অখন্ড ভারতঃ অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান!
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত এবং নিন্দিত শব্দগুচ্ছ “অখন্ড ভারত”। সেক্যুলার নামধারী ভারতের কিছু উগ্র কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের দাবি হচ্ছে ভারতবর্ষকে ‘অখন্ড ভারত’-এ পরিণত করা। অখন্ড ভারত গঠনের মাধ্যমে সারা ভারতবর্ষে রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হবে। তাদের এই দাবি নিছক দিবাস্বপ্ন বৈ আর কিছু নয়।- যা নিকট ভবিষ্যতে কেন, সুদূর ভবিষ্যতেও বাস্তবায়িত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অখন্ড ভারতের যেমন কোনো ভবিষ্যত নেই; তেমন, আদৌ কি তার কোন অতীত আছে? নাকি ভবিষ্যতের দিবাস্বপ্নের মত অতীতও কল্পনাপ্রসূত.!? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে ইতিহাসের অনেকগুলো পাতা উল্টাতে হবে। ব্রিটিশ মোগলদের পিছে ফেলে আরো অনেক অনেক পিছনে ফিরে দেখতে হবে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যই সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে একটি নির্দিষ্ট শাসনের অধীনে আনতে পারেনি। মৌর্য সাম্রাজ্য, মোঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ সাম্রাজ্য – কোন সাম্রাজ্যই সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করতে সক্ষম হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভারতবর্ষ জয়ের অনেক কাছাকাছি গিয়েছিলো চাণক্য নীতি অবলম্বন করে। প্রাচীণ ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধাণ অমাত্য কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামেই পরিচিত।
চাণক্যের সময়কাল আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগে। তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য এবং সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। চাণক্য বিশ্বাস করতো সমগ্র অঞ্চলটিকে একটি নির্দিষ্ট শাসন, প্রশাসন এবং কর্তৃত্বের অধীনে আনতে হবে। সে তার শিষ্য, মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মাধ্যমে তার স্বপ্নের পথে অনেক দূর এগিয়েও যায়। এরপর চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষকে পাঁচ দশকের জন্য তার করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়।
অখন্ড ভারতের অভিলাষ পূরণের জন্য সম্রাট অশোক একের পর স্বাধীন অঞ্চলগুলোতে আগ্রাসন চালায়। এমনই একটি আগ্রাসন হচ্ছে কলিঙ্গের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সম্রাট অশোক প্রায় এক লক্ষ কলিঙ্গ অধিবাসীদের হত্যা করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা সম্রাট অশোকের অন্তরকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। সে অখন্ড ভারতের স্বপ্ন এবং জীবনের সকল বিলাসিতা ছেড়ে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তারই প্রচেষ্টায় সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক ভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পর খুব দ্রুতই মৌর্য সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে।
চানক্যের একটি শিক্ষা ছিল, উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের জন্য – “ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেলো না। সব সীমান্তবর্তী রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে।” আজ, কয়েক হাজার বছর পরে এসে ঠিক সেই মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের পর যদি কোন ধর্ম ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে থাকে, তাহলে তা হচ্ছে ‘বৌদ্ধ ধর্ম’। হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম কখনোই ভারতবর্ষে এককভাবে প্রসারতা বা ব্যপকতা লাভ করতে পারেনি। তাই মৌর্য সাম্রাজ্যের অখন্ড ভারতের স্বপ্ন যদি বর্তমান হিন্দুত্ববাদীরা গ্রহণ করতে চায়; তাহলে ভারতবর্ষে হয় “ইসলামী রাজ্য” বা “গৌতম রাজ্য” প্রতিষ্ঠা লাভ করার কথা। কোনোভাবে অখন্ড ভারতে রাম রাজ্যে প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি।
