বর্তমান সময়ের আমাদের উদারমনা অজ্ঞ মুসলিমদের এ বিষয়টি জানা খুবই জরুরি যে, কাফির ও ইসলামের দুশমনদের মৃত্যু বা বিপদে আমাদের দুঃখিত হওয়া উচিত নাকি আনন্দিত হওয়া। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু মানুষ আনন্দিত হয়, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ পড়ে এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। কিন্তু এর বিপরীতে অধিকাংশ মানুষ কারও মৃত্যু বা বিপদে আনন্দ প্রকাশকে বিকৃত চিন্তা ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ বলে মনে করে এবং এটাকে চরম মানবতা পরিপন্থী কর্ম হিসেবে বিবেচনা করে; চাই সে যার মৃত্যু বা বিপদই হোক না কেন।
আমাদের সমাজের লোকদের এমন উদার মানসিকতা মূলত কুরআন-সুন্নাহ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিরাত থেকে অর্জিত নয়; বরং অজ্ঞাতবশত কিংবা কুফফার গোষ্ঠীর ধোঁকাপূর্ণ মানবতার বুলি থেকেই তাদের এমন চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ তারা যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সালাফের জীবনী অধ্যয়ন করত, তাহলে স্পষ্টই দেখতে পেত, সবার মৃত্যুতে তাঁদের আচরণ একরকম ছিল না। মুমিন ও নেককারদের মৃত্যু আর কাফির ও বিভ্রান্তকারী ফাসিকদের মৃত্যুতে তাঁদের প্রতিক্রিয়া অভিন্ন ছিল না; বরং দু’ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মপদ্ধতি ও আচরণ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। চলুন তাহলে, কুরআন-হাদিস ও সালাফের আচরণের দিকে আমরা একটু ফিরে তাকাই।
* কুরআনের ভাষ্য:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحاً وَجُنُوداً لَمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيراً
‘হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্ঝাবায়ু ও এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম, যাদেরকে তোমরা দেখতে না। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা আল-আহজাব : ০৯)
লক্ষ্য করুন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফিরদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত আসমানি মুসিবত ও অদৃশ্য সেনাদলের সাহায্যকে মুমিনদের জন্য নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, ইসলামের শত্রু কাফিরদের ওপর কোনো বালা-মুসিবত আসলে সেটা মুমিনদের জন্য নিয়ামত। আর নিয়ামতে যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়, তাতে কোনো মুমিনের দ্বিমত থাকতে পারে না।
* হাদিসের ভাষ্য :
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ بْنِ رِبْعِيٍّ الأَنْصَارِيِّ، أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُرَّ عَلَيْهِ بِجِنَازَةٍ، فَقَالَ: مُسْتَرِيحٌ وَمُسْتَرَاحٌ مِنْهُ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا المُسْتَرِيحُ وَالمُسْتَرَاحُ مِنْهُ؟ قَالَ: العَبْدُ المُؤْمِنُ يَسْتَرِيحُ مِنْ نَصَبِ الدُّنْيَا وَأَذَاهَا إِلَى رَحْمَةِ اللَّهِ، وَالعَبْدُ الفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ العِبَادُ وَالبِلاَدُ، وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ.
