তাকওয়া হাসিলের উপায়
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
হযরত ওলামায়ে কেরাম, তালিবে ইলম সাথীগণ ও উপস্থিত সুধিবৃন্দ!
‘ইসলাহে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির বিষয়ে কিছু কথা আপনাদের খিদমতে পেশ করতে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত আমি নিজেই ইসলাহের মুহতাজ। যার নিজেরই ইসলাহের প্রয়োজন, সে অন্যকে এ বিষয়ে কী বলতে পারে!
দ্বিতীয়ত এ মজলিসে বুযুর্গ ব্যক্তিগণ উপস্থিত আছেন। তাঁদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া দুঃসাহসিকতাও বটে। কিন্তু বুযুর্গগণ বলেছেন, ‘আলআমরু ফাওকাল আদব’ অর্থাৎ মুরববীগণ কোনো কাজের নির্দেশ দিলে তা মান্য করাই আদব। তাই নিদের্শ পালনার্থে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমি কুরআন মজীদের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। তার সামান্য ব্যাখ্যা আরজ করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ইখলাসের সাথে বলার তাওফীক দান করুন।
আয়াতের তরজমা হল, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য রাস্তা তালাশ কর এবং তাঁর রাস্তায় মেহনত কর। যাতে এসব কিছুর ফলে তোমাদের সফলতা অর্জিত হয় দুনিয়াতেও, আখিরাতেও।’ (সূরা : মায়িদা : ৩৫)
তাকওয়া এক অতন্দ্র প্রহরী
এ হল আয়াতের অনুবাদ। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে প্রথমে তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুরা কুরআন মজীদ তাকওয়ার নির্দেশে পরিপূর্ণ। স্থানে স্থানে একটু পরপরই তাকওয়ার নির্দেশ এসেছে। কুরআন মজীদের রীতি হল, কোনো নির্দেশ বা বিধান জারি করার পূর্বে বা পরে সাধারণত তাকওয়ার আদেশ করা হয়। কারণ তাকওয়াই হচ্ছে ওই বস্ত্ত, যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার যে কোনো হুকুম পাবন্দীর সাথে মেনে চলতে বাধ্য করে। দুনিয়ার ক্ষেত্রে দেখুন, কোনো সরকার জনগণের জন্য আইন-কানুন জারি করলে অনেক সময় তা কয়েক পয়সার বিনিময়ে বেচাকেনা হয়ে যায়। ঘুষের বাজার গরম হয়ে ওঠে, আর সে বিধানের কোনো মূল্যই থাকে না। প্রকাশ্যে তা লঙ্ঘিত হতে থাকে।
আর কোনো এলাকায় আইন-কানুনের পাবন্দি থাকলেও দেখা যায়, তা কেবল পুলিশের ডান্ডা ও আদালতী ঝামেলার ভয় থাকা পর্যন্তই। এরপর আর কেউ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু একান্ত নির্জনতায় এবং নিশুতি রাতের অন্ধকারেও যে জিনিস মানুষের অন্তরে অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করে তা হল আল্লাহ তাআলার ভয়।
খোদাভীতির একটি দৃষ্টান্ত
হযরত ওমর রা. তাঁর খেলাফতকালে লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা মদীনা মুনাওয়ারায় টহল দিতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের পর টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা জায়েয নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে। তো কথাবার্তার ধরন শুনে তাঁর কৌতূহল হল। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান করা কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’
মেয়ে উত্তরে বলল, ‘মা! আমীরুল মুমিনীন তো দুধের সাথে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।’
এবার মেয়ে বলল, ‘মা, আমীরুল মুমিনীন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো আছেন! তিনি তো দেখছেন! তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’
ওমর রা. দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন যে, ‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’
এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমীরুল মুমিনীনের পুত্রবধু হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করলেন খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয রাহ., যাকে পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ বলা হয়।
তো মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগরুক থাকা যে, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন’-এর নামই তাকওয়া।
