বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৪।। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [তৃতীয় কিস্তি]
কুরাইশ নেতা উমাইহা ইবনে খালফের মৃত্যু
উমাইয়া ইবনে খালফ কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ও সর্দারদের একজন ছিল। মক্কার জীবনে রাসূলকে অনেক কষ্ট দিত। বদর যুদ্ধের অনেক পূর্বে একবার হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহুর থেকে নিজ মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী শুনেছিল। সা’দ ইবনে মুয়ায (রাঃ) তাকে বলেছিলেন, আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে, তুমি মুসলিমদের হাতেই নিহত হবে। এ কারণে যখন মক্কার বাহিনী বের হচ্ছিল তখন সে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আবু জাহলের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে আসতে বাধ্য হয়।উমাইয়া ছিল প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুনিব। মক্কায় থাকাকালীন হযরত বিলাল (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করার কারণে উমাইয়া ইবনে খালফ তাঁকে সীমাহীন কষ্ট দিত। বুকের উপর বিশাল একখণ্ড পাথর চেপে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে রাখত।বদর যুদ্ধে কাফেররা যখন সমানে মারা পড়ছিল তখন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) উমাইয়া ও তার ছেলের হাত ধরে। কারণ তিনি উমাইয়ার বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাই তিনি উমাইয়াকে হত্যা না করে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন বিলাল (রাঃ) উমাইয়াকে দেখলেন তখন চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কুরাইশ-নেতা উমাইয়াকে ধরো! সে যদি বেঁচে যায় তাহলে আমি বাঁচব না!!’ এই আওয়াজ শুনতেই আনসারগণ দৌড়ে আসলেন। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) উমাইয়ার ছেলেকে আনসারদের হাতে ছেড়ে দিলেন, যেন তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হন এবং উমাইয়ার পেছনে না পড়েন। আনসারগণ তাকে হত্যা করে আবার উমাইয়ার পেছনে দৌড়ালেন। হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ) উমাইয়ার উপর শুয়ে পড়লেন, যেন আনসাররা তাকে হত্যা করতে না পারে। কিন্তু আনসাররা আব্দুর রহমানের পায়ের নিচ দিয়ে তরবারি ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এতে আব্দুর রহমান (রাঃ) এর পায়েও চোট লেগেছিল।
কমবখত আবু জাহলের মৃত্যু
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) বর্ণনা করেন, “বদর যুদ্ধে আমি যুদ্ধের কাতারে দাঁড়ানো ছিলাম। হঠাৎ দেখি দুই কিশোর সাহাবী আমার দু’পাশে এসে দাঁড়াল। তারা হল, হযরত মুয়ায ইবনে আফরা ও মুয়ায ইবনে আমর (রাঃ)। [৬] তাদের একজন আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা! আবু জাহলটা কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি তাকে দিয়ে কী করবে?’ সে বলল, ‘আমি শুনেছি সে রাসূলকে খুব কষ্ট দিত। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তাকে দেখামাত্রই আমি তাকে হত্যা করব। আল্লাহর ক্বসম! তাকে দেখার পর আমার ছায়া তার ছায়া থেকে কিছুতেই আলাদা হবে না যতক্ষণ না আমি তাকে হত্যা করি বা শাহাদাত লাভ করি।’ আমি হাতের ইশারায় আবু জাহলকে দেখিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে তারা সেদিকে দৌড়ে গেল এবং আবু জাহলকে ধরাশায়ী করে ফেলল।”মুয়ায ইবনে আমর (রাঃ) যখন আবু জাহলের উপর আঘাত করেন তখন আবু জাহলের ছেলে ইকরিমাহ পিতার সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং মুয়ায ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহুতে সজোরে আঘাত করে। ফলে তাঁর বাহু কেটে যায়। কিন্তু একটু চামড়া অবশিষ্ট ছিল বিধায় তা ঝুলছিল। পরবর্তীতে এই হাতটির কারণে যুদ্ধ করতে তাঁর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছিল, তাই হাতটি পায়ের নিচে ধরে এক টানে চামড়ার অবশিষ্ট অংশ ছিড়ে ফেলেন এবং এভাবেই সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকেন। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে তিনি ইন্তিকাল করেন। [৭]যুদ্ধ তখন শেষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেউ আবু জাহলের খবর নিয়ে আসো। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু জাহলের খোঁজে বের হলেন। তখনো আবু জাহলের জীবন প্রদীপ কিছুটা বাকি ছিল। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল সে।আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমি তার বুকের উপর বসলাম। আবু জাহল চোখ খোলে আমাকে বলল, ‘হে রাখাল! তুই তো অনেক উঁচু স্থানে বসে গেছিস! এত উঁচু স্থানে ইতিপূর্বে কেউ বসতে পারেনি!’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর শোকর।’ তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন দল বিজয়ী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিজয়ী হয়েছেন।’ এরপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখন তোর কী ইচ্ছা?’
