দার কালিমাও আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা।
আরেক হাদিসের রাসুলে আরাবি সা. বলেছেন : مَن أحبَّ للهِ ، وأبغَضَ للهِ ، وأَعْطَى للهِ ، ومنَعَ للهِ ، فقد استَكْمَلَ الإيمانَ
যে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসবে এবং আল্লাহর জন্য কারো সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে এবং আল্লাহর জন্য দান করবে এবং আল্লাহর জন্য দান করা থেকে বিরত থাকবে, সে ঈমান পরিপূর্ণ করে নিল।
সুতরাং একজন ইমানদারের সব কাজ রব্বে কারিমের সন্তুষ্টের জন্য হওয়া চায়।
ইখলাসবিহিন সমস্ত আমল বেকার::
ইখলাস হচ্ছে সমস্ত আমলের মূল, ইখলাস ব্যতিত আমলের কোন মূল্যই নেই, যদিও তা অনেক বড় আমল হোক। রাসুলে আরাবি সা. বলেন : إنَّما الأعمالُ بالنِّيَّاتِ وإنَّما لِكلِّ امرئٍ ما نوى فمن كانت هجرتُهُ إلى اللَّهِ ورسولِهِ فَهجرتُهُ إلى اللَّهِ ورسولِهِ ومن كانت هجرتُهُ إلى دنيا يصيبُها أو امرأةٍ ينْكحُها فَهجرتُهُ إلى ما هاجرَ إليْهِ
সমস্ত আমলের প্রতিদান নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে, যার সে নিয়ত করবে। অতএব যে ব্যক্তির হিজরত আল্লাহ এবং তার রাসূলের জন্য হবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত যে সংকল্প নিয়ে করবে তারই জন্য হবে।
পারিবার-পরিজন, বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে হিজরত করার পরও, তা আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, কারণ সেই হিজরত রবের সন্তুষ্টির জন্য ছিলনা।
সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টের আমল জিহাদের মধ্যেও যদি ইখলাস না থাকে, তাহলে মুজাহিদের সেই ত্যাগ ও কুরবানিও রবের নিকট মূল্যহিন, বেকার হিসাবে সাব্যস্ত হবে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:جاء رجلٌ إلى رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فقال: الرَّجلُ يُقاتِلٌ للمغنم والرجل يقاتل ليذكر والرجل يقاتل ليري مكانه فأنَّى ذلك في سبيلِ اللهِ ؟ قال: ( مَن قاتَل لتكونَ كلمةُ اللهِ هي العليا فهو في سبيلِ اللهِ )
জৈনেক লোক নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলো, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এক ব্যক্তি গনীমাত লাভের জন্য যুদ্ধ করে, অন্য এক ব্যক্তি স্মরণীয় হওয়ার জন্য, আর এক ব্যক্তি যুদ্ধ করে নিজের উচ্চমর্যাদা প্রদর্শনের জন্যে। এগুলার মধ্যে কোনটি আল্লাহর পথে বলে গন্য হবে? তখন রসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালিমা সমুন্নত করার উদ্দেশে যুদ্ধ করে সে ব্যক্তিই আল্লাহর পথে।
উল্লেখিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, যদি জিহাদের মত মহান ইবাদতের মধ্যেও ইখলাস তথা আল্লাহর কালিমা সমুন্নত করার নিয়ত না থাকে, তাহলে সেই জিহাদও মূল্যহীন বলে বিবেচিত হবে।
ইখলাস শূণ্যতার কারণে মানুষ শুধু সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেনা, আখিরাতের পুরস্কার থেকে মাহরুম হবেনা, বরং ইখলাস শূন্যতা বান্দাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে এবং আমলে নেক নিয়ত না থাকলে বান্দা জান্নাত থেকেও মাহরুম হবে, নাঊজুবিল্লাহ! । রাসূলুল্লাহ সা. বলেন :
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنْ الدُّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের ইলমকে দুনিয়া লাভের আশায় অর্জন করলো, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জান্নাতের খোশবু পাবে না।
আরেক হাদিসের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.৩ শ্রেণির শ্রেষ্ট মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা ইখলাস শুন্যতার কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। এক. শহিদ, দুই. আলেম, তিন. দানবির। তাদের একজন নিজের জীবন জিহাদের বিলিয়ে দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, আরেকজন কুরানের ইলম শিখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, আরেকজন কল্যাণের সমস্ত পথে নিজের প্রিয় সম্পদ খরচ করে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কারণ একটিই, রবের সন্তুষ্টির জন্য সেই আমলগুলো না করা, দুনিয়াবি উদ্দেশ্য করা। রাসূলুল্লাহ সা. এর ভাষায় : أوَّلُ النّاسِ يُقْضَي فيهِ يومَ القيامةِ ثلاثةٌ: رجلٌ استُشهِدَ، فأُتِيَ بهِ فعرَّفَه نعِمَهُ، فعرَفَها فقال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: قاتلتُ في سبيلِكَ حتّى استُشهِدتُ. فقال: كذبتَ إنّما أردتَ أن يُقالَ: فلانٌ جريءٌ، فقد قيلَ فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ حتّى أُلْقِيَ في النّارِ
হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির ফায়সালা করা হবে :
এক. আল্লাহর পথে জীবন দানকারী। তাকে ডেকে আল্লাহ বলবেন, বান্দা! পৃথিবীতে আমি তোমাকে যৌবন, যৌবনের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা এবং শক্তি-ক্ষমতা দান করেছিলাম। ইহজগতে তুমি তা কোথায় খরচ করেছ?
