১৯৯২ সালের অযোধ্যা থেকে ২০২০ সালের দিল্লি: সন্ত্রাসী দল বিজেপি’র মূল টার্গেট মসজিদ
ফেব্রুয়ারির শেষ তিন দিন। নয়া দিল্লির উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম বাসিন্দাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও হিন্দু সংখ্যাগুরু আদর্শের সমর্থকরা। ৫৩ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগ মুসলমান, আহত হয় তিনশ’র ওপরে। এই গণহত্যা নিয়ে শত শত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সংবাদ মাধ্যমে। এগুলোতে দেখা যায় মহাসড়ক থেকে শুরু করে ঘিঞ্জি গলি পর্যন্ত শত শত মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাছাই করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে।
১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞের একটি সুষ্পষ্ট রূপ ফুটে উঠেছে। সেসব এলাকায় মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম, সেখানে হামলা হয়েছে সবচেয়ে নারকীয়। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্মী যারা নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসে তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলিমদের সহায়-সম্পত্তির হদিস হামলাকারীদের কাছে সরবরাহ করেছে, এটা স্পষ্ট।
তবে এই ঘটনায় আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, যেসব মহল্লা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার মসজিদগুলো ছিলো হামলাকারীদের বিশেষ টার্গেট। ৪৮ ঘন্টার সহিংসতায় অন্তত ১৪টি মসজিদ ও একটি সুফি দরগাহ আংশিক বা পুরোপুরি তছনছ বা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু মসজিদ মুসলিম বসতির এতটাই গভীরে অবস্থিত যে স্থানীয় কেউ দেখিয়ে না দিলে সেগুলো সহজে খুঁজে বের করা যেতো না। বড়-ছোট কোন মসজিদই রেহাই পায়নি। অথচ পুরো এলাকায় একটি হিন্দু মন্দিরের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি।
যেন ভূমিকম্প
হামলার শিকার সবচেয়ে বড় মসজিদটি হলো গোকালপুরির জান্নাতি মসজিদ। এলাকাটি প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক এলাকা। তিন তলা মসজিদটি ১৯৭০’র দশকে তৈরি এবং দৃষ্টিনন্দন আরবী ক্যালিগ্রাফির কারুকার্য খচিত। মসজিদের আশেপাশে হিন্দুদের বসতি বেশি। তারা বলেছেন মধ্যরাতে মসজিদের উপর যখন হামলা শুরু হয় তাদের মনে হয়েছিলো যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। তারা মসজিদ থেকে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়তে দেখেন। জেলার দরিদ্রতম এলাকা মিলান গার্ডেনের মদিনা মসজিদে প্রকাশ্য দিনের বেলা হামলা করে ২০ জনের মতো গেরুয়া সন্ত্রাসীদের একটি দল।
মসজিদ ও মুসল্লিরা একেবারে শুরু থেকেই সন্ত্রাসী দল বিজেপি ও তাদের আদর্শিক মিত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর টার্গেট।
মধ্যযুগে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে বিজেপি দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক প্রচারণা চালায় সেটাই তাদেরকে ক্ষমতার শীর্ষে যেতে সহায়তা করে। বিজেপির দাবি তীর্থ নগরী অযোধ্যার এই মসজিদ হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থানের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে মন্দির নির্মাণের দাবি করে তারা। তার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তারা মসজিদটি গুড়িয়ে দেয়। ওই ঘটনা ছিলো জাতি হিসেবে ভারতীয়দের জীবনের উপর একটি কালো ছায়াপাত। ওই ঘটনার জেরে শত শত মানুষ মারা যায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি তার আসন সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়, ৮৫ থেকে ১৬১।
২০০২ সালে কসাই নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা বাঁধায় মসজিদের জায়গায় হিন্দু মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে। সেখানেও হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। সেখানেও দিল্লির মতো বেছে বেছে মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়। সেখানে প্রায় ৫০০ মসজিদ ও দরগাহ ধ্বংস করা হয়। আহমেদাবাদে মধ্যযুগে নির্মিত সবেচেয়ে বিশিষ্ট জায়গায় অবস্থিত অত্যন্ত সম্মানিত হিসেবে গণ্য একটি দরগাহ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। দরগাহ ধ্বংসের পর মাত্র ৩৬ ঘন্টার মধ্যে তার উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়। ২০০২ সালের শেষ দিকে রাজ্যের নির্বাচনে মোদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতা ফিরেন এবং বিজেপি প্রমাণ করে মুসলিম-বিরোধী রাজনৈতিক সহিংসতা তাদেরকে সুবিধা করে দেয়।
