দারুল ইসলাম ও দারুল কুফর- তৃতীয় পর্ব
দারুল মুয়াদায়াহ(دار الموادعة) /দারুল আহাদ (دار العَهْد)/ দারুল আমান (دار الأمن)
দারুল কুফর যদি মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হয় তাহলে তা হারবী রাষ্ট্র বা দারুল হারব হিসাবেই গণ্য হবে। আর চুক্তি বা সন্ধি থাকলে তা 'দারুল আহাদ' (চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র) বলে গণ্য হবে।
ফুকাহায়ে আহনাফ মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ দারুল কুফর এর ক্ষেত্রে ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ (সন্ধির আওতাধীন রাষ্ট্র) পরিভাষা ব্যাবহার করেছেন। (দেখুনঃ শারহু সিয়ারীল কাবীর, খণ্ড-৫, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ। বাদায়েউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
“দারুল আমান” শব্দটি পরিভাষা হিসাবে মুতাকাদ্দিমীন মুতায়াখখিরীন মুজতাহিদ ফুকাহাগন ব্যাবহার করেননি। তবে বর্তমান অনেককে এই পরিভাষা ব্যাবহার করতে দেখা যায়। যদি “দারুল আমান” পরিভাষাটি দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ বা ঐ দারুল কুফর যার সাথে মুসলিমদের সন্ধি বা চুক্তি আছে তাহলে তো তা ঠিক আছে। কিন্তু যদি তা দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ভিন্ন কিছু তাহলে তাদের জন্য জরুরী হবে এর পক্ষে শরয়ী নির্ভরযোগ্য দলীল পেশ করা।
মুরতাদ শাসনাধীন রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি
মুরতাদ যদি কোন ইসলামী রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে শাসন করে তাহলে তা দারুল কুফরে পরিণত হবে। তবে তাদের সাথে সন্ধি/চুক্তি করা যাবে কিনা এই ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছে, অনেকে সন্ধি করতে নিষেধ করেছেন ---
আল্লামা মাওয়ারদী রহঃ বলেনঃ
ولا يجوز إقرار المرتد على ردته بجزية ولا عهد، ولا تؤكل ذبيحته، ولا تنكح منه إمرأة
জিযিয়া বা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে স্বীকৃত দেয়া বৈধ নয়। তার জবেহ খাওয়া যাবে না। তার সাথে কোন মেয়ের বিবাহ জায়েয নেই। (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ)
তবে যদি তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি না থাকে তাহলে হানাফী ফুকাহাদের নিকট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি জায়েয। আর শক্তি থাকলে জায়েয নয়।
ইমাম হাসকাফী রহঃ বলেনঃ
و نصالح المرتدين لو غلبوا على بلدة وصارت دارهم دار حرب لو خيرا بلا مال وإلا يغلبوا على بلدة (لا) لان فيه تقرير المرتدين على الردة وذلك: لا يجوز.
মুরতদরা যদি কোন অঞ্চল কবজা করে নেয় আর তাদের অঞ্চল দারুল হারব হয়ে যায়, যদি কল্যাণ দেখি তাহলে আমরা তাদের সাথে সন্ধি করব। কোন অর্থ ছাড়া। আর যদি তারা কোন অঞ্চল দখল করতে না পারে তাহলে তাদের সাথে চুক্তি করা যাবে না। কেননা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে তাদের রিদ্দার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হবে আর এটা জায়েয নেই। (আদ দুররুল মুখতার, কিতাবুল জিহাদ, খণ্ড-৪,পৃষ্ঠা-৩১০)
শামসুল আয়িম্মাহ সারাখসী রহঃ বলেনঃ-
ولا بأس في هذه الحالة بموادعة المرتدين الذين غلبوا على دارهم لأنه لا قوة للمسلمين على قتالهم فكانت الموادعة خيراً لهم
এই অবস্থায় (দুর্বলতার সময়) মুরতাদদের সাথে সন্ধি করতে কোন সমস্যা নেই। যারা তাদের অঞ্চল কবজা করে নিয়েছে। কেননা তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি মুসলিমদের নেই। তাই তাদের সাথে চুক্তি করাই কল্যাণকর হবে। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম সারাখসী রহঃ আরও বলেনঃ
وبعد ما غلبوا على دارهم فقد صارت دارهم دار الحرب حتى إذا وقع الظهور عليهم يكون مالهم غنيمة للمسلمين
