((অনেক দিন হল লেখাটা শুরু করেছিলাম। সময়-সুযোগের অভাবে শেষ করা গেল না। এখন আলহামদু লিল্লাহ কিছুটা সুযোগ হয়েছে। তাই আবার লিখতে শুরু করলাম।))
-----------------------
-----------------------
হত্যার শ্রেণীবিভাগ
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছি যে, কি কি কারণে একজন মুসলমানকে হত্যা করা যায়। এখানে বিষয়টাকে আরেকটু পরিষ্কার করে তোলার চেষ্টা করব। যেসব কারণে একজন মুসলমানকে হত্যা করা যায়, তার সবগুলো একই শ্রেণীভুক্ত নয়। একেক জনের হত্যা একেক শ্রেণীভুক্ত। মৌলিকভাবে আমরা মুসলিম হত্যাকে নিম্নোক্ত চার শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি:
১. হদরূপে হত্যা।
২. কেসাসরূপে হত্যা।
৩. دفع الصائلতথা জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রু রক্ষার্থে হত্যা।
৪. সিয়াসত ও তা’যিররূপে হত্যা।
এক. হদ
হদ বলা হয় শরীয়ত কতৃক সুনির্ধারিত শাস্তি, যাতে কোন ধরণের কম-বেশ বা পরিবর্তনের সুযোগ নেই এবং যা প্রমাণিত হওয়ার পর মাফ করার কোন সুযোগ নেই। যেমন- চোরের হাত কাটা। এটা হদ। এতে কোন পরিবর্তন করা যাবে না। হাত কাটার বদলে জেল-জরিমানা নির্ধারণ করা যাবে না। তদ্রূপ কাযির দরবারে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে চুরি প্রমাণিত হওয়ার পর চোরকে মাফ করে দেয়া এবং হাত না কেটে ছেড়ে দেয়ারও কোন সুযোগ নেই। হানাফি মাযহাব মতে ছয়টি অপরাধের শাস্তি হদ বলে গণ্য:
১. যিনা।
২. মদপান।
৩. মদ ব্যতীত অন্য কোন নেশাজাত দ্রব্য সেবনে মাতাল হয়ে পড়লে। অবশ্য এর শাস্তি মদপানের শাস্তির সমান তথা আশি দোররা।
৪. কজফ তথা পূত-পবিত্র কোন স্বাধীন মুসলমানকে যিনার অপবাদ দেয়া ।
৫. চুরি।
৬. রাহাজানি।
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. (১২৫২হি.) ইবনে কামাল পাশা রহ. (৯৪০হি.) থেকে বর্ণনা করেন,
وهي ستة أنواع: حد الزنا، وحد شرب الخمر خاصة، وحد السكر من غيرها والكمية متحدة فيهما، وحد القذف، وحد السرقة، وحد قطع الطريق. اهـ
“হদ ছয় প্রকার: ১. যিনার হদ। ২. মদপানের হদ। ৩. মদ ব্যতীত অন্য কোন মাদক সেবনে মাতাল হওয়ার হদ। তবে শাস্তির পরিমাণ উভয়টাতে একই। ৪. কজফ তথা যিনার অপবাদ লাগানোর হদ। ৫. চুরির হদ। ৬. রাহাজানির হদ।” (রদ্দুল মুহতার: ৪/৩)হদরূপে যাদের হত্যা করা হবে
এদেরকে রজম করে তথা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে। আর অবিবাহিত হলে একশো বেত্রাঘাত লাগানো হবে। বেত্রাঘাত কুরআনে কারীমের আয়াত দ্বারা, আর রজম হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ}
“যিনাকারী পুরুষ ও যিনাকারী নারী: প্রত্যেককে একশত চাবুক মারবে। তোমরা যদি আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখ, তাহলে তাদের প্রতি করুণাবোধ যেন আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে। আর মু’মিনদের একটা দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (নূর: ২)হাদিসে এসেছে,
لا يحل دم امرئ مسلم يشهد أن لا إله إلا الله وأني رسول الله إلا بإحدى ثلاث النفس بالنفس والثيب الزاني والمارق من الدين التارك للجماعة.
