যুদ্ধ বিরতি চুক্তি : পরিচয়, শরয়ী বিধান, বর্তমান প্রেক্ষাপট
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على رسول الله محمد وعلى آله وصحبه أجمعين أما بعد فاللهم أرنا الحق حقا وارزقنا اتباعه وأرنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه
পর কথা,
আমেরিকার সাথে তালিবান মুজাহিদগণের চুক্তির পর থেকে বিভিন্ন ভাইদের থেকে বিভিন্ন রকম মন্তব্য আসছে। আর সম্ভবত মন্তব্যগুলো ঐ সকল ভাইদের পক্ষ থেকে যারা মুজাহিদগণের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না কিংবা রাখলেও জোরালো সম্পর্ক নয়। অথবা তারা আইসিস দ্বারা প্রভাবিত। এর কিছু মন্তব্য খন্ডন করে দাওয়াহ ইলাল্লাহয় মুহতারাম ইলম ও জিহাদ ভাই, মুহতারাম আদনান মারুফ ভাই, মুহতারাম সুন্নী জিহাদী ভাই, মুহতারাম আবু উসাইমিন ভাইগণের পোস্টগুলো উল্লেখযোগ্য। তাই মুহতারাম ভাইগণের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাদের কিছু মন্তব্য নিম্নরূপ:
১. তালিবানদের আমেরিকার সাথে চুক্তি করা ঠিক হয়নি।
২. তালিবান কি জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল নাকি? যে, তারা এখন শুধু নিজেদের ভূখন্ড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারা কি অন্য দেশ গুলো জয় করবে না?
৩. তালিবান মনে হয় মুসলিম নামধারী মুরতাদ শাসক গোষ্ঠীকে মুসলিম মনে করে।
৪. তালিবান কি আল কায়দার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
৫. তালিবান কোমলপন্থি আর আল কায়দা চরম পন্থি ; কারণ তালিবান মুসলিম নামধারী শাসকদের মুরতাদ বলে না।
মূল আলোচনা
যুদ্ধ বিরতি চুক্তি هدنة أو موادعة أو سلم) পরিচয় :
শাব্দিক অর্থে: هدنة শব্দটি هدن থেকে অর্থ হলো স্থির হয়ে যাওয়া, موادعة শব্দটি ودع থেকে অর্থ হলো ছেড়ে দেওয়া, سلم শব্দটি سَلِم থেকে অর্থ হলো মুক্তি পাওয়া। ( আল মুগরিব ফী তারতীবিল মু'রিব : ১/৪১১, ২/৩৪৬, ২/৩৮১, আল ইনায়াহ ফাতহুল কাদীরের সাথে : ৫/৪৪০, আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ : ৪২/২০৫)
শরয়ী পরিভাষায় এই তিনটি শব্দের অর্থ হলো, মুসলিমদের কল্যাণার্থে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করা। ( আল মুগরিব : ১/৪১১, ২/৩৪৬, ২/৩৮১, আল ইনায়াহ : ৫/৪৪০, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ : ২/১১৭)
যুদ্ধ বিরতি চুক্তির শরয়ী বিধান:
এই চুক্তি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহ দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআন থেকে দলীল :
কুরআন থেকে দলীল :
وإن جنحوا للسلم فاجنح لها وتوكل على الله
যদি তারা ( কাফেররা) চুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে তোমরাও চুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করো। (সূরা আনফাল :৬১)
উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ ও কাতাদা রাঃ থেকে বর্ণিত আছে এই আয়াতটি পরবর্তী কিতালের আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। তাই এই ক্ষেত্রে জুমহুর উলামায়ে কেরাম বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাদীনায় বিভিন্ন ইহুদী গোত্রের সাথে চুক্তি করেছেন। মুশরিকদের সাথে চুক্তি করেছেন। হুদায়বিয়ায় সন্ধি করেছেন। আর এই চুক্তি গুলো ছিলো মুসলিমদের দুর্বলতার কারণে। পরবর্তীতে যখন মুসলিমরা শক্তিশালী হয় তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের সাথে ক্বিতালের নির্দেশ দেন। সুতরাং এখানে বিধানদ্বয় ভিন্ন ভিন্ন দুইটি অবস্থায় এসেছে তাই বিধানদ্বয়কে নিজ অবস্থায় রেখে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মুসলমানরা দুর্বল হলে তাদের কল্যাণার্থে সন্ধি বৈধ হবে। আর শক্তিশালী হলে ক্বিতাল করতে হবে। ( আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস রহিঃ থেকে সংক্ষেপে : ৩/৮৯)