‘কাতাদা বিন রিবয়ি আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পাশ দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি বললেন, সে নিজে স্বস্তি লাভ করল কিংবা তার থেকে অন্যরা স্বস্তি পেল। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্*র রাসুল, “সে নিজে স্বস্তি লাভ করল কিংবা তার থেকে অন্যরা স্বস্তি পেল” এর ব্যাখ্যা কী? তিনি বললেন, মুমিন বান্দা দুনিয়ার কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহ্*র রহমত অভিমুখে যাত্রা করে স্বস্তি লাভ করে। আর নাফরমান বান্দা থেকে সকল মানুষ, শহর-বন্দর, বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু স্বস্তি লাভ করে।’ (সহিহুল বুখারি: ৮/১০৭, হা. নং ৬৫১২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন :
وَقَالَ الدَّاوُدِيُّ أَمَّا اسْتِرَاحَةُ الْعِبَادِ فَلِمَا يَأْتِي بِهِ مِنَ الْمُنْكَرِ فَإِنْ أَنْكَرُوا عَلَيْهِ آذَاهُمْ وَإِنْ تَرَكُوهُ أَثِمُوا وَاسْتِرَاحَةُ الْبِلَادِ مِمَّا يَأْتِي بِهِ مِنَ الْمَعَاصِي فَإِنَّ ذَلِكَ مِمَّا يَحْصُلُ بِهِ الْجَدْبُ فَيَقْتَضِي هَلَاكَ الْحَرْثِ وَالنَّسْلِ... وَيَحْتَمِلُ أَنْ يَكُونَ الْمُرَادُ بِرَاحَةِ الْعِبَادِ مِنْهُ لِمَا يَقَعُ لَهُمْ مِنْ ظُلْمِهِ وَرَاحَةُ الْأَرْضِ مِنْهُ لِمَا يَقَعُ عَلَيْهَا مِنْ غَصْبِهَا وَمَنْعِهَا مِنْ حَقِّهَا وَصَرْفِهِ فِي غَيْرِ وَجْهِهِ وَرَاحَةِ الدَّوَابِّ مِمَّا لَا يَجُوزُ مِنْ إِتْعَابِهَا
‘আল্লামা দাউদি রহ. বলেন, (কাফিরের মৃত্যুতে) মানুষের স্বস্তির কারণ হলো, সে (জীবিত থাকাবস্থায়) শরিয়াবিরোধী কর্মকাণ্ড করত। এতে লোকেরা বাধা দিলে তাদের কষ্ট দিত আর বাধা না দিলে নিজেরা গুনাহগার হতো। আর শহর-বন্দরের স্বস্তির কারণ হলো, গুনাহ ও পাপাচার থেকে মুক্তি পাওয়া। কেননা, এর কারণে দুর্ভিক্ষ-অনাবৃষ্টি আসে; যার কারণে শস্যক্ষেত্র ও জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ...এটাও হতে পারে যে, মানুষের স্বস্তি পাওয়া বলতে তার জুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া। জগতের স্বস্তি পাওয়া বলতে তার জবরদখল, জমির অধিকার বিনষ্ট ও অপাত্রে ব্যবহার থেকে মুক্তি। আর জীবজন্তুর স্বস্তি বলতে অবৈধভাবে কষ্ট দেওয়া থেকে মুক্তি।’ (ফাতহুল বারি : ১১/৩৬৫, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي أَوْفَى، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى يَوْمَ بُشِّرَ بِرَأْسِ أَبِي جَهْلٍ رَكْعَتَيْنِ
‘আব্দুল্লাহ বিন আবু আওফা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আবু জাহলের মাথা কর্তনের ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হলে তিনি দু’রাকআত (শুকরিয়ার) নামাজ পড়লেন।’ (সুনানু ইবনি মাজাহ : ১/৪৪৫, হা. নং ১৩৯১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইল কুতুবিল আরাবিয়্যা, বৈরুত)
এ হাদিসটিতে লক্ষ্য করুন, আবু জাহলের মাথা কর্তনকে সুসংবাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামও জানতেন যে, ইসলামের দুশমন ও কাফিরদের মৃত্যু মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ। দ্বিতীয়ত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর শুনে রাগ বা দুঃখপ্রকাশ তো দূরে থাক, উল্টো অনেক খুশি হয়েছেন। তৃতীয়ত, কেবল খুশিই হননি; বরং শুকরিয়া স্বরূপ দু’রাকআত নামাজও আদায় করেছেন।
