শরীয়াহ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা কাজ করে। এ ধারণাগুলো দীর্ঘদিনের প্রপাগ্যান্ডা, অপব্যাখ্যা, অজ্ঞতা এবং আংশিক জ্ঞানের ফসল। লম্বা সময় ধরে এসব ভুল ধারণার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করেছে ওরিয়েন্টালিস্টরা আর ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির নামে মুসলিমবিশ্বে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো সুশীলরা।
ভুলধারণা:১
শরীয়াহকে ঐচ্ছিক বিষয় মনে করা।
শরীয়াহকে ঐচ্ছিক বিষয় মনে করা।
কেউ কেউ মনে করেন শরীয়াহ গ্রহণ না করেও মুসলিম থাকা সম্ভব। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা; বরং শরীয়াহকে গ্রহণ করা এবং আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন শরীয়াহ অনুযায়ী পরিচালনা করা ঈমানের দাবি। এটি দ্বীনের একটি মৌলিক নীতি। শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে এবং শরীয়াহ ছাড়া অন্য সব ব্যবস্থা বাতিল। যে এ কথা বিশ্বাস করে না তার পক্ষে মুসলিম থাকাই সম্ভব না।
দেখুন
সূরা নিসা : ৬৫ | সূরা নূর : ৫১ |
সূরা মাঈদা : ৫০ | সূরা জাসিয়া : ১৮ |
এটা হলো মৌলিক শর্ত। চিন্তা শুরু করতে হবে এই ধাপ থেকে।
.
এই ধাপে আসার পর বিভিন্ন ইজতিহাদি বিষয়ে ভিন্নমতের সুযোগ আছে। কিন্তু সেই ভিন্নমতের ভিত্তি হতে হবে শরীয়াহ। অর্থাৎ আমরা সবাই শরীয়াহ অনুসরণ করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চাই। আমরা সবাই এই সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম পথটা খুঁজছি, যাতে করে তাঁর ইচ্ছে ও নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে পারি–এই অবস্থানে আসার পর পথ ও পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত হতে পারে।
.
এমন অনেক দল ও আন্দোলন আছে, যারা শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার দাবিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। তারা শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার স্লোগান তোলে কিন্তু তাতে আন্তরিকতা থাকে না। এ ধরনের কোনো দলের বিরোধিতা করা আর শরীয়াহর বিরোধিতা করা, দুটো ভিন্ন বিষয়।
.
শরীয়াহর ব্যাপারে ভুল ইজতিহাদ ত্যাগ করা এক বিষয়, আর আর শরীয়াহর কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করা আরেক বিষয়। কিন্তু আজ এ নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। প্রথমটি করা সঠিক। কিন্তু দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ শরীয়াহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা হলো কুফর।
.
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো মানুষ এ দুটি বিষয়কে আজ হরহামেশাই মিলিয়ে ফেলে। যার ফলে তৈরি হয় অনেক বিভ্রান্তি।
ভুলধারণা : ২
শরীয়াহকে আজকের যুগের জন্য অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত কিংবা অপরিপূর্ণ মনে করা। এমন মনে করা যে শরীয়াহর অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে
আজ অনেকেই মনে করেন শরীয়াহ শাসন দিয়ে বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটানো যাবে না। অনেকে বিশ্বাস করেন পরিপূর্ণভাবে শরীয়াহ অনুসরণ করা আজ সম্ভব না। আধুনিক সময়ে রাষ্ট্র শরীয়াহ দিয়ে চলবে, এ চিন্তাটাই অনেকের কাছে অবাস্তব। তারা মনে করে শরীয়াহ যুগের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। কেউ কেউ এটা সরাসরি বলে ফেলে। আর কেউ কেউ এ চিন্তাগুলো প্রকাশ করে নানান প্রশ্নের মোড়কে।শরীয়াহকে আজকের যুগের জন্য অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত কিংবা অপরিপূর্ণ মনে করা। এমন মনে করা যে শরীয়াহর অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে
এ ধরনের মানুষদের অনেকেই মনে করেন শরীয়াহতে অসম্পূর্ণতা আর কমতি আছে। আর এগুলো মেটানোর জন্য গণতন্ত্রের মতো আদর্শগুলো থেকে কিছু কিছু জিনিস ধার করা দরকার।
নিঃসন্দেহে এটা একটা মারাত্মক ভুল ধারণা।
এই ভুল ধারণার পেছনে বড় একটা কারণ হলো আমাদের আজকের বাস্তবতা। আজ আমরা এমন একটা সিস্টেমের অধীনে থাকি, যা ইসলামের দৃষ্টিতে পুরোপুরি অবৈধ। অবৈধ এ সিস্টেমের প্রভাব আমাদের জীবনে পড়ে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন ক্ষতিকর, হারাম বিষয়। হারামের সাথে সহাবস্থানে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই।
.
