যে ব্যক্তি যথার্থ তাওবা করে মারা যাবে আল্লাহ তাআলা তার সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। তাকে তার গুনাহের কারণে কোন শাস্তি দেবেন না। আর যে ব্যক্তি তাওবা না করে মারা যাবে সে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার উপর থাকবে। ইচ্ছা করলে মাফ করতেও পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন।
আল্লাহর হক:
আল্লাহ তাআলার হক নষ্ট করে থাকলে তাওবা কবুল হওয়ার জন্য হকের কাজা করা জরুরী। যেমন- কেউ তিন বছর নামায পড়েনি। এখন তাওবা করতে চাচ্ছে। তাহলে শুধু লজ্জিত হয়ে মাফ চাওয়ার দ্বারাই মাফ পাবে না। উক্ত তিন বছরের নামায কাজা করতে হবে। অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রেও একই কথা। যদি সামর্থ্য থাকা সত্বেও আল্লাহর হক কাজা করা ব্যতীত মারা যায় তাহলে সে শাস্তির উপযু্ক্ত। তবে আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে মাফও করতে পারেন।
বান্দার হক:
বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে আন্তরিকভাবে তাওবার সাথে সাথে উক্ত হক ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা হকদারের কাছ থেকে মাফ নেয়া জরুরী। হক ফিরিয়ে দেয়া বা মাফ নেয়া ব্যতীত তাওবা কবুল হবে না। কেয়ামতের দিন উক্ত হকের বদলে তার সমপরিমাণ নেক আমল নিয়ে গিয়ে হকদারকে দিয়ে দেয়া হবে। নেক আমল না থাকলে বা শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে হকদারের গুনাহের বোঝা তার মাথায় চাপানো হবে।
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من كانت له مظلمة لأحد من عرضه أو شيء فليتحلله منه اليوم قبل أن لا يكون دينار ولا درهم إن كان له عمل صالح أخذ منه بقدر مظلمته وإن لم تكن له حسنات أخذ من سيئات صاحبه فحمل عليه
“যে ব্যক্তি কারো সম্মান নষ্ট করেছে কিংবা অন্য কোন হক নষ্ট করেছে সে যেন ঐ দিন আসার আগে আজই তার থেকে তার মাফ নিয়ে নেয়, যেদিন তার কোন দীনারও থাকবে না, কোন দিরহামও থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে তাহলে নষ্টকৃত হকের সমপরিমাণ তার থেকে তা নিয়ে নেয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তাহলে হকদার থেকে গুনাহ নিয়ে তার উপর চাপানো হবে।” (সহীহ বুখারী: হাদীস নং ২৩১৭)মুসলিম শরীফে এসেছে,
عن أبى هريرة أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال « أتدرون ما المفلس ». قالوا المفلس فينا من لا درهم له ولا متاع. فقال « إن المفلس من أمتى يأتى يوم القيامة بصلاة وصيام وزكاة ويأتى قد شتم هذا وقذف هذا وأكل مال هذا وسفك دم هذا وضرب هذا فيعطى هذا من حسناته وهذا من حسناته فإن فنيت حسناته قبل أن يقضى ما عليه أخذ من خطاياهم فطرحت عليه ثم طرح فى النار ».
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জান নি:স কোন ব্যক্তি? সাহাবারা উত্তর দিলেন, আমাদের মধ্যে নি:স ঐ ব্যক্তি যার কোন দিরহামও নেই, কোন আসবাব পত্রও নেই। তিনি ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে নি:স ঐ ব্যক্তি যে কেয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিযে হাজির হবে; কিন্তু সে অমুককে গালি দিয়েছিল, অমুককে যিনার অপবাদ দিয়েছিল, অমুকের সম্পদ গ্রাস করেছিল, অমুকের রক্ত প্রবাহিত করেছিল, অমুককে প্রহার করেছিল। এখন অমুককে তার নেক দিয়ে দেয়া হবে, অমুককে তার নেক দিয়ে দেয়া হবে। যদি তার উপর যে পাওনা তা আদায় হওয়ার পূর্বেই তার নেক আমল শেষ হযে যায়, তাহলে তাদের থেকে গুনাহ নিয়ে তার উপর চাপানো হবে অত:পর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (সহীহ মুসলিম: হাদীস নং ৬৭৪৪)তবে কারো কারো সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ইহসানবশত আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মাফ করে দিতে পারেন। আর হকদারদেরকে নিজের পক্ষ থেকে হক আদায় করে সন্তুষ্ট করে দেবেন। ইবনে মাজাহ শরীফের এক হাদীসে এমনটাই এসেছে।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