মুরতাদরা যখন নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে তখন তাদের অঞ্চল দারুল হারবে পরিণত হয়। আর যখন আবার তাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন হবে তখন তাদের মাল গণিমতে পরিণত হবে।(শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وتجوز موادعة المرتدين إذا غلبوا على دار من دور الإسلام ، وخيف منهم ، ولم تؤمن غائلتهم لما فيه من مصلحة دفع الشر للحال ،
মুরতাদরা যদি মুসলিমদের কোন ভূখণ্ড দখলে নেয়। আর তাদের থেকে বিপদের আশংকা করা হয়। তাদের বিপর্যয় থেকে নিরাপদ না থাকা যায়, তাহলে তাদের সাথে চুক্তি জায়েয আছে। কেননা এর মাঝে তাৎক্ষণিক বিপদ প্রতিহতের কল্যাণ নিহিত। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
নোটঃ
(১) মুরতাদরা মুসলিমদের কোন অঞ্চল কবজা করলে তা দারুল কুফর হয়ে যাবে।
(২) মুসলিমদের দুর্বলতার সময় তাদের সাথে চুক্তি ও সন্ধিতে আসা আহনাফের নিকট জায়েয।
যুদ্ধ না করে সন্ধির শর্ত
কাফির ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ না করে সাময়িক চুক্তির ক্ষেত্রে আহলুল ইলম বেশ কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যার মাঝে কিছু শর্তের ব্যাপারে তারা মুত্তাফিক (ঐকমত) কিছু শর্তের ব্যাপারে মুখতালিফ (ভিন্নভিন্ন মত পোষণকারী)। আমরা এখানে শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ফিকহে হানাফীর আলোকে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ্*।
প্রথম শর্তঃ
মুসলিমরা দুর্বল হতে হবে। যুদ্ধ করার শক্তি না থাকতে হবে। যুদ্ধের শক্তি থাকলে সন্ধি বা চুক্তি করা যাবে না।
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
قال أبو حنيفة - رضي الله عنه - : لا ينبغي موادعة أهل الشرك إذا كان بالمسلمين عليهم قوة لأن فيه ترك القتال المأمور به أو تأخيره وذلك مما لا ينبغي للأمير أن يفعله من غير حاجة قال الله - تعالى - : { وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ } الأنفال الاية 139
আবু হানীফা রাদি আল্লাহু আনহু বলেনঃ- মুশরিকদের সাথে সন্ধি করা যাবে না, যখন মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হবে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্* তায়ালার নির্দেশিত বিধান কিতাল তরক করতে হয়। অথবা বিলম্ব করতে হয়। আর কোন আমীরের জন্য প্রয়োজন ছাড়া এটা করা যাবে না। আল্লাহ্* তায়ালা বলেনঃ আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩)
দ্বিতীয় শর্তঃ
সন্ধি করার মাধ্যমে জিহাদ ত্যাগ উদ্দেশ্য হবে না। বরং জিহাদের জন্য আরও বেশী শক্তি অর্জনের জন্যই সন্ধি করতে হবে। যাতে জিহাদের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হবার অবকাশ পাওয়া যায়।
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وشرطها الضرورة ، وهي ضرورة استعداد القتال ، بأن كان بالمسلمين ضعف ، وبالكفرة قوة المجاوزة إلى قوم آخرين ، فلا تجوز عند عدم الضرورة ؛ لأن الموادعة ترك القتال المفروض ، فلا يجوز إلا في حال يقع وسيلة إلى القتال ؛
সন্ধির শর্ত হচ্ছে, জরুরত। অর্থাৎ কিতালের জন্য প্রস্তুত হবার প্রয়োজন সম্মুখীনে আসা।
অর্থাৎ মুসলিমরা যদি দুর্বল হয়। আর কাফেরদের অন্য সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের শক্তি থাকে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে ফরয কিতাল তরক করা হয়। তাই সন্ধি শুধু সেই প্রেক্ষাপটে জায়েয হবে যা কিতাল পর্যন্ত পৌঁছার মাধ্যম হবে। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
তৃতীয় শর্ত
আজীবনের জন্য করা যাবে না। বরং তা নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত হতে হবে। এই সময়ের ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছেন। কেউ বলেছেন ৪ মাস। কেউ ২ বছর, কেউ ১০ বছর সর্বোচ্চ। তবে ফিকহে হানাফীর গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে ততদিন রাখা যাবে যত দিন এর মাঝে মুসলিমদের কল্যাণ থাকবে।
ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَقْتَصِرُ الْحُكْمُ وَهُوَ جَوَازُ الْمُوَادَعَةِ عَلَى الْمُدَّةِ الْمَذْكُورَةِ وَهِيَ عَشْرُ سِنِينَ لِتَعَدِّي الْمَعْنَى الَّذِي بِهِ عَلَّلَ جَوَازَهَا ، وَهُوَ حَاجَةُ الْمُسْلِمِينَ أَوْ ثُبُوتُ مَصْلَحَتِهِمْ فَإِنَّهُ قَدْ يَكُونُ بِأَكْثَرَ بِخِلَافِ مَا إذَا لَمْ تَكُنْ الْمُوَادَعَةُ أَوْ الْمُدَّةُ الْمُسَمَّاةُ خَيْرًا لِلْمُسْلِمِينَ فَإِنَّهُ لَا يَجُوزُ
সন্ধি জায়েয হবার হুকুম উল্লেখিত ১০ বছর সময়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ হবে না। যে কারণে সন্ধি জায়েজ করা হয়েছে তা বাকি থাকার কারণে। আর তা হচ্ছে, মুসলিমদের জরুরত ও তাদের কল্যাণ বিদ্যমান থাকা। তাই কখনও সময় বেশীও হতে পারে। তবে যদি সন্ধি বা উল্লেখিত সময় মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর না হয় তাহলে তা জায়েয হবে না। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
বুরহানুদ্দীন মারগিনানী রহঃ বলেনঃ
وإن صالحهم مدة ثم رأى نقض الصلح أنفع نبذ إليهم وقاتلهم
যদি তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্ধি করা হয় অতঃপর দেখা যায় চুক্তি ভেঙ্গে ফেলাটাই উত্তম তাহলে তাদেরকে চুক্তি ভেঙ্গে ফেলার সংবাদ পৌঁছাবে। এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। (আল-হেদায়া, কিতাবুস সিয়ার, বাবুল মুয়াদায়াহ)
নোটঃ শরীয়তের মধ্যে আসল হচ্ছে হারবীদের সাথে কিতাল করা। তবে শর্ত সাপেক্ষে কখনো কখনো সন্ধি করাও জায়েয আছে। সন্ধির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিহাদের জন্য যাতে মুসলিমগণ প্রস্তুতি নেবার অবকাশ পায়।
চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে সামরিক সহায়তা
ইমাম ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَنْبَغِي أَنْ يُبَاعَ السِّلَاحُ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَلَا يُجَهَّزُ إلَيْهِمْ لِأَنَّ النَّبِيَّ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ نَهَى عَنْ بَيْعِ السِّلَاحِ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَحَمْلِهِ إلَيْهِمْ ، وَلِأَنَّ فِيهِ تَقْوِيَتَهُمْ عَلَى قِتَالِ الْمُسْلِمِينَ فَيُمْنَعُ مِنْ ذَلِكَ وَكَذَا الْكُرَاعُ لِمَا بَيَّنَّا ، وَكَذَلِكَ الْحَدِيدُ لِأَنَّهُ أَصْلُ السِّلَاحِ ، وَكَذَا بَعْدَ الْمُوَادَعَةِ ؛ لِأَنَّهَا عَلَى شَرَفِ النَّقْضِ أَوْ الِانْقِضَاءِ فَكَانُوا حَرْبًا عَلَيْنَا ،
হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করা তাদেরকে অস্ত্রে সজ্জিত করা যাবে না। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করতে ও রপ্তানি করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এর দ্বারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে শক্তিশালী করা হবে। তাই তা নিষেধ। একই ভাবে ঘোড়া, লোহাও কেননা অস্ত্রের মূল সেটাই।
অনুরূপ সন্ধির পরও জায়েয নেই। কেননা সন্ধি ভঙ্গে গেলে বা ভেঙ্গে দিলে তারা আমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
ولا يمنع التجار من حمل التجارات إليهم إلا الكراع والسلاح والحديد لأنهم أهل حرب وإن كانوا موادعين ألا ترى أنهم بعد مضي المدة يعودون حربا للمسلمين
ব্যবসায়ীদেরকে দারুল আহদের অধিবাসীদের কাছে ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি করতে নিষেধ করা হবে না। তবে ঘোড়া অস্ত্র লোহা রপ্তানি করতে পারবে না। কেননা তারা হারবী। যদিও এখন চুক্তিবদ্ধ। তুমি কি জাননা! সময় শেষ হবার পর তারা পুনরায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। (আল-মাবসূত, কিতাবুস সিয়ার খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৮৮)
