ইসলামের তারকাগণ | পর্ব: ১৬ | সায়্যিদুশ শুহাদা, হযরত হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাঃ
পরিচিতি:
উপনাম, আবু উমারাহ। মক্কাতে তিনি এই নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন চাচা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন চাচাদের মধ্যে হযরত হামজা ও আব্বাস (রাঃ)-ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁর আরেকটি সম্পর্ক ছিলো দুধ ভাইয়ের। দু’জনই আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবাহ থেকে দুধ পান করেছেন। বয়সে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দু’বছরের বড় ছিলেন।(১) নবুওয়াত প্রাপ্তির দ্বিতীয়, মতান্তরে চতুর্থ বৎসরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আপন ভাতিজার সার্বিক সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করেন।
হযরত হামজা রাঃ এর ইসলাম গ্রহণ:
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে সীরাতে ইবনে ইসহাক নামক গ্রন্থে।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতের নিকটে নিবিষ্টচিত্তে আপন রবের ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। তখন কমবখত আবু জাহেল রাসূল ﷺ-কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে। আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কেও কটু মন্তব্য করে। প্রিয় রাসূল ﷺ কোনো কথারই প্রতিউত্তর করেননি। একরাশ ব্যাথা নিয়ে নিজের কাজেই মগ্ন থাকেন। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে আবু জাহেল আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং একটি পাথর এনে রাসূল ﷺ-এর মাথায় নিক্ষেপ করে। –আমাদের পিতা-মাতা, জান-মাল সবকিছুই তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক!– যার ফলে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। এরপর কমবখত আবু জেহেল কাবার চত্ত্বরে এসে কুরাইশদের একটি বৈঠকে বসে পড়ে এবং গর্বের সাথে ঘটনার বিবরণ শুনাতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীমাহীন অসহায়ত্বের এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি স্ব-চক্ষে প্রত্যক্ষ করে আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আনের বাঁদি।(২)
নিত্যদিনের অভ্যাস অনুযায়ী হামজা যখন শিকার থেকে ফিরছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আনের বাঁদি তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায় এবং অনুযোগের স্বরে ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলে। তার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের করুণ অভিব্যক্তি হামজাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ঘটনা শোনামাত্রই হামজার মাথায় রক্ত চড়ে বসে। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি দ্রুত পায়ে ছুটেন কাবার দিকে। এ যেন অন্য জগতের অন্য এক হামজা! আজ সে মাজলুম ভাতিজার পক্ষ থেকে জালিম আবু জাহেলের কাছে যাচ্ছে, কৃত জুলুমের প্রতিশোধ নিতে!
আবু জাহেলকে দেখামাত্রই নিজের ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত হানেন তার মাথায়। খুব খারাপভাবে আহত হয় আবু জাহেল। উপস্থিত সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে হামজার পানে। মুহাম্মাদ ﷺ-কে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে এই প্রথম আবু জাহেলের থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে কেউ। ইতিপূর্বে এত বড় স্পর্ধা কেউ দেখায়নি। তাই সেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাখযূম গোত্রের কিছু লোক আবু জাহেলের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে হামজার সামনে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে: কী ব্যাপার হামজা? বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করেছো মনে হচ্ছে! ক্ষিপ্ত হামজা উত্তর দিতে মোটেই বিলম্ব করলেন না-“সত্য প্রকাশিত হবার পর আমাকে তা থেকে বিরত রাখবে-এত বড় সাহস কার? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তিনি যা বলছেন, সত্যই বলছেন। আল্লাহর কসম, আমি আমার এই বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্রও টলবো না। তোমাদের সাহস থাকলে মোকাবিলায় আসো!” তাঁর এই সাহসী উচ্চারণে সকলের পিলে কেঁপে ওঠে। মোকাবিলার সাহস হয়নি কারো।
হযরত হামজা ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত, সম্মানিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সকলেই তাঁকে সীমাহীন সমীহ করে চলতো। তাঁর ইসলাম গ্রহণে মুমিনগণ যারপরনাই আনন্দিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে কাফেরদের বাড়াবাড়ি অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তাঁর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের ব্যাপারে জানতো না- মক্কায় এমন কেউ ছিলো না।
ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন:
মক্কার জমিনে ইসলাম প্রচারের কাজ একটা সময় এসে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মক্কার জমিন ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে মুমিনদের জন্য। কাফেরদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ইতিমধ্যেই শাহাদাত বরণ করেছেন বৃদ্ধা সাহাবী হযরত সুমাইয়া (রাঃ)। শি’আবে আবি তালিবে তিন বছরের কারাবাস, চাচা আবু তালিবের ইন্তিকাল, সহধর্মিণী হযরত খাদিজা রাঃ এর ইন্তিকাল, নির্যাতনে কাফেরদের নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন – সব মিলিয়ে মক্কার জমিন মুমিনদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেলো। পরিত্রাণের জন্য সাহাবায়ে কেরাম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। অবশেষে, মক্কা ত্যাগ করে মদীনার পথে হিজরত করার নির্দেশ এলো স্বয়ং রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকেই। এক এক করে সাহাবায়ে কেরাম মক্কা ছাড়তে আরম্ভ করলেন। পিছিয়ে থাকলে না হামজা (রাঃ)ও। মক্কার প্রভাব-প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা-সবকিছু বিসর্জন দিয়ে লাব্বাইক বললেন হিজরতের ডাকে। হিজরতের পর ধীরে ধীরে জিহাদের বিধান আসতে শুরু হলো। যে কুরআনে এতদিন পর্যন্ত ধৈর্য আর ক্ষমার কথা বাড় বাড় বলা হয়েছে, সে কুরআনেই এখন সশস্ত্র সংগ্রামের নির্দেশনা আসতে থাকলো।
