মহানবী (সা.)কে কটাক্ষক্ষকারীর শরয়ী বিধান
((( জিজ্ঞাসা )))
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করা বলতে কি বুঝায়? কুরআন-হাদীসের আলোকে কটাক্ষকারীর শরয়ী বিধান কি, কটাক্ষকারীর তওবা কবুল করা হবে কিনা?
((( সমাধান )))
হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবই নন বরং তিনি সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসূল। মহান আল্লাহ তাআলার পর তাঁর মর্যাদার আসন, তাঁর আগমন এই বিশ্বের জন্য শান্তি ও রহমত। কোন মানুষ নিজের জান-মাল, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক তাঁকে ভালবাসা ছাড়া মুমিন হতে পারে না। শুধু মুসলিম কেন অমুসলিম পর্যন্ত তাঁর আদর্শে মুগ্ধ। তাঁকে স্থান দিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের আসনে। তাদের কথা ভিন্ন যাদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে, সত্যকে গ্রহণ করার মত সৎসাহস হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোন প্রকৃত ঈমানদার যখন শুনতে পায় যে, কোন নামধারি মুসলমান প্রিয় নবী (সা.)এর কটাক্ষ করেছে, তাঁর ব্যঙ্গ করেছে, তখন তাঁর ঈমানি চেতনা জেগে উঠে এবং তার ধর্মীয় আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। নবীর এই দুশমনের উপযুক্ত সাজার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পায় না। আর স্বস্তি না পাওয়াই কাম্য। কারণ নবীর মর্যাদায় আঘাত হানা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আক্রান্ত করা। বলা বাহুল্য যে, একজন মুসলমান তার ধর্মীয় অনুভূতিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই কোন মুমিনের পে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ বরদাস্ত করা সম্ভবপর হয় না। সুতরাং যারা এমন জঘন্য ও ন্যক্কারজনক কাজে লিপ্ত হবে, কুরআন- হাদীস ও ইজমার আলোকে তাদের কি শাস্তির বিধান রয়েছে তা আলোচনার দাবি রাখে।
কটাক্ষ বলতে কি বুঝায়
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) ‘আছ ছারিমুল মাছলুল আলা শাতেমির রসূল’ কিতাবে নবীজী (সা.)এর শানে কটাক্ষের বিবরণ ও মাত্রা সম্পর্কে কাজী ইয়ায থেকে নকল করেন, তিনি বলেন, কটাক্ষ বলতে বুঝায়, মহানবী (সা.)কে গাল মন্দ করা, তাঁর দোষ চর্চা করা, ব্যঙ্গ চিত্র করা, তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা, তাঁর মহান আদর্শময় জীবনের কোন দিক নিয়ে বিদ্রুপ করা, তাঁর বংশ নিয়ে সমালোচনা করা। তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার নিমিত্তে তাঁর আনিত ধর্ম নিয়ে উপহাস করা, তাঁর প্রতি লানত ও বদ দুআ করা, তাঁর অমঙ্গল কামনা করা, তাঁর সাথে বেআদবি করা, তাঁর শানে অশালীন কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি সবই কটাক্ষ হিসেবে বিবেচিত।
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর সাজা
হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী চারও মাযহাবের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো, যদি কোন নামধারি মুসলমান প্রিয় নবী (সা.)কে কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করে, তাহলে সে সম্পূর্ণ কাফের, মুরতাদ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং তার একমাত্র সাজা মৃত্যুদন্ড। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা মুসলিম শাসকের উপর কর্তব্য। উল্লিখিত বিষয়টি কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কুরআনের আলোকে
১. এক মুনাফেক রসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বিদ্রুপপূর্ণ কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ.
“আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, (তাদের বিদ্রুপ পূর্ণ আচরণের বিষয়ে) তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলেছিলাম এবং কৌতুক করেছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তাঁর হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে। ছলনা করনা, তোমরা কাফের হয়ে গেছ, ঈমান প্রকাশ করার পর।” (সূরা তাওবা: ৬৫-৬৬)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) আয়াতটি উল্লেখ করে বলেন, আয়াতটি আলোচ্যবিষয়ে সুস্পষ্ট, এতে রসূল (সা.)এর কটাক্ষ করার কারণে তাদের কৃত্রিম ওজর গ্রহণ না করে কুফরী আখ্যা দেয়া হয়েছে। (আছ ছারিমুল মাসলূল: ৩৩)
২. অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُهِينًا.
