রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস। আল্লাহ এই মাসটিকে মহিমান্বিত করেছেন। এই মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। নিজের ঈমান ও আমল বাড়ানোর এক সুমহান মৌসুম এই মাস। এই মাসকে আল্লাহ এত বরকতময় করেছেন যা বলে শেষ করা যাবেনা। সমস্ত উশৃংখল ও অবাধ্য শয়তানকে এই মাসে বন্দি করে রাখা হয়। যার ফলে আল্লাহর বান্দাদের পক্ষে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁর ইবাদত করা সহজতর হয়। এই মাসে এমন এক রাত আছে, যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও বেশি। রমজানের শেষ দশ দিনে এই রাত তালাশ করার জন্য হাদিসের উৎসাহিত করা হয়েছে। এই মাসে আছে সিয়াম, যার দ্বারা মুমিন ধৈর্য ও সবরের শিক্ষা লাভ করে। ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে পারে। যারা তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারে না, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে। ফলে আল্লাহ যে, নিয়ামত দিয়েছেন তাতে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারে। সিয়াম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ (যা পাকস্থলী খালি থাকার কারণে সৃষ্টি হয়) আল্লাহর কাছে মেশক আম্বরের চেয়েও অধিক প্রিয়। সিয়ামকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঢাল বানিয়েছেন। ইফতারের সময় কে তিনি মুমিনদের জন্য করেছেন আনন্দময়। আল্লাহ এই মাসের প্রথম অংশে রেখেছেন রহমত। মাঝখানে মাগফিরাত ও শেষে জাহান্নাম থেকে নাজাত। আরো আছে তারাবি কিয়ামুল লাইল, আল্লাহর সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে (সালাতে) কোরআন তেলাওয়াত করার অপূর্ব সুযোগ। যে নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবেনা। রমজানের আছে দোয়া কবুলের অনেক বিশেষ সময়। সেহরির সময়, ইফতারের সময়, তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে, এমনকি প্রতিটা মুহূর্তে।
একেকটা নফল ইবাদতের বিনিময় এই মাসে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। প্রতিটা আমলের জন্যে রয়েছে 70 গুণ বেশি নেকি। এই মাসের একটি ফরজ অন্য মাসে 70 টি ফরজ এর সমান (সওয়াবের দিক থেকে)।
এটা পাথেয় সংগ্রহ করার মাস। একজন মুসাফির যখন তার গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু করে তখন তার পাথেয় সংগ্রহের প্রয়োজন হয়। যদি তার পাথেয় প্রয়োজনের তুলনায় কম হয় তাহলে মাঝপথে তা ফুরিয়ে গেলে তার অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় শোচনীয়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে মরীচিকার পিছনে দৌড়ায়। সুতরাং রমজানে যদি কেউ ঠিকমতো পাথেয় সংগ্রহ করতে না পারে, ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করে তার ঝুলি পূর্ণ করে নিতে না পারে, তাহলে তার রমজানের পরের পুরো বছরটা ঈমান-আমলের লাইনে হয় বিভীষিকাময়। সে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পদে পদে হোঁচট খায়।
রমজান হলো মুনাফা অর্জনের মাস। উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যবসায়ী। তার ব্যবসাটা লাভজনক। কিন্তু সমস্যা হল সে ব্যবসা করার জন্য সময় পাবে মাত্র এক মাস। এই মাসে তার ব্যবসা চলে জমজমাট। বাকি 11 মাস তার পুরো বেকার যায়। সুতরাং এই মাসেই তার এক বছরের জন্য রসদ সংগ্রহ করতে হবে। না হলে সে ও তাঁর পরিবারবর্গ না খেতে পেরে মারা যাবে। এক্ষেত্রে সে কি করবে? নিশ্চয়ই রাতদিন একাকার করে ফেলবে। বসে বসে অলসতা করে সময় নষ্ট করা তো বহু দূরের কথা। বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে চাইবে না মুহূর্ত পরিমাণ। নিলেও তা খুব অল্প সময়ের জন্য। আর আল্লাহ না করুন, অবহেলায় যদি দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায়, আর যথেষ্ট পরিমাণ মুনাফা ঘরে না উঠে, তাহলে তার অবস্থা কেমন হবে সহজেই কল্পনা করা যায়। এই ব্যবসায়ীর জন্য পুরো 11 মাসের তুলনায় এই মাসের গুরুত্ব যেমন একজন মুমিনের জন্য রমজান মাসের গুরুত্বও এমন।
এই কথাগুলো একেবারেই দলিলবিহীন নয়। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি সহীহ বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মিম্বারে আরোহণ করছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে তিনি বললেন আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন আমিন। তৃতীয় সিঁড়িতেও বললেন আমিন। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম রদিয়াল্লাহু আ'নহুম এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন: জিবরাইল আলাইহিস সালাম তিন ব্যক্তির জন্য ধ্বংসের দোয়া করেছেন। প্রথমজন যে রমজান মাস পেল, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক। উত্তরে আমি বলেছি আমিন। দ্বিতীয়, যে আপন মা বাবাকে অথবা তাদের যেকোনো একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, অথচ তাদের দ্বারা জান্নাত অর্জন করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক। আমি বলেছি আমিন। তৃতীয়, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম শুনল, কিন্তু তার উপর দরুদ পাঠ করলো না, সে ধ্বংস হোক। আমি বলেছি আমিন।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথমজন রমজান মাসকে অবহেলায় কাটিয়েছে। গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর দেওয়া এত বড় সুযোগকে হেলায় হারিয়েছে। ফলে তার বিরুদ্ধে একজন ফেরেশতা বদদোয়া করেছেন। যিনি কখনো গুনাহ করেন না, আল্লাহর নাফরমানি করেন না, সব সময় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন। মুহূর্তের জন্যও গাফেল হন না। তার ধ্বংসের জন্য তো এতোটুকুই যথেষ্ট। আর এখানে বদদোয়া করেছেন সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম। এর উত্তরে আমিন বলেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এই ব্যক্তির চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে?