মৌর্যদের অনেক পরে ভারতবর্ষেকে একত্র করার কাজ হাতে নেয় মোগল সাম্রাজ্য। কিন্তু তারাও ভারতবর্ষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়নি। কারণ ভারতের অধিকাংশ জনগণ মোগলদেরকে ভিনদেশী বলে মনে করত। তাই তারা তাদের থেকে পৃথক এবং স্বাধীন থাকাটাই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। তাছাড়া মুঘলদের শাসনটা ছিল মূলত উত্তর ভারত ও পাকিস্তান কেন্দ্রিক।
মুসলিম শাসনামলেও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাতে স্বাধীন সুলতানি শাসন ছিল। গুজরাটে, আসামে আলাদা মুসলিম রাজ্য ছিল।
মুসলমানদের আগমনের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশ নানা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল এবং আলাদা আলাদা রাজা দ্বারা শাসিত হত।
মহারাষ্ট্র স্বাধীন দেশ ছিল তারা বাংলাতে লুটপাট করতে আসত। সেই লুটপাটের কাহিনী নিয়ে একটি ছড়া আছে। “খোকা ঘুমালো পাড়া জোরালো বর্গী এলো দেশে।” এই বর্গী হলো অত্যাচারী হিন্দু ডাকাত সেনরা।
কেরালা-তামিল নাড়ু সবসময়ই স্বাধীন ছিল। তেমনি সর্বদা স্বাধীন রাজ্য ছিল মনিপুর ও মিজোরাম।
আর ব্রিটিশদের কথা বলতে গেলে, ব্রিটিশদের ক্ষেত্রেও এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ-
এক, বৃটিশ শাসককালেও গোয়া, পন্ডিচেরির মত কিছু কিছু অঞ্চল পর্তুগিজ, ফরাসিদের অধীনে ছিল।
দুই, সমগ্র ভারতবর্ষের অর্ধেক অংশই কমবেশি স্বায়ত্তশাসিত মহারাজদের অধীনে ছিল। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীরসহ অনেক স্বাধীন রাজ্যের উপস্থিতি ছিল। টিপু সুলতান দক্ষিন ভারত শাসন করেছেন।
তিন, আরেকটি বিষয় হলো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সরাসরি ভারতীয় সাম্রাজ্য না, এটা পরিচালিতও হতো ব্রিটেন থেকে। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকেও এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যায় না যে, তারা সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করেছিলো।
যদিও অনেক স্বাধীন রাজ্য তাদের ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তার জন্য ব্রিটিশ রাজের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি তারা ব্রিটিশ রাজকে বাৎসরিক খাজনা আদায় করতো। তারপরও এমন অনেক স্বাধীন রাজ্য ছিল যারা আকার আয়তনে ছোট হলেও ভৌগলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে টিকে থাকার উপযোগী ছিল। যেমনঃ হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর।
তবে ব্রিটিশদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের দিক দিয়ে বলতে গেলে তারা ছিলো পূর্বের সকল সাম্রাজ্যের চাইতে বেশি শক্তিশালী।
অখন্ড ভারতের স্লোগান হচ্ছে মূলত প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোকে গ্রাস করার স্লোগান। আর ভারতের যেসব অঞ্চল বা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তাদেরকে ধরে রাখার একটা কুটচাল। ঐতিহাসিকভাবে হাজার বছরের ইতিহাসে অখন্ড ভারত বলে কিছু নেই। ব্রিটিশদের অধীনস্ত ইন্ডিয়ার কথা বাদ দিলে অখন্ড ভারতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও অখন্ড ভারত বলে কিছু হবে না। ইনশাআল্লাহ।।
“অখন্ড ভারত” শব্দগুচ্ছটি আসলে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের একটি ধারণা ও বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, বর্তমান ভারতের দুই পাশে অবস্থিত দুই দেশ- পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক এবং কৃষ্টিগত দিক দিয়ে ভারতের সাথে মিল থাকায় এই সকল দেশকে ভারতের সাথে যোগ দিতে হবে। অখন্ড ভারতের ধারণায় বিশ্বাসীদের যুক্তি হল এসকল দেশ একসময় হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সুতরাং এই সকল অঞ্চল গুলোকে ভারতের সাথে যোগ দিতে হবে এবং এখানকার বাসিন্দাদের সনাতন ধর্মে ফেরত যেতে হবে।
এই অন্ধ-বিশ্বাসকে পুঁজি করেই অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো মুসলমানদের উপর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও মুসলমানরাও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মুসলিমরা এক আল্লাহর দাসত্ব করে, তারা কখনোই ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব মেনে নিবে না।