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা আহযাব: ৫৭)
আয়াতটির ভাষ্য থেকে সুস্পষ্ট যে, রসূল (সা.)কে কষ্টদাতার জন্য কঠোর শাস্তি ও জাহান্নাম অবধারিত। আর সাধারণ থেকে সাধারণ কটাক্ষও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩১৬)
এখানে আরও প্রতীয়মান হয় যে, রসূল (সা.)কে কটাক্ষ বা বিদ্রুপকারীর শাস্তি আল্লাহ নিজেই নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর রসূল (সা.) মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে শাস্তি প্রয়োগ করেছেন, যার বিবরণ সামনে আসছে।
হাদীসের আলোকে
১. ইমাম নাসাঈ (রাহ.) হযরত আনাস( রাযি.) এর সূত্রে সহীহ সনদে বর্ণনা করেন-
أن النبي صلی اللہ علیہ وسلم دخل مكة وعليه المغفر فقيل ابن خطل متعلق بأستار الكعبة فقال اقتلوه.
“নবী করীম (সা.) (মক্কা বিজয়ের সময়) মক্কাতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথায় টুপি ছিলো। তাঁকে সংবাদ দেয়া হলো, ইবনে খতল (যে রসূল (সা.)কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতো) কাবার গিলাফ জড়িয়ে আছে। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা তাকে হত্যা কর।” (সুনানে নাসাঈ: হাদীস নং ২৮৬৭)
২. ইমাম আবু দাউদ (রাহ.) হযরত আলী (রা.) এর সূত্রে বর্ণনা করেন-
أن يهودية كانت تشتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم وتقع فيه ، فخنقها رجل حتى ماتت ، فأبطل رسول الله صلی اللہ علیہ وسلم دمها.
قال العلامة ابن تيمية في الصارم المسلول هذا الحديث جيد: (60)
“এক ইয়াহুদী নারী নবী করীম (সা.)কে গাল-মন্দ করতো এবং তাঁর সমালোচনা করতো। একদিন এক ব্যক্তি তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। তখন রসূল (সা.) তার রক্ত মূল্য বাতিল ঘোষণা করেন।” (সুনানে আবু দাউদ: হাদীস নং ৪৩৬৪)
উপরিউক্ত হাদীসসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা রসূলুল্লাহ (সা.)কে কোনভাবে কষ্ট দিবে তাদের বিধান হলো মৃত্যুদন্ড। প্রথম হাদীসে রসূল (সা.) হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় হাদীসও আলোচ্যবিষয়ে সুস্পষ্ট।
ইজমা
রসূল (সা.)কে কটাক্ষকারীর মৃত্যুদন্ড দেয়ার ব্যাপারে প্রায় প্রথম যুগ থেকেই একাধিক ইমাম ইজমা (সকল উম্মতের ঐক্যমত) নকল করেছেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) ‘আছ ছারিমুল মাসলূল’ কিতাবে অনেকের নাম ও বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম ও বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সুহনূন (রাহ.) বলেন-
أجمع الأمة أن شاتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم والمنتقص له كافر والوعيد جاء عليه بعذاب الله له، وحكمه عند الأمة القتل، ومن شك في كفره وعذابه كفر.
“সমস্ত উম্মত এব্যাপারে একমত যে, মহানবী (সা.)কে গাল-মন্দকারী ও তাঁকে কটাক্ষকারী কাফের। তার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার প থেকে কঠিন শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর নিকট তার বিধান হলো, মৃত্যুদন্ড এবং যে তার কাফের হওয়া ও শাস্তির উপযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে, সেও কাফের হয়ে যাবে।”
২.আবু বকর ইবনুল মুনযির (রাহ.) বলেন-
أجمع عوام أهل العلم على أن من سب النبي صلی اللہ علیہ وسلم عليه القتل.
“যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)কে গালি দিবে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এ সিদ্ধান্তের উপর সকল ওলামায়ে কেরাম একমত পোষণ করেছেন।”
৩. ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (রাহ.) বলেন-
أجمع المسلمون على أن من سب الله، أو سب رسوله صلی اللہ علیہ وسلم ، أو دفع شيئا مما أنزل الله عز وجل، أو قتل نبيا من أنبياء الله عز وجل، أنه كافر بذلك، وإن كان مقرا بكل ما أنزل الله.
“সমস্ত মুসলমান এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা বা তাঁর রসূলকে গাল-মন্দ করবে অথবা আল্লাহ তা‘আলার প থেকে অবতীর্ণ কোন বিষয়কে অস্বীকার করবে কিংবা আল্লাহ তা‘আলার কোন নবীকে হত্যা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। যদিও সে আল্লাহ তা‘আলার প থেকে অবতীর্ণ অন্য সব বিষয়কে স্বীকার করে।” (আছ ছারিমুল মাছলুল: পৃ.৫)
উল্লিখিত ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোন মুসলমান যদি রসূল (সা.)কে কটাক্ষ করে, তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) ইজমার আলোচনা করে বলেন-
ولا عبرة بما أشار إليه ابن حزم الظاهري من الخلاف في تكفير المستخف به، فإنه شيئ لا يعرف لأحد من العلماء، و من استقرأ سير الصحابة تحقق إجماعهم على ذلك فإنه نقل عنهم في قضايا مختلفة منتشرة يستفيض نقلها ولم ينكره أحد.