এই কারণেই দেখা যায় যার রমজান খারাপভাবে কাটে। আমলবিহীন অতিবাহিত হয়, রমজান পরবর্তী সময় তার অবস্থা আরো খারাপ হয়। সে ওই পাথেয় সম্বল ফুরিয়ে যাওয়া মুসাফিরের মতো দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়। ওই নিঃস্ব ব্যবসায়ীর মত দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। কারণ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মতো ফেরেশতার দুআ ও আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমিন কখনো কবুল না হয়ে পারে না।
রমজান যেমন একজন ঈমানদার আমল কারীর জন্য রহমত, বরকত ও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট সুযোগ, তেমনি একজন গাফেলের জন্য অভিশাপ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
আরেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। মানুষকে এই দুনিয়ায় তিনি পাঠিয়েছেন খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি হিসেবে। ফেরেশতারা আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি, কেন আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এজন্য প্রথমে তারা বলেছিলেন- আল্লাহ কেন এমন জাতিকে সৃষ্টি করবেন, যারা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, রক্তপাত করবে? আল্লাহ বললেনঃ আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।
সূরা নূর এর 55 নং আয়াতে উল্লেখ আছে- মানবজাতির মধ্যে যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে আর সৎকাজ করবে তাদেরকে আল্লাহ জমিনের মধ্যে কর্তৃত্ব দান করবেন।
আল্লাহ তার এই ওয়াদা পূর্ণ করেছেন সাহাবায়ে কেরামের সময়। তাদেরকে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন। তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। দুনিয়ার বুকে দুশমনের ভয় থেকে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছেন।
আর আল্লাহ যাদেরকে জমিনে কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুরা হজের 41 নং আয়াতে যা বলেছেন তা হল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা। এই কাজগুলো করার জন্য ক্ষমতা থাকা জরুরি। না থাকলে অর্জন করা আবশ্যক। তার একমাত্র মাধ্যম হল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এ কারণেই জিহাদ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। কেননা তা আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করে।
এবার মূল কথায় আসি। রমজান হলো ইবাদতের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়। প্রতিটা ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ এই মাসে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে জিহাদের মত মহান এবাদত থেকে কেন এই মাস খালি থাকবে? খালি থাকেও নি।
ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই আজ পর্যন্ত অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এই মাসে। রমজান মাসে সংঘটিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে আল্লাহ মুসলিমদের বিজয় দান করেছেন। এজন্য রমজান শুধু সিয়াম আর কিয়ামের মাস না। এটা বীরত্ব ও বিজয়ের মাস।
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর। সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির 17ই রমজান। পুরো ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। মুসলিমদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। 1000 সুসজ্জিত মুশফিক বাহিনীর বিরুদ্ধে 313 জনের ক্ষুদ্র মুসলিম দলটিকে আল্লাহ অবিস্মরনীয় ভাবে বিজয় দান করেছিলেন। এই দিনটি ছিল ইয়াওমুল ফুরকান অর্থাৎ ফয়সালাকারী দিন। এই যুদ্ধে বিজয় দানের মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামের সত্যতা ও কাফেরদের ভ্রান্তি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।
মক্কা বিজয় হয়েছিল অষ্টম হিজরীর ২০ই রমজান। যেদিন কাবা পবিত্র হয়েছিল; দীর্ঘদিন যাবৎ কাবার অভ্যন্তরে জমে থাকা মূর্তির আবর্জনা থেকে। যে দিনটি ছিল ফাতহে মুবিনের বাস্তবায়ন দিবস। হুদাইবিয়ার সন্ধির দিন আল্লাহ যার ওয়াদা করেছিলেন। এটা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে। আরবের মানুষের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হয়েছে। যারা মদিনার মুসলিমও কুরাইশ কাফেরদের মধ্যকার যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল। কোন দল বিজয়ী হবে আর তারা সে দলে যোগ দিবে।
স্পেন বিজয়। 92 হিজরীর 28 রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। একদিকে তারিক বিন জিয়াদ এর নেতৃত্বে 12 হাজার মুসলিম সেনাবাহিনী। অপরদিকে স্পেনের রাজা রডারিক এর অধীনে এক লক্ষ খ্রিস্টান সৈন্য। সম্পূর্ণ অচেনা ভূখণ্ডে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এত বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করা সহজ ছিল না। এ ছিল এক অসম যুদ্ধ। আল্লাহর রহমতে মুসলিমরা এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছিলেন এবং এই বিজয়ের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।
পরাজিত হয়ে রাজা রডারিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায় এবং নিহত হয়। এই যুদ্ধের ফলে পুরো স্পেন জয় করা মুসলমানদের জন্য সহজ হয়ে যায়। গুরুত্বের বিচারে বলা যায় এই যুদ্ধ ছিল ইউরোপে ইসলাম প্রবেশের মাধ্যম।
তুরসের যুদ্ধ। ১১৪ হিজরীর দ্বিতীয় রমজান। গোটা স্পেন তখন মুসলিমদের দখলে। মুসলিমদের বিজয় অভিযান এগিয়ে চলছে। এক পর্যায়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুরস শহরে স্পেনের তৎকালীন আমীর আব্দুর রহমান গাফিকীর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী এবং চার্লস মার্টিলের নেতৃত্বে খ্রিস্টান বাহিনীর মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় মুসলিমরা বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে খ্রিস্টানদের কে পর্যুদস্ত করলেও অপর একটি বাহিনী পিছন থেকে মুসলিমদেরকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফলে মুসলিম বাহিনীকে শৃংখলাবদ্ধ করতে না পেরে আমির আব্দুর রহমান নিজেই তরবারী হস্তে শত্রু বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়েন। যুদ্ধ করতে করতে তিনি শহীদ হয়ে যান। আমির শহীদ হয়ে যাওয়ার পরও মুসলিম বাহিনী দমে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান সন্ধ্যা পর্যন্ত। একের পর এক তারা শাহাদাত বরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার পর উভয় বাহিনী যুদ্ধ বিরতি করতে বাধ্য হয়। মুসলিমদের আমিরের শাহাদাতের কারণে মুসলিমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আর বেশিক্ষণ অবস্থান করা সমীচীন মনে করল না। তারা স্পেনে ফিরে যেতে লাগলো। এই যুদ্ধকে معركه بلاط الشهداء (শহীদদের প্রাসাদের যুদ্ধ)ও বলা হয়। কেননা এই যুদ্ধে এত পরিমান মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেছিলেন যার দ্বারা একটা প্রাসাদ তৈরি করা সম্ভব ছিল। আল্লাহ তাদেরকে কবুল করুন। তাদের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। খ্রিস্টানরা তাদের এই যুদ্ধের বিজয়ের কথা ভুলেনি। কিছুদিন পূর্বে ক্রাইস্ট চার্চে এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী মুসলিমদের উপর জুমআর নামাযের সময় হামলা করেছিল। সে যে রাইফেল নিয়ে আক্রমণ করেছিল তাতে চার্লস মার্টিলের নাম লেখা ছিল।
বিজয়ের মাস রমজানের ঘটনাবলীর মাঝে এই কাহিনীর উল্লেখের কারণ হচ্ছে, আমাদের মুসলিমদের বিজয়ের কাহিনীর সাথে ত্যাগ এবং কুরবানীর কাহিনীর কথাও স্মরণ রাখতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের 140 নম্বর আয়াতে বলেছেন:
إن يمسسكم قرح فقد مس القوم قرح مثله، وتلك الايام نداولها بين الناس وليعلم الله الذين امنوا ويتخذ منكم شهداء،والله لايحب الظالمين.
যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে ঐ লোকদের ও অনুরূপ আঘাত লেগেছে। বস্তুত আমি এই দিনগুলি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তিত করতে থাকি, আর (আল্লাহ এরূপ করেছেন) এ জন্য, যাতে আল্লাহ তাদের জেনে নেন যারা প্রকৃত মুমিন এবং যেন তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর আল্লাহ জালিমদের কে ভালোবাসেন না।
আম্মুরিয়ার যুদ্ধ। ২২৩ হিজরীর 6ই রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আব্বাসী খলিফা মুতাসিমের সময় কালে রোমান সম্রাট নওফেল বিন মিকাইল মুসলিম ভূখন্ডের আক্রমণ চালায়। এসময় তারা শত শত মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা করে। অনেক মুসলিমকে বন্দী করে। এই সংবাদটি খলিফা মুতাসিমের কাছে পৌঁছে যায়। সেই সাথে এক মুসলিম নারীর চিৎকারের কথাও তার কাছে পৌঁছে। ওই নারীকে যখন কাফেররা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে চিৎকার করে ডাকছিলো: ওয়া মুতাসিমা.. ওয়া মুতাসিমা.. বলে। সাথে সাথে খলিফা বলে উঠলেন, লাব্বাইকি ইয়া উখতা-হ, লাব্বাইকি ইয়া উখতা-হ। তৎক্ষণাৎ তিনি সিংহাসন থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে সরাসরি রোমানদের সীমান্তের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন খলিফার আসার সংবাদ শুনে রোমানরা পালিয়ে গিয়েছে। রোমানদের না পেয়ে ক্রুদ্ধ খলিফা জিজ্ঞেস করলেন এ অঞ্চলে রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ কোনটা? সবাই বললো আম্মুরিয়া দুর্গ। তিনি তার সেনাবাহিনীকে এই দুর্গে আক্রমণ করার আদেশ দিলেন। তীব্র আক্রমণের পর মুসলিমরা দূর্গটি জয় করে নিল। এরপরও খলিফার রাগ মিটল না। তিনি দুর্গটি পুরোপুরি মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন।
সুবহানাল্লাহ! কোথায় খলিফা মুতাসিম আর কোথায় আজকের আমাদের মুসলিম দেশগুলোর নপুংসক শাসকবৃন্দ? বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে আজ মুসলিমরা নির্যাতিত। আরাকান, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, ইয়েমেন ও উইঘুর মুসলিমদের কান্নার আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছে। এই ভাইদেরকে আজ আশ্রয় দেওয়ার কেউ নেই। আরাকানের মুসলিমরা পালিয়ে আসছে আর তাদেরকে সমুদ্র থেকেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে তারা যখন সামান্য আশ্রয় পেল তখন প্রথমদিকে আবেগি মুসলিম জনতা তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেল। অথচ এখন তাদেরকে তারা সহ্য করতে পারছে না। তাদের নামে বিষোদাগার ও মিডিয়া প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ রুপী পশু। তাদের নামে পাঠানো অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজেদের পেট পুজো করে যাচ্ছে নামধারী মুসলিম শাসক ও তার কর্মচারীরা।
ফিলিস্তিনের মুসলিমদের জন্য আশেপাশের মুসলিম দেশগুলো সীমান্ত প্রাচীর তুলে দিয়েছে। এখন তারা এক খোলা কারাগারে আবদ্ধ হয়ে আছে। আশেপাশের সমস্ত মুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে যাচ্ছে একের পর এক। সেই সুযোগে ইহুদি সন্ত্রাসীগুলো নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিমদের পক্ষে বিভিন্ন কথা বলে জনপ্রিয়তা অর্জন কারী একজন শাসক; যাকে অনেকে মুসলিমদের সুলতানের আসনে বসিয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করার প্রতিবাদ স্বরুপ কিছুদিন ইজরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আবার নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করেছেন এই সুলতান। মুসলিমদের পক্ষে বড় বড় কথা বলে বাস্তব কোনো সাহায্য সহযোগিতা না করলেও তিনি ইজরায়েলে লাগা আগুন নেভাতে ছুটে যান। অথচ এই আগুন ছিল পুরো মুসলিম উম্মাহর অন্তরের প্রশান্তি। সিরিয়ার মুসলিমদের জন্য তিনি কিছুই করেন নি, উল্টো তাদের জিহাদের ফসল তোলার সময় সেই ফসলে আগুন লাগিয়ে দিলেন। লাগিয়ে দিলেন ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ।
কাশ্মীরে আগ্রাসনকারী চরম হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে না। অথচ কাশ্মীরি মুক্তিকামী মুজাহিদদেরকে জঙ্গী ট্যাগ দিতেও তাদের কোনো দ্বিধা নেই। মুসলিমদের দমনের জন্য চিরশত্রু ও ঐতিহাসিক শত্রুতা সত্ত্বেও ভারতের সাথে জোট করতে যাচ্ছে ইসলামের নামে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান।
সবচেয়ে নির্মম তামাশাটা করা হয়েছে উইঘুর মুসলিমদের সাথে। একেবারে নীরবে এই হতভাগ্য মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, খুন-ধর্ষণ কী হচ্ছে না তাদের সাথে? শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে বিক্রি করছে রক্তপিপাসু চায়নারা। নিষ্পাপ শিশুদেরকে তাদের মার কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের ধর্মীয়, এমনকি মানবিক অধিকার টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতির পরিচয়টুকু পর্যন্ত ভুলিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এই জালিমরা।
অন্যান্য নির্যাতিত মুসলিমরা জুলুম সইতে না পেরে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে পারলেও, উইঘুরদের ভাগ্যে তাও জুটছে না। মুসলিম দেশগুলো তাদেরকে ধরে ধরে চায়নার হাতে তুলে দিচ্ছে। এমনকি রাসূলের জন্মভূমি সৌদি আরবেও তারা আশ্রয় পাচ্ছে না। সেখান থেকেও চীন তাদেরকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