কয়েক বছর আগে এক সফরে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর হিউস্টনে (houston) গিয়েছিলাম। ‘নাসা’র (NASA) সবচেয়ে বড় কেন্দ্র সেখানেই অবস্থিত। আমার মেজবান আমাকে তা পরিদর্শন করানোর জন্য নিয়ে গেলেন। এটা ‘নাইন-ইলেভেন’-এর আগের কথা। এখন কী অবস্থা জানি না। একপর্যায়ে আমরা সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর’ অংশে প্রবেশ করলাম, যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম, দেয়ালে একটি বোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে স্পষ্ট অক্ষরে `You are being watched’ ‘আপনার প্রতি লক্ষ রাখা হচ্ছে’ বা সর্বক্ষণ আপনি আমাদের নজরে রয়েছেন। ব্যাস, এটুকুই! কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই, পুলিশ নেই। শুধু এটুকু লেখা যে, আপনাকে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রবেশকারী বোর্ডের লেখা পড়েই বুঝতে পারে যে, গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ রাখা হচ্ছে, ফলে সে তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যায়। এমন কোনো কাজ করে না, যার ফলে তাকে জবাবদিহি বা গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে হবে।
লেখাটি পড়ে আমি ভাবলাম, ‘এ বোর্ডের কারণে এখানে প্রবেশকারী সবাই সতর্ক হয়ে চলে। আহা! এ অনুভূতিই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, You are being watched by Allah taaala ‘আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমাকে দেখছেন।’
ان الله ان الله يعلم ما تفعلون
يعلم ما تفعلون
‘তোমরা যা করছ, সব তিনি জানেন।’
আমাদের সবার মনে যদি এই চেতনা সদাজাগ্রত থাকে যে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন তাহলে আমাদের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না, একে অপরের হক নষ্ট করবে না। আল্লাহ তাআলার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না। কেবল এই একটি জিনিসই মানুষকে অন্যায়-অপরাধ এবং পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারে। এরই নাম তাকওয়া। নবীগণের মেহনত এবং নবী প্রেরিত হওয়া ও কিতাব নাযিল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা।
তাকওয়া অর্জনের উপায়
কুরআন মজীদের এ আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হল, তাকওয়া অর্জিত হবে কীভাবে? আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে তাকওয়ার নির্দেশ দানের পাশাপাশি তা অর্জনের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
প্রথমটি হল,
وابةغوا اليه الوسيلة وابتغوا اليه الوسيلة
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য ‘ওসীলা’ তালাশ কর। ‘ওসীলা’ কী? মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘ওসীলা’ হল নেক আমল। যত বেশি নেক আমল করবে, ততই তাকওয়া হাসিল হবে এবং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জিত হবে। কেউ অন্য ব্যাখ্যাও করেছেন। একটি ব্যাখ্যা হল-যার সমর্থন অন্য আয়াতেও পাওয়া যায়-‘ওসীলা’ তালাশ করার অর্থ এমন ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করা, যাঁরা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। এটি তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা।
সোহবতের প্রভাব
সোহবত বা সাহচর্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। সোহবতের গুণে মানুষের কর্ম ও চিন্তায় এবং চরিত্র ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আসে।
দ্বীন মূলত সোহবতের মাধ্যমেই চলে আসছে। সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবত অবলম্বন করেছিলেন। সাহাবীদের সোহবত লাভ করেছেন তাবেঈগণ। এভাবে তাবেঈগণের সোহবত লাভ করেছেন তাবে তাবেঈগণ। তাঁদের যুগকেও গণ্য করা হয়েছে সর্বোত্তম যুগের মাঝে।
তাই প্রকৃতপক্ষে বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতের দ্বারাই মানুষের মাঝে দ্বীন পয়দা হয়।
হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. বলেছেন,-‘সাহাবায়ে কেরাম রা. হলেন নবীগণের পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। নবীগণের পরই তাঁদের মর্যাদা। যত বড় ওলী-বুযুর্গ, পীর-মাশায়েখই হোন না কেন, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদার ধারেকাছেও কেউ পৌঁছতে পারবেন না।
পরবর্তী ব্যক্তিদের নামের শুরুতে সম্মানসূচক বিভিন্ন উপাধি ব্যবহার করা হয়। কুতুবুল আকতাব, শায়খুল ইসলাম, ফখরুল মুহাদ্দিসীন, ফকীহুল আসর ইত্যাদি বলা হয়। ‘ইমাম’ উপাধিতে স্মরণ করা হয়। অথচ সাহাবায়ে কেরামের নামের সাথে এ জাতীয় কোনো খেতাব ব্যবহার করা হয় না। কেউ বলে না যে, ইমাম আবু বকর রা. বা মুফতী আবু বকর রা.। কোনো সাহাবীর নামের সাথেই এমন গুরুগম্ভীর বা আড়ম্বরপূর্ণ উপাধি নেই।
শাহ ছাহেব রাহ. বলেন, এর কারণ হল, সাহাবীগণের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য কোনো উপাধির প্রয়োজন নেই। সাহাবী বলার পর আর কিছুই বলার প্রয়োজন হয় না। সাহাবী বলা মানে সবকিছু বলা।
শেখ সাদী রাহ. সুন্দর বলেছেন-
‘যার চেহারাই চাঁদের মতো, তার সাজগোজের কী প্রয়োজন!