“যে মুসলমান স্বাক্ষী দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং আমি আল্লাহর রাসূল; তিন কারণের কোন একটা ব্যতীত তার রক্ত হালাল নয়: জানের বদলায় জান, বিবাহিত যিনাকার এবং মুসলমানদের জামাআত পরিত্যাগকারী দ্বীনত্যাগী (মুরতাদ)।” (সহীহ বুখারী: হাদিস নং ৬৪৮৪ , সহীহ মুসলিম: হাদিস নং ৪৪৬৮)
ইসলামে রজমের বিধান শুরু হয় ইয়াহুদিদের দিয়ে। দুই ইয়াহুদি নারী-পুরুষ যিনা করে। ইয়াহুদিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিচার নিয়ে আসে। তিনি তাদের উভয়কে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করেন এবং বলেন,
اللهم إني أول من أحيا أمرك إذا أماتوه
“হে আল্লাহ! তারা যখন তোমাদের আদেশ মিটিয়ে দিয়েছে, তখন সর্ব প্রথম আমি তা যিন্দা করলাম।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হুদুদ, বাবু রজমিল ইয়াহুদ; সহীহ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, বাবুররজমি ফিল বালাত্ব।)মায়িয আলআসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনা করে ফেলেন। তিনি তাওবা করে লজ্জিত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিজ অপরাধ স্বীকার করে হদ কায়েম করতে বলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তিনি বার বার হদ কায়েমের জন্য আবেদন করতে থাকেন। এভাবে চার বার করার পর তিনি রজমের আদেশ দেন। ফলে তাকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হয়। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, বাব: আর-রজমু বিল মুসাল্লা; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হুদুদ, বাব: মানি’তারাফা আলা নাফসিহি বিয-যিনা।)
জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা যিনা করে ফেলেন। তিনি তাওবা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে হদ কায়েমের আবেদন জানান। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মায়িয আলআসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো তাকেও রজম করে হত্যা করেন। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হুদুদ, বাব: মানি’তারাফা আলা নাফসিহি বিয-যিনা।)
এক লোক এক বাড়িতে কর্মচারি ছিল। সে বাড়ির মালিকের স্ত্রীর সাথে যিনা করে ফেলে। তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপর হদ কায়েম করেন। কর্মচারি লোকটি অবিবাহিত ছিল তাই তাকে একশো বেত্রাঘাত করেন এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন দেন। আর মালিকের স্ত্রী বিবাহিত হওয়ায় তাকে রজম করে হত্যা করেন। (সহীহ বুখারী, কিতাবুশ শুরূত, বাবুশ শুরূতিল্লাতি লা তাহিল্লু ফিলহুদুদ; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হুদুদ, বাব: মানি’তারাফা আলা নাফসিহি বিয-যিনা।)
উল্লেখ্য যে, হানাফি মাযহাব মতে উক্ত নির্বাসন হদ হিসেবে নয়, সিয়াসত হিসেবে। ইমামুল মুসলিমিন যদি কাউকে নির্বাসন দেয়া উচিৎ মনে করেন তাহলে দিতে পারেন। অন্যথায় নির্বাসন দেয়া জরুরী নয়। আর যদি নির্বাসন দিতে গেলে উক্ত লোক মুরতাদ হয়ে যাওয়ার বা গোমরাহ হয়ে যাওয়ার বা অন্যদের ক্ষতি করার সম্ভাবনা থাকে কিংবা অন্য কোন অনিষ্টের সম্ভাবনা থাকে তাহলে নির্বাসন দেয়া উচিৎ হবে না। (দেখুন : শরহু মুখতাসারিত ত্বহাবি, ৬/১৬২-১৬৩; বাদায়িউস সানায়ি’: ৫/৪৯৬)
২. ডাকাত ও রাহজান
