بسم الله الرحمن الرحيم
তাকফীরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কীকরণ
‘ত্রিশা পুস্তিকা”র সংক্ষেপণ
মূলঃ- শাইখ আবু মোহাম্মাদ আসিম আল মাকদেসী
ভাষান্তরেঃ- মুফতি ঊবাইদুল্লাহ হিন্দী
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমস্ত জগতের প্রতিপালক। দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা: এর উপর এবং তার পরিবারবর্গের উপর। আমীন!
আম্মাবাদ..
এটি হল শায়খ আবু মুহাম্মদ আসিম আল মাকদিসি হাফিজাহুল্লাহর মূল্যবান কিতাব ‘তাকফীরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কীকরণ প্রসঙ্গে ত্রিশা পুস্তিকা’র পরিমার্জিত ও সংক্ষিপ্তরূপ।
এই সংক্ষেপণের দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হল, কিতাবটিকে সর্বস্তরের ইসলামী চেতনার যুবকদের জন্য সহজবোধ্য করা। যেন ফায়েদা ব্যাপক হয় এবং সীমালংঘন, বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্য থেকে মুক্ত সঠিক জ্ঞানের প্রসার ঘটে।
এখানে আমি জানিয়ে দিচ্ছি: এই সংক্ষেপণ মূল কিতাবের পরিপূরক হবে না, বরং আমার আশা হচ্ছে, এই সংক্ষিপ্ত রূপটি মূল কিতাব পাঠের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।
আর আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি এই কাজে বরকত দান করুন, তাকে একনিষ্ঠভাবে তার সন্তুষ্টির জন্য কবুল করে নিন এবং এর দ্বারা তার লেখক ও পাঠককে উপকৃত করুন। আল্লাহর নিকট আরো প্রার্থনা করি, আল্লাহ তা’আলা সম্মানিত শায়খ আসিমকে ভরপুর প্রতিদান দিন, তাকে এবং আমাকে হকের উপর অটল রাখুন এবং আমাকে ও তাকে তার পথে শাহাদাতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি দান করুন। আমীন!
প্রথম পরিচ্ছেদ:
‘তাকফীর’ তথা কাফের আখ্যা দানে বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কতা প্রসঙ্গে:-
সম্মানিত পাঠক! আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এবং আপনাকে উপকারী ইলম অর্জন ও তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন! তাকফীর তথা তাকফীরের মাসআলাটি দ্বীনের অন্যান্য বিধি-বিধানের মতই একটি শরয়ী বিধান। তার রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং তার সাথে সম্পর্ক রাখে অনেক বিধি-বিধান ও মাসায়েল। এটি একটি স্পর্শকাতর মাসআলা। চূড়ান্ত স্পর্শকাতর। তার উপর ভিত্তি করে ইহকালীন ও পরকালীন অনেক ফলাফল আবর্তিত হয়। কিন্তু বহু লোক তা বুঝতে ব্যার্থ হয়েছে। ফলে এখানে অনেক পা স্খলিত হয়েছে এবং অনেক বুঝ বিভ্রান্ত হয়েছে।
মূলত: দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সংক্রান্ত মাসআলাসমূহের মধ্যে এটাই সর্ব প্রথম মাসআলা, যার মাঝে উম্মতের মতভেদ হয়েছে। এটা হচ্ছে শাস্তির প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত মাসআলা। যেমন ইবনে তাইমিয়া রা: উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন:
“মনে রাখবেন, কাফের বা ফাসেক আখ্যাদানের মাসআলাসমূহ হল নাম ও বিধান আরোপ সংক্রান্ত এমন মাসআলা, যার সাথে পরকালে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও জাহান্নামের সতর্কবাণী এবং দুনিয়াতে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, হত্যা, নিরাপত্তা লাভ ইত্যাদী বিধি-বিধান সম্পর্ক রাখে। কেননা আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য জান্নাত রেখেছেন এবং কাফেরদের জন্য তা হারাম করেছেন। এটা হল সর্বসময় এবং সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য সামগ্রীক বিধি-বিধানের অন্তর্ভূক্ত”। (মাজমূউল ফাতাওয়া ১২/২৫১)
উদাহরণত: তাকফীর বিষয়ে ফিক্হের কিতাবসমূহ অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পারবে, কী পরিমাণ মাসায়েল ও বিধি-বিধান এর সাথে সম্পর্ক রাখে। আর এ বিষয়টির গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতাও জানতে পারবে।
উদাহরণ স্বরূপ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সাথে সম্পর্কিত মাসআলাগুলো দেখুন: সেখানে রয়েছে-
মুসলিম শাসকদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা, তাদের সাহায্য করা ও তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা স্পষ্ট কুফর প্রকাশ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বের হওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধ করা জায়েয নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইসলামের গ-ির ভিতর থাকে ও আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী ফায়সালা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পিছনে নামায পড়া ও তাদের সঙ্গে মিলে জিহাদ করা শরীয়তে বৈধ; তারা নেককার হউক বা বদকার হউক। যে সমস্ত মুসলিমদের অভিভাবক নেই, মুসলিম শাসক তাদের অভিভাবক।