“শোষণের জন্যই শাসন” – এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ্যবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের মতবাদ হচ্ছে “শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে উপস্থাপন করতে হয়।”
এই শোষণের আদর্শের নামই ব্রাহ্মণ্যধর্ম। তাই ব্রাহ্মণ্যধর্ম কোন ধর্ম নয়, ব্রাহ্মণ্যধর্ম হল আসলে একটি অপরাধের নাম, মানুষকে শোষণের হাতিয়ারের নাম। মানুষে মানুষে বিভাজনের নাম। জাতপ্রথা বর্ণপ্রথা তৈরী করে মানুষকে শোষণের নাম। ব্রাহ্মণ্যবাদ উচ্চ ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করার নাম।
প্রশ্ন হলো যারা নিজের ধর্মের মানুষদেরকে জাতপ্রথা তৈরী করে শোষণ নির্যাতন অত্যাচার করে, তারা কিভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ এবং জৈন ধর্মের মানুষকে আপন মনে করে বুকে জড়িয়ে নিবে?
বর্তমান সময়ে ভারত বরবারই মতোই অখণ্ড ভারত কায়েম করতে ষড়যন্ত্র করেই চলছে । মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে।
নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে হিন্দুসংঘ ২০ হাজার স্কুলে ভূগোল বইয়ে ভারতের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয়। এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, “The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof.”
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে, ততদিন শান্তি আসবে না।
অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ত্রাস; ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (প্রতিচিন্তা:১০৮) এবং ২০০৬ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।
অখন্ড ভারত গঠন প্রক্রিয়া দুইটি আদর্শের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলছে।
এক, সাঙ্গাথান (হিন্দু ঐক্য)। অর্থাৎ, বাংলাদেশ-পাকিস্তানে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদেরকে একত্রিত করা বা তাদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় এবং আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে হিন্দুদের অবস্থান অখন্ড ভারত বিনির্মানে এই আদর্শের প্রয়োগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এবং দুই, শুদ্ধি (বিশুদ্ধিকরণ)। অর্থাৎ ক্ষমতা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম ব্যতীত বাকি সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে সনাতন ধর্ম অবলম্বন করতে বাধ্য করা। সারা ভারতে মুসলিমদের উপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী দেন আক্রমণ মূলত এই আদর্শকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। সামান্য গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মুসলমানদেরকে,- কারণ সনাতন ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। অথবা জয় শ্রীরাম না বলার অপরাধে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে নিরীহ মুসলিমদের।
‘অখন্ড ভারত’ ধারণা থেকেই একে একে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং নেপালের মাওবাদ, শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৯৭১ এর যুদ্ধ এই অখন্ড ভারত অভিলাষের দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনার ফল। এবং তার পর থেকে বাংলাদেশে অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইন্ডিয়ার অতি খবরদারিতা তার স্বরূপ উন্মোচন করছে সবার সামনে। বছর কয়েক আগে নেপালের তরাই অঞ্চলের গণভোট এবং এর পরবর্তী জ্বালানী অবরোধও এই অভিলাষের বাইরে নয়।
বর্তমানে চীন এবং ভারতের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং তালেবান মুজাহিদদের পুনরায় আগফগানিস্থানের ক্ষমতা দখল ভারতকে চাপে ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে যতটা সম্ভব সুসম্পর্ক বজায় রাখা। কিন্তু তা না করে মোদি প্রশাসন মুসলমানদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বৃদ্ধি করেছে। ভারত সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো মুসলিমদের উপর একের পর এক আক্রমণ জারি রেখেছে, যা সেক্যুলার নামধারী ভারতের ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করছে। পাশাপাশি সারা বিশ্বের বিশেষ করে মুসলিমদের অসন্তুষ্টিকে বৃদ্ধি করছে।
অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভারতীয় মুসলিমদের উপর। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাটের গণহত্যা বাদ দিলেও ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলিমদের দমনের জন্য তাদেরই প্রণিত “গণতান্ত্রিক সংবিধান” বিবর্জিত পথ অবলম্বন করছে। যেমন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। আসাম এবং পরবর্তীতে সারা ভারতে এনআরসি আইনের আওতায় মুসলিমদের দেশ ছাড়া করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মুসলিমদেরকে তাদের ভূমি, তাদের আবাসস্থল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য একের পর এক ভূমি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদী ভারতের “অখন্ড ভারত” নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ ভারতের অভ্যন্তরীণ মুসলিমদের পক্ষ থেকে আসাটা সময়ের দাবি। তারা যদি একবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, তাহলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো থেকে মুজাহিদীনরা তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন।
মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। হিন্দুদের দাসত্ব মেনে নেওয়া বা তাদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা সমান অর্থহীন। এগুলো বাদ দিয়ে তাই এখন সময় এসেছে পরিপূর্ণ ভাবে জিহাদের নববী মানহাযে ফিরে আসার। সময় এসেছে বিশুদ্ধ তাওহীদের শিক্ষা আত্মস্থ করার। ইসলামকে ঠিক সেভাবেই বুঝে পালন করার, যেভাবে বুঝেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম- কুরআনের প্রজন্ম- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। সব ফেলে এখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে যে, কিভাবে এই আগ্রসনের মোকাবেলা করা যায়।
এই সত্য জানতে ও বুঝতে হবে যে, এই আগ্রাসী শত্রুদের বিরুদ্ধে কারা আমাদের “ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স”। দিগন্তে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে আর মাটিকে গ্রাস করে নিচ্ছে মুশরিকদের আগ্রাসনের ছায়া।
” যে শত্রু আপনাকে ধ্বংস এবংং নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর তাকে থামাতে হবে, থামতে বাধ্য করতে হবে – যে কোন উপায়ে।”
প্রতিবেদক: আসাদ ইরফান
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত এবং নিন্দিত শব্দগুচ্ছ “অখন্ড ভারত”। সেক্যুলার নামধারী ভারতের কিছু উগ্র কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের দাবি হচ্ছে ভারতবর্ষকে ‘অখন্ড ভারত’-এ পরিণত করা। অখন্ড ভারত গঠনের মাধ্যমে সারা ভারতবর্ষে রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হবে। তাদের এই দাবি নিছক দিবাস্বপ্ন বৈ আর কিছু নয়।- যা নিকট ভবিষ্যতে কেন, সুদূর ভবিষ্যতেও বাস্তবায়িত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অখন্ড ভারতের যেমন কোনো ভবিষ্যত নেই; তেমন, আদৌ কি তার কোন অতীত আছে? নাকি ভবিষ্যতের দিবাস্বপ্নের মত অতীতও কল্পনাপ্রসূত.!? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে ইতিহাসের অনেকগুলো পাতা উল্টাতে হবে। ব্রিটিশ মোগলদের পিছে ফেলে আরো অনেক অনেক পিছনে ফিরে দেখতে হবে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যই সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে একটি নির্দিষ্ট শাসনের অধীনে আনতে পারেনি। মৌর্য সাম্রাজ্য, মোঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ সাম্রাজ্য – কোন সাম্রাজ্যই সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করতে সক্ষম হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভারতবর্ষ জয়ের অনেক কাছাকাছি গিয়েছিলো চাণক্য নীতি অবলম্বন করে। প্রাচীণ ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধাণ অমাত্য কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামেই পরিচিত।