২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভিজিল্যান্ট আর্মিতে পরিণত হয় আরএসএস। এই সংগঠনের সঙ্গে মোদি সরকারের অনেকে সরাসরি জড়িত। আরএসএস জাতীয় রাজধানীর বিভিন্ন অংশের মসজিদ ও জুমার নামাজকে টার্গেট করে। তারা মসজিদের মাইকে আযান দেয়া নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে মামলা করে। জুমার নামাজে বার বার বাধা দেয়। অসংখ্যবার মসজিদের বাইরে হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দিয়ে, পটকা ফাটিয়ে নানা ধরনের উষ্কানীমূলক কর্মকাণ্ড চালায়।
গত বছর সুপ্রিম কোর্ট রায়ে, বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সেখানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। আদালতের রায় বিজেপির গোড়া সমর্থকদের আরো চাঙ্গা করে তুলেছে। মসজিদ ভেঙ্গে সেই জায়গায় মন্দির নির্মাণকে যারা সমর্থন করেন তাদের খুশি করে এই রায়।
এরপরও ভারতের মুসলিমরা আদালতের রায় মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছিল।
মনোভাব বুঝতে ভুল
আদালতের রায়ের পর মুসলমানদের মনোভাব বুঝতে বিজেপি ভুল করে বলে মনে হচ্ছে। এর এক মাস পর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাগরিকত্ব সংশোধিনী আইন (সিএএ) পাস করে, যা মুসলমানদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক। এই নতুন আইনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ শুরু হয়। নয়া দিল্লিতে ছাত্র বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করা হয় বর্বর হস্তে। এর জের ধরে সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়, প্রতিবাদের নতুন আইকনিক ধরন শাহিন বাগের অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। ৯০ দিনের বেশি সময় ধরে সেখানে সব বয়সী মুসলিম নারী ভারতীয় সংবিধান নিয়ে বসে আছে। তারা সংবিধানের সব নাগরিকের সমান অধিকারের দাবি করছে। দাবি করছে চিন্তার স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার।
বিজেপি ও মোদি সরকার এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যা দেয়। বিক্ষোভকারীদের সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করে। দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে বিজেপি’র প্রচারণা মূল লক্ষ্য হয় বিক্ষোভকারীদের প্রতি বিষোদগার। জুনিয়র ইউনিয়ন মন্ত্রী ‘গুলি মারো গাদ্দারো কো’ বলে বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারার হুমকি দেন। মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লির ভোটারদের প্রতি শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীদের তাড়াতে তার দলকে ভোট দিতে বলেন।
কিন্তু নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি ঘটে।
দিল্লিতে হামলার ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিজেপি প্রার্থী কপিল মিশ্র পুলিশকে অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে বলেন। তা নাহলে তার সমর্থকরা হামলা করে তাদের সরিয়ে দেবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন। তখন মন্দির ও মূর্তি ভাঙ্গার মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়। মুসলমানদের উপর যখন নৃশংস হামলা চলে তখন পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে, কোথাও কোথাও হামলাকারীদের সহায়তা করে। দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণে।
নয়া দিল্লির মোস্তফাবাদে একটি মসজিদের মিনারে হিন্দুত্ববাদিদের পতাকা ওড়ানো হয়েছে
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী ও ক্ষুব্ধ তরুণদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সুযোগে হিন্দুত্ববাদী শক্তি পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সহিংসতা চালায়। পুড়িয়ে দেয়া মসজিদ থেকে যখন ধুঁয়া উড়ছিলো তখনো হিন্দুত্ববাদী তরুণদের সেখানে গিয়ে মন্দির ও হনুমানের পতাকা ওড়াতে দেখা গেছে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগে এর গম্বুজে উঠে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের উল্লাস
উত্তর দিল্লির মসজিদগুলো আধুনিক সুশোভিত ভবন। মধ্যযুগের মসজিদের মতো এগুলোর গম্বুজ নেই। ফলে বাবরি মসজিদের উপর উঠে হাঁতুড়ি-শাবল নিয়ে গম্বুজ ভাঙ্গার দৃশ্য এখনকার দিল্লিবাসী হয়তো দেখেননি। কিন্তু তারা যা দেখেছেন সেটা শুধু মসজিদেরই ধ্বংস ছিলো না, পুরো ভারতের ধ্বংস তারা দেখেছেন। তারা এমন এক ভারতকে গুড়িয়ে যেতে দেখেছেন যেখানে সবার চিন্তার স্বাধীনতা রয়েছে।