আমি বললাম, ‘তোর গর্দান কেটে নিতে এসেছি৷’
সে বলল, ‘আচ্ছা! এই যে আমার তরবারি! এটা খুব ধারালো, দ্রুত তোর উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করবে। আমার মাথা কাটার সময় গলার নিচের অংশ থেকে কাটিস, যেন মাথাটা বড় দেখায়। কেউ দেখলেই যেন বুঝতে পারে এটা কুরাইশদের সর্দারের মাথা। আর মুহাম্মাদকে বলে দিস, আমি ইতিপূর্বে তার প্রতি যতটুকু বিদ্বেষ রাখতাম আজকে তা আরো বৃদ্ধিই পেয়েছে।’এরপর তিনি কমবখতের গর্দান কেটে রাসূলের পায়ের কাছে রাখেন এবং তার আখেরি পয়গামও পৌঁছে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এটা আমার উম্মতের ফেরাউন ছিল। বনী ইসরায়েলের ফেরাউনও তো মরতে সময় ঈমানের কালিমা পড়তে চেয়েছিল কিন্তু আমার উম্মতের এই ফেরাউন মরতে সময়ও কুফুরী করতে করতেই মরেছে।”যুদ্ধের ফলাফল
দ্বিতীয় হিজরির ১৭-এ রমাদানের এই মহান যুদ্ধে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের সম্মানজনক বিজয় দান করেছেন। আর কাফের ও মুশরিকদের করেছেন লাঞ্ছিত, অপদস্ত। এ দিনে ১৪ জন মুসলিম পান করেছেন শাহাদাতের অমিয় সুধা। এরমধ্যে ৬ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবী আর ৮ জন ছিলেন আনসার। মুশরিকদের ৭০ জন নিহত আর ৭০ জন বন্দী হয়। কুরাইশদের বড় বড় ২৪ জন নেতা এই যুদ্ধে নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে হিজরতের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ জন নেতার ১১ জন নেতাও ছিল। তাদের মৃতদেহ একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলিমরা পর্যাপ্ত গনীমতপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তিনদিন ময়দানে অবস্থান করে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসেন।
বন্দীদের ব্যাপারে নমনীয়তা: আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তিরস্কার
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৭০ জন যুদ্ধবন্দী নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন, যাদের মধ্যে তাঁর আপন চাচা আব্বাসও আছেন। ৭০ জনকে আনসারদের মাঝে বণ্টন করে দেন এবং সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে রাখেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ পেয়ে আনসার সাহাবীদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা প্রথমেই বন্দীদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন, এরপর কিছু থাকলে নিজেরা খেতেন। না হলে খেজুর খেয়ে দিনাতিপাত করতেন। বন্দীদের প্রতিও যে এত সুন্দর আচরণ করা যায়, তা কল্পনাও করতে পারত না কুরাইশ বন্দীরা। বন্দীদের সাথে মুসলিদের এমন উত্তম আচরণে প্রভাবিত হয়ে বন্দীদের অনেকেই পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। [৮]এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বসলেন বন্দীদের ব্যপারে পরামর্শ করতে। প্রথমেই হযরত উমর (রাঃ) নিজের মত পেশ করলেন এভাবে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এদের প্রত্যেকের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হোক৷ এরা সবাই কাফেরদের সর্দার!”তার এই মতটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনঃপূত হল না। তিনি আবারও পরামর্শ চাইলেন। এবারও হযরত উমরের সেই একই মত, এদের প্রত্যেকের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হোক। এবং সবাই নিজের আপনজনের গর্দান উড়াবে। আলীকে আদেশ দেওয়া হোক তার ভাই আকীলের গর্দান উড়াতে। আমরা আল্লাহ তা’আলাকে দেখিয়ে দিতে চাই যে, আল্লাহর ভালোবাসার সামনে দুনিয়ার আপনদের হত্যা করতেও কুণ্ঠিত নই আমরা।