ইসলাম নিয়ে আমাদের আলোচনার বিশাল একটা অংশ বরাদ্দ থাকে আমাদের জীবনে জোর ঢুকে পড়া এই হারাম বিষয়গুলো নিয়ে।
.
'অমুক জিনিস কি হারাম?
'কেন হারাম?'
আচ্ছা এই হারামের বিকল্প কীভাবে তৈরি করা যায়?'
'আচ্ছা অল্প কিছুটা হারাম কি মেনে নেয়া যায় না?'
আমাদের চিন্তা আটকে থাকে এমন নানান প্রশ্নের গোলকধাঁধায়।
.
অথচ শরীয়াহর ব্যাপ্তি কিন্তু শুধু হারাম-হালাল নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না; বরং শরীয়াহর উদ্দেশ্য হলো এমন এক বাস্তবতা তৈরি করা, যেখানে এই হারামগুলো এবং সেগুলোর প্রয়োজনই থাকবে না। কিন্তু শরীয়াহর পরিপূর্ণ ছবিটা আজ আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। সেটা নিয়ে আলোচনা করার, বোঝার, ভাবার ফুরসত হয় না আমাদের। কালেভদ্রে আমরা এ নিয়ে কথা বলি।
.
তাই আজ অনেকেই শরীয়াহ বলতে বোঝেন নিছক কিছু বাধানিষেধ, আর শাস্তিকে। বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার, ইত্যাদির মতো অল্প কিছু ক্ষেত্রে আমাদের শরীয়াহর কথা মনে পড়ে।
.
অথচ শরীয়াহ একটি পূর্ণাঙ্গ, পরিপূর্ণ ব্যবস্থা। কুরআন, সুন্নাহ, খালিফাহগণের আমল, ইসলামী শাসনের হাজার বছরের ইতিহাস এবং আলিমগণের ইস্তিমবাতে যে গভীর ও বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়, তার দিকে তাকালে যে কেউ বিস্মিত হয়ে যাবে।
কীভাবে আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ এবং শাসক নির্বাচন করা হবে তার বাস্তবসম্মত পদ্ধতি শরীয়াহতে দেয়া আছে। শাসকও যেমন-তেমন হলে হবে না। এমন শাসক হতে হবে যে, মানুষের কাছে গৃহীত হবে এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী সাধারণ মুসলিমদের প্রতি তাঁর চুক্তি অনুযায়ী আমল করতে বাধ্য থাকবে।
.
- শরীয়াহ সুদকে নিষিদ্ধ করছে এবং বিভিন্ন ধরনের অংশীদারীকে হালাল করেছে। শারীয়াতে (ডিউটি, ট্যাক্স) হারাম করা হয়েছে। অন্যদিকে খারাজ, উশর, ওয়াকফ ইত্যাদি থেকে অর্থায়নের পদ্ধতি দেয়া হয়েছে।
- শরীয়াহতে মালিকানার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশনা এসেছে। পানি, জ্বালানি এবং চারণভূমির জনমালিকানার (public ownership) কথা এসেছে।
- শরীয়াহতে একচেটিয়া ব্যবসা (মনোপলি) আর দলবেঁধে লুটপাট করার পুঁজিবাদের (ক্রোনি ক্যাপিটালিযম) উত্থানের পথ বন্ধ করার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। শরীয়াহতে নির্দেশিত হয়েছে যুদ্ধ ও শান্তি-বিষয়ক কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি।
- শরীয়াহ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে দুর্বল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্তদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার, যদিও তারা কাফির হয়।
কিন্তু আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলি না। আসলে শরীয়াহতে কত বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া আছে সেটা আমাদের অধিকাংশেরই অজানা।
শরীয়াহ আমাদের এ কাজগুলো করার শিক্ষা দেয় আখিরাতের জন্য।
শরীয়াহ আমাদের দেয় ইবাদতের এক পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা, যা দুনিয়াবি কোনো ব্যবস্থায় পাওয়া যায় না। নিজের সাথে সৎ হয়ে শরীয়াহর এ বিস্তৃতি ও বিধানগুলোর দিকে তাকালে যে কেউ আল্লাহ ﷻ-এর এই আয়াতের যথার্থতা ও গভীরতা অনুধাবন করবে,
.