প্রধানত ডাকাত ও রাহজান বলতে সেসব লোককে বুঝায়, যারা চলন্ত রাস্তার আশেপাশে লুকিয়ে থাকে। রাস্তা দিয়ে চলাচলরত পথিকদের উপর হামলা করে তাদের মাল লুণ্টন করে। মালের স্বার্থে প্রয়োজনে তাদের জখম বা হত্যা করে। ফিকহের পরিভাষায় ডাকাত বলতে সাধরণ এদেরকেই বুঝানো হয়। তবে আইম্মায়ে কেরাম ঐসব লোককেও ডাকাত ও রাহজানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যারা কোন প্রকার তাবীল ব্যতীত শুধুই অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে ইমামুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফাসেক, জালেম বা মুরতাদ শাসক অপসারণ করে যোগ্য ইমাম নিয়োগ দেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়, অর্থ-সম্পদ আর নেতৃত্ব-ক্ষমতাই তাদের উদ্দেশ্য।
তবে সব ধরণের ডাকাতকে হত্যা করা হবে না। ডাকাতি ও রাহজানির শাস্তি অপরাধের মাত্রা হিসেবে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
- যদি রাহাজানি করতে গিয়ে কাউকে হত্যা করে, তাহলে হদস্বরূপ তাকেও হত্যা করা হবে।
- যদি হত্যার পাশাপাশি মালও লুণ্টন করে, তাহলে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে কিংবা হত্যা করে তিন দিন পর্যন্ত শূলে লটকিয়ে রাখা হবে।
- যদি হত্যা না করে, শুধু মাল লুণ্টন করে: তাহলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেয়া হবে (অর্থাৎ ডান হাত ও বাম পা)।
- আর যদি হত্যাও না করে, মালও লুণ্টন না করে বরং এর আগেই ধরা পড়ে যায়, তাহলে পাকড়াও করে প্রথমত প্রহার করা হবে অতঃপর জেলে বন্দী করে রাখা হবে। যখন তাওবা করে ভাল হয়ে যাবে এবং চেহারা ও চাল-চলনে তাওবার সুস্পষ্ট আলামত প্রকাশ পাবে, তখন ছাড়া হবে। অন্যথায় মৃত্যু পর্যন্তই জেলে বন্দী করে রাখা হবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ}
“যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং যমিনে ফাসাদ-বিশৃংখলা সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে- তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে ওদের নির্বাসিত করা হবে। এটা দুনিয়াতে ওদের লাঞ্চনা, আর আখেরাতে ওদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” (মায়েদা: ৩৩)বি.দ্র.
একাধিক ব্যক্তি বা এক দল মিলে রাহাজানি করলে সবার উপরই সমান শাস্তি বর্তাবে। যেমন, কেউ লুণ্টন ও হত্যা করেছে আর কেউ পাহারা দিয়েছে- তাহলে হদরূপে সকলকেই হত্যা করা হবে। হত্যাকারীদেরকেও হত্যা করা হবে, পাহারাদারদেরকেও হত্যা করেছে। কারণ, হত্যাকারীরা মূলত পাহারাদারদের পাহারার কারণেই হত্যা করতে সমর্থ্য হয়েছে। কাজেই, হত্যায় সকলেই অংশীদার। সকলের উপরই হত্যার বিধান আরোপ হবে।
ডাকাত ও রাহজানদের এ শাস্তিগুলো হদের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই কেউ তা মাফ করতে পারবে না। কেননা, হদ আল্লাহর হক। কেউ তা মাফ করার অধিকার রাখে না। তবে এরা যদি পাকড়াও হওয়ার পূর্বেই তাওবা করে নেয় এবং স্বেচ্ছায় ইমামুল মুসলিমীনের কাছে এসে ধরা দেয়, তাহলে আল্লাহর হক তথা হদ মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ}
“তবে তোমরা তাদের পাকড়াও করার পূর্বেই যারা তাওবা করে নেবে, তাদের বিষয়টা ব্যতিক্রম। এরূপ ক্ষেত্রে জেনে রেখ, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (মায়েদা: ৩৪)আল্লাহর হক মাফ হয়ে গেলেও বান্দার হক তাদের উপর বর্তাবে। তখন বান্দার হক হিসেবে লুণ্টিত মাল ফেরত দিতে হবে। কাউকে জখম বা কোন অঙ্গ নষ্ট করে থাকলে তার বদলা নেয়া হবে। কাউকে হত্যা করে থাকলে কেসাস নেয়া হবে।
এ দু’টি অপরাধ হদ হওয়ার ব্যাপারে আইম্মায়ে কেরামের দ্বিমত নেই। আরোও কয়েকটি অপরাধ রয়েছে, যেগুলো হদ হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে:
৩. সমকামীতা।
৪. নামায তরক করা।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি করা।
Comment