মক্কাবাসীদের জীবন ছিলো ব্যবসা-নির্ভর। তাদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিলো শাম দেশ। মজার ব্যাপার হলো, ভৌগোলিকভাবে মদীনার অবস্থান ছিলো শাম এবং মক্কার মাঝপথে। ফলে,মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলাগুলোকে শামে যেতে হলে বা ফিরতে হলে, অনিবার্যভাবেই মদীনার পাশ কেটে যেতে হতো। তাদের অর্থনীতির মূলে আঘাত করার এটা ছিলো একটা মোক্ষম সুযোগ। মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা শাম দেশে কখন যায় আর কখন ফিরে- অতি সন্তর্পণে সে খবর রাখতে থাকেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হিজরতের সপ্তম মাস, পবিত্র রমাজান মাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারেন, তিন’শ জনের একটি ব্যাবসায়িক কাফেলা আবু জাহেলের নেতৃত্বে শাম দেশ থেকে ফিরছে৷ কাফেলাটি মদীনার অনতিদূর দিয়েই অতিক্রম করে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালক্ষেপণ না করে ত্রিশ জন মুহাজিরের(৩) একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং হামজা (রাঃ) এর নেতৃত্বে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। সমূদ্র-উপকূলীয় “ঈস” অঞ্চলের দিকে রওয়ানা হলো জিহাদী কাফেলা। ১৩ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে গেলেন সাহাবায়ে কেরাম রাঃ। তাঁদের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো প্রতিশোধের আগুন।
কাফেলাটি মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরম যত্নের সঙ্গে কালিমা খচিত একটি সাদা ঝাণ্ডা তুলে দেন হযরত হামজা (রাঃ) এর হাতে। ঐতিহাসিকদের মতে, এটাই ছিলো জিহাদের জন্য সর্বপ্রথম বাহিনী প্রেরণ এবং ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন।(৪) অসাধারণ বীরত্বের কল্যাণে যে গৌরব লাভ করেন হযরত হামজা রাঃ।
নির্ধারিত স্থানে উভয় বাহিনী সারিবদ্ধভাবে মুখোমুখি দাঁড়ায়। উভয় বাহিনীই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। একদিকে তিনশ মুশরিক। অপরদিকে ত্রিশজন সাহাবী, যাঁদের প্রত্যেকেই বুকভরা সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইস্পাত কঠিন প্রাচীরের ন্যায়। কিন্তু মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মাজদী ইবনে আমর জুহানী। যেহেতু সে উভয় পক্ষের হালীফ (মৈত্রীচুক্তিবদ্ধ) ছিলো, তাই সে উভয় বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। অবশেষে তার মধ্যস্থতায় উভয় বাহিনীর মাঝে সন্ধি হয়ে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এ ছাড়া “আবওয়া, উশাইরা ও বনু কাইনুকার যুদ্ধেও তিনি ইসলামের ঝাণ্ডা বহনের গৌরব অর্জন করেন।
হযরত হামজা রাঃ এর বীরত্ব ও শাহাদাত :
বদর ছিলো ইসলামী ইতিহাসের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ। ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো এই বদর যুদ্ধ৷
বদরের ময়দান তখন প্রস্তুত৷ একদিকে আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজারের বিশাল বাহিনী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত, অপরদিকে গুটিকতক সাহাবী, নগণ্য কিছু যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে রাসূল ﷺ-এর নেতৃত্বে দণ্ডায়মান। উভয় বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়ানো। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে তুমুল লড়াই৷ তৎকালীন নিয়ম ছিলো, মূল যুদ্ধের পূর্বে উভয় বাহিনীর বাছাই করা বীরদের দ্বারা সংঘটিত হতো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। সে অনুযায়ী কাফেরদের সারি থেকে উতবাহ, শাইবাহ ও ওয়ালিদ ইবনে উতবাহ বের হয়ে আসে এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহ্বান করে৷ মুসলিমদের সারি থেকে তিন আনসার সাহাবী, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, আউফ ও মুওয়াওবিয (রাঃ) সিংহের গর্জন ছেড়ে মাঠে আসেন। কিন্তু কুরাইশরা আনসারদের সাথে যুদ্ধ করাকে নিজেদের জন্য অপমানজনক মনে করছিলো। তাই উতবাহ হাঁক ছেড়ে বল্লো, ‘হে মুহাম্মাদ, আমাদের মোকাবিলায় আমাদের গোত্রের লোকদের পাঠাও।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশে হযরত হামজা, আলী ও উবাইদা ইবনে হারিস (রাঃ) মাঠে আসলেন। তারা শুধু নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। হযরত হামজা (রাঃ) যেনো বীরত্ব প্রকাশের এক অনুমপ সুযোগ পেয়ে গেলেন! ময়দানে এসেই তিনি শাইবার (৫) সামনে দাঁড়ান এবং এক আঘাতেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। তিন মুসলিম বীর মিলে কাফেরদের দম্ভ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সদর্পে ফিরে এলেন। অবশ্য, হযরত উবাইদা (রাঃ) পায়ে একটি আঘাত পেয়েছিলেন। যে আঘাতের কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
বদরের যুদ্ধে হযরত হামজা (রাঃ) নিজের পাগড়ির মধ্যে উটপাখীর পালক গুঁজে রেখেছিলেন। যার কারণে তিনি যে দিকেই যাচ্ছিলেন তাঁকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিলো। কাফেরদের বূহ্য ভেদ করে তিনি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। যে-ই সামনে পড়ছিলো তার উপরেই তিনি স্বীয় তরবারির ধার পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন। এক হামজার কারণেই কাফেররা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিলো। কাফেরদের জন্য তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ছিলেন। পেছনে লাশের সারি ফেলে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন বীরবিক্রমে।