সুন্নাহ থেকে দলীল:
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদায়বিয়াতে কাফিরদের সাথে সন্ধি করেছেন। (মুসনাদু আহমাদ : সুনানু আবী দাউদ:২৭৬০, মুসনাদু আহমদ : ১৮৯১০, নসবুর রায়াহ:৩/৩৮৮)
ইজমায়ে উম্মাহ থেকে দলীল :
সমস্ত ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের কল্যাণার্থে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করা বৈধ। ( বাদায়েয়ুস সানায়ে':৯/৩৬৯, ফাতহুল কাদীর:৫/৪৪০, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ:২/২১৭, শরহুয যারক্বানী:৩/১৪৮,মুগনিল মুহতাজ: ৪/২৬০, আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ : ৪২/২০৭)
কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি, ইমাম আলী আল মারগিনানী রহিঃ বলেন,
وإذا رأي الإمام أن يصالح أهل الحرب أو فريقا منهم بمال أو بغير مال وكان ذلك مصلحة المسلمين فلا بأس به لقوله تعالى وإن للسلم فاجنح لها وتوكل على الله
যদি ইমাম হরবীদের সাথে কিংবা হরবীদের কোনো একটি দলের সম্পদের বিনিময়ে কিংবা সম্পদ ছাড়া সন্ধি করতে চায় এবং তাতে মুসলমানদের কল্যাণ থাকে তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই ; কারণ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,যদি তারা ( কাফেররা) চুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে তোমরাও চুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করো। (সূরা আনফাল :৬১) (হেদয়াহ:৪/১৭১, ফাতহুল কাদীর:৫/৪৪০)
সন্ধির কিছু শর্ত:
১. মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হতে হবে। যদি কল্যাণকর না হয় সন্ধি বৈধ হবে না।
২. শরীয়াহ বিরোধী কোনো শর্ত থাকতে পারবে না। যেমন: কোনো অমুসলিম মুসলিম হয়ে মুসলমানদের নিকট আশ্রয় নিলে তাকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি) এই দুইটি শর্ত সর্বসম্মতিক্রমে।
৩. চুক্তির সময় নির্ধারণ করা।
৪. ইমাম বা ইমামের নায়েব উপস্থিত থাকা
এই দুইটি শর্তের ক্ষেত্রে ইখতিলাফ হয়েছে, হানাফী উলামায়ে কেরাম বলেন, সময় নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন নেই ; কারণ কুরআনের আয়াত এই ক্ষেত্রে ব্যাপক। তাতে সময় নির্ধারণ করার কথা নেই। তদ্রূপ ভাবে চতুর্থ শর্তটিও। (দেখুন: ফাতাওয়ে হিন্দিয়্যাহ : ২/২১৭-২১৮, আল মাওসুআহ:৪২/২০৭-২১৬)
এতক্ষণ আমরা সন্ধির পরিচয়, শর্ত, শরয়ী অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন আমরা একটু আফগান চুক্তির সাথে মিলিয়ে দেখবো যাতে করে আমরা এই খারেজিদের ফেতনা থেকে বাঁচতে পারি এবং মুজাহিদগণের ব্যাপারে পরিপূর্ণ আস্থা লাভ করতে পারি।
আমরা একটি কথা সর্বদা মাথায় রাখবো। তাহলো সন্ধিকে বিধিবদ্ধ করাই হয়েছে মুসলিমদের কল্যাণার্থে যাতে করে মুসলিমরা এই সময় শক্তি অর্জন করতে পারে। মুসলিমদের শক্তি থাকলে সন্ধি বৈধ নয়। কারণ তখন তাতে মুসলিমদের কল্যাণ থাকে না। (আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস : ৩/৮৯)