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَثْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَنِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
.
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। [তরজমা, সূরা মা'ইদা, ৩]
..
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। [তরজমা, সূরা মা'ইদা, ৩]
আমাদের এক সমৃদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাণ্ডার আছে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে বসে আছি। সেটা ফেলে সমাধান খুঁজছি নানা তন্ত্রমন্ত্রে। শরীয়াহ নিয়ে এবং শরীয়াহর এ দিকগুলো নিয়ে আজ কথা বলা হয় না। স্কুলে এগুলো পড়ানো হয় না; বরং স্কুলে শিশুদের জাহিলিয়্যাহর শিক্ষা দেয়া হয়। অথচ শরীয়াহ থেকে উৎসারিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় এবং তা থেকে তারা উপকৃতও হয়।
.
শরীয়াহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে, সমাধান দিয়েছে। সেই সাথে অবিচার বন্ধ করা এবং নির্দেশনা দেয়ার জন্যে সীমাও ঠিক করে দেয়া হয়েছে শরীয়াহতে। প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে ইজতিহাদের জায়গাও।
.
আল্লাহ ﷻ-এর এ আয়াত নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَيُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
.
আর আমি তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ। [তরজমা, সূরা আন-নাহল, ৮৯]
.وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَيُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
.
আর আমি তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ। [তরজমা, সূরা আন-নাহল, ৮৯]
আল্লাহ বলছেন যে, তিনি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা নাযিল করেছেন। তাহলে এটা কী করে সম্ভব যে, আল্লাহ আমাদের যথাযথ রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেননি? এটা কী করে সম্ভব যে, তিনি আমাদের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা ঠিক করে দেননি, যা মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে?
এট কি আদৌ হতে পারে?
ভুলধারণা : ৩
শরীয়াহ, আর শরীয়াহর প্রয়োগে ভুল বা বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা।
মুসলিম শাসকদের ভুল বা বিচ্যুতির অনেক উদাহরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। সমস্যা হলো আমরা অনেকেই ধরে নিই, এই ভুলগুলোর উৎস বা কারণ হলো শরীয়াহ। অথবা আমরা ধরে নিই, এই ভুল বা বিচ্যুতিগুলো ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা শরীয়াহতে নেই।শরীয়াহ, আর শরীয়াহর প্রয়োগে ভুল বা বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা।
.
যেমন আমরা ধরে নিই, শরীয়াহ শাসনের ক্ষেত্রে শাসক যুলুম করতে পারে। ইতিহাসে এমন আমরা এমন অনেক শাসক দেখেছি, যারা মোটাদাগে, সামগ্রিকভাবে শরীয়াহ দিয়ে শাসন করেছেন। মুসলিমদের স্বার্থ এবং সম্মান রক্ষা করেছেন, মুসলিমদের শত্রুদের তটস্থ করেছেন এবং জি হা দের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদের ভূমি বিস্তৃত করেছেন। কিন্তু তাদের এসব অবদান সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুলুমের অভিযোগ আছে।
.
সমস্যা হলো, আমরা ধরে নিচ্ছি এই যুলুম শরীয়াহ শাসনের ফলাফল। কিন্তু আসলে এগুলো হলো শরীয়াহ থেকে তাদের বিচ্যুতির ফল।
.
