ভুলে যাওয়া সোপোর গণহত্যা : ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার খণ্ডচিত্র
সোপোর গণহত্যা।
জানুয়ারী ৬, ১৯৯৩ সালের এই দিনেই ভারতীয় দখলদার বাহিনী কাশ্মীরের সোপোরে একটি ঘটনার অজুহাত তুলে ৫৭ জন নিরীহ বেসামরিক মুসলিমকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল।
সোপোর উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলার মধ্যে কাশ্মীরের একটি প্রধান শহর, শ্রীনগর থেকে ৫০ কি.মি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
অভিযোগ ছিল, সেখানে স্বাধীনতাকামীরা একটি অতর্কিত হামলায় ভারতীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে। এই অজুহাত তুলেই সেদিন ভারতীয় হানাদার বাহিনী সোপোরের বেসামরিক মুসলিমদের উপর নৃশংস তাণ্ডব চলায়। এটি ছিল হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর ঠাণ্ডা মাথায় চালানো এক মুসলিম গণহত্যা।
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী একজন দোকানদার গোলাম রসুল গানাই বলেছেন, "কথিত জঙ্গি হামলার পরে ভারতীয় বাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র বেসামরিকদের উপর গুলি চালায় এবং বাজার- বিশেষ করে প্রধান চক থেকে তহসিল অফিস পর্যন্ত এলাকা জ্বালিয়ে দেয়...
...৫৭ জন মৃত বেসামরিক নাগরিকের মধ্যে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সৈন্যরা একটি এসআরটিসি বাসের (রেজিস্ট্রেশন নম্বর JKY-1901) থেকে চালককে টেনে নিয়ে যায় এবং বোর্ডে থাকা যাত্রীদের উপর গুলি বর্ষণ করে, যার ফলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ২০ জন যাত্রীর।"
গোলাম রসুল আরও বলেন, "সৈন্যরা পরে আশেপাশের অনেক বিল্ডিং, দোকান এবং বাড়িতে গান পাউডার এবং পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। শালপোরা, শাহাবাদ, মুসলিমপির, ক্রালটাং এবং আরামপোরা সহ পাঁচটি এলাকায় ২৫০ টি দোকান সহ আশেপাশের ৪৫০ টিরও বেশি স্থাপনা এবং ৭৫ টি আবাসিক বাড়ি ছাই-এ পরিণত হয়। ভবনগুলির মধ্যে কিছু ল্যান্ডমার্ক রয়েছে- যেমন মহিলা ডিগ্রি কলেজ এবং সামাদ টকিজ।"
গোলাম রসুলের বর্ণিত ঐ বাস্তি ছিল বিয়ের বরযাত্রী বোঝাই একটি বাস। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ঐ বাসে মেশিনগানের আগুন দিয়ে স্প্রে করে, চালক এবং ১৫ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে।
বাসের প্রায় সব যাত্রী নিহত হলেও বর ও কনে আল্লাহ্র ইচ্ছায় বেঁচে যান, তবে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে। হামলায় আহত হয়য়ে যখন কনে শাহানা ও তার এক গর্ভভতি আত্মীয়া কাতরাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় নৃশংস ঐ বিএসএফ জওয়ানরা ঐ দুই নারীকে পাশের ক্যাম্পএ নিয়ে রাতভর ধর্ষণ করে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো ফুপিয়ে উথেন শাহানা।
ঐদিন আরও তিনটি গাড়িতেও গুলি চালানো হয় এবং তারপর আধাসামরিক বাহিনী গাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
কাশ্মীরে উন্নয়ন আর কাশ্মীরবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের মেকি শ্লোগান তোলা হিন্দুত্ববাদী ভারত এমন উন্নয়ন আর প্রগতিই উপহার দিয়েছে কাশ্মীরবাসী মুসলিমদেরকে, যার ক্ষত এখনো দগদগে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরকে গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পর সেখানে উন্নয়ন ঘটার এমন কাহিনীই তো প্রচার করেছে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদের দালাল মিডিয়াগুলো!