“আল্লামা ইবনে হাযম (রাহ.) বিদ্রুপকারী কাফের হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্যেরযে দাবি করেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এমন দাবি অন্য কোন আলেম থেকে পাওয়া যায় না। (আর কাফের হওয়ার বিষয়টি এতস্পষ্ট যে,) কেউ সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পাঠ করলে,এ ব্যাপারে ঐক্যমতের বিষয়টি জানতে পারবে। কারণ এটি তাদের প থেকে বিভিন্ন বিচারের রায়ে ব্যাপকভাবে বর্ণিত রয়েছে, যা কেউ অস্বীকার করেনি।”
মোটকথা, রসূল (সা.)এর সমালোচনাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড এটি নতুন কোন দাবি নয় বা মুসলমানদের উদ্ভাবিতও নয় বরং তার মৃত্যুদন্ডের সাজা আল্লাহ কর্তৃক এবং সর্বজন স্বীকৃত, যা পূর্ব যুগ থেকে চলে আসছে। আর বলা বাহুল্য যে, কোন একজনকে এমন শাস্তি দিলে পরবর্তীতে অন্য কেউ এরূপ ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পাবে না। অন্যথায় এ ধরনের সমালোচনাকারীরা পশ্রয় পেয়ে বারবার দুঃসাহস দেখানোর চেষ্টা করবে। তাই অন্যায়কে আশ্রয় না দিয়ে নির্মূল করাই অপরিহার্য কর্তব্য।
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর তওবা
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারী নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করলে, আশা করা যায় পরকালের জন্য আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন এবং তার আখেরাতের সাজা মাফ করে দিবেন। এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু দুনিয়াতে তওবার কারণে মৃত্যুদন্ড রহিত হবে কিনা? এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের মতপার্থক্য রয়েছে।
মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব
মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের মতামত হলো, তওবার কারণে তার মৃত্যুদন্ড রহিত হবে না। চাই সে বন্দী হওয়ার পূর্বে তওবা করুক বা পরে । কারণ এটা ‘হদ’ (শরীআতের একটি বিশেষ শাস্তি) যা তওবার কারণে মাফ হয় না। ইমাম আহমদ (রাহ.) বলেন-
كل من شتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم وتنقصه مسلما كان أو كافرا فعليه القتل ولا يستتاب.
যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)কে গালমন্দ করে, কটাক্ষ করে, চাই সে মুসলমান হোক বা কাফির, তার শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। তার তওবা গ্রহণ করা হবে না।
আল্লামা কাজী ইয়াজ (রাহ.) এর ব্যাখ্যা এভাবে পেশ করেন-
لأن حق النبي صلی اللہ علیہ وسلم يتعلق به حقان حق لله وحق لآدمي والعقوبة إذا تعلق بها حق لله وحق لآدمي لم تسقط بالتوبة.
“এক্ষেত্রে মহানবী (সা.)এর সাথে দু’টি ‘হক’ সম্পৃক্ত। আল্লাহর ‘হক’ ও বান্দার ‘হক’। আর যখন কোন সাজা বা অপরাধের সম্পর্ক আল্লাহ ও বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তখন সেই সাজা তওবা দ্বারা মাফ হয় না।” (আছ ছারেমুল মাসলূল: পৃ.৩৯৭)
আল্লামা শামী (রাহ.) মালেকী মাযহাব সম্পর্কে বলেন-
وبعد فاعلم أن مشهور مذهب مالك وأصحابه وقول السلف وجمهور العلماء قتله حدا لا كفرا، إن أظهر التوبة منه، ولهذا لا تقبل عندهم توبته ولا تنفع استقالته، وحكمه حكم الزنديق، سواء كانت توبته بعد القدرة عليه أو جاء تائبا من قبل نفسه لأنه حد وجب لا تسقطه التوبة.
“ইমাম মালেক (রাহ.) সহ আরো অনেক ওলামায়ে কেরামের প্রসিদ্ধ মত হলো, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর সাজা হলো মৃত্যুদন্ড। যা ‘হদ’ হিসেবে প্রয়োগ করা হবে, কুফরী হিসেবে নয়। যদি সে তওবা প্রকাশ করে। তাই তাদের নিকট তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুরূপভাবে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার দ্বারাও কোন লাভ হবে না। তার সাজা ও নাস্তিকের সাজা এক ও অভিন্ন। চাই সে আটক হওয়ার পূর্বে তওবা করুক বা পরে। কেননা, এটা ‘হদ’ যা তওবা দ্বারা রহিত হয় না।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩২০)
শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাব
শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাবের মতামত হলো, কটাক্ষকারী ও মুরতাদের হুকুম এক ও অভিন্ন। অতএব যদি সে নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করে তওবা করে, তবে তার তওবা কবুল করা হবে। তার মৃত্যুদন্ড রহিত হবে। আর যদি তওবা না করে, তাহলে মুরতাদের ন্যায় তাকেও তিন দিন বন্দী রেখে তওবা করতে বলা হবে। তার কোন সন্দেহ থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করা হবে, তবে এটা আবশ্যক নয় বরং উত্তম। তাই কাজী ইচ্ছা করলে তাকে তাৎণিক মৃত্যুদন্ড দিতে পারেন, আর যদি কটাক্ষকারী বা মুরতাদ মহিলা হয়, তবে তাকে হত্যা করা যাবে না বরং তওবা না করা পর্যন্ত বন্দী করে রাখা হবে।
আল্লামা সুবকী (রাহ.) বলেন-
ولكن المشهور على الألسنة وعند الحكام وما زالوا يحكمون به على أن مذهب الشافعي قبول التوبة.
