শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং মুফতি তাকি উসমানি সাহেবের বক্তব্যের কিছু অসংগতি
ইসলাম আউর সিয়াসি নজরিয়াত কিতাবে তাকি উসমানি সাহেব শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে যে আলোচনা করেছেন, তাতে বেশ কিছু অসংগতি ঘটে গেছে। বিশেষত হানাফি মাযহাব বয়ানের ক্ষেত্রে। অতি সংক্ষেপে কয়েকটি অসংগতি তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ।
এক.
বর্তমান তাগুত শাসকদেরকে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ এবং আব্বাসী খলিফা মানসুরের হুকুমে ধরেছেন। স্পষ্ট যে, এটি একেবারেই না মুনাসিব একটি কিয়াস। উমাইয়া-আব্বাসী কোনো খলিফাই শরীয়ত প্রত্যাখ্যান করে কুফরি সংবিধান চালু করেনি। বেশির চেয়ে বেশি তারা যা করেছেন: ক্ষমতা ধরে রাখতে অনেকের উপর জুলুম করেছে এবং বাইতুল মালের সম্পদ অনেক ক্ষেত্রে নিজের সম্পদের মতো ভোগ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে জুলুম ও নাজায়েয। কিন্তু তারা তাগুত ছিলেন না। শরীয়ত প্রত্যাখ্যান করেননি। কাফেরদের দালালী করেননি। বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে ইসলাম পাকাপোক্তা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
পক্ষান্তরে বর্তমান তাগুত শাসকরা ইসলামের বিরুদ্ধে কাফেরদের পক্ষ নিয়ে মুসলিমদের হত্যা করছে। শরীয়ত প্রতিষ্ঠার সকল পথ বন্ধ করে দিয়ে কুফর পাকাপোক্তা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এদেরকে ইয়াজিদ বা মানসুরের উপর কিয়াস করা কুফরকে ঈমানের উপর কিয়াস করার নামান্তর।
দুই.
মুরতাদ শাসকসহ যেকোনো শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জায়েয হওয়ার জন্য তিনি দু’টি শর্ত আরোপ করেছেন: ক. যুদ্ধ করে শাসককে হটানোর মতো পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি থাকতে হবে।
খ. বর্তমানের চেয়ে বড় কোনো ফিতনা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা না থাকতে হবে।
প্রথমত মুরতাদ ও কাফের শাসকের বিরুদ্ধে কিতাল জায়েয হওয়ার জন্য এ দুই শর্ত কোনো ইমাম আরোপ করেছেন বা কুরআন সুন্নাহর কোথাও এসেছে বলে জানা নেই। মুরতাদ শাসকের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম বলেছেন,
يَنعَزِلُ بالكفر إجماعا فيجبُ على كل مسلمٍ القيامُ في ذلك، فمن قَوِيَ على ذلك فله الثوابُ، ومن داهن فعليه الإثمُ، ومن عَجَزَ وجبتْ عليه الهجرةُ من تلكَ الأرضِ. اهـ
“কুফরীর কারণে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। তখন প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ হলো, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথীলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম, তার জন্য আবশ্য হলো ঐ ভূমি থেকে হিজরত করা।” – ফাতহুল বারি: ১৩/১৫৩
“কুফরীর কারণে শাসক সর্বসম্মতিক্রমে অপসারিত হয়ে যাবে। তখন প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ হলো, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যে তাতে সক্ষম হবে, তার জন্য রয়েছে প্রতিদান। যে শিথীলতা করবে, সে গুনাহগার হবে। আর যে অক্ষম, তার জন্য আবশ্য হলো ঐ ভূমি থেকে হিজরত করা।” – ফাতহুল বারি: ১৩/১৫৩
মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে ফরয বলেছেন, শুধু জায়েয বলেননি।
শক্তি না থাকলে ঐ ভূমি থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে যেতে বলেছেন। অর্থাৎ যেখানে গেলে শক্তি সঞ্চয় করে এ মুরতাদকে হটানো সম্ভব।
পক্ষান্তরে তাকি উসমানি সাহেব মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে ফরয না বলে জায়েয বলেছেন। তাও আবার নিজ থেকে দু’টি শর্ত আরোপ করে দিয়েছেন।
স্পষ্ট যে, উপরোক্ত শর্ত দু’টি যদি পাওয়া যায়, তাহলে মুরতাদ কেন, মুসলিম জালেম শাসককেও হটিয়ে দেয়া ফরয। হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
ونقل بن التين عن الداودي قال الذي عليه العلماء في أمراء الجور أنه إن قدر على خلعه بغير فتنة ولا ظلم وجب وإلا فالواجب الصبر. فتح الباري لابن حجر (13/ 8)
ইবনুততীন রহ. দাউদি রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, জালেম শাসকদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের রায় হলো, যদি কোনো ফিতনা ও জুলুম ব্যতীত হটিয়ে দেয়া যায় তাহলে হটিয়ে দেয়া ফরয। অন্যথায় ফরয হচ্ছে সবর করে থাকা। -ফাতহুল বারি: ১৩/৮
ইবনুততীন রহ. দাউদি রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, জালেম শাসকদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের রায় হলো, যদি কোনো ফিতনা ও জুলুম ব্যতীত হটিয়ে দেয়া যায় তাহলে হটিয়ে দেয়া ফরয। অন্যথায় ফরয হচ্ছে সবর করে থাকা। -ফাতহুল বারি: ১৩/৮
তিন.