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবতের কারণে সাহাবাগণ যে মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন ‘সাহাবী’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষণ ব্যবহার করে তা বর্ণনা করা কঠিন।
সারকথা এই যে, দ্বীন অর্জনের মূল পদ্ধতি সোহবত। যারা মনে করে যে, শুধু বই পড়েই দ্বীনদার হয়ে যাব, তাদের ধারণা সঠিক নয়।
অনেক সময় আল্লাহওয়ালাদের সামান্য সাহচর্য মানুষের জীবনের গতিধারা পাল্টে দেয়। কবি বলেছেন-
يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد ساله طاعت بى رياء
ساله طاعت بى رياء
আল্লাহ ওয়ালাদের সামান্য সময়ের সোহবত একশত বছরের রিয়ামুক্ত ইবাদতের চেয়েও উত্তম!’
হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে কেউ বলল, হযরত! এ তো অতিরঞ্জন বলে মনে হচ্ছে। একশত বছর ইখলাসের সাথে ইবাদত করে একজন যা অর্জন করল, সামান্য সময় আল্লাহওয়ালার সোহবতে থেকেই আরেকজন তেমনি লাভবান হয়ে গেল! তা কীভাবে হয়?
হযরত রাহ. বললেন, ‘ভাই! অতিরঞ্জন নয়, শত বছর না বলে যদি শত লক্ষ বছর বলা হত তাহলেও অতিশয়োক্তি হত না। কারণ ইবাদতের জন্য শুধু রিয়ামুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, তা সহীহ তরীকায় হওয়াও জরুরি। আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতের দ্বারা ইবাদতের তরীকা সহীহ হয়। তেমনি ফিকির ও মেজাযের উন্নতি হয়। আল্লাহ তাআলার মুহাববত নিয়ে ইবাদত করতে শেখে, ফলে ইবাদত আল্লাহর দরবারে মকবুল হয় এবং তার মান বহু গুণে বেড়ে যায়।
বাকি অংশ নিচে...........
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
হযরত ওলামায়ে কেরাম, তালিবে ইলম সাথীগণ ও উপস্থিত সুধিবৃন্দ!
‘ইসলাহে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির বিষয়ে কিছু কথা আপনাদের খিদমতে পেশ করতে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত আমি নিজেই ইসলাহের মুহতাজ। যার নিজেরই ইসলাহের প্রয়োজন, সে অন্যকে এ বিষয়ে কী বলতে পারে!
দ্বিতীয়ত এ মজলিসে বুযুর্গ ব্যক্তিগণ উপস্থিত আছেন। তাঁদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া দুঃসাহসিকতাও বটে। কিন্তু বুযুর্গগণ বলেছেন, ‘আলআমরু ফাওকাল আদব’ অর্থাৎ মুরববীগণ কোনো কাজের নির্দেশ দিলে তা মান্য করাই আদব। তাই নিদের্শ পালনার্থে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমি কুরআন মজীদের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। তার সামান্য ব্যাখ্যা আরজ করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ইখলাসের সাথে বলার তাওফীক দান করুন।
আয়াতের তরজমা হল, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য রাস্তা তালাশ কর এবং তাঁর রাস্তায় মেহনত কর। যাতে এসব কিছুর ফলে তোমাদের সফলতা অর্জিত হয় দুনিয়াতেও, আখিরাতেও।’ (সূরা : মায়িদা : ৩৫)
তাকওয়া এক অতন্দ্র প্রহরী
এ হল আয়াতের অনুবাদ। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে প্রথমে তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুরা কুরআন মজীদ তাকওয়ার নির্দেশে পরিপূর্ণ। স্থানে স্থানে একটু পরপরই তাকওয়ার নির্দেশ এসেছে। কুরআন মজীদের রীতি হল, কোনো নির্দেশ বা বিধান জারি করার পূর্বে বা পরে সাধারণত তাকওয়ার আদেশ করা হয়। কারণ তাকওয়াই হচ্ছে ওই বস্ত্ত, যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার যে কোনো হুকুম পাবন্দীর সাথে মেনে চলতে বাধ্য করে। দুনিয়ার ক্ষেত্রে দেখুন, কোনো সরকার জনগণের জন্য আইন-কানুন জারি করলে অনেক সময় তা কয়েক পয়সার বিনিময়ে বেচাকেনা হয়ে যায়। ঘুষের বাজার গরম হয়ে ওঠে, আর সে বিধানের কোনো মূল্যই থাকে না। প্রকাশ্যে তা লঙ্ঘিত হতে থাকে।
আর কোনো এলাকায় আইন-কানুনের পাবন্দি থাকলেও দেখা যায়, তা কেবল পুলিশের ডান্ডা ও আদালতী ঝামেলার ভয় থাকা পর্যন্তই। এরপর আর কেউ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু একান্ত নির্জনতায় এবং নিশুতি রাতের অন্ধকারেও যে জিনিস মানুষের অন্তরে অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করে তা হল আল্লাহ তাআলার ভয়।
খোদাভীতির একটি দৃষ্টান্ত