وَفِي رِوَايَةِ بن سَعْدٍ فَلَمَّا بَلَغُوا بَقِيعَ الْغَرْقَدِ كَبَّرُوا وَقَدْ قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تِلْكَ اللَّيْلَةَ يُصَلِّي فَلَمَّا سَمِعَ تَكْبِيرَهُمْ كَبَّرَ وَعَرَفَ أَنْ قَدْ قَتَلُوهُ ثُمَّ انْتَهَوْا إِلَيْهِ فَقَالَ أَفْلَحَتِ الْوُجُوهُ فَقَالُوا وَوَجْهُكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَرَمُوا رَأْسَهُ بَيْنَ يَدَيْهِ فَحَمِدَ اللَّهَ عَلَى قَتْلِهِ
‘ইবনে সাদের বর্ণনায় এসেছে, সাহাবায়ে কিরাম (ইসলামের দুশমন পাপিষ্ঠ কাব বিন আশরাফকে হত্যা করে) যখন বাকিউল গারকাদে পৌঁছলেন, তখন সবাই “আল্লাহু আকবার” বলে ধ্বনি দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে রাতে নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যখন তাঁদের তাকবির-ধ্বনি শুনতে পেলেন, তিনিও তাকবির-ধ্বনি দিলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা তাকে হত্যা করে ফেলেছে। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম তাঁর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন, সফল হোক (তোমাদের) চেহারাগুলো। তাঁরা প্রতিউত্তরে বললেন, এবং আপনার চেহারাও (সফল হোক), হে আল্লাহর রাসুল। তাঁরা তার (কর্তিত) মাথা তাঁর সামনে ফেললে তিনি তার নিহত হওয়ায় আল্লাহর প্রশংসা করলেন।’ (ফাতহুল বারি : ৭/৩৪০, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)
* সালাফের আচরণ :
قِتَالِهِمْ وَقَاتَلَهُمْ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَذَكَرَ فِيهِمْ سُنَّةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَضَمِّنَةَ لِقِتَالِهِمْ وَفَرِحَ بِقَتْلِهِمْ وَسَجَدَ لِلَّهِ شُكْرًا لَمَّا رَأَى أَبَاهُمْ مَقْتُولًا وَهُوَ ذُو الثدية
‘আলি রা. খারিজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাদের নিহত হওয়ায় তিনি আনন্দিত হয়েছেন এবং তাদের নেতা জুস-সুদাইয়াকে নিহত দেখে শুকরিায় স্বরূপ সিজদা দিয়েছেন।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২০/৩৯৪-৩৯৫, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
قِيلَ لِأَبِي عَبْدِ اللَّهِ: الرَّجُلُ يَفْرَحُ بِمَا يَنْزِلُ بِأَصْحَابِ ابْنِ أَبِي دُؤَادَ، عَلَيْهِ فِي ذَلِكَ إِثْمٌ؟، قَالَ: وَمَنْ لَا يَفْرَحُ بِهَذَا؟
‘ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, (দ্বীন বিকৃতিকারী ও ইসলামের চরম ক্ষতিকারী) ইবনে আবু দাউদের অনুসারী কারও বিপদে খুশি হলে কি গুনাহ হবে? তিনি উত্তরে বললেন, কে এতে খুশি হবে না!? অর্থাৎ সকল মুমিনই এতে খুশি হবে।’ (আস-সুন্নাহ, খাল্লাল : ৫/১২১, হা. নং ১৭৬৯, প্রকাশনী : দারুর রায়া, রিয়াদ)
قَالَ سَلَمَةُ بنُ شَبِيْبٍ: كُنْتُ عِنْدَ عَبْدِ الرَّزَّاقِ، فَجَاءنَا مَوْتُ عَبْدِ المَجِيْدِ، وَذَلِكَ فِي سَنَةِ سِتٍّ وَمائَتَيْنِ، فَقَالَ: الحَمْدُ للهِ الَّذِي أَرَاحَ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ مِنْ عَبْدِ المَجِيْدِ
‘সালামা বিন শাবিব রহ. বলেন, আমি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক রহ.-এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে তাঁর নিকট (মুরজিয়াদের নেতা) আব্দুল মাজিদের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছল। সময়টি ছিল তখন ২০৬ হিজরি। সংবাদ শুনে তিনি বলে উঠলেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি উম্মতে মুহাম্মাদিকে আব্দুল মাজিদ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৯/৪৩৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
وهب بن وهب بن وهب بن كبير بن عبد الله بن زمعة بن الأسود بن المطلب بن أسد بن عبد العزى بن قصي القاضي أبو البختري القرشي المدني... ولما بلغ ابن المهدي موته قال: الحمد لله الذي أراح المسلمين منه.