উমাইয়া ইবনে খালফ আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে জিজ্ঞেস করেছিলো, উটপাখীর পালক ওয়ালা ওই ব্যক্তিটি কে? তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামজা। উমাইয়া বললো, আজকের যুদ্ধে এই ব্যক্তির কারণেই আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ হয়েছে।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয় উহুদ যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তর যুদ্ধ ছিলো এটি। নিয়ম অনুযায়ী এ যুদ্ধেও উসমান ইবনে আবু তালহা দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহবান করলে মুসলিম বাহিনী থেকে হযরত হামজা (রাঃ) বেরিয়ে আসেন। এক আঘাতেই প্রতিদ্বন্দ্বীর ইহলিলা সাঙ্গ করে দেন তিনি। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। কাফেরদের সারি তছনছ করে সামনে বাড়ছিলেন হযরত হামজা (রাঃ)। এ জন্য তাকে নিয়ে সবাই খুব পেরেশান ছিলো। যে দিকেই তিনি যাচ্ছিলেন, সেদিকেই শত্রুদের লাশের সারি পড়ে যাচ্ছিলো। তিনি যার উপরেই আঘাত করছিলেন, তাকেই মাটিতে পড়ে কাতরাতে দেখা যাচ্ছিলো। শাহাদাতের অমীয় সুধা তাকে যেনো তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো! উহুদের যুদ্ধে তিনি একাই কাফেরদের ত্রিশজনকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন।
হযরত হামজা (রাঃ) যেহেতু বদরের যুদ্ধে কাফেরদের বাছাবাছা সর্দারদের হত্যা করেছিলেন, তাই মক্কার সবাই তাঁর উপর ক্ষেপে ছিলো। তাঁর রক্তনেশায় উন্মাদ ছিলো সবাই৷ বদরের যুদ্ধে তুআইমা ইবনে আদী নিহত হয়েছিলো হামজা (রাঃ) এর হাতে। তুআইমার ভাতিজা জুবাইর ইবনে মুতয়িমের কৃতদাস ছিলো ওয়াহশী।(৬) জুবাইর তার কৃতদাস ওয়াহশীকে বলেছিলো, মুহাম্মাদের চাচা হামজাকে হত্যা করতে পারলে তোমাকে আযাদ করে দিবো।
ওয়াহশীর ভাষায়, ‘আমি শুধু হামজাকে হত্যা করতেই উহুদের ময়দানে গিয়েছিলাম। একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে হামজার গতিবিধি লক্ষ করছিলাম৷ হঠাৎ সিবা ইবনে আব্দুল উযযাকে দেখতে পেলাম, “আছে কি কেউ, আমার সাথে লড়বে?”- বলতে বলতে আমার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। তাকে দেখেই হামজা এই বলতে বলতে তেড়ে আসলেন “আরে ওই আরব্য নারীদের খতনাকারী মহিলার অপবিত্র সন্তান,(৭) তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে! আয় সামনে আয়!” এই বলেই তিনি তাকে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উযযার অপবিত্র দেহকে রক্ত আর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখা গেলো এবং কিছুক্ষণ পরেই তার নাপাক আত্মা ইহকাল ত্যাগ করলো। আমি আমার বর্শাটা নেড়েচেড়ে নিলাম এবং সুযোগ বুঝে তা ছুঁড়ে মারলাম। বর্শাটি হামজার নাভিতে বিদ্ধ হলো। মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর তলপেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে বর্শা বেরিয়ে গেলো। আহত সিংহের ন্যায় প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে তিনি ছুটে আসতে চাইলেন আমার দিকে। কিন্তু পারলেন না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসলো তাঁর সমস্ত শরীর। মুহূর্ত কয়েক পরেই চিরদিনের মত মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তাঁর অবশ দেহ। বীরত্বের ইতিহাস রচনা করে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিলেন হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)।
তারপর আমি ওঠে গিয়ে আমার বর্শাটা কুড়িয়ে নিলাম এবং আমার স্থানে এসে বসে গেলাম। আমার আর যুদ্ধ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কারণ আমি তো শুধু আযাদ হওয়ার লোভেই ময়দানে এসেছিলাম! এরপর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবা(৮) হযরত হামজা (রাঃ) এর লাশ বিকৃত করে। তার নাক, কান, গলা কেটে মালা বানায়। তার পেট চিড়ে কলিজা বের করে চিবাতে থাকে। কিন্তু গিলতে না পেরে শেষে ফেলে দেয়।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, যুদ্ধ শেষ হলে সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে জড়ো হচ্ছিলেন। কিন্তু হামজাকে দেখা যাচ্ছিলো না। আমি বললাম, আমি হামজাকে অমুক গাছের নিকট এই কথাগুলো বলতে শুনেছিলাম:
أنا أسد الله و أسد رسوله
“আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিংহ”
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিকে অগ্রসর হলেন। যখন হামজা (রাঃ) এর কপাল দেখতে পেলেন তখন কাঁদতে শুরু করলেন। আর যখন তাঁর বিকৃত লাশ দেখলেন, তখন হেঁচকি তুলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন:
عن جابر بن عبدالله: سيدُ الشهداءِ عندَ اللهِ يومَ القيامةِ حمزةُ بنُ عبدِ المطلبِ.
কিয়ামতের দিন, আল্লাহ তা’আলার দরবারে শহীদকুলের সর্দার আখ্যায়িত হবেন হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। (আল জামিউস সাগীর-৪৭৩০)
তিনি আরো ইরশাদ করেন:
رحمةُ اللهِ عليكَ، لقد كنتَ وصولًا للرحمِ، فعولًا للخيرِ،
হে চাচা! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন, বেশি বেশি ভালো কাজ করতেন!(ফাতহুল বারী-৭/৪৩০,)
তিনি আরো বলেন, যদি সাফিয়্যা (৯) এবং অন্য মহিলাদের শোক আর দুঃখের কথা না ভাবতাম এবং পরবর্তীরা এর উপর আমল শুরু করবে এই ভয় না হতো, তাহলে আপনাকে এভাবেই ফেলে রাখতাম যেনো, পশু-পখী আপনাকে খেয়ে ফেলে এবং হাশরের ময়দানে আপনি পশু-পখীর পেট থেকে বের হয়ে আসেন!
আপন চাচার বিকৃত লাশ দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত রাগান্বিত হয়েছিলেন যে, তিনি বলেছিলেন:
“لَئِنْ ظَهَرْنَا عَلَيْهِمْ لَنُمَثِّلَنَّ بِثَلَاثِينَ رَجُلًا مِنْهُمْ” فَلَمَّا سَمِعَ الْمُسْلِمُونَ ذَلِكَ قَالُوا: وَاللَّهِ لَئِنْ ظَهَرْنَا عَلَيْهِمْ لَنُمَثِّلَنَّ بِهِمْ مُثْلَةً لَمْ يُمَثِّلْهَا أَحَدٌ مِنَ الْعَرَبِ بِأَحَدٍ قَطُّ.
“যদি আমরা তাদের উপর বিজয়ী হতে পারি, তাহলে তাদের ত্রিশজনকে এভাবে বিকৃত করবো।”(১০) এটা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, আমরা তাদের উপর বিজয়ী হলে, তাদেরকে এমনভাবে বিকৃত করবো, আজ পর্যন্ত যা আরবের কেউ কাউকেই করেনি!”