সে বলবে, আমি তা আপনার রাস্তায় জিহাদে ব্যয় করেছি, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো চেয়েছিলে লোকেরা তোমাকে বীরপুরুষ বলবে। তা তো পৃথিবীতে বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
ورجلٌ تعلَّمَ العلمَ، وقرأ القرآنَ، فأُتِيَ بهِ، فعرَّفَهُ نعِمَهُ، فعرَفَها فقال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: تعلَّمتُ العِلمَ وقرأتُ القرآنَ وعلَّمتُهُ فيكَ، قال كذبتَ وإنّما أردتَ أن يُقالَ فلانٌ عالمٌ، وفلانٌ قارئٌ، فقد قيلَ فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ إلى النّارِ
দুই. আল্লাহ তাআলা আলেম ও কারীকে ডেকে নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, পৃথিবীতে আমি তোমাকে ইল্ম ও কুরআন দান করেছিলাম। তা তুমি কোন্ কাজে ব্যবহার করেছ?
তারা বলবে, ইলম ও কুরআনের শিক্ষা অর্জন করেছি এবং মানুষকে শিখিয়েছি আপনার সন্তুষ্টির জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো তা করেছ, যেন লোকেরা তোমাকে আলেম বলে, কারী বলে। দুনিয়াতে তা বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
ورجلٌ آتاهُ اللهُ مِن أنواعِ المالِ، فأُتِيَ بهِ فعرَّفَهُ نعِمَهُ فعرَفَها. قال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: ما تركتُ مِن شيءٍ تحبُّ أن يُنفَقَ فيهِ إلّا أنفقتُ فيهِ لكَ. فقال: كذبتَ. إنّما أردتَ أن يُقالَ: فلانٌ جَوادٌ فقد قيلَ، فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ حتّى أُلْقِيَ في النّارِ
তিন. ধনসম্পদের অধিকারীকে আল্লাহ বলবেন, পৃথিবীতে আমি তোমাকে বিপুল সম্পদের অধিকারী করেছিলাম। আমার প্রদত্ত সম্পদ তুমি কী কাজে ব্যয় করেছ?
সে বলবে, আপনার প্রদত্ত সম্পদ আমি অকাতরে আপনার রাস্তায় ব্যয় করেছি (তা দ্বারা নিঃস্ব-দরিদ্র অভাবগ্রস্ত ও অসহায়দের সাহায্য করেছি, মসজিদ মাদরাসা নির্মাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করেছি)।
আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি সবই করেছ, যেন লোকেরা তোমাকে বড় দানবীর বলে। তা তো পৃথিবীতে বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
সুতরাং আমাদের প্রতিটি আমলে নিয়তের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা উচিত, কোন আমলে দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্য যেন ঢুকতে না পারে। বিশেষ করে যারা দুনিয়ার সুখ, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে জিহাদের পথ, পিচ্ছিল ও কন্টকাকীর্ণ পথ বেচে নিয়েছেন , ইখলাসে ব্যাপারে তাদের আরো বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকা উচিত।
কারণ তাদের ইখলাসে কমতি থাকলে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা যেন সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত না হয়, যারা দ্বিনের জন্য ত্যাগ ও কুরাবানি দিয়েও, আখিরাতে মাহরুম থাকবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন:
إن الله سيؤيد هذا الدين بأقوام لا خلاق لهم
নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এই দ্বিন কে এমন লোকদের দ্বারা শক্তিশালি করেন, যাদের আখিরাতে কোন অংশ নেই।
আর ইখলাস এমন এক শক্তি, যা বান্দাকে সিসাঢালা প্রাচীরে পরিণত করে, কারো প্রশংসা বা নিন্দা তাকে বিচলিত করতে পারেনা, দুনিয়ার কোন প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু তাকে রবের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনা, পৃথিবির সমস্ত কুফুরি শক্তি একত্র হয়ে তাকে দ্বিনের পথ থেকে বিন্দু পরিমান সরাতে পারেনা। পথের নির্জনতা, পথিকের সল্পতা তাকে থামাতে সক্ষম হয়না, সকল ভালোবাসা ও বিপদ পিছনে ফেলে, তাগুতের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে দ্বিনের পথে চলে দুর্বার গতিতে। ইখলাস বান্দাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, বান্দা তার রবের সন্তুষ্টির জন্য হাসিমুখে নিক্ষিপ্ত হয় জ্বলন্ত আগুনে, নির্মম নির্যাতনেও তাওহিদের বাণি জবান থেকে উচ্চারিত হয়, রবের সন্তুষ্টির জন্য দেহ ছিন্ন-বিন্ন হয়ে যাওয়াকেও পরোয়া করেনা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের মধ্যে পূর্ণ ইখলাস দান করুন, আমিন!
Comment