وأما حق المظلوم فلا يسقط بمجرد التوبة، وهذا حق، ولا فرق في ذلك بين القاتل وسائر الظالمين، فمن تاب من ظلم لم يسقط بتوبته حق المظلوم، لكن من تمام توبته أن يعوضه بمثل مظلمته، وإن لم يعوضه في الدنيا فلا بد له من العوض في الآخرة، فينبغي للظالم التائب أن يستكثر من الحسنات، حتى إذا استوفى المظلومون حقوقهم لم يبق مفلسًا، ومع هذا فإذا شاء الله أن يعوض المظلوم من عنده فلا رادَّ لفضله، كما إذا شاء أن يغفر ما دون الشرك لمن يشاء
“মজলুমের হক শুধু তাওবার দ্বারা মাফ হবে না। এটাই বাস্তব। এক্ষেত্রে হত্যাকারী এবং অন্যান্য জালেমের মাঝে কোন তফাৎ নেই। যে ব্যক্তি জুলুম থেকে তাওবা করেছে, তার তাওবার দ্বারাই মজলুমের হক মাফ হয়ে যাবে না। বরং তার তাওবা পূর্ণ হওয়ার জন্য নষ্ট করা হকের সমপরিমাণ বদলা দিতে হবে। বদলা দুনিয়াতে না দিয়ে থাকলে আখেরাতে অবশ্যই দিতে হবে। কাজেই যে জালেম ব্যক্তি তাওবা করতে চায় তার উচিৎ বেশি বেশি নেক আমল করা, যেন মজলুমরা তাদের হক আদায় করে নেয়ার পর তাকে নি:স থেকে যেতে না হয়। তবে আল্লাহ তাআলা যদি নিজের পক্ষ থেকে বদলা দিয়ে দিতে চান তবে (তিনি তা করতে পারেন। কেননা, ) তার ইহসানকে প্রত্যাখ্যান করার মত কেউ নেই। যেমন, তিনি যাকে চান শিরিক ব্যতীত অন্য সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (মাজমুউল ফাতাওয়া: ১৮/১৮৭) বি.দ্র. আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিতে পারেন এই আশায় গুনাহ করে যেতে থাকা নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছু নয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন لمن يشاء (যাকে চান তাকে মাফ করবেন)। যাকে চাননা তাকে মাফ করবেন না। বরং শাস্তি দেবেন।
ইবনে আবিল ঈয্ হানাফী রহ. (মৃত্যু ৭৯২ হি.) বলেন,
وقد قال تعالى : { إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ } . فتأمل كيف جعل رجاءهم مع إيمانهم بهذه الطاعات ؟ فالرجاء إنما يكون مع الإتيان بالأسباب التي اقتضتها حكمة الله تعالى ، شرعه وقدرته وثوابه وكرامته . ولو أن رجلا له أرض يؤمل أن يعود عليه من مغلها ما ينفعه ، فأهملها ولم يحرثها ولم يبذرها ، ورجا أنه يأتي من مغلها مثل ما يأتي من حرث وزرع وتعاهد الأرض - : لعده الناس من أسفه السفهاء! وكذا لو رجا وحسن ظنه أن يجيئه ولد من غير جماع! أو يصير أعلم أهل زمانه من غير طلب العلم وحرص تام! وأمثال ذلك . فكذلك من حسن ظنه وقوي رجاؤه في الفوز بالدرجات العلى والنعيم المقيم ، من غير طاعة ولا تقرب إلى الله تعالى بامتثال أوامره واجتناب نواهيه .
“আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, { إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ }
(নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর রহমতের আশা করতে পারে। আর আল্লাহ তাআলা মহা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু) [বাক্বারা ২১৮] চিন্তা করে দেখ, কিভাবে আল্লাহ তাআলা তাদের আশাবাদিতা ব্যক্ত করেছেন ঈমান আনা সহ এসব সৎকর্মের প্রেক্ষিতে। অতএব, আশা কেবল তখনই করা যাবে যখন ঐসব আসবাব আঞ্জাম দেয়া হবে, আল্লাহ তাআলা নিজ হেকমতে যেগুলো নির্ধারণ করেছেন এবং যেগুলোর জন্য সওয়াব ও সম্মানের ব্যবস্থা করেছেন। যদি কোন ব্যক্তির একটি জমি থাকে আর সে তা থেকে তার উপকারে আসবে মত ফসল লাভ করতে চায় কিন্তু সে তা চাষ করে বীজ বপন না করে বরং তাকে বেকার ফেলে রাখে; আবার আশাও করে যে, তারও তেমনি ফসল লাভ হবে যেমন ঐ ব্যক্তির হচ্ছে যে জমি চাষ করে তার দেখাশুনা করেছে- তাহলে এ ব্যক্তিকে লোকজন বড় নির্বোধদের একজন গণ্য করবে। তদ্রূপ যে ব্যক্তি সহবাস ব্যতীত সন্তান আশা করে, কিংবা ইলম তলব ও ইলমের প্রতি পূর্ণ লালসা ব্যতীতই যমানার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম হয়ে যেতে চায়। এ রকম আরো উদাহরণ রয়েছে। ঐ ব্যক্তিও তেমনি যে আল্লাহ তাআলার আদেশসমূহ পালন এবং আল্লাহ তাআলার নিষেধসমূহ বর্জন করে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভ ব্যতীতই সুউচ্চ মর্যাদা এবং চিরস্থায়ী নিয়ামত লাভ করে সফল হওয়ার প্রবল আশাবাদি।” (শরহুল আকীদাতিত ত্বহাবিয়্যাহ্: ৩২২-৩২৩)
তাছাড়া জাহান্নাম থেকে মুক্তির অর্থ তো এটা নয় যে, সকল আযাব থেকেই মুক্তি। মৃত্যুর কষ্ট, কবরের আযাব, হাশরের আযাব, পুলসিরাতের আযাব- এগুলোও তো আছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন! আমীন!
Comment