কিন্তু রাহমানুর রহীম আল্লাহ তা’আলা আপন বান্দাদের প্রতি দয়া দেখালেন। তাই হযরত জিবরীল (আঃ)-কে দিয়ে সূরা আন-নাহলের ১২৫-১২৬ নং আয়াত নাজিল করলেন। যেখানে ইরশাদ হয়েছে:
وَاِنۡ عَاقَبۡتُمۡ فَعَاقِبُوۡا بِمِثۡلِ مَا عُوۡقِبۡتُمۡ بِہٖ ؕ وَلَئِنۡ صَبَرۡتُمۡ لَہُوَ خَیۡرٌ لِّلصّٰبِرِیۡنَ
আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করো, তাহলে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ-ই গ্রহণ করো, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। আর যদি সবর করো, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।(সূরা আন নাহল, আয়াত নং-১২৬)
এরপর সাহাবায়ে কেরাম রাঃ কসমের কাফফারা দেন।
হযরত হামজা (রাঃ)-কে একটি চাদর দিয়ে কাফন পরানো হয়। এটি এত ছোট ছিলো যে, পা ঢাকলে মাথা খালি হয়ে যেতো আর মাথা ঢাকলে পা খালি হয়ে যেতো। তাই মাথার দিকে চাদর দিয়ে পায়ের উপর ঘাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
উহুদের শহীদদের মধ্যে প্রত্যেক দু’জনকে একটি করে কবরে দাফন করা হয়৷ সেইমতে হযরত হামজা ও আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশকে (রাঃ) এক কবরে দাফন করা হয়।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা এটি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো ষাটের কাছাকাছি।
হযরত জাবির (রাঃ) বলেন: যেদিন হযরত মু’আবিয়া রাঃ উহুদে কূপ খনন করেছিলেন সেদিন আমরা উহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করেছিলাম। শহীদদের আমরা পূর্ণ তাজা অবস্থায় পেয়েছিলাম। এক ব্যক্তি হযরত হামজা রাঃ এর পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।
প্রাপ্ত শিক্ষা:
১. রাসূলুল্লাহ ﷺ হযরত হামজা (রাঃ) এর ছোট ছিলেন এবং ভাতিজা ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সর্বক্ষেত্রে রাসূল ﷺ-কে মান্য করেছেন। তাই দ্বীন ও জিহাদের পথে চলতে কখনো যদি আমাদের ছোট কাউকে আমীর বানানো হয় তাহলেও তা মানতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়। হাল যামানায় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, শাইখ উসামা এবং শাইখ যাওয়াহিরী। শাইখ যাওয়াহিরী শাইখ উসামার চেয়ে সাত বছরের বড় হয়েও তাকে মেনে চলেছেন।
২. জালিমকে কখনো ছাড় দিতে নেই; সে আমার গোত্রের সর্দারই হোক না কেনো! যেমন আবু জাহেলকে ছাড় দেননি হযরত হামজা (রাঃ)।
৩. সত্য প্রকাশিত হবার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা উচিৎ নয়। সত্য(নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেও-)গ্রহণের যোগ্যতা আল্লাহ তা’আলার অনেক বড় নিয়ামত।
৪.নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা কখনোই আল্লাহ তা’আলার সত্য দ্বীনের পথে বাধা হতে পারে না! হযরত হামজা (রাঃ) এ সব ছেড়েই হিজরত করেছিলেন।
৫.যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো, শত্রুকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। সামরিক শক্তিতে শত্রুকে পরাজিত করতে এই কৌশলটির গুরুত্ব অপরিসীম।
৬.কখনো কখনো শহীদদের লাশ পঁচে না, শহীদের কবরে সাওয়াল-জবাব নেই, তাঁর মৃত্যুর কষ্ট হবে পিঁপড়ার কামর বা তাঁর থেকেও কম, আর শহীদের রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার আগেই তাঁর জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। এসকল কারণে শহীদ হওয়ার তীব্র বাসনা হৃদয়ে লালন করা।
নোটঃ
(১) কারো কারো মতে চার বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু দু’বছরের মতটিই প্রাধান্যযোগ্য।
(২)আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আন মক্কার একজন দানশীল ব্যক্তি ছিলো। কিন্তু ইসলাম নসীব হয়নি। তার বাঁদিও ইসলাম গ্রহণ করেনি।
(৩)এই যুদ্ধে কোন আনসারী সাহাবী ছিলেন না। যদিও কেউ কেউ এই দাবি করেছেন! তাদের দাবিটি দুর্বল। কেননা, আনসারগণ মদীনার ভেতরে থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেফাজত করার উপর বাইয়াত দিয়েছিলেন।
(৪) কারো কারো মতে হযরত উবাইদা ইবনুল হারিস (রাঃ) এর অভিযান ছিলো ইসলামের প্রথম অভিযান। এবং তিনিই সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন করেন।
(৫) কেউ কেউ মনে করেন, হযরত হামজা (রাঃ) উতবাহকে আর হযরত উবাইদাহ (রাঃ) শাইবাকে হত্যা করেছেন।
(৬)ওয়াহশী ইবনে হারব। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে হামজা (রাঃ) কে হত্যা করার বিস্তারিত ঘটনা শুনেছিলেন। এরপর বলেছিলেন, তুমি কখনো আমার সামনে এসো না, তোমাকে দেখলে আমার চাচার কথা মনে পড়ে। পরে ভণ্ড নবী মুসাইলামাতুল কাযযাবকে হত্যা করার মাধ্যমে তিনি হামজা (রাঃ)-কে হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।
(৭) সিবার মা “উম্মে আনমার” নারীদের খৎনা করাতো।
(৮)আবু সুফিয়ান ও হিন্দা, তারা উভয়েই ফাতহে মক্কার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
(৯)সাফিয়্যাহ ছিলেন হযরত হামজা (রাঃ) এর সহোদরা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু।
(১০)কোনো কোনো রেওয়াতে ৭০ জনের কথাও এসেছে।
লেখক: মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্রঃ
১. সীরাতে ইবনে হিশাম।
২. সীরাতে ইবনে ইসহাক।
৩. মাগাযীয়ে ওয়াক্বিদী।
৪. যা-দুল মা’আদ।
৫.তাফসীরে ইবনে কাসীর।
৬.হায়াতুস সাহাবা।
৭.সীরাতে মুস্তফা।
سيدُ الشهداءِ عندَ اللهِ يومَ القيامةِ حمزةُ بنُ عبدِ المطلبِ
(হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নিকট শহীদকুলের সর্দার।)
(হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নিকট শহীদকুলের সর্দার।)
পরিচিতি:
উপনাম, আবু উমারাহ। মক্কাতে তিনি এই নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন চাচা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন চাচাদের মধ্যে হযরত হামজা ও আব্বাস (রাঃ)-ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁর আরেকটি সম্পর্ক ছিলো দুধ ভাইয়ের। দু’জনই আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবাহ থেকে দুধ পান করেছেন। বয়সে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দু’বছরের বড় ছিলেন।(১) নবুওয়াত প্রাপ্তির দ্বিতীয়, মতান্তরে চতুর্থ বৎসরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আপন ভাতিজার সার্বিক সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করেন।
হযরত হামজা রাঃ এর ইসলাম গ্রহণ:
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে সীরাতে ইবনে ইসহাক নামক গ্রন্থে।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতের নিকটে নিবিষ্টচিত্তে আপন রবের ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। তখন কমবখত আবু জাহেল রাসূল ﷺ-কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে। আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কেও কটু মন্তব্য করে। প্রিয় রাসূল ﷺ কোনো কথারই প্রতিউত্তর করেননি। একরাশ ব্যাথা নিয়ে নিজের কাজেই মগ্ন থাকেন। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে আবু জাহেল আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং একটি পাথর এনে রাসূল ﷺ-এর মাথায় নিক্ষেপ করে। –আমাদের পিতা-মাতা, জান-মাল সবকিছুই তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক!– যার ফলে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। এরপর কমবখত আবু জেহেল কাবার চত্ত্বরে এসে কুরাইশদের একটি বৈঠকে বসে পড়ে এবং গর্বের সাথে ঘটনার বিবরণ শুনাতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীমাহীন অসহায়ত্বের এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি স্ব-চক্ষে প্রত্যক্ষ করে আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আনের বাঁদি।(২)
নিত্যদিনের অভ্যাস অনুযায়ী হামজা যখন শিকার থেকে ফিরছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আনের বাঁদি তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায় এবং অনুযোগের স্বরে ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলে। তার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের করুণ অভিব্যক্তি হামজাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ঘটনা শোনামাত্রই হামজার মাথায় রক্ত চড়ে বসে। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি দ্রুত পায়ে ছুটেন কাবার দিকে। এ যেন অন্য জগতের অন্য এক হামজা! আজ সে মাজলুম ভাতিজার পক্ষ থেকে জালিম আবু জাহেলের কাছে যাচ্ছে, কৃত জুলুমের প্রতিশোধ নিতে!
আবু জাহেলকে দেখামাত্রই নিজের ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত হানেন তার মাথায়। খুব খারাপভাবে আহত হয় আবু জাহেল। উপস্থিত সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে হামজার পানে। মুহাম্মাদ ﷺ-কে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে এই প্রথম আবু জাহেলের থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে কেউ। ইতিপূর্বে এত বড় স্পর্ধা কেউ দেখায়নি। তাই সেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাখযূম গোত্রের কিছু লোক আবু জাহেলের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে হামজার সামনে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে: কী ব্যাপার হামজা? বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করেছো মনে হচ্ছে! ক্ষিপ্ত হামজা উত্তর দিতে মোটেই বিলম্ব করলেন না-“সত্য প্রকাশিত হবার পর আমাকে তা থেকে বিরত রাখবে-এত বড় সাহস কার? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তিনি যা বলছেন, সত্যই বলছেন। আল্লাহর কসম, আমি আমার এই বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্রও টলবো না। তোমাদের সাহস থাকলে মোকাবিলায় আসো!” তাঁর এই সাহসী উচ্চারণে সকলের পিলে কেঁপে ওঠে। মোকাবিলার সাহস হয়নি কারো।
হযরত হামজা ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত, সম্মানিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সকলেই তাঁকে সীমাহীন সমীহ করে চলতো। তাঁর ইসলাম গ্রহণে মুমিনগণ যারপরনাই আনন্দিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে কাফেরদের বাড়াবাড়ি অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তাঁর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের ব্যাপারে জানতো না- মক্কায় এমন কেউ ছিলো না।
ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন:
মক্কার জমিনে ইসলাম প্রচারের কাজ একটা সময় এসে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মক্কার জমিন ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে মুমিনদের জন্য। কাফেরদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ইতিমধ্যেই শাহাদাত বরণ করেছেন বৃদ্ধা সাহাবী হযরত সুমাইয়া (রাঃ)। শি’আবে আবি তালিবে তিন বছরের কারাবাস, চাচা আবু তালিবের ইন্তিকাল, সহধর্মিণী হযরত খাদিজা রাঃ এর ইন্তিকাল, নির্যাতনে কাফেরদের নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন – সব মিলিয়ে মক্কার জমিন মুমিনদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেলো। পরিত্রাণের জন্য সাহাবায়ে কেরাম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। অবশেষে, মক্কা ত্যাগ করে মদীনার পথে হিজরত করার নির্দেশ এলো স্বয়ং রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকেই। এক এক করে সাহাবায়ে কেরাম মক্কা ছাড়তে আরম্ভ করলেন। পিছিয়ে থাকলে না হামজা (রাঃ)ও। মক্কার প্রভাব-প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা-সবকিছু বিসর্জন দিয়ে লাব্বাইক বললেন হিজরতের ডাকে। হিজরতের পর ধীরে ধীরে জিহাদের বিধান আসতে শুরু হলো। যে কুরআনে এতদিন পর্যন্ত ধৈর্য আর ক্ষমার কথা বাড় বাড় বলা হয়েছে, সে কুরআনেই এখন সশস্ত্র সংগ্রামের নির্দেশনা আসতে থাকলো।