দারুল মুয়াদায়াহ(دار الموادعة) /দারুল আহাদ (دار العَهْد)/ দারুল আমান (دار الأمن)
দারুল কুফর যদি মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হয় তাহলে তা হারবী রাষ্ট্র বা দারুল হারব হিসাবেই গণ্য হবে। আর চুক্তি বা সন্ধি থাকলে তা 'দারুল আহাদ' (চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র) বলে গণ্য হবে।
ফুকাহায়ে আহনাফ মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ দারুল কুফর এর ক্ষেত্রে ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ (সন্ধির আওতাধীন রাষ্ট্র) পরিভাষা ব্যাবহার করেছেন। (দেখুনঃ শারহু সিয়ারীল কাবীর, খণ্ড-৫, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ। বাদায়েউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
“দারুল আমান” শব্দটি পরিভাষা হিসাবে মুতাকাদ্দিমীন মুতায়াখখিরীন মুজতাহিদ ফুকাহাগন ব্যাবহার করেননি। তবে বর্তমান অনেককে এই পরিভাষা ব্যাবহার করতে দেখা যায়। যদি “দারুল আমান” পরিভাষাটি দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ বা ঐ দারুল কুফর যার সাথে মুসলিমদের সন্ধি বা চুক্তি আছে তাহলে তো তা ঠিক আছে। কিন্তু যদি তা দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ভিন্ন কিছু তাহলে তাদের জন্য জরুরী হবে এর পক্ষে শরয়ী নির্ভরযোগ্য দলীল পেশ করা।
মুরতাদ শাসনাধীন রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি
মুরতাদ যদি কোন ইসলামী রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে শাসন করে তাহলে তা দারুল কুফরে পরিণত হবে। তবে তাদের সাথে সন্ধি/চুক্তি করা যাবে কিনা এই ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছে, অনেকে সন্ধি করতে নিষেধ করেছেন ---
আল্লামা মাওয়ারদী রহঃ বলেনঃ
ولا يجوز إقرار المرتد على ردته بجزية ولا عهد، ولا تؤكل ذبيحته، ولا تنكح منه إمرأة
জিযিয়া বা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে স্বীকৃত দেয়া বৈধ নয়। তার জবেহ খাওয়া যাবে না। তার সাথে কোন মেয়ের বিবাহ জায়েয নেই। (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ)
তবে যদি তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি না থাকে তাহলে হানাফী ফুকাহাদের নিকট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি জায়েয। আর শক্তি থাকলে জায়েয নয়।
ইমাম হাসকাফী রহঃ বলেনঃ
و نصالح المرتدين لو غلبوا على بلدة وصارت دارهم دار حرب لو خيرا بلا مال وإلا يغلبوا على بلدة (لا) لان فيه تقرير المرتدين على الردة وذلك: لا يجوز.
মুরতদরা যদি কোন অঞ্চল কবজা করে নেয় আর তাদের অঞ্চল দারুল হারব হয়ে যায়, যদি কল্যাণ দেখি তাহলে আমরা তাদের সাথে সন্ধি করব। কোন অর্থ ছাড়া। আর যদি তারা কোন অঞ্চল দখল করতে না পারে তাহলে তাদের সাথে চুক্তি করা যাবে না। কেননা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে তাদের রিদ্দার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হবে আর এটা জায়েয নেই। (আদ দুররুল মুখতার, কিতাবুল জিহাদ, খণ্ড-৪,পৃষ্ঠা-৩১০)
শামসুল আয়িম্মাহ সারাখসী রহঃ বলেনঃ-
ولا بأس في هذه الحالة بموادعة المرتدين الذين غلبوا على دارهم لأنه لا قوة للمسلمين على قتالهم فكانت الموادعة خيراً لهم
এই অবস্থায় (দুর্বলতার সময়) মুরতাদদের সাথে সন্ধি করতে কোন সমস্যা নেই। যারা তাদের অঞ্চল কবজা করে নিয়েছে। কেননা তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি মুসলিমদের নেই। তাই তাদের সাথে চুক্তি করাই কল্যাণকর হবে। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম সারাখসী রহঃ আরও বলেনঃ
وبعد ما غلبوا على دارهم فقد صارت دارهم دار الحرب حتى إذا وقع الظهور عليهم يكون مالهم غنيمة للمسلمين