চাণক্যের সময়কাল আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগে। তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য এবং সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। চাণক্য বিশ্বাস করতো সমগ্র অঞ্চলটিকে একটি নির্দিষ্ট শাসন, প্রশাসন এবং কর্তৃত্বের অধীনে আনতে হবে। সে তার শিষ্য, মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মাধ্যমে তার স্বপ্নের পথে অনেক দূর এগিয়েও যায়। এরপর চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষকে পাঁচ দশকের জন্য তার করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়।
অখন্ড ভারতের অভিলাষ পূরণের জন্য সম্রাট অশোক একের পর স্বাধীন অঞ্চলগুলোতে আগ্রাসন চালায়। এমনই একটি আগ্রাসন হচ্ছে কলিঙ্গের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সম্রাট অশোক প্রায় এক লক্ষ কলিঙ্গ অধিবাসীদের হত্যা করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা সম্রাট অশোকের অন্তরকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। সে অখন্ড ভারতের স্বপ্ন এবং জীবনের সকল বিলাসিতা ছেড়ে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তারই প্রচেষ্টায় সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক ভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পর খুব দ্রুতই মৌর্য সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে।
চানক্যের একটি শিক্ষা ছিল, উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের জন্য – “ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেলো না। সব সীমান্তবর্তী রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে।” আজ, কয়েক হাজার বছর পরে এসে ঠিক সেই মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের পর যদি কোন ধর্ম ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে থাকে, তাহলে তা হচ্ছে ‘বৌদ্ধ ধর্ম’। হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম কখনোই ভারতবর্ষে এককভাবে প্রসারতা বা ব্যপকতা লাভ করতে পারেনি। তাই মৌর্য সাম্রাজ্যের অখন্ড ভারতের স্বপ্ন যদি বর্তমান হিন্দুত্ববাদীরা গ্রহণ করতে চায়; তাহলে ভারতবর্ষে হয় “ইসলামী রাজ্য” বা “গৌতম রাজ্য” প্রতিষ্ঠা লাভ করার কথা। কোনোভাবে অখন্ড ভারতে রাম রাজ্যে প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি।
মৌর্যদের অনেক পরে ভারতবর্ষেকে একত্র করার কাজ হাতে নেয় মোগল সাম্রাজ্য। কিন্তু তারাও ভারতবর্ষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়নি। কারণ ভারতের অধিকাংশ জনগণ মোগলদেরকে ভিনদেশী বলে মনে করত। তাই তারা তাদের থেকে পৃথক এবং স্বাধীন থাকাটাই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। তাছাড়া মুঘলদের শাসনটা ছিল মূলত উত্তর ভারত ও পাকিস্তান কেন্দ্রিক।
মুসলিম শাসনামলেও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাতে স্বাধীন সুলতানি শাসন ছিল। গুজরাটে, আসামে আলাদা মুসলিম রাজ্য ছিল।
মুসলমানদের আগমনের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশ নানা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল এবং আলাদা আলাদা রাজা দ্বারা শাসিত হত।
মহারাষ্ট্র স্বাধীন দেশ ছিল তারা বাংলাতে লুটপাট করতে আসত। সেই লুটপাটের কাহিনী নিয়ে একটি ছড়া আছে। “খোকা ঘুমালো পাড়া জোরালো বর্গী এলো দেশে।” এই বর্গী হলো অত্যাচারী হিন্দু ডাকাত সেনরা।
কেরালা-তামিল নাড়ু সবসময়ই স্বাধীন ছিল। তেমনি সর্বদা স্বাধীন রাজ্য ছিল মনিপুর ও মিজোরাম।
আর ব্রিটিশদের কথা বলতে গেলে, ব্রিটিশদের ক্ষেত্রেও এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ-
এক, বৃটিশ শাসককালেও গোয়া, পন্ডিচেরির মত কিছু কিছু অঞ্চল পর্তুগিজ, ফরাসিদের অধীনে ছিল।
দুই, সমগ্র ভারতবর্ষের অর্ধেক অংশই কমবেশি স্বায়ত্তশাসিত মহারাজদের অধীনে ছিল। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীরসহ অনেক স্বাধীন রাজ্যের উপস্থিতি ছিল। টিপু সুলতান দক্ষিন ভারত শাসন করেছেন।