মক্কাবাসীদের জীবন ছিলো ব্যবসা-নির্ভর। তাদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিলো শাম দেশ। মজার ব্যাপার হলো, ভৌগোলিকভাবে মদীনার অবস্থান ছিলো শাম এবং মক্কার মাঝপথে। ফলে,মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলাগুলোকে শামে যেতে হলে বা ফিরতে হলে, অনিবার্যভাবেই মদীনার পাশ কেটে যেতে হতো। তাদের অর্থনীতির মূলে আঘাত করার এটা ছিলো একটা মোক্ষম সুযোগ। মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা শাম দেশে কখন যায় আর কখন ফিরে- অতি সন্তর্পণে সে খবর রাখতে থাকেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হিজরতের সপ্তম মাস, পবিত্র রমাজান মাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারেন, তিন’শ জনের একটি ব্যাবসায়িক কাফেলা আবু জাহেলের নেতৃত্বে শাম দেশ থেকে ফিরছে৷ কাফেলাটি মদীনার অনতিদূর দিয়েই অতিক্রম করে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালক্ষেপণ না করে ত্রিশ জন মুহাজিরের(৩) একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং হামজা (রাঃ) এর নেতৃত্বে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। সমূদ্র-উপকূলীয় “ঈস” অঞ্চলের দিকে রওয়ানা হলো জিহাদী কাফেলা। ১৩ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে গেলেন সাহাবায়ে কেরাম রাঃ। তাঁদের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো প্রতিশোধের আগুন।
কাফেলাটি মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরম যত্নের সঙ্গে কালিমা খচিত একটি সাদা ঝাণ্ডা তুলে দেন হযরত হামজা (রাঃ) এর হাতে। ঐতিহাসিকদের মতে, এটাই ছিলো জিহাদের জন্য সর্বপ্রথম বাহিনী প্রেরণ এবং ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন।(৪) অসাধারণ বীরত্বের কল্যাণে যে গৌরব লাভ করেন হযরত হামজা রাঃ।
নির্ধারিত স্থানে উভয় বাহিনী সারিবদ্ধভাবে মুখোমুখি দাঁড়ায়। উভয় বাহিনীই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। একদিকে তিনশ মুশরিক। অপরদিকে ত্রিশজন সাহাবী, যাঁদের প্রত্যেকেই বুকভরা সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইস্পাত কঠিন প্রাচীরের ন্যায়। কিন্তু মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মাজদী ইবনে আমর জুহানী। যেহেতু সে উভয় পক্ষের হালীফ (মৈত্রীচুক্তিবদ্ধ) ছিলো, তাই সে উভয় বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। অবশেষে তার মধ্যস্থতায় উভয় বাহিনীর মাঝে সন্ধি হয়ে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এ ছাড়া “আবওয়া, উশাইরা ও বনু কাইনুকার যুদ্ধেও তিনি ইসলামের ঝাণ্ডা বহনের গৌরব অর্জন করেন।
হযরত হামজা রাঃ এর বীরত্ব ও শাহাদাত :
বদর ছিলো ইসলামী ইতিহাসের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ। ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো এই বদর যুদ্ধ৷
বদরের ময়দান তখন প্রস্তুত৷ একদিকে আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজারের বিশাল বাহিনী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত, অপরদিকে গুটিকতক সাহাবী, নগণ্য কিছু যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে রাসূল ﷺ-এর নেতৃত্বে দণ্ডায়মান। উভয় বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়ানো। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে তুমুল লড়াই৷ তৎকালীন নিয়ম ছিলো, মূল যুদ্ধের পূর্বে উভয় বাহিনীর বাছাই করা বীরদের দ্বারা সংঘটিত হতো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। সে অনুযায়ী কাফেরদের সারি থেকে উতবাহ, শাইবাহ ও ওয়ালিদ ইবনে উতবাহ বের হয়ে আসে এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহ্বান করে৷ মুসলিমদের সারি থেকে তিন আনসার সাহাবী, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, আউফ ও মুওয়াওবিয (রাঃ) সিংহের গর্জন ছেড়ে মাঠে আসেন। কিন্তু কুরাইশরা আনসারদের সাথে যুদ্ধ করাকে নিজেদের জন্য অপমানজনক মনে করছিলো। তাই উতবাহ হাঁক ছেড়ে বল্লো, ‘হে মুহাম্মাদ, আমাদের মোকাবিলায় আমাদের গোত্রের লোকদের পাঠাও।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশে হযরত হামজা, আলী ও উবাইদা ইবনে হারিস (রাঃ) মাঠে আসলেন। তারা শুধু নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। হযরত হামজা (রাঃ) যেনো বীরত্ব প্রকাশের এক অনুমপ সুযোগ পেয়ে গেলেন! ময়দানে এসেই তিনি শাইবার (৫) সামনে দাঁড়ান এবং এক আঘাতেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। তিন মুসলিম বীর মিলে কাফেরদের দম্ভ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সদর্পে ফিরে এলেন। অবশ্য, হযরত উবাইদা (রাঃ) পায়ে একটি আঘাত পেয়েছিলেন। যে আঘাতের কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
বদরের যুদ্ধে হযরত হামজা (রাঃ) নিজের পাগড়ির মধ্যে উটপাখীর পালক গুঁজে রেখেছিলেন। যার কারণে তিনি যে দিকেই যাচ্ছিলেন তাঁকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিলো। কাফেরদের বূহ্য ভেদ করে তিনি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। যে-ই সামনে পড়ছিলো তার উপরেই তিনি স্বীয় তরবারির ধার পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন। এক হামজার কারণেই কাফেররা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিলো। কাফেরদের জন্য তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ছিলেন। পেছনে লাশের সারি ফেলে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন বীরবিক্রমে।