“সর্বসাধারণের নিকট প্রসিদ্ধ মতামত যা দ্বারা শাফে‘য়ী মাযহাবের বিচারকগণ বিচার করে থাকেন, তাহলো, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর তওবা কবুল করা হবে।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩২৩)
আল্লামা শামী (রাহ.) বলেন-
أنه تقبل توبته ويندرئ عنه القتل بها وأنه يستتاب كما هو رواية الوليد عن مالك وهو المنقول عن أبي حنيفة وأصحابه كما صرح به علماء المذاهب الثلاثة كالقاضي عياض في الشفا ذكر أن الإمام الطبري نقله عنه أيضا وكذا صرح به شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى وكذا شيخ الإسلام التقي السبكي وهو الموافق لما صرح به الحنفية كالإمام أبي يوسف في كتابه الخراج حيث قال: أيما رجل مسلم سب رسول الله صلی اللہ علیہ وسلم أو كذبه أو عابه أو تنقصه فقد كفر بالله تعالى وبانت منه امرأته فإن تاب وإلا قتل وكذلك المرأة إلا أبا حنيفة قال: لا تقتل المرأة وتجبر على الإسلام. علق قتله على عدم التوبة فدل على أنه لا يقتل بعدها.
ولما صرح به في النتف ونقلوه في عدة كتب عن شرح الطحاوي من أنه مرتد وحكمه حكم المرتد ويفعل به ما يفعل بالمرتد ولما صرح به في الحاوي من أنه ليس له توبة سوى تجديد الإسلام وهو الموافق أيضا لإطلاق عبارات المتون كافة.
“তার তওবা কবুল করা হবে এবং তওবার দ্বারা তার মৃত্যুদন্ড রহিত হয়ে যাবে ও তাকে তওবা করতে বলা হবে। এমতটি ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) ও তাঁর শাগরেদগণ থেকে বর্ণিত আছে। যেমনটি মাযহাবত্রয়ের ওলামায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন কাজী ইয়ায আশশিফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম তবরী (রাহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) থেকে উক্ত মতামতটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে বর্ণানা করেছেন শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এবং শায়খুল ইসলাম তাকি আস সুবকী (রাহ.) যা হানাফীদের বর্ণিত মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমনটি ইমাম আবু ইউসুফ (রাহ.)এর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি ‘কিতাবুল খারাজ’ এ বলেন, যে কোন মুসলমান রসূল (সা.)কে গালি দিবে, তাঁকে মিথ্যাবাদী বলবে, তাঁর সমালোচনা করবে বা কটাক্ষ করবে সে কাফের হয়ে যাবে, তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। যদি সে তওবা করে, তবে মাফ করা হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। এমনিভাবে মহিলারও একই শাস্তি, তবে ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) বলেন, মহিলাকে হত্যা করা যাবে না। ইসলাম কবুল করার জন্য তাকে বাধ্য করা হবে। মৃত্যুদন্ডকে তওবা না করার সাথে শর্ত করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, তওবার পর তাকে হত্যা করা যাবে না। ইমাম ত্বাহাবী (রাহ.) এর বরাত দিয়ে বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারী মুরতাদ। তার হুকুম ও মুরতাদের হুকুম এক ও অভিন্ন। ফলে মুরতাদের সাথে যে আচরণ করা হয়, তার সাথেও তাই করা হবে। ‘হাবী’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করা ব্যতীত তার কোন তওবা গ্রহণযোগ্য নয়।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩৪৩)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) উভয় মতের দলীল বিশ্লেষণ করে এ মতটিকে শক্তিশালী বলেছেন। (বিস্তারিত দেখুন, রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩৪২-৩৪৭)
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন হাদীস ও ইজমার আলোকে মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করা, তার শানে বিদ্রুপপূর্ণ আচরণ করা জঘন্যতম অপরাধ, যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাই মুসলিম শাসকের জন্য এ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করে, আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা নত করা ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো অপরিহার্য।
সত্যায়নে-
* মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম (দা.বা.)