হযরত ওমর রা. তাঁর খেলাফতকালে লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা মদীনা মুনাওয়ারায় টহল দিতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের পর টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা জায়েয নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে। তো কথাবার্তার ধরন শুনে তাঁর কৌতূহল হল। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান করা কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’
মেয়ে উত্তরে বলল, ‘মা! আমীরুল মুমিনীন তো দুধের সাথে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।’
এবার মেয়ে বলল, ‘মা, আমীরুল মুমিনীন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো আছেন! তিনি তো দেখছেন! তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’
ওমর রা. দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন যে, ‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’
এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমীরুল মুমিনীনের পুত্রবধু হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করলেন খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয রাহ., যাকে পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ বলা হয়।
তো মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগরুক থাকা যে, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন’-এর নামই তাকওয়া।
কয়েক বছর আগে এক সফরে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর হিউস্টনে (houston) গিয়েছিলাম। ‘নাসা’র (NASA) সবচেয়ে বড় কেন্দ্র সেখানেই অবস্থিত। আমার মেজবান আমাকে তা পরিদর্শন করানোর জন্য নিয়ে গেলেন। এটা ‘নাইন-ইলেভেন’-এর আগের কথা। এখন কী অবস্থা জানি না। একপর্যায়ে আমরা সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর’ অংশে প্রবেশ করলাম, যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম, দেয়ালে একটি বোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে স্পষ্ট অক্ষরে `You are being watched’ ‘আপনার প্রতি লক্ষ রাখা হচ্ছে’ বা সর্বক্ষণ আপনি আমাদের নজরে রয়েছেন। ব্যাস, এটুকুই! কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই, পুলিশ নেই। শুধু এটুকু লেখা যে, আপনাকে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রবেশকারী বোর্ডের লেখা পড়েই বুঝতে পারে যে, গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ রাখা হচ্ছে, ফলে সে তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যায়। এমন কোনো কাজ করে না, যার ফলে তাকে জবাবদিহি বা গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে হবে।
লেখাটি পড়ে আমি ভাবলাম, ‘এ বোর্ডের কারণে এখানে প্রবেশকারী সবাই সতর্ক হয়ে চলে। আহা! এ অনুভূতিই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, You are being watched by Allah taaala ‘আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমাকে দেখছেন।’
ان الله ان الله يعلم ما تفعلون
يعلم ما تفعلون
‘তোমরা যা করছ, সব তিনি জানেন।’
আমাদের সবার মনে যদি এই চেতনা সদাজাগ্রত থাকে যে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন তাহলে আমাদের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না, একে অপরের হক নষ্ট করবে না। আল্লাহ তাআলার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না। কেবল এই একটি জিনিসই মানুষকে অন্যায়-অপরাধ এবং পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারে। এরই নাম তাকওয়া। নবীগণের মেহনত এবং নবী প্রেরিত হওয়া ও কিতাব নাযিল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা।
তাকওয়া অর্জনের উপায়
কুরআন মজীদের এ আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হল, তাকওয়া অর্জিত হবে কীভাবে? আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে তাকওয়ার নির্দেশ দানের পাশাপাশি তা অর্জনের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
প্রথমটি হল,
