মুফতী শফী রহ. এর ‘জাওয়াহিরুল ফিকহ’ এবং মুফতী তাকী উসমানী সাহেব দা.বা. এর ‘তাকলীদ কি শরয়ী হাইসিয়্যাত’ কিতাবদ্বয় থেকে বুঝা যাচ্ছে, জনসাধারণের জন্য সকল মাসআলায় কোন এক মাযহাব মেনে চলা আবশ্যক। যা থেকে বুঝা যাচ্ছে, হানাফী মাযহাবের অনুসারী কোন সাধারণ মুসলামনকে সর্বদা হানাফী মুফতীর কাছেই মাসআলা জিজ্ঞেস করতে হবে এবং সে অনুযায়ীই আমল করতে হবে। অন্য কোন মাযহাবের মুফতীর ফতোয়া অনুযায়ী আমল করতে পারবে না।
কিন্তু ফতোয়া শামী দেখার পর বিষয়টা খটকা লাগছে। ফতোয়া শামীতে ইবনুল হুমাম রহ. (মৃত্যু ৮৬১ হি.) এর যে বক্তব্য আল্লামা শামী রহ. (মৃত্যু ১২৫২ হি.) উল্লেখ করেছেন এবং তিনি নিজেও তা সমর্থন করেছেন তা থেকে এর বিপরীত বুঝা যাচ্ছে। সেখান থেকে বুঝা যাচ্ছে, সাধারণ জনগণের জন্য সকল মাসআলায় কোন এক মাযহাব মেনে চলা আবশ্যক নয়। তবে যে মাসআলায় একবার কোন মাযহাব মতে আমল করেছে, অনন্যোপায় না হলে সে মাসআলাতে উক্ত মাযহাব থেকে ফিরে গিয়ে অন্য মাযহাব মতে আমল করতে পারবে না। তবে যদি এমন মাসআলা সামনে আসে যে মাসলাতে এখনো সে কোন মাযহাব মতে আমল করেনি তাহলে উক্ত মাসআলাতে অন্য মাযহাব মতেও আমল করতে পারবে। তবে এরপর থেকে অনন্যোপায় না হলে উক্ত মাসআলাতে উক্ত মাযহাব থেকে ফিরে গিয়ে অন্য মাযহাব মতে আমল করতে পারবে না। কারণ, ইতিপূর্বে যে মাযহাব মতে সে আমল করেছে তা তার বিশ্বাস অনুযায়ী সঠিক ছিল। এখন কোন ওজর ছাড়াই অন্য মাযহাবে চলে যাওয়াটা হবে দ্বীন নিয়ে তামাশার শামিল, যা নিষিদ্ধ। যদি বিশেষ কোন জরুরত ছাড়াই শুধু খাহেশাতের কারণে কিংবা দুনিয়াবী কোন লাভের কারণে অন্য মাযহাবে চলে যায় তাহলে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তাকে তা’জীর করা হবে এবং তার আদালাত-ন্যায়পরায়ণতা নষ্ট হয়ে গেছে বলা ধরা হবে। ফলে তার শাহাদাত-স্বাক্ষ্য কবুল হবে না।
এ থেকে বুঝে আসছে, বর্তমানে যারা হারামাইন শরীফাইন বা অন্য এমন কোন অঞ্চলে বসবাস করেন যেখানে বিভিন্ন মাযহাবের নির্ভরযোগ্য মুফতী বিদ্যমান, তাদের সামনে যদি এমন কোন নতুন মাসআলা আসে যে মাসআলাতে ইতিপূর্বে তারা কোন মাযহাব মতে আমল করেননি, তারা চাইলে উক্ত মাসআলায় নিজের মাযহাবের মুফতীর কাছে না গিয়ে অন্য মাযহাবের মুফতীর কাছে জিজ্ঞাসা করেও আমল করতে পারবেন।
বি.দ্র: তবে এক্ষেত্রে যে মুফতীকে জিজ্ঞাসা করবেন তাকে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য হতে হবে। যে কোন আলেমের কাছে জিজ্ঞাসা করা যাবে না। তদ্রূপ নিজে কোন বইয়ে পড়ে বা শুনে শুনে আমল করে ফেলা যাবে না।
এবারে আমি আল্লামা শামী রহ. এর বক্তব্যটি তুলে ধরছি। তিনি বলেন,
وفي آخر التحرير للمحقق ابن الهمام: مسألة لا يرجع فيما قلد فيه أي عمل به اتفاقا، وهل يقلد غيره في غيره؟ المختار نعم للقطع بأنهم كانوا يستفتون مرة واحدا ومرة غيره غير ملتزمين مفتيا واحدا فلو التزم مذهبا معينا كأبي حنيفة والشافعي، فقيل يلزم، وقيل لا، وقيل مثل من لم يلتزم، وهو الغالب على الظن لعدم ما يوجبه شرعا اهـ ملخصا
