মুসলমানদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছেঃ প্রসঙ্গ শ্রীলঙ্কা
রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয় উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা দু–দুবার প্রেসিডেন্ট পদে ছিল। গোতাবায়া নিজে তখন মাহিন্দা সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিল। দুই ভাই-ই কট্টর সিংহলি জাতীয়তাবাদ এবং বিরুদ্ধমতের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক আচরণের নীতিতে বিশ্বাসী। তাঁরা কঠোরভাবে তামিলদের দমন করেছে। গোতাবায়া নির্বাচনের প্রচারণার সময় কথিত ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। ফলে মনে করা যেতে পারে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে অজানা আশঙ্কা তৈরি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। মোট জনগণের ১০ শতাংশ নাগরিক এই মুসলমানরা সেখানে এখন নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। গোতাবায়া ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও সেই ভোটের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ভোট নেই বললেই চলে।
শ্রীলঙ্কায় বরাবরই মুসলমানদের ‘কিং মেকার’ হিসেবে দেখে আসা হয়েছে। তাদের সমর্থনের ওপর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল অনেকাংশে নির্ভর করত। কিন্তু এবার সে চিত্র বদলে গেছে। ২০১৫ সালে মুসলমানরা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তামিল ও সিংহলিদের জোটে যোগ দিয়েছিলেন এবং মাহিন্দা হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর নির্বাচনে তারা সে ধরনের কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এবং নতুন মন্ত্রিসভায় (আগামী জানুয়ারিতে যাঁরা শপথ নেবেন) তাদের একজন প্রতিনিধিও নেই। কিন্তু মন্ত্রিসভায় তাদের কোনো প্রতিনিধি না থাকাই বর্তমান আতঙ্কের একমাত্র কারণ নয়।
টানা ১০ বছর ধরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এবং অত্যন্ত নির্মমভাবে তামিল বিদ্রোহীদের দমন করার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোতাবায়ার প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল জাতীয় নিরাপত্তা দেওয়া, বিশেষ করে ‘মুসলিম উগ্রবাদ’ দমন করা। এ কারণে মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, গোতাবায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলমানদের দমনপীড়নের যে অভিযোগ উঠেছিল, সে অবস্থা আবার ফিরে আসতে পারে।
গত ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় বোমা হামলায় আড়াই শর বেশি মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনার ওপর ভর করেই গোতাবায়া তাঁর নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে। এরপরই সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধরা মুসলমানদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক প্রচার চালাতে শুরু করে। নির্বাচনের আগে সেই প্রচার তুঙ্গে ওঠে। কুরুনেগালা, কুলিয়াপিটিয়া, মিনুয়ানগোড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় তাদের হামলায় মুসলমানরা হতাহত হয়। ৩০টির বেশি মসজিদ-মাদ্রাসা, ৫০টির মতো মুসলমানের মালিকানাধীন দোকান ও শতাধিক বাড়িঘরে সিংহলি বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। বেনেরাবল রত্নাহিমি এবং গালাবোড়া গানাসারার মতো নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরু ওই সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে জনতাকে খেপিয়ে তুলতে উসকানি দিয়েছে। তাঁরা মুসলমানদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছে এবং এই প্রচারের পুরো সুফল পেয়েছে গোতাবায়া। সে নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে এবং ভোটাররা সেই আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে তাঁকে ভোট দিয়েছে।
এই চাপা উত্তেজনা ও আতঙ্ক আসলে আজকের নয়। এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বহু আগে শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য করতে আসা মুসলমানরা ব্যবসা–বাণিজ্যে এগিয়ে থাকার কারণে সিংহলিরা তাদের ঈর্ষার চোখে দেখে। এই ঈর্ষা থেকে তাদের মধ্যে প্রথম থেকেই শত্রুতামূলক মনোভাব রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ইস্টার সানডে হামলার আগেই বহুবার সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। সিংহলিরা সংখ্যাগুরু হওয়ার পরও তাদের মধ্যে এ ধরনের ভীতি আছে। তামিলরা চরমভাবে কোণঠাসা হলেও সিংহলিরা মনে করে, যেহেতু প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৭ কোটি তামিল আছে এবং মুসলমানদের সঙ্গে তামিলদের সম্পর্ক ভালো, সেহেতু তামিলদের সঙ্গে মুসলমানদের এককাট্টা হওয়া তাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিতে পারে। এ কারণেও মুসলমানদের প্রতি তারা সহিংস মনোভাব রাখে। সিংহলিদের এ মনোভাবকে অনেক রাজনৈতিক নেতাই কাজে লাগাতে চায়।
২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিত করতে মাহিন্দা রক্তক্ষয়ী অভিযান চালান এবং এরপর প্রতিরক্ষা খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বাড়ায়। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় এবং মাহিন্দা সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ওই সময় মাহিন্দা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে একমাত্র উপায় ছিল উগ্র বৌদ্ধ গ্রুপ বদু বালা সেনা এবং রাবণ বলয়ের মতো সংগঠন। মুসলমানদের শত্রু হিসেবে দেখা এই সংগঠনগুলো মাহিন্দার পাশে দাঁড়ায় এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে ন্যায্যতা দিতে তারা প্রচার চালায়। ফলে তাদের কাছে রাজাপক্ষেদের ঋণ রয়ে গেছে। এবার মুসলমানদের দমনপীড়ন করে তাঁরা সেই ঋণ শোধ করবেন কি না, সেটাই সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রধান চিন্তার বিষয়।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: https://alfirdaws.org/2019/11/24/28928/
রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয় উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা দু–দুবার প্রেসিডেন্ট পদে ছিল। গোতাবায়া নিজে তখন মাহিন্দা সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিল। দুই ভাই-ই কট্টর সিংহলি জাতীয়তাবাদ এবং বিরুদ্ধমতের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক আচরণের নীতিতে বিশ্বাসী। তাঁরা কঠোরভাবে তামিলদের দমন করেছে। গোতাবায়া নির্বাচনের প্রচারণার সময় কথিত ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। ফলে মনে করা যেতে পারে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে অজানা আশঙ্কা তৈরি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। মোট জনগণের ১০ শতাংশ নাগরিক এই মুসলমানরা সেখানে এখন নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। গোতাবায়া ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও সেই ভোটের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ভোট নেই বললেই চলে।
শ্রীলঙ্কায় বরাবরই মুসলমানদের ‘কিং মেকার’ হিসেবে দেখে আসা হয়েছে। তাদের সমর্থনের ওপর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল অনেকাংশে নির্ভর করত। কিন্তু এবার সে চিত্র বদলে গেছে। ২০১৫ সালে মুসলমানরা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তামিল ও সিংহলিদের জোটে যোগ দিয়েছিলেন এবং মাহিন্দা হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর নির্বাচনে তারা সে ধরনের কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এবং নতুন মন্ত্রিসভায় (আগামী জানুয়ারিতে যাঁরা শপথ নেবেন) তাদের একজন প্রতিনিধিও নেই। কিন্তু মন্ত্রিসভায় তাদের কোনো প্রতিনিধি না থাকাই বর্তমান আতঙ্কের একমাত্র কারণ নয়।
টানা ১০ বছর ধরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এবং অত্যন্ত নির্মমভাবে তামিল বিদ্রোহীদের দমন করার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোতাবায়ার প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল জাতীয় নিরাপত্তা দেওয়া, বিশেষ করে ‘মুসলিম উগ্রবাদ’ দমন করা। এ কারণে মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, গোতাবায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলমানদের দমনপীড়নের যে অভিযোগ উঠেছিল, সে অবস্থা আবার ফিরে আসতে পারে।
গত ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় বোমা হামলায় আড়াই শর বেশি মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনার ওপর ভর করেই গোতাবায়া তাঁর নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে। এরপরই সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধরা মুসলমানদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক প্রচার চালাতে শুরু করে। নির্বাচনের আগে সেই প্রচার তুঙ্গে ওঠে। কুরুনেগালা, কুলিয়াপিটিয়া, মিনুয়ানগোড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় তাদের হামলায় মুসলমানরা হতাহত হয়। ৩০টির বেশি মসজিদ-মাদ্রাসা, ৫০টির মতো মুসলমানের মালিকানাধীন দোকান ও শতাধিক বাড়িঘরে সিংহলি বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। বেনেরাবল রত্নাহিমি এবং গালাবোড়া গানাসারার মতো নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরু ওই সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে জনতাকে খেপিয়ে তুলতে উসকানি দিয়েছে। তাঁরা মুসলমানদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছে এবং এই প্রচারের পুরো সুফল পেয়েছে গোতাবায়া। সে নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে এবং ভোটাররা সেই আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে তাঁকে ভোট দিয়েছে।
এই চাপা উত্তেজনা ও আতঙ্ক আসলে আজকের নয়। এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বহু আগে শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য করতে আসা মুসলমানরা ব্যবসা–বাণিজ্যে এগিয়ে থাকার কারণে সিংহলিরা তাদের ঈর্ষার চোখে দেখে। এই ঈর্ষা থেকে তাদের মধ্যে প্রথম থেকেই শত্রুতামূলক মনোভাব রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ইস্টার সানডে হামলার আগেই বহুবার সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। সিংহলিরা সংখ্যাগুরু হওয়ার পরও তাদের মধ্যে এ ধরনের ভীতি আছে। তামিলরা চরমভাবে কোণঠাসা হলেও সিংহলিরা মনে করে, যেহেতু প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৭ কোটি তামিল আছে এবং মুসলমানদের সঙ্গে তামিলদের সম্পর্ক ভালো, সেহেতু তামিলদের সঙ্গে মুসলমানদের এককাট্টা হওয়া তাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিতে পারে। এ কারণেও মুসলমানদের প্রতি তারা সহিংস মনোভাব রাখে। সিংহলিদের এ মনোভাবকে অনেক রাজনৈতিক নেতাই কাজে লাগাতে চায়।
২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিত করতে মাহিন্দা রক্তক্ষয়ী অভিযান চালান এবং এরপর প্রতিরক্ষা খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বাড়ায়। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় এবং মাহিন্দা সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ওই সময় মাহিন্দা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে একমাত্র উপায় ছিল উগ্র বৌদ্ধ গ্রুপ বদু বালা সেনা এবং রাবণ বলয়ের মতো সংগঠন। মুসলমানদের শত্রু হিসেবে দেখা এই সংগঠনগুলো মাহিন্দার পাশে দাঁড়ায় এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে ন্যায্যতা দিতে তারা প্রচার চালায়। ফলে তাদের কাছে রাজাপক্ষেদের ঋণ রয়ে গেছে। এবার মুসলমানদের দমনপীড়ন করে তাঁরা সেই ঋণ শোধ করবেন কি না, সেটাই সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রধান চিন্তার বিষয়।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: https://alfirdaws.org/2019/11/24/28928/
Comment