উইঘুর মুসলিমদের উপর এই নির্যাতন দেখে অনেক কাফের রাষ্ট্রও প্রতিবাদ করেছে। 22 টি রাষ্ট্র (যাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মত ক্রুসেডার রাষ্ট্রও ছিল, অথচ কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই।) জাতিসংঘের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
এর কয়েকদিন পর 37 টা দেশ চীনের পক্ষাবলম্বন করে এর বিরুদ্ধে পাল্টা চিঠি দেয়। যাদের মধ্যে পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান কাতার, বাহরাইন, কুয়েত এই মুসলিম দেশগুলোও ছিল। (পরবর্তীতে কাতার নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়)
যদিও জাতিসংঘ বা ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলো মুসলিমদের জন্য কিছু করবে না, তবুও মৌখিক প্রতিবাদটুকু করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি তথাকথিত মুসলিম শাসকরা।
আইনে জালুতের যুদ্ধ। 658 হিজরীর 25শে রমজান সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর মাঝে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর মুসলিম বাহিনী মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিধ্বস্ত করে দিতে সক্ষম হয়। কমান্ডার বাইবার্সের অপূর্ব রণদক্ষতায় মুসলিমরা হানাদার মোঙ্গলদেরকে প্রায় সাড়ে 300 কিলোমিটার পথ তাড়িয়ে নিয়ে যায়। গুটিকয়েক হানাদার বাদে সব মোঙ্গল সৈন্যকে মুসলিমরা হত্যা করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধের পর মোঙ্গলরা আর পূর্বের মত আগ্রসন চালিয়ে যেতে পারেনি। এ যুদ্ধ শুধুমাত্র মুসলিমদের রক্ষা করে নি। বরং এটা পুরো বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ছিল। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে আশঙ্কা ছিল বর্বর মোঙ্গলরা শুধু মিশর কেন, পুরো উত্তর আফ্রিকা এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমগ্র সভ্যতা ধ্বংস করে দিত।
এন্টিওক জয়। 666 হিজরীর প্রথম রমজান দীর্ঘ 170 বছর পর সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স মুসলমানদের হাত থেকে বেদখল হয়ে যাওয়া এন্টিওক শহরকে পুনরুদ্ধার করেন। এ শহরটি সর্বপ্রথম হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ইয়ারমুক যুদ্ধের পর মুসলিমদের অধিকারে আসে। পরবর্তীতে এগারোশো শতাব্দীতে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হলে খ্রিস্টানরা কৌশলগত এ শহরটি দখল করে নেয়। সুলতান বাইবার্স ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার চলমান যুদ্ধের এক পর্যায়ে এ শহরটি দখল করে নেন। এই যুদ্ধে অসংখ্য খ্রিস্টান সৈন্য নিহত এবং বন্দি হয়। এই যুদ্ধের পর খ্রিস্টান বাহিনী আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এবং মুসলিম ভূখণ্ড থেকে তাদের শিকড় পুরোপুরি উপড়ে ফেলা হয়।
সিন্ধু বিজয়। সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর কাছে জাহাজ ভর্তি কিছু উপঢৌকন পাঠান। ঐ জাহাজে কিছু মুসলিম পরিবারও ছিল। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জাহাজটি দেবল বন্দরে (বর্তমান করাচি) ভিড়তে বাধ্য হয়। তখন ভারতের রাজা দাহির জাহাজটিকে দখল করে ফেলে। এবং অনেক মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা ও বন্দি করে। এ সংবাদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর কাছে পৌঁছায়। সেই সাথে এক মুসলিম বোনের রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি ও পৌঁছায়। হাজ্জাজ প্রথমে রাজা দাহিরের কাছে দূত প্রেরণ করেন, যাতে সে মুসলিমদেরকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু দাহির হাজ্জাজের কথার ভ্রুক্ষেপ করে না। উপরন্তু দুতকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে হাজ্জাজ পরপর দুটি মুসলিম সেনাদল প্রেরণ করেন। সবশেষ নিজের 17 বছরের ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেন। 93 হিজরীর ৭ই রমজান মুহাম্মদ বিন কাসিম সর্বপ্রথম দেবল বন্দর বিজয় করেন। এরপর তিনি একের পর এক সিন্ধুর ভূখন্ড গুলো জয় করে করে অগ্রসর হন। এক পর্যায়ে রাওয়ার নামক স্থানে দাহিরের সাথে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা হয়। কয়েকদিন ব্যাপী যুদ্ধের পর মুসলিমরা বিজয়ী হয়। দাহির পরাজিত ও নিহত হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সিন্ধু বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণের জন্য মুসলমানদের পথ খুলে দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হতো উপমহাদেশের 'বাবুল ইসলাম' বা ইসলামের প্রবেশপথ।
যাল্লাকার যুদ্ধ। স্পেনে উমাইয়া আমীরদের শাসনের সময়টা শেষ হওয়ার পর স্পেনের গোত্রীয় আমিররা ভাগাভাগি করে স্পেন শাসন করতে শুরু করলো। এদেরকে বলা হতো তায়েফী আমির। সেসময় স্পেন 22 টি খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই আমিররা পরস্পর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতো। খ্রিষ্টান রাজা ষষ্ঠ আলফোনসো স্পেনে তখন অনেক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। এই সময়টা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তায়েফী শাসকরা পরস্পরকে পরাজিত করার জন্য খ্রিস্টানদের কে ডেকে নিয়ে আসত। খ্রিস্টানরাও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েনি। এসময় তায়েফী শাসকদের খ্রিস্টান রাজাদের নিকট উচ্চহারে কর দিতে হতো। ফলে খ্রিস্টানরা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠল। 478 হিজরীতে আলফোনসো স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য টলেডো দখল করে নেয়। এবার তায়েফী রাজারা বুঝতে পারে, তারা কর দিয়ে দিয়ে যে হাতকে এতদিন শক্তিশালী করেছে তা এখন তাদের শাহরগ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু এখন আলফোনসোর মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। তাই তারা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আফ্রিকার মহান বীর ইউসুফ বিন তাশফিনকে আলফোনসোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুরোধ করলো। তিনি তায়েফী রাজাদের অপরিণামদর্শীতার কথা জেনেও স্পেনে আসতে রাজি হলেন। 480 হিজরী 13ই রমজান যাল্লাকার প্রান্তরে ইউসুফ বিন তাশফিন, তায়েফী রাজাদের যৌথ বাহিনী ও আলফোনসো ও খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় পুরো খিষ্টান বাহিনী মুসলিমদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তারা।
