হাদিসের সমন্বয়
আমরা দেখলাম, শরীয়ত উক্ত তিন শ্রেণী ছাড়াও আরো অনেক মুসলমানকে হত্যার বৈধতা দিয়েছে; এতদসত্ত্বেও উপরোক্ত হাদিসে শুধু তিন শ্রেণীর মাঝে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হল কিভাবে?
এর নিরসন বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে করেছেন। যেমন-
১. কেউ বলেছেন, এ হাদিস মানসূখ হয়ে গেছে। যেমন- ইবনে হাজার রহ. দাউদী রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আয়াতে মুহারাবা দ্বারা এ হাদিস মানসূখ হয়ে গেছে।
২. কেউ বলেন, এ হাদিসের বাইরে অন্য যত হত্যার কথা এসেছে, সেগুলোকে এ হাদিসে উল্লিখিত তিন শ্রেণীর কোন না কোন একটা মধ্যে ফেলা যায়। যেমন- সমকামিতা এবং পশুসঙ্গমকে যিনার শ্রেণীতে ফেলা যায়। খাওয়ারেজ ও বাগীদেরকে দ্বীনত্যাগী শ্রেণীতে ফেলা যায়। এভাবে সবগুলোকেই তিন শ্রেণীর কোন না কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়। অতএব, মৌলিক কারণ তিনটিই, তবে তার শাখা-প্রশাখা অনেক।
৩. তবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত বুঝে আসছে হাফেয ইবনে হাজার রহ. যে নিরসন পেশ করেছেন- সেটি। তা হল- হাদিসে যে তিন শ্রেণীর হত্যার কথা এসেছে (অর্থাৎ অন্যায় হত্যাকারী, বিবাহিত যিনাকার পুরুষ বা মহিলা, মুরতাদ) তাদেরকে সর্বাবস্থায় হত্যা করা ফরয। চাই এরা কারোও অনিষ্ট সাধন করুক বা না করুক- সর্বাবস্থায় তাদের হত্যা করতে। এই তিন ব্যক্তি এমন যে, এদের ব্যক্তিত্বটাই হত্যার যোগ্য। তারা কি অন্য কোন অনিষ্ট করল কি করল না- তা দেখার বিষয় নয়। যিনা, হত্যা ও ইরতিদাদ এমন অপরাধ, যাতে লিপ্ত হওয়ার পর উক্ত ব্যক্তি আর বেঁচে থাকার যোগ্য থাকে না। উক্ত অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পর সে অন্য কোন অপরাধ না করলেও তাকে হত্যা করে দিতে হবে।
পক্ষান্তরে বাকি ১৮ শ্রেণী, যাদের হত্যার কথা বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে এসেছে- তাদেরকে হত্যা করতে হয় তাদের অনিষ্ট থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে। এখানে ব্যক্তি উদ্দেশ্য নয়, অনিষ্ট দমন উদ্দেশ্য। অনিষ্ট যদি হত্যা ছাড়াই দমন করা সম্ভব হয়, তাহলে তাদের হত্যা করা যাবে না। যেমন-
- বাগী যদি বিদ্রোহ ছেড়ে দেয়, তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে না।
- কারো জান, মাল বা ইজ্জতের উপর আক্রমণকারী ব্যক্তি যদি হত্যা ছাড়াই (ধমকি, চিৎকার বা প্রহারের দ্বারা) বিরত হয়ে যায়, তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে না।
- যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারী যদি যাকাত আদায়ে সম্মত হয়ে যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করা হবে না।
বাকিগুলোরও একই কথা। হত্যা ছাড়াই যদি তাদের অনিষ্ট দমন করা যায়, তাহলে হত্যা করা হবে না। কিন্তু ঐ হাদিসে উল্লিখিত তিন শ্রেণী ব্যতিক্রম। এদের বিষয়টা অনিষ্ট দমনের সাথ সম্পর্কিত নয়, বরং এদের ব্যক্তিত্বটাই এমন যে, এরা আর বেঁচে থাকার অধিকার রাখে না। এদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
উদাহরণ
যেমন ধরুন, নামায এমন একটা বিধান, যা প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে হওয়া উদ্দেশ্য। একজনের নামায অন্যজন আদায় করলে হবে না। এক পরিবারের একজন বাকি সকলের নামায একাই পড়ে নিলে বাকিদের নামায আদায় হবে না। তাদের নামায তাদেরকেই আদায় করতে হবে। কিন্তু জিহাদ এমন একটা বিধান, যা প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে হওয়া উদ্দেশ্য নয়। কাফেরদের শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ বা জিযিয়া প্রদানে বাধ্য করা এর উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য যদি কিছু সংখ্যক মুসলমানের দ্বারা অর্জন হয়ে যায়, তাহলে বাকিরা জিহাদ না করলেও চলবে। তবে নফিরে আম হয়ে গেলে তখন কথা ভিন্ন। তখন সকলকেই শরীক হতে হবে।
এখানেও বিষয়টা এমনই। উপরোক্ত তিন শ্রেণীর ব্যক্তিত্বটাই পৃথিবীতে থাকার অনুপযুক্ত। তাই তাদেরকে হত্যা করে ফেলতে হবে। আর বাকিদের অনিষ্ট দমন উদ্দেশ্য। অনিষ্ট যদি হত্যা ছাড়াই দমন হয়ে যায়, তাহলে হত্যা করা হবে না। আর হত্যা ছাড়া দমন সম্ভব না হলে হত্যা করা হবে। কাজেই, এ হাদিসের সাথে অন্যান্য আয়াত ও হাদিসের বিরোধ নেই। এ হাদিসে বিশেষ তিন শ্রেণীর কথা এসেছে আর অন্যান্য আয়াত ও হাদিসে অন্য প্রকারগুলোর কথা এসেছে। একটার সাথে আরেকটার কোন বিরোধ নেই।
এবার ইবনে হাজার রহ. এর বক্তব্য লক্ষ্য করুন। তিনি সংক্ষেপ কথায় বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছেন-
والتحقيق في جواب ذلك أن الحصر فيمن يجب قتله عينا أما من ذكرهم فان قتل الواحد منهم إنما يباح إذا وقع حال المحاربة والمقاتلة. اهـ
“এর প্রকৃত জওয়াব হল- তিন শ্রেণীতে সীমাবদ্ধের কথাটা এসেছে এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে, যাদের স্বয়ং ব্যক্তিটাকে হত্যা করাই ফরয। পক্ষান্তরে অন্য যাদের কথা বলা হয়েছে- তাদের কাউকে তো হত্যা করা বৈধ হবে কেবল ঐ সময়, যখন তার সাথে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ বেঁধে যায়। (ফাতহুল বারি: ৭/৩৫৩)বি.দ্র.
বিবাহিত যিনাকার (যদি গোলাম বা বান্দি না হয়; কেননা, তাদের হুকুম ভিন্ন) তাওবা করুক বা না করুক- সর্বাবস্থায় তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে। তাকে মাফ করার অধিকার কারো নেই।
মুরতাদ যদি তাওবা না করে, তাহলে তাকে হত্যা করে ফেলা ফরয। তাকে মাফ করার অধিকার কারো নেই।
তবে অন্যায় হত্যাকারীকে যদি নিহত ব্যক্তির অলী (অভিভাবকরা) মাফ করে দেয়, তাহলে মাফ পেয়ে যাবে, অন্যথায় হত্যা করে দেয়া হবে।
Comment