গণহত্যার বেঁচে যাওয়া আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী তারিক আহমেদ কানজওয়াল (৪৮), তিনি তখন ছিলেন ২০ বছরের যুবক। তিনি জানান, "একটি দোকানে পুড়ে যাওয়া একজন ব্যক্তির ছবি আমাকে সর্বদা তাড়িত করবে। তার মাথা জ্বলছিল।"
তারিকের আরও মনে আছে কিভাবে "শাহীন স্টুডিওর মালিক শাহীন এবং তার সহকারীকে দোকানে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।"
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার দাবি করেছিল। সোপোর গণহত্যা নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে "রক্তের জোয়ার উঠছে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। - আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিবাদ বলতে গেলে এততুকুই। এই ঘতন্র জন্য না কথিত জাতিসংঘ কোনদিন ভারতের নিন্দা করেছে, আর না ভারতীয়রা কখনো ঐ গণহত্যায় জড়িত কোন সৈনিকের বিচার করেছে।
এথেকেই ঐ মুসলিম গণহত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের সরাসরি জড়িত থাকা এবং কাশ্মীরে মুসলিম নিধনে কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌন সম্মতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
কাশ্মীরি গণহত্যার ভুলে যাওয়া এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টি তুলে ধরার উদ্দেশ্য হল ভারতীয় নৃশংসতা আর বিশ্ববাসীর নির্লিপ্তটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, যেন বিশ্ববাসী এই ধোঁকাবাজীর অবস্থান থেকে সরে এসে কাশ্মীরি মুসলিমদের অসহায়ত্ব অনুধাবন করে, তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের ভুলে না যায়। এবং, সর্বোপরি, যেন হিন্দুত্ববাদী ভারতের জুলুম-নৃশংসতার প্রকৃত চিত্র আর হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ংকর নোংরা চেহারটা বিশ্ববাসী চিনতে ও চিনাতে পারে।
লেখক: আব্দুল্লাহ বিন নযর
তথ্যসূত্র :
------
১। SOPORE MASSACRE: When 57 civilians were killed, 400 shops and 75 houses burnt down -
২। https://tinyurl.com/mpzbdnft
৩। Sopore massacre -
সোপোর গণহত্যা।
জানুয়ারী ৬, ১৯৯৩ সালের এই দিনেই ভারতীয় দখলদার বাহিনী কাশ্মীরের সোপোরে একটি ঘটনার অজুহাত তুলে ৫৭ জন নিরীহ বেসামরিক মুসলিমকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল।
সোপোর উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলার মধ্যে কাশ্মীরের একটি প্রধান শহর, শ্রীনগর থেকে ৫০ কি.মি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
অভিযোগ ছিল, সেখানে স্বাধীনতাকামীরা একটি অতর্কিত হামলায় ভারতীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে। এই অজুহাত তুলেই সেদিন ভারতীয় হানাদার বাহিনী সোপোরের বেসামরিক মুসলিমদের উপর নৃশংস তাণ্ডব চলায়। এটি ছিল হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর ঠাণ্ডা মাথায় চালানো এক মুসলিম গণহত্যা।
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী একজন দোকানদার গোলাম রসুল গানাই বলেছেন, "কথিত জঙ্গি হামলার পরে ভারতীয় বাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র বেসামরিকদের উপর গুলি চালায় এবং বাজার- বিশেষ করে প্রধান চক থেকে তহসিল অফিস পর্যন্ত এলাকা জ্বালিয়ে দেয়...