সূত্র: https://alfirdaws.org/2020/03/21/34766/
ফেব্রুয়ারির শেষ তিন দিন। নয়া দিল্লির উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম বাসিন্দাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও হিন্দু সংখ্যাগুরু আদর্শের সমর্থকরা। ৫৩ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগ মুসলমান, আহত হয় তিনশ’র ওপরে। এই গণহত্যা নিয়ে শত শত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সংবাদ মাধ্যমে। এগুলোতে দেখা যায় মহাসড়ক থেকে শুরু করে ঘিঞ্জি গলি পর্যন্ত শত শত মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাছাই করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে।
১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞের একটি সুষ্পষ্ট রূপ ফুটে উঠেছে। সেসব এলাকায় মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম, সেখানে হামলা হয়েছে সবচেয়ে নারকীয়। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্মী যারা নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসে তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলিমদের সহায়-সম্পত্তির হদিস হামলাকারীদের কাছে সরবরাহ করেছে, এটা স্পষ্ট।
তবে এই ঘটনায় আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, যেসব মহল্লা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার মসজিদগুলো ছিলো হামলাকারীদের বিশেষ টার্গেট। ৪৮ ঘন্টার সহিংসতায় অন্তত ১৪টি মসজিদ ও একটি সুফি দরগাহ আংশিক বা পুরোপুরি তছনছ বা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু মসজিদ মুসলিম বসতির এতটাই গভীরে অবস্থিত যে স্থানীয় কেউ দেখিয়ে না দিলে সেগুলো সহজে খুঁজে বের করা যেতো না। বড়-ছোট কোন মসজিদই রেহাই পায়নি। অথচ পুরো এলাকায় একটি হিন্দু মন্দিরের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি।
যেন ভূমিকম্প
হামলার শিকার সবচেয়ে বড় মসজিদটি হলো গোকালপুরির জান্নাতি মসজিদ। এলাকাটি প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক এলাকা। তিন তলা মসজিদটি ১৯৭০’র দশকে তৈরি এবং দৃষ্টিনন্দন আরবী ক্যালিগ্রাফির কারুকার্য খচিত। মসজিদের আশেপাশে হিন্দুদের বসতি বেশি। তারা বলেছেন মধ্যরাতে মসজিদের উপর যখন হামলা শুরু হয় তাদের মনে হয়েছিলো যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। তারা মসজিদ থেকে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়তে দেখেন। জেলার দরিদ্রতম এলাকা মিলান গার্ডেনের মদিনা মসজিদে প্রকাশ্য দিনের বেলা হামলা করে ২০ জনের মতো গেরুয়া সন্ত্রাসীদের একটি দল।
মসজিদ ও মুসল্লিরা একেবারে শুরু থেকেই সন্ত্রাসী দল বিজেপি ও তাদের আদর্শিক মিত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর টার্গেট।
মধ্যযুগে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে বিজেপি দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক প্রচারণা চালায় সেটাই তাদেরকে ক্ষমতার শীর্ষে যেতে সহায়তা করে। বিজেপির দাবি তীর্থ নগরী অযোধ্যার এই মসজিদ হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থানের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে মন্দির নির্মাণের দাবি করে তারা। তার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তারা মসজিদটি গুড়িয়ে দেয়। ওই ঘটনা ছিলো জাতি হিসেবে ভারতীয়দের জীবনের উপর একটি কালো ছায়াপাত। ওই ঘটনার জেরে শত শত মানুষ মারা যায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি তার আসন সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়, ৮৫ থেকে ১৬১।
২০০২ সালে কসাই নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা বাঁধায় মসজিদের জায়গায় হিন্দু মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে। সেখানেও হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। সেখানেও দিল্লির মতো বেছে বেছে মুসলিম বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়। সেখানে প্রায় ৫০০ মসজিদ ও দরগাহ ধ্বংস করা হয়। আহমেদাবাদে মধ্যযুগে নির্মিত সবেচেয়ে বিশিষ্ট জায়গায় অবস্থিত অত্যন্ত সম্মানিত হিসেবে গণ্য একটি দরগাহ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। দরগাহ ধ্বংসের পর মাত্র ৩৬ ঘন্টার মধ্যে তার উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়। ২০০২ সালের শেষ দিকে রাজ্যের নির্বাচনে মোদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতা ফিরেন এবং বিজেপি প্রমাণ করে মুসলিম-বিরোধী রাজনৈতিক সহিংসতা তাদেরকে সুবিধা করে দেয়।