তায়েফী রাজাদের এই একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বাঁচিয়ে দিল পুরো স্পেনের মুসলিম জাতিকে। কিন্তু তবুও তারা শোধরালো না। তাই ইউসুফ বিন তাশফিন স্পেন জয় করে নিলেন। তায়েফী রাজাদের বিতাড়িত করলেন। এর ফলে স্পেন পরবর্তী চারশো বছর টিকে থাকার রসদ পেয়ে যায়।
অসংখ্য ঘটনা থেকে অল্প কিছু ঘটনাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ঘটনাগুলো থেকে বুঝা গেল রমজান জিহাদের জন্য ও বিজয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রেরণাদায়ক। আমাদের উচিত জিহাদের জন্য রমজানে অধিক পরিমাণে কাজ করা। অধিক থেকে অধিক পরিমাণে সারিয়া প্রেরণ করা। কুফফারদের জন্য রমজান মাসকে বানাতে হবে আতংকের। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। এই মহান মাসের বরকত পুরোপুরি অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।
একেকটা নফল ইবাদতের বিনিময় এই মাসে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। প্রতিটা আমলের জন্যে রয়েছে 70 গুণ বেশি নেকি। এই মাসের একটি ফরজ অন্য মাসে 70 টি ফরজ এর সমান (সওয়াবের দিক থেকে)।
এটা পাথেয় সংগ্রহ করার মাস। একজন মুসাফির যখন তার গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু করে তখন তার পাথেয় সংগ্রহের প্রয়োজন হয়। যদি তার পাথেয় প্রয়োজনের তুলনায় কম হয় তাহলে মাঝপথে তা ফুরিয়ে গেলে তার অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় শোচনীয়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে মরীচিকার পিছনে দৌড়ায়। সুতরাং রমজানে যদি কেউ ঠিকমতো পাথেয় সংগ্রহ করতে না পারে, ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করে তার ঝুলি পূর্ণ করে নিতে না পারে, তাহলে তার রমজানের পরের পুরো বছরটা ঈমান-আমলের লাইনে হয় বিভীষিকাময়। সে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পদে পদে হোঁচট খায়।
রমজান হলো মুনাফা অর্জনের মাস। উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যবসায়ী। তার ব্যবসাটা লাভজনক। কিন্তু সমস্যা হল সে ব্যবসা করার জন্য সময় পাবে মাত্র এক মাস। এই মাসে তার ব্যবসা চলে জমজমাট। বাকি 11 মাস তার পুরো বেকার যায়। সুতরাং এই মাসেই তার এক বছরের জন্য রসদ সংগ্রহ করতে হবে। না হলে সে ও তাঁর পরিবারবর্গ না খেতে পেরে মারা যাবে। এক্ষেত্রে সে কি করবে? নিশ্চয়ই রাতদিন একাকার করে ফেলবে। বসে বসে অলসতা করে সময় নষ্ট করা তো বহু দূরের কথা। বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে চাইবে না মুহূর্ত পরিমাণ। নিলেও তা খুব অল্প সময়ের জন্য। আর আল্লাহ না করুন, অবহেলায় যদি দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায়, আর যথেষ্ট পরিমাণ মুনাফা ঘরে না উঠে, তাহলে তার অবস্থা কেমন হবে সহজেই কল্পনা করা যায়। এই ব্যবসায়ীর জন্য পুরো 11 মাসের তুলনায় এই মাসের গুরুত্ব যেমন একজন মুমিনের জন্য রমজান মাসের গুরুত্বও এমন।
এই কথাগুলো একেবারেই দলিলবিহীন নয়। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি সহীহ বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মিম্বারে আরোহণ করছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে তিনি বললেন আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন আমিন। তৃতীয় সিঁড়িতেও বললেন আমিন। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম রদিয়াল্লাহু আ'নহুম এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন: জিবরাইল আলাইহিস সালাম তিন ব্যক্তির জন্য ধ্বংসের দোয়া করেছেন। প্রথমজন যে রমজান মাস পেল, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক। উত্তরে আমি বলেছি আমিন। দ্বিতীয়, যে আপন মা বাবাকে অথবা তাদের যেকোনো একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, অথচ তাদের দ্বারা জান্নাত অর্জন করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক। আমি বলেছি আমিন। তৃতীয়, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম শুনল, কিন্তু তার উপর দরুদ পাঠ করলো না, সে ধ্বংস হোক। আমি বলেছি আমিন।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথমজন রমজান মাসকে অবহেলায় কাটিয়েছে। গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর দেওয়া এত বড় সুযোগকে হেলায় হারিয়েছে। ফলে তার বিরুদ্ধে একজন ফেরেশতা বদদোয়া করেছেন। যিনি কখনো গুনাহ করেন না, আল্লাহর নাফরমানি করেন না, সব সময় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন। মুহূর্তের জন্যও গাফেল হন না। তার ধ্বংসের জন্য তো এতোটুকুই যথেষ্ট। আর এখানে বদদোয়া করেছেন সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম। এর উত্তরে আমিন বলেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এই ব্যক্তির চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে?