তিন, আরেকটি বিষয় হলো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সরাসরি ভারতীয় সাম্রাজ্য না, এটা পরিচালিতও হতো ব্রিটেন থেকে। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকেও এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যায় না যে, তারা সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করেছিলো।
যদিও অনেক স্বাধীন রাজ্য তাদের ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তার জন্য ব্রিটিশ রাজের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি তারা ব্রিটিশ রাজকে বাৎসরিক খাজনা আদায় করতো। তারপরও এমন অনেক স্বাধীন রাজ্য ছিল যারা আকার আয়তনে ছোট হলেও ভৌগলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে টিকে থাকার উপযোগী ছিল। যেমনঃ হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর।
তবে ব্রিটিশদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের দিক দিয়ে বলতে গেলে তারা ছিলো পূর্বের সকল সাম্রাজ্যের চাইতে বেশি শক্তিশালী।
অখন্ড ভারতের স্লোগান হচ্ছে মূলত প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোকে গ্রাস করার স্লোগান। আর ভারতের যেসব অঞ্চল বা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তাদেরকে ধরে রাখার একটা কুটচাল। ঐতিহাসিকভাবে হাজার বছরের ইতিহাসে অখন্ড ভারত বলে কিছু নেই। ব্রিটিশদের অধীনস্ত ইন্ডিয়ার কথা বাদ দিলে অখন্ড ভারতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও অখন্ড ভারত বলে কিছু হবে না। ইনশাআল্লাহ।।
“অখন্ড ভারত” শব্দগুচ্ছটি আসলে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের একটি ধারণা ও বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, বর্তমান ভারতের দুই পাশে অবস্থিত দুই দেশ- পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক এবং কৃষ্টিগত দিক দিয়ে ভারতের সাথে মিল থাকায় এই সকল দেশকে ভারতের সাথে যোগ দিতে হবে। অখন্ড ভারতের ধারণায় বিশ্বাসীদের যুক্তি হল এসকল দেশ একসময় হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সুতরাং এই সকল অঞ্চল গুলোকে ভারতের সাথে যোগ দিতে হবে এবং এখানকার বাসিন্দাদের সনাতন ধর্মে ফেরত যেতে হবে।
এই অন্ধ-বিশ্বাসকে পুঁজি করেই অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো মুসলমানদের উপর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও মুসলমানরাও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মুসলিমরা এক আল্লাহর দাসত্ব করে, তারা কখনোই ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব মেনে নিবে না।
“শোষণের জন্যই শাসন” – এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ্যবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের মতবাদ হচ্ছে “শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে উপস্থাপন করতে হয়।”
এই শোষণের আদর্শের নামই ব্রাহ্মণ্যধর্ম। তাই ব্রাহ্মণ্যধর্ম কোন ধর্ম নয়, ব্রাহ্মণ্যধর্ম হল আসলে একটি অপরাধের নাম, মানুষকে শোষণের হাতিয়ারের নাম। মানুষে মানুষে বিভাজনের নাম। জাতপ্রথা বর্ণপ্রথা তৈরী করে মানুষকে শোষণের নাম। ব্রাহ্মণ্যবাদ উচ্চ ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করার নাম।
প্রশ্ন হলো যারা নিজের ধর্মের মানুষদেরকে জাতপ্রথা তৈরী করে শোষণ নির্যাতন অত্যাচার করে, তারা কিভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ এবং জৈন ধর্মের মানুষকে আপন মনে করে বুকে জড়িয়ে নিবে?
বর্তমান সময়ে ভারত বরবারই মতোই অখণ্ড ভারত কায়েম করতে ষড়যন্ত্র করেই চলছে । মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে।
নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে হিন্দুসংঘ ২০ হাজার স্কুলে ভূগোল বইয়ে ভারতের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয়। এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, “The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof.”