“মুহাক্কিক ইবনুল হুমাম রহ. এর কিতাব ‘আত-তাহরীর’ এর শেষের দিকে বলা হয়েছে, ‘মাসআলা: ((যে মাসআলায় একবার কোন ইমামের তাকলীদ করে আমল করেছে সে মাসআলা থেকে আর ফিরে আসতে পারবে না। এ ব্যাপারে সকলেই একমত। অন্য মাসআলাতে কি অন্য ইমামের তাকলীদ করতে পারবে? গ্রহণযোগ্য মত হল পারবে। কারণ, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, সালাফগণ একসময় একজনের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতেন অন্যসময় অন্যজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতেন। আবশ্যিকভাবে কোন এক মুফতীকেই মেনে চলতেন না। যদি কোন এক মাযহাবকে নিজের জন্য মেনে চলা আবশ্যক করে নেয়; যেমন, হানাফী মাযহাব বা শাফিয়ী মাজহাব, তাহলে বলা হয়,
- (উক্ত মাযহাব মেনে চলাই) আবশ্যক হবে।
- আবার এও বলা হয় যে, আবশ্যক হবে না।
- এও বলা হয় যে, এই ব্যক্তির বিধান ঐ ব্যক্তির মতই যে কোন এক মাযহাব মতে চলা নিজের জন্য আবশ্যক করে নেয়নি।
এই শেষোক্ত মতটিই সঠিক বলে প্রবল ধারণা হচ্ছে। কারণ, শরীয়তে এমন কোন দলীল নেই যা এক মাযহাব মতে চলাকে আবশ্যক সাব্যস্ত করে।)) সংক্ষিপ্তাকারে ইবনুল হুমাম রহ. এর বক্তব্য শেষ হল।” [ফাতাওয়া শামী: বাবুত তা’জীর।]
এ থেকে এও বুঝে আসছে যে, আমরা যারা নিজেদেরকে হানাফী, হাম্বলী ইত্যাদী বলে দাবি করি তাদের জন্য সকল মাসআলাতে হানাফী বা হাম্বলী বা অন্য কোন মাযহাব মতে আমল করা জরুরী নয়। বরং যে মাসআলা নতুন, যাতে এখনোও কোন মাযহাব মতে আমল করিনি, সে মাসআলাতে অন্য মাযহাব মতে আমল করা যাবে।
আল্লামা শামী রহ. অন্যত্র বলেন,
العامي يجب عليه تقليد العالم إذا كان يعتمد على فتواه ثم قال وقد علم من هذا أن مذهب العامي فتوى مفتيه من غير تقييد بمذهب ولهذا قال في الفتح: الحكم في حق العامي فتوى مفتيه، وفي النهاية ويشترط أن يكون المفتي ممن يؤخذ منه الفقه ويعتمد على فتواه في البلدة ... ولا معتبر بغيره. اهـ. (2\411، كتاب الصوم)
“সাধারণ ব্যক্তিদের জন্য ওয়াজিব হল কোন আলেমের তাকলীদ করা, যদি আলেম এমন নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকেন যে, (উক্ত অঞ্চলে) তার ফতোয়া মেনে চলা হয়। ইবনে নুজাইম রহ. এরপর বলেন, ‘এ থেকে বুঝা গেল সাধারণ ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট কোন মাযহাব নেই। মুফতীর ফতোয়াই তাদের মাযহাব। ফাতহুল কাদীরে (ইবনুল হুমাম রহ.) বলেন, ‘সাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মুফতীর ফতোয়াই তার বিধান।’ ‘আন-নিহায়া’তে বলা হয়েছে, ‘শর্ত হচ্ছে, মুফতী এমন ব্যক্তি হতে হবে যার থেকে ফিকহ-ইসলামী আইনশাস্ত্র আহরণ করা হয় এবং এবং ঐ শহরে তার ফতোয়া গ্রহণ করা হয়। … এমন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।” [ফাতাওয়া শামী: কিতাবুস সাওম।] এ থেকে বুঝা গেল, যার তার কাছে জিজ্ঞাসা করা যাবে না – যেমনটা আজকাল করা হচ্ছে। মুফতীকে ইলমে ফিকহে এমন পারদর্শী হতে হবে যে, তার থেকে ইলমে ফিকহ শিখা হয় এবং ফতোয়া দানের ক্ষেত্রে এমন দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে যে, তার ফতোয়া উক্ত এলাকায় মেনে চলা হয়।
যারা খাহেশাতের কারণে কিংবা দুনিয়াবী লাভের উদ্দেশ্যে মাযহাব বদলায় তাদের ব্যাপারে বলেন,
يعزر) أي إذا كان ارتحاله لا لغرض محمود شرعا ... أخاف عليه أن يذهب إيمانه وقت النزع؛ لأنه استخف بمذهبه الذي هو حق عنده وتركه لأجل جيفة منتنة، ولو أن رجلا برئ من مذهبه باجتهاد وضح له كان محمودا مأجورا. أما انتقال غيره من غير دليل بل لما يرغب من عرض الدنيا وشهوتها فهو المذموم الآثم المستوجب للتأديب والتعزير لارتكابه المنكر في الدين واستخفافه بدينه ومذهبه اهـ ملخصا.