এ ধরনের শাসকদের ব্যাপারে আমাদের আচরণ কেমন হবে? শরীয়াহ আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করতে বলে।
.
একদিকে মুসলিমদের ঐক্য বজায় রক্ষা, শত্রুদের মোকাবিলায় শক্তি মজবুত রাখা জরুরি। অন্যদিকে শাসকের যুলুমের সমর্থন না করা, একে অনুমোদন না দেয়া, তাদের আগ্রাসনের নিন্দা করা এবং আগ্রাসন ও যুলুম থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টা করাও জরুরি।
.
শরীয়াহ আমাদের এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করার শিক্ষা দেয়।
এ তো গেল ওই শাসকদের কথা, যারা সামগ্রিকভাবে ইসলাম দিয়ে শাসন করা সত্ত্বে বিভিন্ন সময় যুলুম করছেন।
.
অন্যদিকে আজ আমরা যেসব স্বৈরাচারী শাসক দেখি, তাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্কই নেই। এই শাসকেরা বরং শরীয়াহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ক্রুসেইডার ও যায়োনিস্টদের সাথে হাত মিলিয়েছে এবং ইসলামের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিতে চাচ্ছে।
.
এদের অনুগত দরবারি কিছু আলিম আছে। শাসকদের গদি রক্ষার জন্যে এই দরবারি আলিমরা সাধারণ মানুষের সামনে কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরে। শরীয়াহর বিভিন্ন দলীলকে আউট অফ কন্টেক্সট ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। ক্ষমতার গোলামি করা এই আলিমরা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে আজকের শাসকদের বৈধতা তৈরি করতে চায়।
.
এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, কিছু মানুষ স্বৈরাচারী শাসকদের কার্যকলাপ আর আগেকার মুসলিম শাসকদের যুলুমের উদাহরণ টেনে এনে শরীয়াহর ওপর দোষারোপ করে। আর সমাধান হিসেবে বলে গণতন্ত্রের কথা।
.
কিন্তু শাসকের একনায়কতন্ত্র এবং স্বেচ্ছাচার শরীয়াহতে বৈধ না। শরীয়াহর সাথে এর কোনো সম্পর্কও নেই; বরং মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো শরীয়াহর নির্দেশিত পন্থায় এর প্রতিবাদ করা এবং শাসককে যুলুম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
.
আর শাসকের যুলুম শুধু শরীয়াহ শাসনের ক্ষেত্রে হয় না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রসহ সব ধরনের শাসন ব্যবস্থায় এটা হয়ে থাকে; বরং যে ব্যবস্থার কথা বলে আজ শরীয়াহর সমালোচনা করা হয়, সেখানে যুলুম হয় আরও বেশি।
.
সারা দুনিয়ার নব্বই শতাংশের বেশি সম্পদ আজ অল্প কিছু মানুষ আর কর্পোরেশানের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। এটা হলো পুঁজিবাদের ফলাফল। এর চেয়ে বড় যুলুম আর কী হতে পারে?
.
এই অল্প কিছু লোক নিয়ন্ত্রণ করছে দুনিয়ার সব বড় বড় মিডিয়া। প্রপাগ্যান্ডার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্রেইনওয়াশ করছে। নিজেদের ইচ্ছেমতো জনমত তৈরি করে দিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের আগুন। সাধারণ মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে টাকা গুনছে করছে অস্ত্র বিক্রেতা, তেল কোম্পানি আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। মিডিয়া আর পপ কালচারের মাধ্যমে ওরা উস্কে দিচ্ছে অনৈতিকতা, অধঃপতন এবং পশুর মতো যৌনতা। ধ্বংস করছে মানুষের দুনিয়া আর আখিরাতকে।
.
কীভাবে এই সীমাহীন যুলুম আল্লাহ ﷻ-এর নাযিল করা হিদায়াতের বিকল্প হতে পারে?
ভুলধারণা : ৪
শরীয়াহতে দুনিয়াবি বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাই শরীয়াহর অধীনে দৈনন্দিন জীবন অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
শরীয়াহতে দুনিয়াবি বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাই শরীয়াহর অধীনে দৈনন্দিন জীবন অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
আমরা প্রায়ই অনেককে বলতে শুনি–লোকেরা যতদিন শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার দাবি না তুলে কেবল দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ততদিন তাদের অবস্থার উন্নতি হবে না।
.