* হযরত মাওলানা মুফতী ফরীদুল হক (দা.বা.)
http://www.darululoom-hathazari.com/...fotowa_cat.php
((( জিজ্ঞাসা )))
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করা বলতে কি বুঝায়? কুরআন-হাদীসের আলোকে কটাক্ষকারীর শরয়ী বিধান কি, কটাক্ষকারীর তওবা কবুল করা হবে কিনা?
((( সমাধান )))
হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবই নন বরং তিনি সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসূল। মহান আল্লাহ তাআলার পর তাঁর মর্যাদার আসন, তাঁর আগমন এই বিশ্বের জন্য শান্তি ও রহমত। কোন মানুষ নিজের জান-মাল, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক তাঁকে ভালবাসা ছাড়া মুমিন হতে পারে না। শুধু মুসলিম কেন অমুসলিম পর্যন্ত তাঁর আদর্শে মুগ্ধ। তাঁকে স্থান দিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের আসনে। তাদের কথা ভিন্ন যাদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে, সত্যকে গ্রহণ করার মত সৎসাহস হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোন প্রকৃত ঈমানদার যখন শুনতে পায় যে, কোন নামধারি মুসলমান প্রিয় নবী (সা.)এর কটাক্ষ করেছে, তাঁর ব্যঙ্গ করেছে, তখন তাঁর ঈমানি চেতনা জেগে উঠে এবং তার ধর্মীয় আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। নবীর এই দুশমনের উপযুক্ত সাজার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পায় না। আর স্বস্তি না পাওয়াই কাম্য। কারণ নবীর মর্যাদায় আঘাত হানা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আক্রান্ত করা। বলা বাহুল্য যে, একজন মুসলমান তার ধর্মীয় অনুভূতিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই কোন মুমিনের পে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ বরদাস্ত করা সম্ভবপর হয় না। সুতরাং যারা এমন জঘন্য ও ন্যক্কারজনক কাজে লিপ্ত হবে, কুরআন- হাদীস ও ইজমার আলোকে তাদের কি শাস্তির বিধান রয়েছে তা আলোচনার দাবি রাখে।
কটাক্ষ বলতে কি বুঝায়
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) ‘আছ ছারিমুল মাছলুল আলা শাতেমির রসূল’ কিতাবে নবীজী (সা.)এর শানে কটাক্ষের বিবরণ ও মাত্রা সম্পর্কে কাজী ইয়ায থেকে নকল করেন, তিনি বলেন, কটাক্ষ বলতে বুঝায়, মহানবী (সা.)কে গাল মন্দ করা, তাঁর দোষ চর্চা করা, ব্যঙ্গ চিত্র করা, তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা, তাঁর মহান আদর্শময় জীবনের কোন দিক নিয়ে বিদ্রুপ করা, তাঁর বংশ নিয়ে সমালোচনা করা। তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার নিমিত্তে তাঁর আনিত ধর্ম নিয়ে উপহাস করা, তাঁর প্রতি লানত ও বদ দুআ করা, তাঁর অমঙ্গল কামনা করা, তাঁর সাথে বেআদবি করা, তাঁর শানে অশালীন কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি সবই কটাক্ষ হিসেবে বিবেচিত।
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর সাজা
হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী চারও মাযহাবের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো, যদি কোন নামধারি মুসলমান প্রিয় নবী (সা.)কে কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করে, তাহলে সে সম্পূর্ণ কাফের, মুরতাদ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং তার একমাত্র সাজা মৃত্যুদন্ড। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা মুসলিম শাসকের উপর কর্তব্য। উল্লিখিত বিষয়টি কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কুরআনের আলোকে
১. এক মুনাফেক রসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বিদ্রুপপূর্ণ কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ.
“আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, (তাদের বিদ্রুপ পূর্ণ আচরণের বিষয়ে) তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলেছিলাম এবং কৌতুক করেছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তাঁর হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে। ছলনা করনা, তোমরা কাফের হয়ে গেছ, ঈমান প্রকাশ করার পর।” (সূরা তাওবা: ৬৫-৬৬)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) আয়াতটি উল্লেখ করে বলেন, আয়াতটি আলোচ্যবিষয়ে সুস্পষ্ট, এতে রসূল (সা.)এর কটাক্ষ করার কারণে তাদের কৃত্রিম ওজর গ্রহণ না করে কুফরী আখ্যা দেয়া হয়েছে। (আছ ছারিমুল মাসলূল: ৩৩)
২. অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُهِينًا.
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা আহযাব: ৫৭)
আয়াতটির ভাষ্য থেকে সুস্পষ্ট যে, রসূল (সা.)কে কষ্টদাতার জন্য কঠোর শাস্তি ও জাহান্নাম অবধারিত। আর সাধারণ থেকে সাধারণ কটাক্ষও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩১৬)
এখানে আরও প্রতীয়মান হয় যে, রসূল (সা.)কে কটাক্ষ বা বিদ্রুপকারীর শাস্তি আল্লাহ নিজেই নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর রসূল (সা.) মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে শাস্তি প্রয়োগ করেছেন, যার বিবরণ সামনে আসছে।
হাদীসের আলোকে
১. ইমাম নাসাঈ (রাহ.) হযরত আনাস( রাযি.) এর সূত্রে সহীহ সনদে বর্ণনা করেন-
أن النبي صلی اللہ علیہ وسلم دخل مكة وعليه المغفر فقيل ابن خطل متعلق بأستار الكعبة فقال اقتلوه.