উমাইয়া ইবনে খালফ আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে জিজ্ঞেস করেছিলো, উটপাখীর পালক ওয়ালা ওই ব্যক্তিটি কে? তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামজা। উমাইয়া বললো, আজকের যুদ্ধে এই ব্যক্তির কারণেই আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ হয়েছে।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয় উহুদ যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তর যুদ্ধ ছিলো এটি। নিয়ম অনুযায়ী এ যুদ্ধেও উসমান ইবনে আবু তালহা দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহবান করলে মুসলিম বাহিনী থেকে হযরত হামজা (রাঃ) বেরিয়ে আসেন। এক আঘাতেই প্রতিদ্বন্দ্বীর ইহলিলা সাঙ্গ করে দেন তিনি। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। কাফেরদের সারি তছনছ করে সামনে বাড়ছিলেন হযরত হামজা (রাঃ)। এ জন্য তাকে নিয়ে সবাই খুব পেরেশান ছিলো। যে দিকেই তিনি যাচ্ছিলেন, সেদিকেই শত্রুদের লাশের সারি পড়ে যাচ্ছিলো। তিনি যার উপরেই আঘাত করছিলেন, তাকেই মাটিতে পড়ে কাতরাতে দেখা যাচ্ছিলো। শাহাদাতের অমীয় সুধা তাকে যেনো তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো! উহুদের যুদ্ধে তিনি একাই কাফেরদের ত্রিশজনকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন।
হযরত হামজা (রাঃ) যেহেতু বদরের যুদ্ধে কাফেরদের বাছাবাছা সর্দারদের হত্যা করেছিলেন, তাই মক্কার সবাই তাঁর উপর ক্ষেপে ছিলো। তাঁর রক্তনেশায় উন্মাদ ছিলো সবাই৷ বদরের যুদ্ধে তুআইমা ইবনে আদী নিহত হয়েছিলো হামজা (রাঃ) এর হাতে। তুআইমার ভাতিজা জুবাইর ইবনে মুতয়িমের কৃতদাস ছিলো ওয়াহশী।(৬) জুবাইর তার কৃতদাস ওয়াহশীকে বলেছিলো, মুহাম্মাদের চাচা হামজাকে হত্যা করতে পারলে তোমাকে আযাদ করে দিবো।
ওয়াহশীর ভাষায়, ‘আমি শুধু হামজাকে হত্যা করতেই উহুদের ময়দানে গিয়েছিলাম। একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে হামজার গতিবিধি লক্ষ করছিলাম৷ হঠাৎ সিবা ইবনে আব্দুল উযযাকে দেখতে পেলাম, “আছে কি কেউ, আমার সাথে লড়বে?”- বলতে বলতে আমার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। তাকে দেখেই হামজা এই বলতে বলতে তেড়ে আসলেন “আরে ওই আরব্য নারীদের খতনাকারী মহিলার অপবিত্র সন্তান,(৭) তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে! আয় সামনে আয়!” এই বলেই তিনি তাকে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উযযার অপবিত্র দেহকে রক্ত আর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখা গেলো এবং কিছুক্ষণ পরেই তার নাপাক আত্মা ইহকাল ত্যাগ করলো। আমি আমার বর্শাটা নেড়েচেড়ে নিলাম এবং সুযোগ বুঝে তা ছুঁড়ে মারলাম। বর্শাটি হামজার নাভিতে বিদ্ধ হলো। মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর তলপেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে বর্শা বেরিয়ে গেলো। আহত সিংহের ন্যায় প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে তিনি ছুটে আসতে চাইলেন আমার দিকে। কিন্তু পারলেন না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসলো তাঁর সমস্ত শরীর। মুহূর্ত কয়েক পরেই চিরদিনের মত মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তাঁর অবশ দেহ। বীরত্বের ইতিহাস রচনা করে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিলেন হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)।
তারপর আমি ওঠে গিয়ে আমার বর্শাটা কুড়িয়ে নিলাম এবং আমার স্থানে এসে বসে গেলাম। আমার আর যুদ্ধ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কারণ আমি তো শুধু আযাদ হওয়ার লোভেই ময়দানে এসেছিলাম! এরপর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবা(৮) হযরত হামজা (রাঃ) এর লাশ বিকৃত করে। তার নাক, কান, গলা কেটে মালা বানায়। তার পেট চিড়ে কলিজা বের করে চিবাতে থাকে। কিন্তু গিলতে না পেরে শেষে ফেলে দেয়।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, যুদ্ধ শেষ হলে সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে জড়ো হচ্ছিলেন। কিন্তু হামজাকে দেখা যাচ্ছিলো না। আমি বললাম, আমি হামজাকে অমুক গাছের নিকট এই কথাগুলো বলতে শুনেছিলাম:
أنا أسد الله و أسد رسوله
“আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিংহ”
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিকে অগ্রসর হলেন। যখন হামজা (রাঃ) এর কপাল দেখতে পেলেন তখন কাঁদতে শুরু করলেন। আর যখন তাঁর বিকৃত লাশ দেখলেন, তখন হেঁচকি তুলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন:
عن جابر بن عبدالله: سيدُ الشهداءِ عندَ اللهِ يومَ القيامةِ حمزةُ بنُ عبدِ المطلبِ.
কিয়ামতের দিন, আল্লাহ তা’আলার দরবারে শহীদকুলের সর্দার আখ্যায়িত হবেন হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। (আল জামিউস সাগীর-৪৭৩০)
তিনি আরো ইরশাদ করেন:
رحمةُ اللهِ عليكَ، لقد كنتَ وصولًا للرحمِ، فعولًا للخيرِ،
হে চাচা! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন, বেশি বেশি ভালো কাজ করতেন!(ফাতহুল বারী-৭/৪৩০,)
তিনি আরো বলেন, যদি সাফিয়্যা (৯) এবং অন্য মহিলাদের শোক আর দুঃখের কথা না ভাবতাম এবং পরবর্তীরা এর উপর আমল শুরু করবে এই ভয় না হতো, তাহলে আপনাকে এভাবেই ফেলে রাখতাম যেনো, পশু-পখী আপনাকে খেয়ে ফেলে এবং হাশরের ময়দানে আপনি পশু-পখীর পেট থেকে বের হয়ে আসেন!
আপন চাচার বিকৃত লাশ দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত রাগান্বিত হয়েছিলেন যে, তিনি বলেছিলেন:
“لَئِنْ ظَهَرْنَا عَلَيْهِمْ لَنُمَثِّلَنَّ بِثَلَاثِينَ رَجُلًا مِنْهُمْ” فَلَمَّا سَمِعَ الْمُسْلِمُونَ ذَلِكَ قَالُوا: وَاللَّهِ لَئِنْ ظَهَرْنَا عَلَيْهِمْ لَنُمَثِّلَنَّ بِهِمْ مُثْلَةً لَمْ يُمَثِّلْهَا أَحَدٌ مِنَ الْعَرَبِ بِأَحَدٍ قَطُّ.
“যদি আমরা তাদের উপর বিজয়ী হতে পারি, তাহলে তাদের ত্রিশজনকে এভাবে বিকৃত করবো।”(১০) এটা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, আমরা তাদের উপর বিজয়ী হলে, তাদেরকে এমনভাবে বিকৃত করবো, আজ পর্যন্ত যা আরবের কেউ কাউকেই করেনি!”