‘ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদি রহ.-এর নিকট অহাব বিন অহাব কুরাশির মৃত্যু সংবাদ পৌঁছলে বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি মুসলমানদেরকে তার থেকে স্বস্তি দান করেছেন।’ (লিসানুল মিজান: ৮/৪০২, প্রকাশনী : দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যা, বৈরুত)
الحسن بن صافي بن بزدن التُّرْكِيُّ كَانَ مِنْ أَكَابِرِ أُمَرَاءِ بَغْدَادَ الْمُتَحَكِّمِينَ فِي الدَّوْلَةِ، وَلَكِنَّهُ كَانَ رَافِضِيًّا خَبِيثًا مُتَعَصِّبًا لِلرَّوَافِضِ، وَكَانُوا فِي خِفَارَتِهِ وَجَاهِهِ، حَتَّى أَرَاحَ اللَّهُ الْمُسْلِمِينَ مِنْهُ فِي هَذِهِ السَّنَةِ فِي ذِي الْحِجَّةِ مِنْهَا، وَدُفِنَ بِدَارِهِ ثُمَّ نُقِلَ إلى مقابر قريش فلله الحمد والمنة. وحين مات فرح أهل السنة بموته فرحاً شديداً، وأظهروا الشكر لله، فلا تجد أحداً منهم إلا يحمد الله، فغضب الشيعة من ذلك، ونشأت بينهم فتنة بسبب ذلك
‘হাসান বিন সাফি বাগদাদের একজন স্বৈরাচারী গভর্নর ছিল। কিন্তু সে ছিল একজন নিকৃষ্ট রাফিজি ও রাফিজিদের পক্ষপাতিত্বকারী। রাফিজিরা সবাই তার তত্ত্বাবধান ও প্রভাবে চলত। অতঃপর এই বছর (৫৬৮ হিজরিতে) জিলহজ মাসে আল্লাহ তাআলা তার থেকে মুসলমানদের নিষ্কৃতি দিয়েছেন। প্রথমে তাকে তার বাসস্থানেই দাফন করা হয়েছিল, অতঃপর কুরাইশদের গোরস্থানে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়। সুতরাং সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ আল্লাহরই। সে মারা যাওয়ায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী সবাই অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। তুমি এমন কাউকে পাবে না, যে এ সংবাদে “আল-হামদুলিল্লাহ” বলেনি। এতে শিয়ারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং এর কারণে তাদের মাঝে ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছিল।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১২/৩৩৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
عبيد الله بن عبد الله بن الحسين أبو القاسم الخفاف، المعروف بابن النقيب... كتبت عنه وكان سماعه صحيحا، وكان شديدا في السنة، وبلغني أنه جلس للتهنئة لما مات ابن المعلم شيخ الرافضة وقال: ما أبالي أي وقت مت بعد أن شاهدت موت ابن المعلم.
‘ইবনুন নাকিব উবাইদুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ রহ.। ...(খতিবে বাগদাদি রহ. বলেন,) আমি তার থেকে হাদিস লিখেছি এবং তাঁর হাদিসশ্রবণ সঠিক। তিনি সুন্নাতের কঠোর পাবন্দ ছিলেন। আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, যখন তাঁর কাছে রাফিজিদের শাইখ ইবনুল মুআল্লিমের মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছল, তখন তিনি অভিনন্দন জানানোর জন্য বসে গেলেন এবং বললেন, ‘ইবনুল মুআল্লিমের মৃত্যু দেখার পর আমার আর কোনো পরোয়া নেই যে, আমি কখন মারা যাব।’ (তারিখু বাগদাদ : ১২/১১৬, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
এরকম প্রসিদ্ধ পাপাচারী, গোমরাহকারী, বিদআতি ও কাফিরদের মৃত্যুর সংবাদে খুশি হওয়ার দৃষ্টান্ত আরও অনেক আছে। সব উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে এবং পাঠক বিরক্ত হয়ে পড়বে। আত্মসমর্পণকারী মুমিন ও বিবেকবানদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