وابةغوا اليه الوسيلة وابتغوا اليه الوسيلة
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য ‘ওসীলা’ তালাশ কর। ‘ওসীলা’ কী? মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘ওসীলা’ হল নেক আমল। যত বেশি নেক আমল করবে, ততই তাকওয়া হাসিল হবে এবং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জিত হবে। কেউ অন্য ব্যাখ্যাও করেছেন। একটি ব্যাখ্যা হল-যার সমর্থন অন্য আয়াতেও পাওয়া যায়-‘ওসীলা’ তালাশ করার অর্থ এমন ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করা, যাঁরা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। এটি তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা।
সোহবতের প্রভাব
সোহবত বা সাহচর্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। সোহবতের গুণে মানুষের কর্ম ও চিন্তায় এবং চরিত্র ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আসে।
দ্বীন মূলত সোহবতের মাধ্যমেই চলে আসছে। সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবত অবলম্বন করেছিলেন। সাহাবীদের সোহবত লাভ করেছেন তাবেঈগণ। এভাবে তাবেঈগণের সোহবত লাভ করেছেন তাবে তাবেঈগণ। তাঁদের যুগকেও গণ্য করা হয়েছে সর্বোত্তম যুগের মাঝে।
তাই প্রকৃতপক্ষে বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতের দ্বারাই মানুষের মাঝে দ্বীন পয়দা হয়।
হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. বলেছেন,-‘সাহাবায়ে কেরাম রা. হলেন নবীগণের পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। নবীগণের পরই তাঁদের মর্যাদা। যত বড় ওলী-বুযুর্গ, পীর-মাশায়েখই হোন না কেন, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদার ধারেকাছেও কেউ পৌঁছতে পারবেন না।
পরবর্তী ব্যক্তিদের নামের শুরুতে সম্মানসূচক বিভিন্ন উপাধি ব্যবহার করা হয়। কুতুবুল আকতাব, শায়খুল ইসলাম, ফখরুল মুহাদ্দিসীন, ফকীহুল আসর ইত্যাদি বলা হয়। ‘ইমাম’ উপাধিতে স্মরণ করা হয়। অথচ সাহাবায়ে কেরামের নামের সাথে এ জাতীয় কোনো খেতাব ব্যবহার করা হয় না। কেউ বলে না যে, ইমাম আবু বকর রা. বা মুফতী আবু বকর রা.। কোনো সাহাবীর নামের সাথেই এমন গুরুগম্ভীর বা আড়ম্বরপূর্ণ উপাধি নেই।
শাহ ছাহেব রাহ. বলেন, এর কারণ হল, সাহাবীগণের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য কোনো উপাধির প্রয়োজন নেই। সাহাবী বলার পর আর কিছুই বলার প্রয়োজন হয় না। সাহাবী বলা মানে সবকিছু বলা।
শেখ সাদী রাহ. সুন্দর বলেছেন-
‘যার চেহারাই চাঁদের মতো, তার সাজগোজের কী প্রয়োজন!
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবতের কারণে সাহাবাগণ যে মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন ‘সাহাবী’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষণ ব্যবহার করে তা বর্ণনা করা কঠিন।
সারকথা এই যে, দ্বীন অর্জনের মূল পদ্ধতি সোহবত। যারা মনে করে যে, শুধু বই পড়েই দ্বীনদার হয়ে যাব, তাদের ধারণা সঠিক নয়।
অনেক সময় আল্লাহওয়ালাদের সামান্য সাহচর্য মানুষের জীবনের গতিধারা পাল্টে দেয়। কবি বলেছেন-
يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد ساله طاعت بى رياء
ساله طاعت بى رياء
আল্লাহ ওয়ালাদের সামান্য সময়ের সোহবত একশত বছরের রিয়ামুক্ত ইবাদতের চেয়েও উত্তম!’
হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে কেউ বলল, হযরত! এ তো অতিরঞ্জন বলে মনে হচ্ছে। একশত বছর ইখলাসের সাথে ইবাদত করে একজন যা অর্জন করল, সামান্য সময় আল্লাহওয়ালার সোহবতে থেকেই আরেকজন তেমনি লাভবান হয়ে গেল! তা কীভাবে হয়?
হযরত রাহ. বললেন, ‘ভাই! অতিরঞ্জন নয়, শত বছর না বলে যদি শত লক্ষ বছর বলা হত তাহলেও অতিশয়োক্তি হত না। কারণ ইবাদতের জন্য শুধু রিয়ামুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, তা সহীহ তরীকায় হওয়াও জরুরি। আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতের দ্বারা ইবাদতের তরীকা সহীহ হয়। তেমনি ফিকির ও মেজাযের উন্নতি হয়। আল্লাহ তাআলার মুহাববত নিয়ে ইবাদত করতে শেখে, ফলে ইবাদত আল্লাহর দরবারে মকবুল হয় এবং তার মান বহু গুণে বেড়ে যায়।
বাকি অংশ নিচে...........
Comment