...৫৭ জন মৃত বেসামরিক নাগরিকের মধ্যে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সৈন্যরা একটি এসআরটিসি বাসের (রেজিস্ট্রেশন নম্বর JKY-1901) থেকে চালককে টেনে নিয়ে যায় এবং বোর্ডে থাকা যাত্রীদের উপর গুলি বর্ষণ করে, যার ফলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ২০ জন যাত্রীর।"
গোলাম রসুল আরও বলেন, "সৈন্যরা পরে আশেপাশের অনেক বিল্ডিং, দোকান এবং বাড়িতে গান পাউডার এবং পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। শালপোরা, শাহাবাদ, মুসলিমপির, ক্রালটাং এবং আরামপোরা সহ পাঁচটি এলাকায় ২৫০ টি দোকান সহ আশেপাশের ৪৫০ টিরও বেশি স্থাপনা এবং ৭৫ টি আবাসিক বাড়ি ছাই-এ পরিণত হয়। ভবনগুলির মধ্যে কিছু ল্যান্ডমার্ক রয়েছে- যেমন মহিলা ডিগ্রি কলেজ এবং সামাদ টকিজ।"
গোলাম রসুলের বর্ণিত ঐ বাস্তি ছিল বিয়ের বরযাত্রী বোঝাই একটি বাস। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ঐ বাসে মেশিনগানের আগুন দিয়ে স্প্রে করে, চালক এবং ১৫ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে।
বাসের প্রায় সব যাত্রী নিহত হলেও বর ও কনে আল্লাহ্র ইচ্ছায় বেঁচে যান, তবে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে। হামলায় আহত হয়য়ে যখন কনে শাহানা ও তার এক গর্ভভতি আত্মীয়া কাতরাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় নৃশংস ঐ বিএসএফ জওয়ানরা ঐ দুই নারীকে পাশের ক্যাম্পএ নিয়ে রাতভর ধর্ষণ করে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো ফুপিয়ে উথেন শাহানা।
ঐদিন আরও তিনটি গাড়িতেও গুলি চালানো হয় এবং তারপর আধাসামরিক বাহিনী গাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
কাশ্মীরে উন্নয়ন আর কাশ্মীরবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের মেকি শ্লোগান তোলা হিন্দুত্ববাদী ভারত এমন উন্নয়ন আর প্রগতিই উপহার দিয়েছে কাশ্মীরবাসী মুসলিমদেরকে, যার ক্ষত এখনো দগদগে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরকে গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পর সেখানে উন্নয়ন ঘটার এমন কাহিনীই তো প্রচার করেছে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদের দালাল মিডিয়াগুলো!
গণহত্যার বেঁচে যাওয়া আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী তারিক আহমেদ কানজওয়াল (৪৮), তিনি তখন ছিলেন ২০ বছরের যুবক। তিনি জানান, "একটি দোকানে পুড়ে যাওয়া একজন ব্যক্তির ছবি আমাকে সর্বদা তাড়িত করবে। তার মাথা জ্বলছিল।"
তারিকের আরও মনে আছে কিভাবে "শাহীন স্টুডিওর মালিক শাহীন এবং তার সহকারীকে দোকানে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।"
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার দাবি করেছিল। সোপোর গণহত্যা নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে "রক্তের জোয়ার উঠছে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। - আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিবাদ বলতে গেলে এততুকুই। এই ঘতন্র জন্য না কথিত জাতিসংঘ কোনদিন ভারতের নিন্দা করেছে, আর না ভারতীয়রা কখনো ঐ গণহত্যায় জড়িত কোন সৈনিকের বিচার করেছে।
এথেকেই ঐ মুসলিম গণহত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের সরাসরি জড়িত থাকা এবং কাশ্মীরে মুসলিম নিধনে কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌন সম্মতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
কাশ্মীরি গণহত্যার ভুলে যাওয়া এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টি তুলে ধরার উদ্দেশ্য হল ভারতীয় নৃশংসতা আর বিশ্ববাসীর নির্লিপ্তটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, যেন বিশ্ববাসী এই ধোঁকাবাজীর অবস্থান থেকে সরে এসে কাশ্মীরি মুসলিমদের অসহায়ত্ব অনুধাবন করে, তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের ভুলে না যায়। এবং, সর্বোপরি, যেন হিন্দুত্ববাদী ভারতের জুলুম-নৃশংসতার প্রকৃত চিত্র আর হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ংকর নোংরা চেহারটা বিশ্ববাসী চিনতে ও চিনাতে পারে।
লেখক: আব্দুল্লাহ বিন নযর
তথ্যসূত্র :
------
১। SOPORE MASSACRE: When 57 civilians were killed, 400 shops and 75 houses burnt down -
২। https://tinyurl.com/mpzbdnft
৩। Sopore massacre -
Comment