“নবী করীম (সা.) (মক্কা বিজয়ের সময়) মক্কাতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথায় টুপি ছিলো। তাঁকে সংবাদ দেয়া হলো, ইবনে খতল (যে রসূল (সা.)কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতো) কাবার গিলাফ জড়িয়ে আছে। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা তাকে হত্যা কর।” (সুনানে নাসাঈ: হাদীস নং ২৮৬৭)
২. ইমাম আবু দাউদ (রাহ.) হযরত আলী (রা.) এর সূত্রে বর্ণনা করেন-
أن يهودية كانت تشتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم وتقع فيه ، فخنقها رجل حتى ماتت ، فأبطل رسول الله صلی اللہ علیہ وسلم دمها.
قال العلامة ابن تيمية في الصارم المسلول هذا الحديث جيد: (60)
“এক ইয়াহুদী নারী নবী করীম (সা.)কে গাল-মন্দ করতো এবং তাঁর সমালোচনা করতো। একদিন এক ব্যক্তি তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। তখন রসূল (সা.) তার রক্ত মূল্য বাতিল ঘোষণা করেন।” (সুনানে আবু দাউদ: হাদীস নং ৪৩৬৪)
উপরিউক্ত হাদীসসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা রসূলুল্লাহ (সা.)কে কোনভাবে কষ্ট দিবে তাদের বিধান হলো মৃত্যুদন্ড। প্রথম হাদীসে রসূল (সা.) হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় হাদীসও আলোচ্যবিষয়ে সুস্পষ্ট।
ইজমা
রসূল (সা.)কে কটাক্ষকারীর মৃত্যুদন্ড দেয়ার ব্যাপারে প্রায় প্রথম যুগ থেকেই একাধিক ইমাম ইজমা (সকল উম্মতের ঐক্যমত) নকল করেছেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) ‘আছ ছারিমুল মাসলূল’ কিতাবে অনেকের নাম ও বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম ও বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সুহনূন (রাহ.) বলেন-
أجمع الأمة أن شاتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم والمنتقص له كافر والوعيد جاء عليه بعذاب الله له، وحكمه عند الأمة القتل، ومن شك في كفره وعذابه كفر.
“সমস্ত উম্মত এব্যাপারে একমত যে, মহানবী (সা.)কে গাল-মন্দকারী ও তাঁকে কটাক্ষকারী কাফের। তার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার প থেকে কঠিন শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর নিকট তার বিধান হলো, মৃত্যুদন্ড এবং যে তার কাফের হওয়া ও শাস্তির উপযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে, সেও কাফের হয়ে যাবে।”
২.আবু বকর ইবনুল মুনযির (রাহ.) বলেন-
أجمع عوام أهل العلم على أن من سب النبي صلی اللہ علیہ وسلم عليه القتل.
“যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)কে গালি দিবে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এ সিদ্ধান্তের উপর সকল ওলামায়ে কেরাম একমত পোষণ করেছেন।”
৩. ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (রাহ.) বলেন-
أجمع المسلمون على أن من سب الله، أو سب رسوله صلی اللہ علیہ وسلم ، أو دفع شيئا مما أنزل الله عز وجل، أو قتل نبيا من أنبياء الله عز وجل، أنه كافر بذلك، وإن كان مقرا بكل ما أنزل الله.
“সমস্ত মুসলমান এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা বা তাঁর রসূলকে গাল-মন্দ করবে অথবা আল্লাহ তা‘আলার প থেকে অবতীর্ণ কোন বিষয়কে অস্বীকার করবে কিংবা আল্লাহ তা‘আলার কোন নবীকে হত্যা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। যদিও সে আল্লাহ তা‘আলার প থেকে অবতীর্ণ অন্য সব বিষয়কে স্বীকার করে।” (আছ ছারিমুল মাছলুল: পৃ.৫)
উল্লিখিত ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোন মুসলমান যদি রসূল (সা.)কে কটাক্ষ করে, তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) ইজমার আলোচনা করে বলেন-
ولا عبرة بما أشار إليه ابن حزم الظاهري من الخلاف في تكفير المستخف به، فإنه شيئ لا يعرف لأحد من العلماء، و من استقرأ سير الصحابة تحقق إجماعهم على ذلك فإنه نقل عنهم في قضايا مختلفة منتشرة يستفيض نقلها ولم ينكره أحد.