এই কারণেই দেখা যায় যার রমজান খারাপভাবে কাটে। আমলবিহীন অতিবাহিত হয়, রমজান পরবর্তী সময় তার অবস্থা আরো খারাপ হয়। সে ওই পাথেয় সম্বল ফুরিয়ে যাওয়া মুসাফিরের মতো দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়। ওই নিঃস্ব ব্যবসায়ীর মত দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। কারণ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মতো ফেরেশতার দুআ ও আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমিন কখনো কবুল না হয়ে পারে না।
রমজান যেমন একজন ঈমানদার আমল কারীর জন্য রহমত, বরকত ও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট সুযোগ, তেমনি একজন গাফেলের জন্য অভিশাপ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
আরেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। মানুষকে এই দুনিয়ায় তিনি পাঠিয়েছেন খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি হিসেবে। ফেরেশতারা আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি, কেন আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এজন্য প্রথমে তারা বলেছিলেন- আল্লাহ কেন এমন জাতিকে সৃষ্টি করবেন, যারা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, রক্তপাত করবে? আল্লাহ বললেনঃ আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।
সূরা নূর এর 55 নং আয়াতে উল্লেখ আছে- মানবজাতির মধ্যে যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে আর সৎকাজ করবে তাদেরকে আল্লাহ জমিনের মধ্যে কর্তৃত্ব দান করবেন।
আল্লাহ তার এই ওয়াদা পূর্ণ করেছেন সাহাবায়ে কেরামের সময়। তাদেরকে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন। তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। দুনিয়ার বুকে দুশমনের ভয় থেকে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছেন।
আর আল্লাহ যাদেরকে জমিনে কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুরা হজের 41 নং আয়াতে যা বলেছেন তা হল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা। এই কাজগুলো করার জন্য ক্ষমতা থাকা জরুরি। না থাকলে অর্জন করা আবশ্যক। তার একমাত্র মাধ্যম হল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এ কারণেই জিহাদ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। কেননা তা আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করে।
এবার মূল কথায় আসি। রমজান হলো ইবাদতের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়। প্রতিটা ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ এই মাসে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে জিহাদের মত মহান এবাদত থেকে কেন এই মাস খালি থাকবে? খালি থাকেও নি।
ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই আজ পর্যন্ত অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এই মাসে। রমজান মাসে সংঘটিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে আল্লাহ মুসলিমদের বিজয় দান করেছেন। এজন্য রমজান শুধু সিয়াম আর কিয়ামের মাস না। এটা বীরত্ব ও বিজয়ের মাস।
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর। সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির 17ই রমজান। পুরো ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। মুসলিমদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। 1000 সুসজ্জিত মুশফিক বাহিনীর বিরুদ্ধে 313 জনের ক্ষুদ্র মুসলিম দলটিকে আল্লাহ অবিস্মরনীয় ভাবে বিজয় দান করেছিলেন। এই দিনটি ছিল ইয়াওমুল ফুরকান অর্থাৎ ফয়সালাকারী দিন। এই যুদ্ধে বিজয় দানের মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামের সত্যতা ও কাফেরদের ভ্রান্তি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।
মক্কা বিজয় হয়েছিল অষ্টম হিজরীর ২০ই রমজান। যেদিন কাবা পবিত্র হয়েছিল; দীর্ঘদিন যাবৎ কাবার অভ্যন্তরে জমে থাকা মূর্তির আবর্জনা থেকে। যে দিনটি ছিল ফাতহে মুবিনের বাস্তবায়ন দিবস। হুদাইবিয়ার সন্ধির দিন আল্লাহ যার ওয়াদা করেছিলেন। এটা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে। আরবের মানুষের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হয়েছে। যারা মদিনার মুসলিমও কুরাইশ কাফেরদের মধ্যকার যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল। কোন দল বিজয়ী হবে আর তারা সে দলে যোগ দিবে।
স্পেন বিজয়। 92 হিজরীর 28 রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। একদিকে তারিক বিন জিয়াদ এর নেতৃত্বে 12 হাজার মুসলিম সেনাবাহিনী। অপরদিকে স্পেনের রাজা রডারিক এর অধীনে এক লক্ষ খ্রিস্টান সৈন্য। সম্পূর্ণ অচেনা ভূখণ্ডে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এত বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করা সহজ ছিল না। এ ছিল এক অসম যুদ্ধ। আল্লাহর রহমতে মুসলিমরা এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছিলেন এবং এই বিজয়ের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।
পরাজিত হয়ে রাজা রডারিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায় এবং নিহত হয়। এই যুদ্ধের ফলে পুরো স্পেন জয় করা মুসলমানদের জন্য সহজ হয়ে যায়। গুরুত্বের বিচারে বলা যায় এই যুদ্ধ ছিল ইউরোপে ইসলাম প্রবেশের মাধ্যম।
তুরসের যুদ্ধ। ১১৪ হিজরীর দ্বিতীয় রমজান। গোটা স্পেন তখন মুসলিমদের দখলে। মুসলিমদের বিজয় অভিযান এগিয়ে চলছে। এক পর্যায়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুরস শহরে স্পেনের তৎকালীন আমীর আব্দুর রহমান গাফিকীর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী এবং চার্লস মার্টিলের নেতৃত্বে খ্রিস্টান বাহিনীর মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় মুসলিমরা বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে খ্রিস্টানদের কে পর্যুদস্ত করলেও অপর একটি বাহিনী পিছন থেকে মুসলিমদেরকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফলে মুসলিম বাহিনীকে শৃংখলাবদ্ধ করতে না পেরে আমির আব্দুর রহমান নিজেই তরবারী হস্তে শত্রু বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়েন। যুদ্ধ করতে করতে তিনি শহীদ হয়ে যান। আমির শহীদ হয়ে যাওয়ার পরও মুসলিম বাহিনী দমে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান সন্ধ্যা পর্যন্ত। একের পর এক তারা শাহাদাত বরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার পর উভয় বাহিনী যুদ্ধ বিরতি করতে বাধ্য হয়। মুসলিমদের আমিরের শাহাদাতের কারণে মুসলিমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আর বেশিক্ষণ অবস্থান করা সমীচীন মনে করল না। তারা স্পেনে ফিরে যেতে লাগলো। এই যুদ্ধকে معركه بلاط الشهداء (শহীদদের প্রাসাদের যুদ্ধ)ও বলা হয়। কেননা এই যুদ্ধে এত পরিমান মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেছিলেন যার দ্বারা একটা প্রাসাদ তৈরি করা সম্ভব ছিল। আল্লাহ তাদেরকে কবুল করুন। তাদের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। খ্রিস্টানরা তাদের এই যুদ্ধের বিজয়ের কথা ভুলেনি। কিছুদিন পূর্বে ক্রাইস্ট চার্চে এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী মুসলিমদের উপর জুমআর নামাযের সময় হামলা করেছিল। সে যে রাইফেল নিয়ে আক্রমণ করেছিল তাতে চার্লস মার্টিলের নাম লেখা ছিল।
বিজয়ের মাস রমজানের ঘটনাবলীর মাঝে এই কাহিনীর উল্লেখের কারণ হচ্ছে, আমাদের মুসলিমদের বিজয়ের কাহিনীর সাথে ত্যাগ এবং কুরবানীর কাহিনীর কথাও স্মরণ রাখতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের 140 নম্বর আয়াতে বলেছেন:
إن يمسسكم قرح فقد مس القوم قرح مثله، وتلك الايام نداولها بين الناس وليعلم الله الذين امنوا ويتخذ منكم شهداء،والله لايحب الظالمين.
যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে তবে ঐ লোকদের ও অনুরূপ আঘাত লেগেছে। বস্তুত আমি এই দিনগুলি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তিত করতে থাকি, আর (আল্লাহ এরূপ করেছেন) এ জন্য, যাতে আল্লাহ তাদের জেনে নেন যারা প্রকৃত মুমিন এবং যেন তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর আল্লাহ জালিমদের কে ভালোবাসেন না।
আম্মুরিয়ার যুদ্ধ। ২২৩ হিজরীর 6ই রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আব্বাসী খলিফা মুতাসিমের সময় কালে রোমান সম্রাট নওফেল বিন মিকাইল মুসলিম ভূখন্ডের আক্রমণ চালায়। এসময় তারা শত শত মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা করে। অনেক মুসলিমকে বন্দী করে। এই সংবাদটি খলিফা মুতাসিমের কাছে পৌঁছে যায়। সেই সাথে এক মুসলিম নারীর চিৎকারের কথাও তার কাছে পৌঁছে। ওই নারীকে যখন কাফেররা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে চিৎকার করে ডাকছিলো: ওয়া মুতাসিমা.. ওয়া মুতাসিমা.. বলে। সাথে সাথে খলিফা বলে উঠলেন, লাব্বাইকি ইয়া উখতা-হ, লাব্বাইকি ইয়া উখতা-হ। তৎক্ষণাৎ তিনি সিংহাসন থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে সরাসরি রোমানদের সীমান্তের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন খলিফার আসার সংবাদ শুনে রোমানরা পালিয়ে গিয়েছে। রোমানদের না পেয়ে ক্রুদ্ধ খলিফা জিজ্ঞেস করলেন এ অঞ্চলে রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ কোনটা? সবাই বললো আম্মুরিয়া দুর্গ। তিনি তার সেনাবাহিনীকে এই দুর্গে আক্রমণ করার আদেশ দিলেন। তীব্র আক্রমণের পর মুসলিমরা দূর্গটি জয় করে নিল। এরপরও খলিফার রাগ মিটল না। তিনি দুর্গটি পুরোপুরি মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন।
সুবহানাল্লাহ! কোথায় খলিফা মুতাসিম আর কোথায় আজকের আমাদের মুসলিম দেশগুলোর নপুংসক শাসকবৃন্দ? বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে আজ মুসলিমরা নির্যাতিত। আরাকান, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, ইয়েমেন ও উইঘুর মুসলিমদের কান্নার আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছে। এই ভাইদেরকে আজ আশ্রয় দেওয়ার কেউ নেই। আরাকানের মুসলিমরা পালিয়ে আসছে আর তাদেরকে সমুদ্র থেকেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে তারা যখন সামান্য আশ্রয় পেল তখন প্রথমদিকে আবেগি মুসলিম জনতা তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেল। অথচ এখন তাদেরকে তারা সহ্য করতে পারছে না। তাদের নামে বিষোদাগার ও মিডিয়া প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ রুপী পশু। তাদের নামে পাঠানো অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজেদের পেট পুজো করে যাচ্ছে নামধারী মুসলিম শাসক ও তার কর্মচারীরা।
ফিলিস্তিনের মুসলিমদের জন্য আশেপাশের মুসলিম দেশগুলো সীমান্ত প্রাচীর তুলে দিয়েছে। এখন তারা এক খোলা কারাগারে আবদ্ধ হয়ে আছে। আশেপাশের সমস্ত মুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে যাচ্ছে একের পর এক। সেই সুযোগে ইহুদি সন্ত্রাসীগুলো নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিমদের পক্ষে বিভিন্ন কথা বলে জনপ্রিয়তা অর্জন কারী একজন শাসক; যাকে অনেকে মুসলিমদের সুলতানের আসনে বসিয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করার প্রতিবাদ স্বরুপ কিছুদিন ইজরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আবার নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করেছেন এই সুলতান। মুসলিমদের পক্ষে বড় বড় কথা বলে বাস্তব কোনো সাহায্য সহযোগিতা না করলেও তিনি ইজরায়েলে লাগা আগুন নেভাতে ছুটে যান। অথচ এই আগুন ছিল পুরো মুসলিম উম্মাহর অন্তরের প্রশান্তি। সিরিয়ার মুসলিমদের জন্য তিনি কিছুই করেন নি, উল্টো তাদের জিহাদের ফসল তোলার সময় সেই ফসলে আগুন লাগিয়ে দিলেন। লাগিয়ে দিলেন ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ।
কাশ্মীরে আগ্রাসনকারী চরম হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে না। অথচ কাশ্মীরি মুক্তিকামী মুজাহিদদেরকে জঙ্গী ট্যাগ দিতেও তাদের কোনো দ্বিধা নেই। মুসলিমদের দমনের জন্য চিরশত্রু ও ঐতিহাসিক শত্রুতা সত্ত্বেও ভারতের সাথে জোট করতে যাচ্ছে ইসলামের নামে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান।
সবচেয়ে নির্মম তামাশাটা করা হয়েছে উইঘুর মুসলিমদের সাথে। একেবারে নীরবে এই হতভাগ্য মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, খুন-ধর্ষণ কী হচ্ছে না তাদের সাথে? শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে বিক্রি করছে রক্তপিপাসু চায়নারা। নিষ্পাপ শিশুদেরকে তাদের মার কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের ধর্মীয়, এমনকি মানবিক অধিকার টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতির পরিচয়টুকু পর্যন্ত ভুলিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এই জালিমরা।
অন্যান্য নির্যাতিত মুসলিমরা জুলুম সইতে না পেরে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে পারলেও, উইঘুরদের ভাগ্যে তাও জুটছে না। মুসলিম দেশগুলো তাদেরকে ধরে ধরে চায়নার হাতে তুলে দিচ্ছে। এমনকি রাসূলের জন্মভূমি সৌদি আরবেও তারা আশ্রয় পাচ্ছে না। সেখান থেকেও চীন তাদেরকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
উইঘুর মুসলিমদের উপর এই নির্যাতন দেখে অনেক কাফের রাষ্ট্রও প্রতিবাদ করেছে। 22 টি রাষ্ট্র (যাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মত ক্রুসেডার রাষ্ট্রও ছিল, অথচ কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই।) জাতিসংঘের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
এর কয়েকদিন পর 37 টা দেশ চীনের পক্ষাবলম্বন করে এর বিরুদ্ধে পাল্টা চিঠি দেয়। যাদের মধ্যে পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান কাতার, বাহরাইন, কুয়েত এই মুসলিম দেশগুলোও ছিল। (পরবর্তীতে কাতার নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়)
যদিও জাতিসংঘ বা ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলো মুসলিমদের জন্য কিছু করবে না, তবুও মৌখিক প্রতিবাদটুকু করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি তথাকথিত মুসলিম শাসকরা।