এসব দলিল ও বর্ণনায় আমরা দেখতে পেলাম, কাফিরদের ওপর আপতিত বিপদকে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য নিয়ামত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজে কাফিরদের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং শুকরিয়ার সালাতও আদায় করেছেন। তাঁর সাহাবায়ে কিরামও তেমনটি করেছেন। পরবর্তী সালাফ যাঁরা, তাঁরাও এর ব্যতিক্রম করেননি। আমাদের অনুসরণীয় এমন কোনো সালাফকে পাওয়া যাবে না, যিনি কাফির ও ইসলামের দুশমনদের মৃত্যুতে দুঃখিত হতে বা ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়তে বলেছেন। যে পথে আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলেছেন, যে পথে তাঁর সাহাবা চলেছেন এবং যে পথে আমাদের সালাফ চলেছেন, সেটাই আমাদের পথ, সেটাই আমাদের মত।
বিশ্ব কুফফার গোষ্ঠী যতই আমাদের মানবতার সবক শেখাক না কেন, আমরা তাদের ফাঁকা বুলিতে ধোঁকা খাওয়ার মতো মুসলিম নই। তাদের চালবাজি আর দ্বিমুখী আচরণ চক্ষুষ্মান কোনো মুমিনের আজ অজানা নয়। যেখানে জিম্মি কাফিরদের ব্যাপারেই ইসলাম নমনীয় নয়, সেখানে হারিব কাফিরদের জন্য আমাদের অজ্ঞ মুসলিম ভাইদের মায়াকান্না দেখলে বড় অবাক লাগে। সমস্যা হলো, আমরা কাফিরদের মিথ্যা বুলি ও প্রোপাগাণ্ডায় বিভ্রান্ত হতে পছন্দ করি, ভালোবাসি তাদের চাল-চলন ও আচার-আচরণকে এবং ফলো করি তাদের সকল আদেশ-নিষেধ ও মিথ্যা সংবাদকে। বস্তুত যতদিন না আমরা প্রকৃত তাওহিদ ও ওয়ালা বারা শিখব এবং রাসুলের পূর্ণাঙ্গ সিরাত অনুসরণ করব, ততদিন এভাবে আমাদের ধোঁকা খেয়েই যেতে হবে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, কাফিরদের ওপর আপতিত কোনো বিপদে মুসলমানদেরও কমবেশি ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু উভয়ের ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের বিপদ কাফিরদের জন্য আসে আজাব স্বরূপ, আর মুমিনদের জন্য আবির্ভূত হয় নিয়ামত হিসেবে। এতে কাফিররা মারা গেলে তাদের জন্য রয়েছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, যেখানে মুমিনদের জন্য রয়েছে শাহাদাতের মর্যাদা ও জান্নাতের শীতল ছায়া। তাই কাফিরদের ওপর আল্লাহর এ আজাব দেখে আমাদের ব্যথিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাদের এ বিপর্যয়ে বরং মুমিনদের আনন্দিত হওয়া উচিত। হ্যাঁ, এ বিপদের কিয়দংশ মুমিনদের গায়েও লাগতে পারে, কিন্তু সেটা আজাব হিসেবে নয়; বরং রহমত ও চিরমুক্তির পরোয়ানা হিসেবে। তাই এসব বিপদে কোনো মুমিন আক্রান্ত হলে আমরা অবশ্যই তার জন্য দুআ ও সাধ্যমতো সেবা-শুশ্রূষা করব, কিন্তু এর কারণে এটাকে কাফিরদের ওপর আজাব হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করা যাবে না।
এটাই সুন্নাহ যে, ইসলামের দুশমন যারা, তাদের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করা হবে, শুকরিয়ার সালাত আদায় করা হবে এবং অন্যদের কাছে এটাকে সুসংবাদ হিসেবে বলা হবে। এমন লোকদের মৃত্যুতে আমরা অবশ্যই আনন্দিত হই, যারা আমাদের অসংখ্য মুমিন ভাইকে হত্যা করেছে, আমাদের অগণিত বোনকে ধর্ষণ করেছে, হাজার হাজার জনপদ বিরান করেছে, পুরো বিশ্বে ত্রাস ও ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে; চাই তাদের মৃত্যু মুমিনদের পাল্টা আক্রমণে হোক কিংবা আসমানি কোনো মুসিবতের কারণে হোক। এমন লোকদের মৃত্যু আমাদেরকে সামান্যও ব্যথিত করে না। ইসলামের দুশনদের বিপদে একজন খাঁটি মুমিন কখনো মর্মাহত হতে পারে না। ইমানি মর্যাদাবোধ তাকে এমনটা করতে প্রবলভাবে বাধা দেবে। কুফফার গোষ্ঠীর মানবতার বুলি ও প্রোপাগাণ্ডার বিপরীতে আমার-আপনার ইমান কতটা দৃঢ়, এ থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করে নিন। আল্লাহ আমাদের প্রকৃত মুমিন হওয়ার তাওফিক দিন, যারা মুমিনদের প্রতি হবে রহমদিল, আর কাফিরদের ব্যাপারে হবে অত্যন্ত কঠোর।
©
Comment