“যদি শরীয়তে প্রশংসনীয় কোন উদ্দেশ্য ব্যতীরেকেই বদলিয়ে থাকে তাহলে শাস্তি দেয়া হবে। … আমার ভয় হয় যে, মৃত্যুর সময় তার ঈমান না’কি চলে যায়। কেননা, সে তার নিজের মাযহাব যা তার বিশ্বাস মতে হক, তার অবমাননা করেছে। পুঁতি-দুর্গন্ধময় আবর্জনা লাভের উদ্দেশ্যে সে তা ত্যাগ করে দিয়েছে। যদি কোন মুজতাহিদ সুস্পষ্ট ইজতিহাদের ভিত্তিতে নিজ মাজহাব তরক করতো তাহলে প্রশংসিত ও সওয়াবপ্রাপ্ত হতো। কিন্তু মুজতাহিদ ভিন্ন অন্য ব্যক্তি কোন প্রকার দলীল ছাড়াই বরং দুনিয়ার লোভে এবং খাহেশাতের কারণে মাযহাব ত্যাগ করা নিশ্চয় নিন্দনীয় এবং গুনাহের কাজ, যার ফলে তাকে তা’জীর করা ও শাস্তি দেয়া আবশ্যক। কেননা, সে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তিজনক কাজে লিপ্ত হয়েছে এবং তার ধর্ম ও মাযহাবের অবমাননা করেছে। সংক্ষিপ্তাকারে তাতারখানিয়ার বক্তব্য শেষ হল।” [ফাতাওয়া শামী: বাবুত তা’জীর] বিনা কারণে যারা নিজ মাযহাব বদলায় তাদের স্বাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য না হওয়ার ব্যাপারে বলেন,
ليس للعامي أن يتحول من مذهب إلى مذهب ، ويستوي فيه الحنفي والشافعي ... وإن انتقل إليه لقلة مبالاته في الاعتقاد والجراءة على الانتقال من مذهب إلى مذهب كما يتفق له ويميل طبعه إليه لغرض يحصل له فإنه لا تقبل شهادته ا هـ .
“সাধারণ ব্যক্তি এক মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাবে যেতে পারবে না। হানাফী-শাফিয়ী সবাই এক্ষেত্রে বরাবর। যদি আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব প্রদানের কারণে এবং দুনিয়াবী লাভের উদ্দেশ্যে মন মত এক মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাবে চলে যাওয়ার প্রতি দু:সাহসিকতার কারণে নিজ মাযহাব ত্যাগ করে তাহলে তার স্বাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।” [ফাতাওয়া শামী: কিতাবুশ শাহাদাত।]বিশেষ দ্রষ্টব্য:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল,
ক. সাধারণ ব্যক্তির জন্য সকল মাসআলায় এক মাযহাব মানা ওয়াজিব- কথাটা নি:শর্তভাবে প্রযোজ্য নয় বরং কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরত ছাড়াই অন্য মাযহাব মানারও অবকাশ আছে।
খ. যার তার কাছে মাসআলা জিজ্ঞাসা করা যাবে না এবং কারো কাছে জিজ্ঞাসা ব্যতীত নিজের মন মতোও আমল করা যাবে না। বরং নির্ভরযোগ্য মুফতীর কাছে জিজ্ঞাসা করে আমল করতে হবে।
গ. যে মাসআলায় যে মাযহাব মেনে আসছে কোন জরুরত ছাড়াই উক্ত মাসআলায় উক্ত মাযহাব ত্যাগ করা দ্বীন নিয়ে তামাশার শামিল, যার কারণে ব্যক্তি শাস্তির উপযুক্ত হয়ে পড়ে এবং স্বাক্ষ্য প্রদানের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
একটি অনুরোধ:
তাকলীদের এই মাসআলায় আমি ফতোয়া দিচ্ছি না। আমার কাছে খটকা লেগেছে তাই শুধু আরজ করছি। আপনারা কেউ আমার এই লেখার উপর ভিত্তি করেই অন্য মাযহাব মতে আমল শুরু করতে যাবেন না।
এই লেখার দ্বারা উদ্দেশ্য:
আমার উদ্দেশ্য মুফতী শফী রহ. কিংবা মুফতী তাকি উসমানী দা.বা.কে হেয় করা নয়। আমার খটকাটা শুধু আমি পেশ করেছি। তবে এ কথা অবশ্যই সত্য যে, বড়দের পেশকৃত তাহকীক অন্ধভাবে মেনে নিতে হবে এমনটা নয়। তাঁদের তাহকীকের উপরও আপত্তি থাকতে পারে। তাঁদের তাহকীকের পরও তাহকীক হতে পারে।
###
Comment