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে, ততদিন শান্তি আসবে না।
অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ত্রাস; ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (প্রতিচিন্তা:১০৮) এবং ২০০৬ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।
অখন্ড ভারত গঠন প্রক্রিয়া দুইটি আদর্শের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলছে।
এক, সাঙ্গাথান (হিন্দু ঐক্য)। অর্থাৎ, বাংলাদেশ-পাকিস্তানে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদেরকে একত্রিত করা বা তাদের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় এবং আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে হিন্দুদের অবস্থান অখন্ড ভারত বিনির্মানে এই আদর্শের প্রয়োগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এবং দুই, শুদ্ধি (বিশুদ্ধিকরণ)। অর্থাৎ ক্ষমতা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম ব্যতীত বাকি সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে সনাতন ধর্ম অবলম্বন করতে বাধ্য করা। সারা ভারতে মুসলিমদের উপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী দেন আক্রমণ মূলত এই আদর্শকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। সামান্য গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মুসলমানদেরকে,- কারণ সনাতন ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। অথবা জয় শ্রীরাম না বলার অপরাধে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে নিরীহ মুসলিমদের।
‘অখন্ড ভারত’ ধারণা থেকেই একে একে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং নেপালের মাওবাদ, শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৯৭১ এর যুদ্ধ এই অখন্ড ভারত অভিলাষের দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনার ফল। এবং তার পর থেকে বাংলাদেশে অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইন্ডিয়ার অতি খবরদারিতা তার স্বরূপ উন্মোচন করছে সবার সামনে। বছর কয়েক আগে নেপালের তরাই অঞ্চলের গণভোট এবং এর পরবর্তী জ্বালানী অবরোধও এই অভিলাষের বাইরে নয়।
বর্তমানে চীন এবং ভারতের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং তালেবান মুজাহিদদের পুনরায় আগফগানিস্থানের ক্ষমতা দখল ভারতকে চাপে ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে যতটা সম্ভব সুসম্পর্ক বজায় রাখা। কিন্তু তা না করে মোদি প্রশাসন মুসলমানদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বৃদ্ধি করেছে। ভারত সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো মুসলিমদের উপর একের পর এক আক্রমণ জারি রেখেছে, যা সেক্যুলার নামধারী ভারতের ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করছে। পাশাপাশি সারা বিশ্বের বিশেষ করে মুসলিমদের অসন্তুষ্টিকে বৃদ্ধি করছে।
অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভারতীয় মুসলিমদের উপর। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাটের গণহত্যা বাদ দিলেও ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলিমদের দমনের জন্য তাদেরই প্রণিত “গণতান্ত্রিক সংবিধান” বিবর্জিত পথ অবলম্বন করছে। যেমন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। আসাম এবং পরবর্তীতে সারা ভারতে এনআরসি আইনের আওতায় মুসলিমদের দেশ ছাড়া করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মুসলিমদেরকে তাদের ভূমি, তাদের আবাসস্থল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য একের পর এক ভূমি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদী ভারতের “অখন্ড ভারত” নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ ভারতের অভ্যন্তরীণ মুসলিমদের পক্ষ থেকে আসাটা সময়ের দাবি। তারা যদি একবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, তাহলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো থেকে মুজাহিদীনরা তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন।
মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। হিন্দুদের দাসত্ব মেনে নেওয়া বা তাদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা সমান অর্থহীন। এগুলো বাদ দিয়ে তাই এখন সময় এসেছে পরিপূর্ণ ভাবে জিহাদের নববী মানহাযে ফিরে আসার। সময় এসেছে বিশুদ্ধ তাওহীদের শিক্ষা আত্মস্থ করার। ইসলামকে ঠিক সেভাবেই বুঝে পালন করার, যেভাবে বুঝেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম- কুরআনের প্রজন্ম- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। সব ফেলে এখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে যে, কিভাবে এই আগ্রসনের মোকাবেলা করা যায়।
এই সত্য জানতে ও বুঝতে হবে যে, এই আগ্রাসী শত্রুদের বিরুদ্ধে কারা আমাদের “ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স”। দিগন্তে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে আর মাটিকে গ্রাস করে নিচ্ছে মুশরিকদের আগ্রাসনের ছায়া।
” যে শত্রু আপনাকে ধ্বংস এবংং নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর তাকে থামাতে হবে, থামতে বাধ্য করতে হবে – যে কোন উপায়ে।”
প্রতিবেদক: আসাদ ইরফান
Comment