আইনে জালুতের যুদ্ধ। 658 হিজরীর 25শে রমজান সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর মাঝে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর মুসলিম বাহিনী মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিধ্বস্ত করে দিতে সক্ষম হয়। কমান্ডার বাইবার্সের অপূর্ব রণদক্ষতায় মুসলিমরা হানাদার মোঙ্গলদেরকে প্রায় সাড়ে 300 কিলোমিটার পথ তাড়িয়ে নিয়ে যায়। গুটিকয়েক হানাদার বাদে সব মোঙ্গল সৈন্যকে মুসলিমরা হত্যা করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধের পর মোঙ্গলরা আর পূর্বের মত আগ্রসন চালিয়ে যেতে পারেনি। এ যুদ্ধ শুধুমাত্র মুসলিমদের রক্ষা করে নি। বরং এটা পুরো বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ছিল। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে আশঙ্কা ছিল বর্বর মোঙ্গলরা শুধু মিশর কেন, পুরো উত্তর আফ্রিকা এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমগ্র সভ্যতা ধ্বংস করে দিত।
এন্টিওক জয়। 666 হিজরীর প্রথম রমজান দীর্ঘ 170 বছর পর সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স মুসলমানদের হাত থেকে বেদখল হয়ে যাওয়া এন্টিওক শহরকে পুনরুদ্ধার করেন। এ শহরটি সর্বপ্রথম হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ইয়ারমুক যুদ্ধের পর মুসলিমদের অধিকারে আসে। পরবর্তীতে এগারোশো শতাব্দীতে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হলে খ্রিস্টানরা কৌশলগত এ শহরটি দখল করে নেয়। সুলতান বাইবার্স ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার চলমান যুদ্ধের এক পর্যায়ে এ শহরটি দখল করে নেন। এই যুদ্ধে অসংখ্য খ্রিস্টান সৈন্য নিহত এবং বন্দি হয়। এই যুদ্ধের পর খ্রিস্টান বাহিনী আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এবং মুসলিম ভূখণ্ড থেকে তাদের শিকড় পুরোপুরি উপড়ে ফেলা হয়।
সিন্ধু বিজয়। সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর কাছে জাহাজ ভর্তি কিছু উপঢৌকন পাঠান। ঐ জাহাজে কিছু মুসলিম পরিবারও ছিল। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জাহাজটি দেবল বন্দরে (বর্তমান করাচি) ভিড়তে বাধ্য হয়। তখন ভারতের রাজা দাহির জাহাজটিকে দখল করে ফেলে। এবং অনেক মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা ও বন্দি করে। এ সংবাদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর কাছে পৌঁছায়। সেই সাথে এক মুসলিম বোনের রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি ও পৌঁছায়। হাজ্জাজ প্রথমে রাজা দাহিরের কাছে দূত প্রেরণ করেন, যাতে সে মুসলিমদেরকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু দাহির হাজ্জাজের কথার ভ্রুক্ষেপ করে না। উপরন্তু দুতকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে হাজ্জাজ পরপর দুটি মুসলিম সেনাদল প্রেরণ করেন। সবশেষ নিজের 17 বছরের ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেন। 93 হিজরীর ৭ই রমজান মুহাম্মদ বিন কাসিম সর্বপ্রথম দেবল বন্দর বিজয় করেন। এরপর তিনি একের পর এক সিন্ধুর ভূখন্ড গুলো জয় করে করে অগ্রসর হন। এক পর্যায়ে রাওয়ার নামক স্থানে দাহিরের সাথে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা হয়। কয়েকদিন ব্যাপী যুদ্ধের পর মুসলিমরা বিজয়ী হয়। দাহির পরাজিত ও নিহত হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সিন্ধু বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণের জন্য মুসলমানদের পথ খুলে দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হতো উপমহাদেশের 'বাবুল ইসলাম' বা ইসলামের প্রবেশপথ।
যাল্লাকার যুদ্ধ। স্পেনে উমাইয়া আমীরদের শাসনের সময়টা শেষ হওয়ার পর স্পেনের গোত্রীয় আমিররা ভাগাভাগি করে স্পেন শাসন করতে শুরু করলো। এদেরকে বলা হতো তায়েফী আমির। সেসময় স্পেন 22 টি খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই আমিররা পরস্পর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতো। খ্রিষ্টান রাজা ষষ্ঠ আলফোনসো স্পেনে তখন অনেক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। এই সময়টা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তায়েফী শাসকরা পরস্পরকে পরাজিত করার জন্য খ্রিস্টানদের কে ডেকে নিয়ে আসত। খ্রিস্টানরাও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েনি। এসময় তায়েফী শাসকদের খ্রিস্টান রাজাদের নিকট উচ্চহারে কর দিতে হতো। ফলে খ্রিস্টানরা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠল। 478 হিজরীতে আলফোনসো স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য টলেডো দখল করে নেয়। এবার তায়েফী রাজারা বুঝতে পারে, তারা কর দিয়ে দিয়ে যে হাতকে এতদিন শক্তিশালী করেছে তা এখন তাদের শাহরগ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু এখন আলফোনসোর মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। তাই তারা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আফ্রিকার মহান বীর ইউসুফ বিন তাশফিনকে আলফোনসোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুরোধ করলো। তিনি তায়েফী রাজাদের অপরিণামদর্শীতার কথা জেনেও স্পেনে আসতে রাজি হলেন। 480 হিজরী 13ই রমজান যাল্লাকার প্রান্তরে ইউসুফ বিন তাশফিন, তায়েফী রাজাদের যৌথ বাহিনী ও আলফোনসো ও খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় পুরো খিষ্টান বাহিনী মুসলিমদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তারা।
তায়েফী রাজাদের এই একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বাঁচিয়ে দিল পুরো স্পেনের মুসলিম জাতিকে। কিন্তু তবুও তারা শোধরালো না। তাই ইউসুফ বিন তাশফিন স্পেন জয় করে নিলেন। তায়েফী রাজাদের বিতাড়িত করলেন। এর ফলে স্পেন পরবর্তী চারশো বছর টিকে থাকার রসদ পেয়ে যায়।
অসংখ্য ঘটনা থেকে অল্প কিছু ঘটনাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ঘটনাগুলো থেকে বুঝা গেল রমজান জিহাদের জন্য ও বিজয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রেরণাদায়ক। আমাদের উচিত জিহাদের জন্য রমজানে অধিক পরিমাণে কাজ করা। অধিক থেকে অধিক পরিমাণে সারিয়া প্রেরণ করা। কুফফারদের জন্য রমজান মাসকে বানাতে হবে আতংকের। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। এই মহান মাসের বরকত পুরোপুরি অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।
Comment