২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভিজিল্যান্ট আর্মিতে পরিণত হয় আরএসএস। এই সংগঠনের সঙ্গে মোদি সরকারের অনেকে সরাসরি জড়িত। আরএসএস জাতীয় রাজধানীর বিভিন্ন অংশের মসজিদ ও জুমার নামাজকে টার্গেট করে। তারা মসজিদের মাইকে আযান দেয়া নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে মামলা করে। জুমার নামাজে বার বার বাধা দেয়। অসংখ্যবার মসজিদের বাইরে হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দিয়ে, পটকা ফাটিয়ে নানা ধরনের উষ্কানীমূলক কর্মকাণ্ড চালায়।
গত বছর সুপ্রিম কোর্ট রায়ে, বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সেখানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। আদালতের রায় বিজেপির গোড়া সমর্থকদের আরো চাঙ্গা করে তুলেছে। মসজিদ ভেঙ্গে সেই জায়গায় মন্দির নির্মাণকে যারা সমর্থন করেন তাদের খুশি করে এই রায়।
এরপরও ভারতের মুসলিমরা আদালতের রায় মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছিল।
মনোভাব বুঝতে ভুল
আদালতের রায়ের পর মুসলমানদের মনোভাব বুঝতে বিজেপি ভুল করে বলে মনে হচ্ছে। এর এক মাস পর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাগরিকত্ব সংশোধিনী আইন (সিএএ) পাস করে, যা মুসলমানদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক। এই নতুন আইনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ শুরু হয়। নয়া দিল্লিতে ছাত্র বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করা হয় বর্বর হস্তে। এর জের ধরে সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়, প্রতিবাদের নতুন আইকনিক ধরন শাহিন বাগের অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। ৯০ দিনের বেশি সময় ধরে সেখানে সব বয়সী মুসলিম নারী ভারতীয় সংবিধান নিয়ে বসে আছে। তারা সংবিধানের সব নাগরিকের সমান অধিকারের দাবি করছে। দাবি করছে চিন্তার স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার।
বিজেপি ও মোদি সরকার এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যা দেয়। বিক্ষোভকারীদের সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করে। দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে বিজেপি’র প্রচারণা মূল লক্ষ্য হয় বিক্ষোভকারীদের প্রতি বিষোদগার। জুনিয়র ইউনিয়ন মন্ত্রী ‘গুলি মারো গাদ্দারো কো’ বলে বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারার হুমকি দেন। মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লির ভোটারদের প্রতি শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীদের তাড়াতে তার দলকে ভোট দিতে বলেন।
কিন্তু নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি ঘটে।
দিল্লিতে হামলার ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিজেপি প্রার্থী কপিল মিশ্র পুলিশকে অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে বলেন। তা নাহলে তার সমর্থকরা হামলা করে তাদের সরিয়ে দেবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন। তখন মন্দির ও মূর্তি ভাঙ্গার মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়। মুসলমানদের উপর যখন নৃশংস হামলা চলে তখন পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে, কোথাও কোথাও হামলাকারীদের সহায়তা করে। দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণে।
নয়া দিল্লির মোস্তফাবাদে একটি মসজিদের মিনারে হিন্দুত্ববাদিদের পতাকা ওড়ানো হয়েছে
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী ও ক্ষুব্ধ তরুণদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সুযোগে হিন্দুত্ববাদী শক্তি পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সহিংসতা চালায়। পুড়িয়ে দেয়া মসজিদ থেকে যখন ধুঁয়া উড়ছিলো তখনো হিন্দুত্ববাদী তরুণদের সেখানে গিয়ে মন্দির ও হনুমানের পতাকা ওড়াতে দেখা গেছে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগে এর গম্বুজে উঠে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের উল্লাস
উত্তর দিল্লির মসজিদগুলো আধুনিক সুশোভিত ভবন। মধ্যযুগের মসজিদের মতো এগুলোর গম্বুজ নেই। ফলে বাবরি মসজিদের উপর উঠে হাঁতুড়ি-শাবল নিয়ে গম্বুজ ভাঙ্গার দৃশ্য এখনকার দিল্লিবাসী হয়তো দেখেননি। কিন্তু তারা যা দেখেছেন সেটা শুধু মসজিদেরই ধ্বংস ছিলো না, পুরো ভারতের ধ্বংস তারা দেখেছেন। তারা এমন এক ভারতকে গুড়িয়ে যেতে দেখেছেন যেখানে সবার চিন্তার স্বাধীনতা রয়েছে।
সূত্র: https://alfirdaws.org/2020/03/21/34766/
Comment