“আল্লামা ইবনে হাযম (রাহ.) বিদ্রুপকারী কাফের হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্যেরযে দাবি করেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এমন দাবি অন্য কোন আলেম থেকে পাওয়া যায় না। (আর কাফের হওয়ার বিষয়টি এতস্পষ্ট যে,) কেউ সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পাঠ করলে,এ ব্যাপারে ঐক্যমতের বিষয়টি জানতে পারবে। কারণ এটি তাদের প থেকে বিভিন্ন বিচারের রায়ে ব্যাপকভাবে বর্ণিত রয়েছে, যা কেউ অস্বীকার করেনি।”
মোটকথা, রসূল (সা.)এর সমালোচনাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড এটি নতুন কোন দাবি নয় বা মুসলমানদের উদ্ভাবিতও নয় বরং তার মৃত্যুদন্ডের সাজা আল্লাহ কর্তৃক এবং সর্বজন স্বীকৃত, যা পূর্ব যুগ থেকে চলে আসছে। আর বলা বাহুল্য যে, কোন একজনকে এমন শাস্তি দিলে পরবর্তীতে অন্য কেউ এরূপ ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পাবে না। অন্যথায় এ ধরনের সমালোচনাকারীরা পশ্রয় পেয়ে বারবার দুঃসাহস দেখানোর চেষ্টা করবে। তাই অন্যায়কে আশ্রয় না দিয়ে নির্মূল করাই অপরিহার্য কর্তব্য।
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর তওবা
মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারী নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করলে, আশা করা যায় পরকালের জন্য আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন এবং তার আখেরাতের সাজা মাফ করে দিবেন। এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু দুনিয়াতে তওবার কারণে মৃত্যুদন্ড রহিত হবে কিনা? এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের মতপার্থক্য রয়েছে।
মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব
মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের মতামত হলো, তওবার কারণে তার মৃত্যুদন্ড রহিত হবে না। চাই সে বন্দী হওয়ার পূর্বে তওবা করুক বা পরে । কারণ এটা ‘হদ’ (শরীআতের একটি বিশেষ শাস্তি) যা তওবার কারণে মাফ হয় না। ইমাম আহমদ (রাহ.) বলেন-
كل من شتم النبي صلی اللہ علیہ وسلم وتنقصه مسلما كان أو كافرا فعليه القتل ولا يستتاب.
যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)কে গালমন্দ করে, কটাক্ষ করে, চাই সে মুসলমান হোক বা কাফির, তার শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। তার তওবা গ্রহণ করা হবে না।
আল্লামা কাজী ইয়াজ (রাহ.) এর ব্যাখ্যা এভাবে পেশ করেন-
لأن حق النبي صلی اللہ علیہ وسلم يتعلق به حقان حق لله وحق لآدمي والعقوبة إذا تعلق بها حق لله وحق لآدمي لم تسقط بالتوبة.
“এক্ষেত্রে মহানবী (সা.)এর সাথে দু’টি ‘হক’ সম্পৃক্ত। আল্লাহর ‘হক’ ও বান্দার ‘হক’। আর যখন কোন সাজা বা অপরাধের সম্পর্ক আল্লাহ ও বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তখন সেই সাজা তওবা দ্বারা মাফ হয় না।” (আছ ছারেমুল মাসলূল: পৃ.৩৯৭)
আল্লামা শামী (রাহ.) মালেকী মাযহাব সম্পর্কে বলেন-
وبعد فاعلم أن مشهور مذهب مالك وأصحابه وقول السلف وجمهور العلماء قتله حدا لا كفرا، إن أظهر التوبة منه، ولهذا لا تقبل عندهم توبته ولا تنفع استقالته، وحكمه حكم الزنديق، سواء كانت توبته بعد القدرة عليه أو جاء تائبا من قبل نفسه لأنه حد وجب لا تسقطه التوبة.
“ইমাম মালেক (রাহ.) সহ আরো অনেক ওলামায়ে কেরামের প্রসিদ্ধ মত হলো, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর সাজা হলো মৃত্যুদন্ড। যা ‘হদ’ হিসেবে প্রয়োগ করা হবে, কুফরী হিসেবে নয়। যদি সে তওবা প্রকাশ করে। তাই তাদের নিকট তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুরূপভাবে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার দ্বারাও কোন লাভ হবে না। তার সাজা ও নাস্তিকের সাজা এক ও অভিন্ন। চাই সে আটক হওয়ার পূর্বে তওবা করুক বা পরে। কেননা, এটা ‘হদ’ যা তওবা দ্বারা রহিত হয় না।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩২০)
শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাব
শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাবের মতামত হলো, কটাক্ষকারী ও মুরতাদের হুকুম এক ও অভিন্ন। অতএব যদি সে নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করে তওবা করে, তবে তার তওবা কবুল করা হবে। তার মৃত্যুদন্ড রহিত হবে। আর যদি তওবা না করে, তাহলে মুরতাদের ন্যায় তাকেও তিন দিন বন্দী রেখে তওবা করতে বলা হবে। তার কোন সন্দেহ থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করা হবে, তবে এটা আবশ্যক নয় বরং উত্তম। তাই কাজী ইচ্ছা করলে তাকে তাৎণিক মৃত্যুদন্ড দিতে পারেন, আর যদি কটাক্ষকারী বা মুরতাদ মহিলা হয়, তবে তাকে হত্যা করা যাবে না বরং তওবা না করা পর্যন্ত বন্দী করে রাখা হবে।
আল্লামা সুবকী (রাহ.) বলেন-
ولكن المشهور على الألسنة وعند الحكام وما زالوا يحكمون به على أن مذهب الشافعي قبول التوبة.