কিন্তু রাহমানুর রহীম আল্লাহ তা’আলা আপন বান্দাদের প্রতি দয়া দেখালেন। তাই হযরত জিবরীল (আঃ)-কে দিয়ে সূরা আন-নাহলের ১২৫-১২৬ নং আয়াত নাজিল করলেন। যেখানে ইরশাদ হয়েছে:
وَاِنۡ عَاقَبۡتُمۡ فَعَاقِبُوۡا بِمِثۡلِ مَا عُوۡقِبۡتُمۡ بِہٖ ؕ وَلَئِنۡ صَبَرۡتُمۡ لَہُوَ خَیۡرٌ لِّلصّٰبِرِیۡنَ
আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করো, তাহলে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ-ই গ্রহণ করো, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। আর যদি সবর করো, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।(সূরা আন নাহল, আয়াত নং-১২৬)
এরপর সাহাবায়ে কেরাম রাঃ কসমের কাফফারা দেন।
হযরত হামজা (রাঃ)-কে একটি চাদর দিয়ে কাফন পরানো হয়। এটি এত ছোট ছিলো যে, পা ঢাকলে মাথা খালি হয়ে যেতো আর মাথা ঢাকলে পা খালি হয়ে যেতো। তাই মাথার দিকে চাদর দিয়ে পায়ের উপর ঘাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
উহুদের শহীদদের মধ্যে প্রত্যেক দু’জনকে একটি করে কবরে দাফন করা হয়৷ সেইমতে হযরত হামজা ও আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশকে (রাঃ) এক কবরে দাফন করা হয়।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা এটি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো ষাটের কাছাকাছি।
হযরত জাবির (রাঃ) বলেন: যেদিন হযরত মু’আবিয়া রাঃ উহুদে কূপ খনন করেছিলেন সেদিন আমরা উহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করেছিলাম। শহীদদের আমরা পূর্ণ তাজা অবস্থায় পেয়েছিলাম। এক ব্যক্তি হযরত হামজা রাঃ এর পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।
প্রাপ্ত শিক্ষা:
১. রাসূলুল্লাহ ﷺ হযরত হামজা (রাঃ) এর ছোট ছিলেন এবং ভাতিজা ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সর্বক্ষেত্রে রাসূল ﷺ-কে মান্য করেছেন। তাই দ্বীন ও জিহাদের পথে চলতে কখনো যদি আমাদের ছোট কাউকে আমীর বানানো হয় তাহলেও তা মানতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়। হাল যামানায় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, শাইখ উসামা এবং শাইখ যাওয়াহিরী। শাইখ যাওয়াহিরী শাইখ উসামার চেয়ে সাত বছরের বড় হয়েও তাকে মেনে চলেছেন।
২. জালিমকে কখনো ছাড় দিতে নেই; সে আমার গোত্রের সর্দারই হোক না কেনো! যেমন আবু জাহেলকে ছাড় দেননি হযরত হামজা (রাঃ)।
৩. সত্য প্রকাশিত হবার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা উচিৎ নয়। সত্য(নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেও-)গ্রহণের যোগ্যতা আল্লাহ তা’আলার অনেক বড় নিয়ামত।
৪.নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা কখনোই আল্লাহ তা’আলার সত্য দ্বীনের পথে বাধা হতে পারে না! হযরত হামজা (রাঃ) এ সব ছেড়েই হিজরত করেছিলেন।
৫.যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো, শত্রুকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। সামরিক শক্তিতে শত্রুকে পরাজিত করতে এই কৌশলটির গুরুত্ব অপরিসীম।
৬.কখনো কখনো শহীদদের লাশ পঁচে না, শহীদের কবরে সাওয়াল-জবাব নেই, তাঁর মৃত্যুর কষ্ট হবে পিঁপড়ার কামর বা তাঁর থেকেও কম, আর শহীদের রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার আগেই তাঁর জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। এসকল কারণে শহীদ হওয়ার তীব্র বাসনা হৃদয়ে লালন করা।
নোটঃ
(১) কারো কারো মতে চার বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু দু’বছরের মতটিই প্রাধান্যযোগ্য।
(২)আব্দুল্লাহ ইবনে যাদ’আন মক্কার একজন দানশীল ব্যক্তি ছিলো। কিন্তু ইসলাম নসীব হয়নি। তার বাঁদিও ইসলাম গ্রহণ করেনি।
(৩)এই যুদ্ধে কোন আনসারী সাহাবী ছিলেন না। যদিও কেউ কেউ এই দাবি করেছেন! তাদের দাবিটি দুর্বল। কেননা, আনসারগণ মদীনার ভেতরে থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেফাজত করার উপর বাইয়াত দিয়েছিলেন।
(৪) কারো কারো মতে হযরত উবাইদা ইবনুল হারিস (রাঃ) এর অভিযান ছিলো ইসলামের প্রথম অভিযান। এবং তিনিই সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন করেন।
(৫) কেউ কেউ মনে করেন, হযরত হামজা (রাঃ) উতবাহকে আর হযরত উবাইদাহ (রাঃ) শাইবাকে হত্যা করেছেন।
(৬)ওয়াহশী ইবনে হারব। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে হামজা (রাঃ) কে হত্যা করার বিস্তারিত ঘটনা শুনেছিলেন। এরপর বলেছিলেন, তুমি কখনো আমার সামনে এসো না, তোমাকে দেখলে আমার চাচার কথা মনে পড়ে। পরে ভণ্ড নবী মুসাইলামাতুল কাযযাবকে হত্যা করার মাধ্যমে তিনি হামজা (রাঃ)-কে হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।
(৭) সিবার মা “উম্মে আনমার” নারীদের খৎনা করাতো।
(৮)আবু সুফিয়ান ও হিন্দা, তারা উভয়েই ফাতহে মক্কার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
(৯)সাফিয়্যাহ ছিলেন হযরত হামজা (রাঃ) এর সহোদরা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু।
(১০)কোনো কোনো রেওয়াতে ৭০ জনের কথাও এসেছে।
লেখক: মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্রঃ
১. সীরাতে ইবনে হিশাম।
২. সীরাতে ইবনে ইসহাক।
৩. মাগাযীয়ে ওয়াক্বিদী।
৪. যা-দুল মা’আদ।
৫.তাফসীরে ইবনে কাসীর।
৬.হায়াতুস সাহাবা।
৭.সীরাতে মুস্তফা।
Comment