জনসাধারণ কি অস্ত্র প্রয়োগ ও হত্যার অধিকার রাখে?
এ প্রশ্নের উত্তরের আগে একটা বিষয় বুঝে নেয়া চাই। তা হলো- (হুদুদ-কেসাস) ও (উপস্থিত যুলম ও অন্যায় প্রতিহত করণ)- এর মধ্যকার ব্যবধান। বিষয়টি বুঝার জন্য দু’টি উদাহরণ দিচ্ছি:
এক.
ধরুন একটা বাজারে কোন একটা সন্ত্রাসী একজন নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করতে তার উপর চড়াও হয়েছে। সে ছুরি বের করে তাকে যবাই করে ফেলতে চাইছে। আশেপাশে যারা উপস্থিত আছে তাদের সামর্থ্য আছে উক্ত সন্ত্রাসীকে প্রতিহত করে নিরপরাধ লোকটাকে তার হাত থেকে রক্ষা করার। হতে পারে উপস্থিত লোকদের ধমকিতে, কিংবা শারীরিক আঘাতে সে সরে যাবে। আবার এও হতে পারে- উক্ত সন্ত্রাসী সহজে দমতে চাইবে না। এমনও হতে পারে- অস্ত্র প্রয়োগ কিংবা হত্যা করা ছাড়া তাকে দমন করা যাবে না। নিরপরাধ মুসলিম লোকটাকে তার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
এমতাবস্থায় বিধান কি? যদি অস্ত্র ব্যবহার বা হত্যা ছাড়া সন্ত্রাসীটাকে দমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে উক্ত নিরপরাধ মুসলমান নিজে বা উপস্থিত লোকজন তার বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করতে কিংবা তাকে হত্যা করতে পারবে কি?
দ্বিতীয়ত: সন্ত্রাসী যদি নিরপরাধ লোকটাকে হত্যা করেই ফেলে, তাহলে শরীয়তের বিধান মতে একজন নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যার কারণে সন্ত্রাসীকে হত্যা করতে হবে। একে কেসাস বলে।
এমতাবস্থায় বিধান কি? সাধারণ জনগণ কি কেসাসস্বরূপ তাকে হত্যা করতে পারবে?
দুই.
একটা লম্পট একজন নারীর সম্ভ্রবহানি করতে চাচ্ছে। সেখানে অনেকেই উপস্থিত। অবস্থা এমন যে, উক্ত লম্পটের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ ছাড়া কিংবা তাকে হত্যা করা ছাড়া নারীটির সম্ভ্রব রক্ষা করা সম্ভব না।
এমতাবস্থায় বিধান কি? উক্ত নারী কিংবা উপস্থিত লোকজন কি উক্ত লম্পটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করতে কিংবা তাকে হত্যা করতে পারবে?
দ্বিতীয়ত: লম্পট লোকটা যদি উক্ত নারীর সম্ভ্রবহানি করেই ফেলে, তাহলে তার উপর যিনার শাস্তি বর্তাবে। একে হদ বলে। লম্পটটা অবিবাহিত হলে তাকে একশ দোররা মারতে হবে আর বিবাহিত হলে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করতে হবে।
এমতাবস্থায় বিধান কি? সাধারণ জনগণ কি তার উপর যিনার হদ (বেত্রাঘাত বা প্রস্তারাঘাতে হত্যা) কায়েম করতে পারবে?
এ দু’টি উদাহরণে হত্যায় লিপ্ত সন্ত্রাসী এবং যিনায় লিপ্ত লম্পটের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ, কিংবা প্রয়োজনে হত্যা করে নিরপরাধ মুসলমান ও উক্ত নারীকে রক্ষা করা হল- (উপস্থিত যুলম ও অন্যায় প্রতিহত করণ)। এটি ‘আমর বিল মা’রূপ ও নাহি আনিল মুনকারের’ মধ্যে পড়ে। আর হত্যা বা যিনা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর শরীয়তের নিয়মানুযায়ী হত্যাকারী বা যিনাকারকে হত্যা করা বা বেত্রাঘাত করা হল- (হদ ও কেসাস)।
এখন প্রশ্ন:
- সাধারণ জনগণ কি (আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার) এবং (হদ-কেসাস) উভয়টিই কায়েম করতে পারবে?
- না’কি কোনটাই পারবে না?
- না’কি একটা পারবে আরেকটা পারবে না?