এখন আমরা মূল আলোচনায় আসি, প্রথমে আমরা তালিবান মুজাহিদগণের শর্তাবলী উল্লেখ করছি।
১. আমেরিকা চুক্তির পর ১৪ মাস সময়ের মধ্যে সমস্ত সেনা, গোয়েন্দা মোট কথা তাদের সমস্ত কর্মকর্তা প্রত্যাহার করে নিবে।
২. চুক্তির পর পাঁচ হাজার তালিবান বন্দি মুক্তি দিতে হবে। এর মধ্যে এক হাজার ১০ই মার্চ ২০২০ এর মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। যাতে করে অভ্যন্তরীণ আলোচনা শুরু করা যায়।
৩. ১৬ ই আগস্ট ২০২০ এর আগে তালিবান নেতৃবৃন্দের নাম ব্ল্যাক লিস্ট থেকে মুছে দিতে হবে এবং তাদের মাথার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. আমেরিকা আফগানের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৫. আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
নিশ্চয়ই তালিবান মুজাহিদগণের চুক্তি মুসলিমদের কল্যাণেই হয়েছে ; কারণ দীর্ঘ চল্লিশ বছর লড়াইয়ে উম্মাহ এখন ক্লান্ত শ্রান্ত। অনেক শক্তি ক্ষয় হয়েছে। এখন তাদের প্রয়োজন আরো শক্তি অর্জন করা। এখানে একটি শর্তও শরীয়াহ বিরোধী নয়। আর যুদ্ধ বিরতি চুক্তি এমনই হয়ে থাকে। এখন কেউ বলতে পারে, পাঁচ নম্বর শর্তটি কেমন যেন মনে হচ্ছে? তাহলে আমরা বলবো এই শর্ত ছাড়া চুক্তি সম্ভবই নয়। এই শর্ত না থাকলে আবার যেই সেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদাইবিয়াতে এর চেয়ে আরো কঠোর শর্তে চুক্তি করেছেন। যেমন, মুসলিম হলে ফিরিয়ে দেওয়া। আর চুক্তির দাবিই হলো একে অপরকে আঘাত না করা। সুতরাং আমরা বলতে পারি তালিবান মুজাহিদ গণের এই চুক্তি শরীয়াহ সম্মত চুক্তি।
এতক্ষণ ছিলো প্রথম আপত্তিটির জবাব।
দুই, তালিবান মুজাহিদগণ যদি এই চুক্তির কারণে জাতীয়তাবাদী হয়ে থাকেন তাহলে চৌদ্দশত বছর পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাতীয়তাবাদী ছিলেন; কারণ তখন তিনি হুদাইবিয়াতে বলেছিলেন, আমরা তোমাদের উপর আঘাত করবো না তোমরাও আমাদের উপর আঘাত করবে না। ( সুনানু আবী দাউদ : ২৭৬০, সীরাতে ইবনে ইসহাক :৪৬২ আর রহীকুল মাখতুম :২৯৯)নাউযুবিল্লাহ। আরে ভাই যুদ্ধ বিরতি চুক্তিই এমন হয়। এতে জাতীয়তাবাদী হওয়ার কী আছে।
তিন, তালিবান মুসলিম নামধারী শাসকদের মুসলিম মনে করলে এতোদিন দেশীয় মুরতাদ সরকারের সাথে লড়াই করতো না। আমেরিকা চলে গেলেই ক্ষান্ত হয়ে যেতো। আর স্বাভাবিক ভাবে যখন চুক্তি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে তখন চুক্তিবদ্ধ দেশ গুলোর বিরুদ্ধে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এটাই শরীয়ার নির্দেশ।
চার, তালিবান আল কায়দার সম্পর্ক হলো আমীর মা'মুরের। এখানে আর কিছু বললাম না। বুদ্ধিমানের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
পাঁচ, এটা কখনোই সম্ভব না। কারণ তালিবান কোমলপন্থি হলে এতোদিন পর্যন্ত চরমপন্থি আল কায়দার সাথে সম্পর্ক রাখতো না। এবং তাদের বাইয়াহ নিতো না।
অবশেষে একটি কথা বলে শেষ করছি, মুজাহিদ গণের কোনো বিষয় বুঝে না আসলে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করবো এবং মুজাহিদ আলেম গণের নিকট থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করে নিবো। শুধু শুধু না জেনে কোনো মন্তব্য করবো না।
আল্লাহ তা'আলা আমাদের বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
Comment