সাধারণ মানুষ যে মনে করে শরীয়াহতে দুনিয়াবি বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হয় না, তার পেছনে এ ধরনের কথার একটা বড় ভূমিকা আছে।
.
শরীয়াহ অথবা দুনিয়া, বিষয়টাকে এভাবে উপস্থাপন করা উচিত না।মহান আল্লাহ এভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেননি। এ ধরনের বক্তব্যের কারণে মানুষ ভাবতে শুরু করে যে শরীয়াহ শাসন দিয়ে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা কিংবা জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা সম্ভব না। আর এমন অবস্থায়, সুন্দর জীবনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয় আল্লাহর শত্রুরা। স্বাভাবিকভাবেই অনেক মুসলিম তখন তাদের ফাঁদে পা দেয়।
.
- আল্লাহর শরীয়াহ উদ্দেশ্য কি মানুষকে দুনিয়ার শাসকদের গোলামি থেকে মুক্ত করা না?
- মানুষের প্রয়োজনগুলো পূর্ণ করা, তাদের সম্পদ লুট হওয়া থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে তাদের স্বীয় রবের ইবাদতে মনোনিবেশের সুযোগ দেয়া কি শরীয়াহর উদ্দেশ্য না?
- শরীয়াহ কি দুনিয়াবি জীবনের সংকীর্ণতা ও যুলুম থেকে মুক্ত করে মানুষকে আখিরাতের প্রাচুর্য ও বিশালতার সাথে যুক্ত করে দেয় না?
যেমনটা সাহাবী রিবি' ইবনু আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন –
"আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব থেকে স্রষ্টার দাসত্বে নিয়ে আসতে। সমস্ত বাতিল ধর্মের জুলুম থেকে মানুষকে মুক্ত করে দ্বীন ইসলামের ইনসাফের দিকে আনতে। এবং দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যেতে।"
ভুলধারণা : ৫
শরীয়াহকে সামগ্রিকভাবে না দেখে কেবল রাষ্ট্রীয় শাসনের সাথে সম্পর্কিত মনে করা।
শরীয়াহকে সামগ্রিকভাবে না দেখে কেবল রাষ্ট্রীয় শাসনের সাথে সম্পর্কিত মনে করা।
অনেকে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন এটা কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু পরিবর্তনের ব্যাপার। অল্প কিছু পদ্ধতি বদলে নিয়ে কিছু অদল-বদল করলেই শরীয়াহ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে।
.
কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে কলুষিত জীবনব্যবস্থার অধীনে আমরা বর্তমানে আছি, শরীয়াহর কাজ হলো একে আমূল বদলে দিয়ে ইসলামের ভিত্তির ওপর আমাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করা।
.
যেন পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, বস্তুবাদের মোহ আমাদের মধ্যে আর না থাকে। যাতে যন্ত্রের মতো কেবল লাভ-লোকসান আর কার্যকারণের হিসেব কষতে কষতে আমাদের জীবন কেটে না যায়।
.
কারণ, শরীয়াহ একটি স্বতন্ত্র এবং নিখুঁত ব্যবস্থা। এটি এমন এক প্রাসাদ, যার কোনো মেরামতের কিংবা সংস্কারের প্রয়োজন নেই।
এই প্রাসাদ কোনো ত্রুটিপূর্ণ ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠেনি।
ভুলধারণা : ৬
শত্রুর মুখোমুখি হবার আশঙ্কায় শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বাদ দেয়া।
শরীয়াহর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আরেকটি ভুল ধারণা হলো, আজকের বিশ্বব্যবস্থা কোনোভাবেই শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না। তারা সর্বশক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করবে। তাই এ চেষ্টা বাদ দেয়াই ভালো। কাফিরদের মোকাবিলা করা সম্ভব না। আমরা বরং অন্য কোনো উপায়ে মুসলিমদের স্বাধীন আর মুক্ত করার চেষ্টায় মনোযোগ দিই।শত্রুর মুখোমুখি হবার আশঙ্কায় শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বাদ দেয়া।
.