তিনি বলেছেন, হানাফি উলামাদেরও রায় হলো, জালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নাজায়েয, যতক্ষণ সে কাফের না হয়। দলীল হিসেবে তাহযিবুত তাহযিবে হাসান বিন সালিহ বিন হাই- এর জীবনী আলোচনায় ইবনে হাজার রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। এটি হানাফি মাযহাবের খেলাফ। বরং বড় ফিতনার আশঙ্কা না হলে জালেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জায়েয- এটাই হানাফি মাযহাবের মুফতা বিহি কওল।
ইবনে আবিদিন রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,
وقال في المسايرة: وإذا قلد عدلا ثم جار وفسق لا ينعزل ولكن يستحق العزل إن لم يستلزم فتنة. اهـ. وفي المواقف وشرحه: إن للأمة خلع الإمام وعزله بسبب يوجبه، مثل أن يوجد منه ما يوجب اختلال أحوال المسلمين وانتكاس أمور الدين كما كان لهم نصبه وإقامته لانتظامها وإعلائها، وإن أدى خلعه إلى فتنة احتمل أدنى المضرتين. اهـ. اهـ
“ইবনুল হুমাম রহ. ‘আলমুসাইয়ারাহ্’তে বলেন, আদেল ব্যক্তিকে খলিফা বানানোর পর যদি সে জুলুম করতে শুরু করে এবং ফাসেক হয়ে যায়, তাহলে সে বরখাস্ত ও অপসারিত হয়ে যাবে না। তবে ফিতনা না হলে অপসারণ করে দেয়ার সে উপযুক্ত’।
‘আলমাওয়াকিফ’ ও তার ব্যাখ্যাগ্রন্থে আছে, ‘যথোপযুক্ত কারণ থাকলে উম্মাহর অধিকার রয়েছে ইমামকে বরখাস্ত ও অপসারিত করে দেয়ার। যেমন, তার থেকে এমন কিছু পাওয়া যাওয়া যার দ্বারা মুসলমানদের অবস্থা অধঃপতিত হচ্ছে এবং দ্বীনের অবনতি হচ্ছে। যেমন তাদের অধিকার ছিল এসব বিষয়ের সুব্যবস্থা ও উন্নতির জন্য ইমাম নিয়োগ দেয়ার। যদি তাকে অপসারণ করতে গেলে ফিতনা দেখা দেয়, তাহলে তুলনামূলক কম ফিতনা যেটাতে সেটা অবলম্বন করা হবে’।”- রদ্দুল মুহতার ৪/২৬৪
অর্থাৎ যদি বিদ্রোহ করে অপসারণ করে দিলে দ্বীনের লাভ বেশি হবে মনে হয় তাহলে বিদ্রোহ করা যাবে। “ইবনুল হুমাম রহ. ‘আলমুসাইয়ারাহ্’তে বলেন, আদেল ব্যক্তিকে খলিফা বানানোর পর যদি সে জুলুম করতে শুরু করে এবং ফাসেক হয়ে যায়, তাহলে সে বরখাস্ত ও অপসারিত হয়ে যাবে না। তবে ফিতনা না হলে অপসারণ করে দেয়ার সে উপযুক্ত’।
‘আলমাওয়াকিফ’ ও তার ব্যাখ্যাগ্রন্থে আছে, ‘যথোপযুক্ত কারণ থাকলে উম্মাহর অধিকার রয়েছে ইমামকে বরখাস্ত ও অপসারিত করে দেয়ার। যেমন, তার থেকে এমন কিছু পাওয়া যাওয়া যার দ্বারা মুসলমানদের অবস্থা অধঃপতিত হচ্ছে এবং দ্বীনের অবনতি হচ্ছে। যেমন তাদের অধিকার ছিল এসব বিষয়ের সুব্যবস্থা ও উন্নতির জন্য ইমাম নিয়োগ দেয়ার। যদি তাকে অপসারণ করতে গেলে ফিতনা দেখা দেয়, তাহলে তুলনামূলক কম ফিতনা যেটাতে সেটা অবলম্বন করা হবে’।”- রদ্দুল মুহতার ৪/২৬৪
ফতোয়া দেয়ার উসূল হলো, যেকোনো বিষয় ঐ বিষয়ের নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে নিতে হবে। এক মাযহাব অন্য মাযহাবের কিতাব থেকে নেয়া যাবে না। ফিকহের মাসআলা ফিকহের কিতাব থেকে নিতে হবে, অন্য কিতাব থেকে বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো জায়গা থেকে নেয়া যাবে না।
তিনি এখানে এ সবগুলো উসূলের খেলাফ করেছেন। তাহযিবুত তাহযিব রিজালের কিতাব, ফিকহের কিতাব নয়। অধিকন্তু সেটি হানাফি মাযহাবের কিতাবও নয়, হানাফি কারও লেখাও নয়। মাযহাবের কিতাব বাদ দিয়ে সেখানকার বক্তব্য থেকে মাযহাব প্র্রমাণ করার চেষ্টা করা ফিকহ ফতোয়ার উসূলের খেলাফ।
Comment