“সর্বসাধারণের নিকট প্রসিদ্ধ মতামত যা দ্বারা শাফে‘য়ী মাযহাবের বিচারকগণ বিচার করে থাকেন, তাহলো, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারীর তওবা কবুল করা হবে।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩২৩)
আল্লামা শামী (রাহ.) বলেন-
أنه تقبل توبته ويندرئ عنه القتل بها وأنه يستتاب كما هو رواية الوليد عن مالك وهو المنقول عن أبي حنيفة وأصحابه كما صرح به علماء المذاهب الثلاثة كالقاضي عياض في الشفا ذكر أن الإمام الطبري نقله عنه أيضا وكذا صرح به شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى وكذا شيخ الإسلام التقي السبكي وهو الموافق لما صرح به الحنفية كالإمام أبي يوسف في كتابه الخراج حيث قال: أيما رجل مسلم سب رسول الله صلی اللہ علیہ وسلم أو كذبه أو عابه أو تنقصه فقد كفر بالله تعالى وبانت منه امرأته فإن تاب وإلا قتل وكذلك المرأة إلا أبا حنيفة قال: لا تقتل المرأة وتجبر على الإسلام. علق قتله على عدم التوبة فدل على أنه لا يقتل بعدها.
ولما صرح به في النتف ونقلوه في عدة كتب عن شرح الطحاوي من أنه مرتد وحكمه حكم المرتد ويفعل به ما يفعل بالمرتد ولما صرح به في الحاوي من أنه ليس له توبة سوى تجديد الإسلام وهو الموافق أيضا لإطلاق عبارات المتون كافة.
“তার তওবা কবুল করা হবে এবং তওবার দ্বারা তার মৃত্যুদন্ড রহিত হয়ে যাবে ও তাকে তওবা করতে বলা হবে। এমতটি ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) ও তাঁর শাগরেদগণ থেকে বর্ণিত আছে। যেমনটি মাযহাবত্রয়ের ওলামায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন কাজী ইয়ায আশশিফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম তবরী (রাহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) থেকে উক্ত মতামতটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে বর্ণানা করেছেন শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এবং শায়খুল ইসলাম তাকি আস সুবকী (রাহ.) যা হানাফীদের বর্ণিত মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমনটি ইমাম আবু ইউসুফ (রাহ.)এর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি ‘কিতাবুল খারাজ’ এ বলেন, যে কোন মুসলমান রসূল (সা.)কে গালি দিবে, তাঁকে মিথ্যাবাদী বলবে, তাঁর সমালোচনা করবে বা কটাক্ষ করবে সে কাফের হয়ে যাবে, তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। যদি সে তওবা করে, তবে মাফ করা হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। এমনিভাবে মহিলারও একই শাস্তি, তবে ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) বলেন, মহিলাকে হত্যা করা যাবে না। ইসলাম কবুল করার জন্য তাকে বাধ্য করা হবে। মৃত্যুদন্ডকে তওবা না করার সাথে শর্ত করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, তওবার পর তাকে হত্যা করা যাবে না। ইমাম ত্বাহাবী (রাহ.) এর বরাত দিয়ে বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মহানবী (সা.)কে কটাক্ষকারী মুরতাদ। তার হুকুম ও মুরতাদের হুকুম এক ও অভিন্ন। ফলে মুরতাদের সাথে যে আচরণ করা হয়, তার সাথেও তাই করা হবে। ‘হাবী’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করা ব্যতীত তার কোন তওবা গ্রহণযোগ্য নয়।” (রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩৪৩)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) উভয় মতের দলীল বিশ্লেষণ করে এ মতটিকে শক্তিশালী বলেছেন। (বিস্তারিত দেখুন, রসায়েলে ইবনে আবেদীন: ১/৩৪২-৩৪৭)
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন হাদীস ও ইজমার আলোকে মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করা, তার শানে বিদ্রুপপূর্ণ আচরণ করা জঘন্যতম অপরাধ, যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাই মুসলিম শাসকের জন্য এ সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করে, আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা নত করা ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো অপরিহার্য।
সত্যায়নে-
* মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম (দা.বা.)
* হযরত মাওলানা মুফতী ফরীদুল হক (দা.বা.)
http://www.darululoom-hathazari.com/...fotowa_cat.php
Comment