যারা এমনটা মনে করেন তাদের বলছি–হে আমার ভাই, শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা করার মানে হলো, এই বিশ্বব্যবস্থার গোলামি থেকে মুক্তি। আজ পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হবার তাৎপর্য কেমন হবে জানেন?
.
মনে করুন, পৃথিবীর সব মানুষ বিশাল বিশাল জেলখানায় বন্দী। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ভয়ংকর জেল ভেঙে একসাথে কয়েক কোটি মানুষ বেরিয়ে গেল।
.
বাকিদের ওপর এর প্রভাব কেমন হবে? এটা বাকি বন্দীদের উজ্জীবিত করবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করবে গোলামির শেকল ছিঁড়ে ফেলতে।
.
আজকে শরীয়াহর প্রতিষ্ঠা পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য এমনই এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। যারা গোলামির বাস্তবতাকে এখনো চেনেনি, তারাও তখন বুঝতে পারবে কীভাবে পুঁজিবাদ তাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে।
হ্যাঁ, এ মুক্তির দাম চড়া। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই চড়া দামের ভয়ে জীবনভর শরীয়াহর বিকল্প খুঁজে বেড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এ বিকল্পগুলো হলো কারাগারের অলিগলিতে বন্দীর নিষ্ফল ঘোরাঘুরির মতো। এসব করে অল্প কিছু সময়ের জন্য সূর্যের আলো দেখা যাবে, হয়তো পাওয়া যাবে দু-এক মুঠো ভালো খাবারের সন্ধান কিংবা মিলবে ঠাণ্ডা পানির খোঁজ। কিন্তু বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
.
কিন্তু শরীয়াহর তরবারির আঘাতে যখন কারাগারের শিক ভেঙে ফেলা হবে, তখনই আসবে সত্যিকারের মর্যাদা, সম্মান, মুক্তি।
.
দশকের পর দশক গোলামির শেকল বয়ে চলা উম্মাহ কি রক্তের দাম না মিটিয়েই মুক্তি পাবে?
- আদৌ কি তা সম্ভব?
- লড়াই, আঘাত আর আত্মত্যাগ ছাড়া কি বন্দী কখনো অন্ধকূপ থেকে বেরোতে পারে?
- লোহার শিক ভাঙতে গেলে হাতে ব্যথা লাগা স্বাভাবিক। এ দাম যে চুকাতেই হবে। কিন্তু এই দাম, এই যখম, এই রক্তের বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি?
দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান এবং সঠিক পথের দিশা।
সেই মুক্তির পথ ও পদ্ধতি কী হবে, সেটা একটা ভিন্ন আলোচনা। হয়তো আগামীতে সেই আলোচনার সুযোগ হবে। তবে আমার এই আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল দুটি বিষয়ে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করা,
১) এমন কোনো আদর্শ অনুসরণ না করা, যা শরীয়াহর গুরুত্ব অস্বীকার করে, অথবা শরীয়াহকে বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। আর এর দ্বারা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
.
২) কারাগারের অলিগলিতে সময় নষ্ট না করে, সব সময়, শক্তি আর প্রচেষ্টা ওই পথে উজাড় করে দিতে হবে, যে পথ আমাদের রবকে সন্তুষ্ট করে।
.
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَن يُؤْمِنَ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ ، وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
....যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। [তরজমা, সূরা আত-তাগ্বাবুন, ১১]
.وَمَن يُؤْمِنَ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ ، وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
....যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। [তরজমা, সূরা আত-তাগ্বাবুন, ১১]
"শরীয়াহ নিয়ে ভুল ধারণা" সিরিজ এখানেই সমাপ্ত। আল্লাহ আমাদের এগুলোর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
📖 শরীয়াহ নিয়ে ভুল ধারণা ||
ড. ইয়াদ আল কুনাইবী হাফিজাহুল্লাহ ||
বই: আয়নাঘর ||
ড. ইয়াদ আল কুনাইবী হাফিজাহুল্লাহ ||
বই: আয়নাঘর ||
Comment