পক্ষান্তরে কাফের শাসকের বাইআত করা, তার সাহায্য করা, তার সাথে সখ্যতা করা বা তার সহযোগীতা করা জায়েয নেই। তার পতাকাতলে যুদ্ধ করা, তার পিছনে নামায পড়া বা তার কাছে বিচার ফায়সালা কামনা করা বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার কর্তত্ব বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার আনুগত্য আবশ্যক নয়। বরং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, তাকে অপসারণের চেষ্টা করা, তাকে প্রতিহত করার জন্য কাজ করা এবং তার স্থানে একজন মুসলিম শাসক বসানোর চেষ্টা করা ওয়াজিব।
এর উপর ভিত্তি করে মাসআলা বের হয়ে আসে:- যে তার সাথে বন্ধুত্ব করে বা তার কুফর বা কুফরী আইন-কানুনের সাহায্য করে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, তা দৃঢ় করার কাজে অংশগ্রহণ করে, তার বিধান পাশ করে বা তদানুযায়ী বিচার ফায়সালা করে (-যা বর্তমানে বিচারপতি ও এজাতীয় লোকদের অবস্থা) সে কাফের।
নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কোন মুসলিমের উপর কাফেরের কর্তৃত্ব বৈধ নয়। সুতরাং কোন কাফেরের জন্য মুসলমানদের গভর্ণর বা বিচারক হওয়া, তাদের নামাযের ইমামতি করা, কোন মুসলিম রমনীর বিবাহে অভিভাবক হওয়া, মুসলমানদের সন্তানদের অভিভাবক হওয়া ও তাদের লালন-পালন করা অথবা মুসলমানদের ইয়াতীম বা এজাতীয় লোকদের সম্পদের তত্ববধান করা বৈধ নয়।
বিবাহ সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কোন কাফেরের জন্য কোন মুসলিম নারীকে বিবাহ করা জায়েয নেই এবং সে তার বিবাহের অভিভাবকও হতে পারবে না...। যখন কোন মুসলিম পুরুষ মুসলিম নারীকে বিবাহ করে, অত:পর সে মুরতাদ হয়ে যায় তখন তার বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে এবং তাদেরকে পৃথক করে দেওয়া হবে।
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: জমহুর উলামায়ে কেরামের নিকট ধর্মের ভিন্নতা উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক।
রক্ত ও ‘কিসাস’ (হত্যার বদলায় হত্যার শাস্তি)র বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কাফেরের বদলায় মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না...। হারবী কাফের বা মুরতাদকে ইচ্ছাকৃত বা ভুল বশত: হত্যা করলে কোন কাফ্ফারা বা দিয়্যত নেই। পক্ষান্তরে মুসলিমের বেলায় দিয়্যত ওয়াজিব হবে...।
জানাযা সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কাফেরের জানাযা পড়া যাবে না, গোসল দেওয়া যাবে না এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা যাবে না। তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা বা তার কবরের পাশে দ-ায়মান হওয়া জায়েয নেই। পক্ষান্তরে মুসলিমের বিধান এর বিপরীত।
বিচার সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কাফেরের বিচারপতি হওয়া বৈধ নয়। মুসলিমের জন্য কাফেরের সাক্ষ্য জায়েয নেই...। কুফরী আইনের মাধ্যমে বিচার ফায়সালাকারী কাফের বিচারকের নিকট বিচার-ফায়সালার জন্য যাওয়া জায়েয নেই। শরয়ীভাবে তার ফায়সালা কার্যকর হবে না এবং তার কোন ফলাফলও বর্তাবে না।
যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: কাফের, মুশরিক ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ আর বিদ্রোহী ও অবাধ্য মুসলিমদের সাথে যুদ্ধের মাঝে পার্থক্য করা হবে। তাই মুসলিমদের মুদাব্বার (মুনিবের মৃত্যুর সাথে যে ক্রীতদাসের মুক্তিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে তাকে) কে কিছু বলা হবে না। তাদের আহতদেরকে মেরে ফেলা যাবে না। তাদের সম্পদর গনিমত হবে না, তাদের নারীদেরকে বন্দী করা হবে না ইত্যাদি, যা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে বৈধ মনে করা হয়। মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের ক্ষেত্রে মূল বিধান হচ্ছে তার ঈমানের কারণে তা সুসংরক্ষিত বা নিরাপদ। পক্ষান্তরে কাফেরের এ সমস্ত বিষয়ের মূল বিধান হচ্ছে তা মুসলিমদের জন্য বৈধ; তবে যদি নিরাপত্তাচুক্তি বা এধরণের কোন মাধ্যমে তা নিরাপদ হয়, তবে ভিন্ন কথা।
বন্ধুত্ব ও সম্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে: মুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব ওয়াজিব; তার থেকে পরিপূর্ণভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা জায়েয নেই। তবে তার গুনাহসমূহ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে...। আর কাফেরের সাথে বন্ধুত্ব করা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করা বা মুসলমানদের গোপন তথ্য তাকে জানিয়ে দেওয়া হারাম। বরং তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে হবে। তার সাথে সম্প্রীতি জায়েয নেই।
[ ইনশাআল্লাহ চলবে .........]
Comment