মুরতাদরা যখন নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে তখন তাদের অঞ্চল দারুল হারবে পরিণত হয়। আর যখন আবার তাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন হবে তখন তাদের মাল গণিমতে পরিণত হবে।(শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وتجوز موادعة المرتدين إذا غلبوا على دار من دور الإسلام ، وخيف منهم ، ولم تؤمن غائلتهم لما فيه من مصلحة دفع الشر للحال ،
মুরতাদরা যদি মুসলিমদের কোন ভূখণ্ড দখলে নেয়। আর তাদের থেকে বিপদের আশংকা করা হয়। তাদের বিপর্যয় থেকে নিরাপদ না থাকা যায়, তাহলে তাদের সাথে চুক্তি জায়েয আছে। কেননা এর মাঝে তাৎক্ষণিক বিপদ প্রতিহতের কল্যাণ নিহিত। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
নোটঃ
(১) মুরতাদরা মুসলিমদের কোন অঞ্চল কবজা করলে তা দারুল কুফর হয়ে যাবে।
(২) মুসলিমদের দুর্বলতার সময় তাদের সাথে চুক্তি ও সন্ধিতে আসা আহনাফের নিকট জায়েয।
যুদ্ধ না করে সন্ধির শর্ত
কাফির ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ না করে সাময়িক চুক্তির ক্ষেত্রে আহলুল ইলম বেশ কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যার মাঝে কিছু শর্তের ব্যাপারে তারা মুত্তাফিক (ঐকমত) কিছু শর্তের ব্যাপারে মুখতালিফ (ভিন্নভিন্ন মত পোষণকারী)। আমরা এখানে শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ফিকহে হানাফীর আলোকে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ্*।
প্রথম শর্তঃ
মুসলিমরা দুর্বল হতে হবে। যুদ্ধ করার শক্তি না থাকতে হবে। যুদ্ধের শক্তি থাকলে সন্ধি বা চুক্তি করা যাবে না।
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
قال أبو حنيفة - رضي الله عنه - : لا ينبغي موادعة أهل الشرك إذا كان بالمسلمين عليهم قوة لأن فيه ترك القتال المأمور به أو تأخيره وذلك مما لا ينبغي للأمير أن يفعله من غير حاجة قال الله - تعالى - : { وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ } الأنفال الاية 139
আবু হানীফা রাদি আল্লাহু আনহু বলেনঃ- মুশরিকদের সাথে সন্ধি করা যাবে না, যখন মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হবে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্* তায়ালার নির্দেশিত বিধান কিতাল তরক করতে হয়। অথবা বিলম্ব করতে হয়। আর কোন আমীরের জন্য প্রয়োজন ছাড়া এটা করা যাবে না। আল্লাহ্* তায়ালা বলেনঃ আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩)
দ্বিতীয় শর্তঃ
সন্ধি করার মাধ্যমে জিহাদ ত্যাগ উদ্দেশ্য হবে না। বরং জিহাদের জন্য আরও বেশী শক্তি অর্জনের জন্যই সন্ধি করতে হবে। যাতে জিহাদের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হবার অবকাশ পাওয়া যায়।
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وشرطها الضرورة ، وهي ضرورة استعداد القتال ، بأن كان بالمسلمين ضعف ، وبالكفرة قوة المجاوزة إلى قوم آخرين ، فلا تجوز عند عدم الضرورة ؛ لأن الموادعة ترك القتال المفروض ، فلا يجوز إلا في حال يقع وسيلة إلى القتال ؛
সন্ধির শর্ত হচ্ছে, জরুরত। অর্থাৎ কিতালের জন্য প্রস্তুত হবার প্রয়োজন সম্মুখীনে আসা।
অর্থাৎ মুসলিমরা যদি দুর্বল হয়। আর কাফেরদের অন্য সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের শক্তি থাকে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে ফরয কিতাল তরক করা হয়। তাই সন্ধি শুধু সেই প্রেক্ষাপটে জায়েয হবে যা কিতাল পর্যন্ত পৌঁছার মাধ্যম হবে। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
তৃতীয় শর্ত
আজীবনের জন্য করা যাবে না। বরং তা নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত হতে হবে। এই সময়ের ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছেন। কেউ বলেছেন ৪ মাস। কেউ ২ বছর, কেউ ১০ বছর সর্বোচ্চ। তবে ফিকহে হানাফীর গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে ততদিন রাখা যাবে যত দিন এর মাঝে মুসলিমদের কল্যাণ থাকবে।
ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَقْتَصِرُ الْحُكْمُ وَهُوَ جَوَازُ الْمُوَادَعَةِ عَلَى الْمُدَّةِ الْمَذْكُورَةِ وَهِيَ عَشْرُ سِنِينَ لِتَعَدِّي الْمَعْنَى الَّذِي بِهِ عَلَّلَ جَوَازَهَا ، وَهُوَ حَاجَةُ الْمُسْلِمِينَ أَوْ ثُبُوتُ مَصْلَحَتِهِمْ فَإِنَّهُ قَدْ يَكُونُ بِأَكْثَرَ بِخِلَافِ مَا إذَا لَمْ تَكُنْ الْمُوَادَعَةُ أَوْ الْمُدَّةُ الْمُسَمَّاةُ خَيْرًا لِلْمُسْلِمِينَ فَإِنَّهُ لَا يَجُوزُ
সন্ধি জায়েয হবার হুকুম উল্লেখিত ১০ বছর সময়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ হবে না। যে কারণে সন্ধি জায়েজ করা হয়েছে তা বাকি থাকার কারণে। আর তা হচ্ছে, মুসলিমদের জরুরত ও তাদের কল্যাণ বিদ্যমান থাকা। তাই কখনও সময় বেশীও হতে পারে। তবে যদি সন্ধি বা উল্লেখিত সময় মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর না হয় তাহলে তা জায়েয হবে না। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
বুরহানুদ্দীন মারগিনানী রহঃ বলেনঃ
وإن صالحهم مدة ثم رأى نقض الصلح أنفع نبذ إليهم وقاتلهم
যদি তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্ধি করা হয় অতঃপর দেখা যায় চুক্তি ভেঙ্গে ফেলাটাই উত্তম তাহলে তাদেরকে চুক্তি ভেঙ্গে ফেলার সংবাদ পৌঁছাবে। এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। (আল-হেদায়া, কিতাবুস সিয়ার, বাবুল মুয়াদায়াহ)
নোটঃ শরীয়তের মধ্যে আসল হচ্ছে হারবীদের সাথে কিতাল করা। তবে শর্ত সাপেক্ষে কখনো কখনো সন্ধি করাও জায়েয আছে। সন্ধির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিহাদের জন্য যাতে মুসলিমগণ প্রস্তুতি নেবার অবকাশ পায়।
চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে সামরিক সহায়তা
ইমাম ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَنْبَغِي أَنْ يُبَاعَ السِّلَاحُ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَلَا يُجَهَّزُ إلَيْهِمْ لِأَنَّ النَّبِيَّ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ نَهَى عَنْ بَيْعِ السِّلَاحِ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَحَمْلِهِ إلَيْهِمْ ، وَلِأَنَّ فِيهِ تَقْوِيَتَهُمْ عَلَى قِتَالِ الْمُسْلِمِينَ فَيُمْنَعُ مِنْ ذَلِكَ وَكَذَا الْكُرَاعُ لِمَا بَيَّنَّا ، وَكَذَلِكَ الْحَدِيدُ لِأَنَّهُ أَصْلُ السِّلَاحِ ، وَكَذَا بَعْدَ الْمُوَادَعَةِ ؛ لِأَنَّهَا عَلَى شَرَفِ النَّقْضِ أَوْ الِانْقِضَاءِ فَكَانُوا حَرْبًا عَلَيْنَا ،
হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করা তাদেরকে অস্ত্রে সজ্জিত করা যাবে না। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করতে ও রপ্তানি করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এর দ্বারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে শক্তিশালী করা হবে। তাই তা নিষেধ। একই ভাবে ঘোড়া, লোহাও কেননা অস্ত্রের মূল সেটাই।
অনুরূপ সন্ধির পরও জায়েয নেই। কেননা সন্ধি ভঙ্গে গেলে বা ভেঙ্গে দিলে তারা আমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
ولا يمنع التجار من حمل التجارات إليهم إلا الكراع والسلاح والحديد لأنهم أهل حرب وإن كانوا موادعين ألا ترى أنهم بعد مضي المدة يعودون حربا للمسلمين
ব্যবসায়ীদেরকে দারুল আহদের অধিবাসীদের কাছে ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি করতে নিষেধ করা হবে না। তবে ঘোড়া অস্ত্র লোহা রপ্তানি করতে পারবে না। কেননা তারা হারবী। যদিও এখন চুক্তিবদ্ধ। তুমি কি জাননা! সময় শেষ হবার পর তারা পুনরায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। (আল-মাবসূত, কিতাবুস সিয়ার খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৮৮)
Comment