উত্তর: একটা পারবে আরেকটা পারবে না। আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার সম্পাদন করতে পারবে, কিন্তু হদ বা কেসাস কায়েম করতে পারবে না। হুদুদ-কেসাস কায়েম করার দায়িত্ব ইমাম, সুলতান বা তাদের কতৃক নির্ধারিত ব্যক্তির (যেমন- কাজি)। সাধারণ জনগণের তা কায়েম করার অধিকার নেই।
অতএব, উপরোক্ত উদাহরণ দু’টিতে নিরপরাধ মুসলমান এবং উক্ত নারীকে রক্ষার জন্য সাধারণ জনগণ প্রয়োজনে অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারবে। যদি হত্যা করা ব্যতীত উক্ত মহিলা বা মুসলমানকে রক্ষা করা সম্ভব না হয়, তাহলে হত্যাও করতে পারবে। এটি আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হত্যা বা যিনা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার তাদের উপর হদ বা কেসাস কায়েম করতে পারবে না। তাই কেসাসস্বরূপ সন্ত্রাসীকে হত্যা বা হদরূপে যিনাকারকে হত্যা বা বেত্রাঘাত করতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হল- একটা পারবে আরেকটা পারবে না কেন? আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার করতে পারবে কিন্তু হুদুদ-কেসাস কায়েম করতে পারবে না কেন?
বিষয়টা একটু গোঁড়া থেকে বুঝতে চেষ্টা করি-
আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার সম্পাদনের দায়িত্ব যেমন উম্মাহর, হুদুদ-কেসাস কায়েম করার দায়িত্বও উম্মাহর। কিন্তু আমর বিল মারূ’ফ ও নাহি আনিল মুনকার উম্মাহর সকলেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পাদন করতে পারবে, কিন্তু হুদুদ-কেসাস কায়েম করবেন উম্মাহর পক্ষ থেকে উম্মাহর ইমাম, সুলতান বা তাদের কতৃক নির্ধারিত ব্যক্তিগণ। সাধারণ জনগণ নিজেরা তা কায়েম করতে পারবে না। কারণ- আমর বিল মারূ’ফ ও নাহি আনিল মুনকার এবং হুদুদ-কেসাসের মাঝে ব্যবধান আছে:
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় তার অনুমতি ব্যতীত কোন সাহাবী কোন হদ বা কেসাস কায়েম করেননি, কিন্তু আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার সকলেই সম্পাদন করতেন।
- খোলাফায়ে রাশেদিনের খেলাফতকালে হুদুদ-কেসাস খোলাফায়ে রাশেদিন নিজেরা বা তাদের কতৃক নির্ধারিত ব্যক্তিরা কায়েম করতেন। তাদের অনুমতি ব্যতীত সাধারণ জনগণ তা কায়েম করতে পারতো না, কিন্তু আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার সকলেই আঞ্জাম দিতেন।
- হুদুদ-কেসাস কায়েমের জন্য এতটুকু শক্তি-সামর্থ্য থাকা আবশ্যক যে, অবাধ্য অপরাধিদের পাকড়াও করে তাদের উপর হদ-কেসাস কায়েম করতে পারে এবং এর প্রতিক্রিয়ারূপে যে ফিতনা-ফাসাদ সংঘটিত হওয়ার সম্ভবনা আছে তা প্রতিহত করতে পারে। আর স্পষ্ট যে, পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং উদ্ভূত ফেতনা-ফাসাদ প্রতিহত করার ক্ষমতা সাধারণ জনগণের নেই, কিন্তু তা ইমাম বা সুলতানের আছে। সাধারণ জনগণ হদ বা কেসাস কায়েম করতে গেলে উল্টো আরো ফেতনা-ফাসাদ ছড়াবে। তাই তারা তা কায়েম করতে পারবে না। কিন্তু ইমাম বা সুলতানের অবস্থা এর ব্যতিক্রম। তারা তাদের শক্তিবলে পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং উদ্ভূত সব ধরণের ফেতনা-ফাসাদ প্রতিহত করতে পারবেন। তাই তারা হুদুদ-কেসাস কায়েম করতে পারবেন।
- সাধারণ জনগণের উপর আপত্তি আসতে পারে যে, তারা স্বজনপ্রীতি, ঘুষ বা অন্য কোন দুনিয়াবি স্বার্থে কাউকে শাস্তি দিচ্ছে বা হত্যা করছে। কিন্তু ইমাম বা সুলতানের ক্ষেত্রে সাধারণত এ অভিযোগ আসবে না।
- চলমান উপস্থিত যুলুম ও অন্যায়ের অবস্থা এক রকম আর তা সম্পাদন শেষ হয়ে গেলে তার অবস্থা আরেক রকম। চলমান অবস্থায় অপরাধ দৃশ্যমান। চোখের সামনেই তা সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু অপরাধ শেষ হয়ে গেলে তখন এর বিপরীতে হদ বা কেসাস কায়েমের জন্য শরীয়ত কয়েকটি জিনিস আবশ্যক করেছে। যেমন:
ক. যথোপোযুক্ত স্বাক্ষী-প্রমাণসহ অপরাধ প্রমাণ করা।
খ. স্বাক্ষীদের অবস্থা যাচাই করা যে, তারা সত্যবাদি না মিথ্যাবাদি।
গ. হদ কায়েমের পর্যাপ্ত শর্তাবলী পাওয়া গিয়েছে কি’না- তা নিশ্চিত হওয়া।
ইত্যাদি আরোও বিভিন্ন বিষয়, যা হুদুদ-কেসাসে প্রয়োজন। কিন্তু অপরাধ যখন সংঘটিত হচ্ছে, একজন স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষ করছে, তখন এসব কিছুই দরকার নেই। তাই, জনসাধারণের সম্মুখে সুস্পষ্ট কোন অন্যায় বা যুলুম সংঘটিত হলে তারা তৎক্ষণাৎ তা প্রতিহত করতে পারবে। প্রয়োজনে অস্ত্র প্রয়োগ ও হত্যা পর্যন্ত করতে পারবে। কিন্তু হুদুদ-কেসাসের অবস্থা তার ব্যতিক্রম।
বি.দ্র.-১
সাধারণ জনগণ আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার কেবল ঐসব বিষয়েই করতে পারবে, যেগুলো শরীয়তে সুস্পষ্ট হারাম এবং সুস্পষ্ট জুলুম ও অন্যায়। যেমন- যিনা, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি। পক্ষান্তরে যেসব বিষয় সুস্পষ্ট নয়, যেগুলো হারাম-হালাল উভয়টারই সম্ভবনা রাখে, সেসব বিষয়ে করতে পারবে না। উলামাগণ বিশেষ শর্তসাপেক্ষে করতে পারবেন।
বি.দ্র.-২
কেউ যদি কাউকে যিনা, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদির মতো সুস্পষ্ট কোন অপরাধে লিপ্ত দেখে এবং তাকে হত্যা ব্যতীত উক্ত হারাম বা যুলুম থেকে বিরত রাখা সম্ভব না হয়, ফলে বাধ্য হয়ে তাকে হত্যা করে দেয়- তাহলে আল্লাহ তাআলার দরবারে তার কোন জবাবদিহি করতে হবে না, বরং সওয়াবের অধিকারি হবে। কিন্তু কাজির দরবারে সে যদি উপযুক্ত স্বাক্ষী-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে না পারে যে, উক্ত অপরাধে লিপ্ত থাকা অবস্থায় তাকে হত্যা করেছে, তাহলে কাজির দরবারে সে হত্যাকারী বলে বিবেচিত হবে। হত্যাকারি হিসেবেই দুনিয়াতে তার বিচার হবে। বিচারস্বরূপ কোন কোন ক্ষেত্রে তাকে হত্যার বদলে হত্যা করা হবে, আর কোন কোন ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির রক্তমূল্য (দিয়াত) পরিশোধ করতে হবে। আর যদি প্রমাণ করতে পারে যে, সে তাকে উপরোক্ত অপরাধে লিপ্ত থাকা অবস্থায় বাধ্য হয়ে হত্যা করেছে, তাহলে মুক্তি পেয়ে যাবে।
বি.দ্র.-৩
মুজাহিদগণ যে সব এলাকা দখল করেছেন, সেগুলোতে হুদুদ-কেসাস কায়েম করতে পারবেন কি?
উত্তর: যেখানে মুজাহিদদের পূর্ণ ক্ষমতা বিদ্যমান এবং তারা ইসলামী ইমারা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন, সেখানে তো অবশ্যই কায়েম করবেন। আর যেসব এলাকায় তাদের একক আদিপত্য এখনোও কায়েম হয়নি, বরং হামলার মুখে যে কোন সময় ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে, সেগুলোতে হুদুদ-কেসাস কায়েম করবেন কি’না ভেবে দেখতে হবে। যদি সেখানে হুদুদ-কেসাস কায়েম করার দ্বারা লোকজন বিগড়ে না যায়, জিহাদের কোন ক্ষতি না হয়, কাফেররা সুবিধা গ্রহণ না করার আশংকা না থাকে- তাহলে ইনশাআল্লাহ কায়েম করতে পারেন। পক্ষান্তরে যদি লোকজন বিগড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে, জিহাদের ক্ষতির আশংকা থাকে, কাফেরদের সুবিধা লাভের সম্ভাবনা থাকে- তাহলে কায়েম করবেন না। হুদুদ-কেসাসের পরিবর্তে মুনাসিব মতো অন্য কোন শরয়ী শাস্তি নির্ধারণ করে নেবেন। দাওয়াত, ইসলাহ ও সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। যতদিন আল্লাহ তাআলা পূর্ণ তামকীন না দেন, ততদিন জরুরত বশত এভাবে চলতে হবে। এটা আল্লাহর হুদুদ ও কেসাসের প্রতি উদাসীনতার কারণে নয়, জরুরতে কারণে।
Comment