কিন্তু হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত ছিল কিছুটা সহানুভূতিপূর্ণ। তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা তো আমাদেরই ভাই, আত্মীয়-স্বজন। আমরা তাদের থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিতে পারি, হয়তো আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ইসলামের জন্য কবুল করে নিবেন৷”এই মতটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনঃপূত হল। তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই সহানুভূতিপূর্ণ মতের উপর নিজের সিন্ধান্ত শুনিয়ে দিলেন। প্রত্যেকের থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এই মতটি হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত আল্লাহ তা’আলারও পছন্দ ছিল না। তাই আল্লাহ তা’আলা এই মর্মে পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল করে সতর্ক করলেন :مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہٗۤ اَسۡرٰی حَتّٰی یُثۡخِنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ تُرِیۡدُوۡنَ
عَرَضَ الدُّنۡیَا ٭ۖ وَاللّٰہُ یُرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ؕ وَاللّٰہُ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ.
لَوۡلَا کِتٰبٌ مِّنَ اللّٰہِ سَبَقَ لَمَسَّکُمۡ فِیۡمَاۤ اَخَذۡتُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ.
“কোনো নবীর জন্য এটা উচিত না যে, তাঁর হাতে যুদ্ধবন্দী থাকবে, কিন্তু তাদের হত্যা করে তিনি জমিনে রক্ত প্রবাহিত করবেন না! তোমরা পার্থিব সম্পদ কামনা কর, অথচ আল্লাহ তা’আলা আখেরাতের কল্যাণ চান। আল্লাহ তা’আলা মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
যদি পূর্ব থেকেই লিখিত একটি বিষয় না হত, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ সেজন্য ভয়াবহ আযাব তোমাদেরকে স্পর্শ করত।” (সূরা আনফাল, আয়াত নং-৬৭-৬৮)
এই আয়াতদ্বয় নাযিল হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর (রাঃ) কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর বলতে থাকেন, “আজকে যদি আযাব এসেই যেত, তাহলে এক উমর ছাড়া আর কেউ রক্ষা পেত না।” [৯]সবশেষে বন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিন্ধান্তই বলবত থাকে। আল্লাহ তা’আলা হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে রাসূলকে জানিয়ে দেন যে, আজকে তোমাদের এই ৭০ জনকে ছেড়ে দেওয়ার কারণে আগামী বছর তোমাদের ৭০ জনকে জীবন দিতে হবে। এটা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেন এবং বলেন, “আল্লাহ তা’আলা আমাদের থেকে যাকে চাইবেন তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দিবেন।”
এভাবেই ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযানের সমাপ্তি ঘটে। শত শত বছর ধরে চলতে থাকা কুফুর-শিরকের একচ্ছত্র আধিপত্যে এই প্রথম আঘাত লাগে। শত বছরের কুফুরী বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে ঈমান ও কুফুরের প্রথম লড়াই। এর মাধ্যমেই কুফুরী সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
সেদিন থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে ঈমান ও কুফুরের এই লড়াই। এই উম্মাহর শেষ বাহিনী দাজ্জালের সাথে লড়াই করা পর্যন্ত চলতে থাকবে হক্ব ও বাতিলের এই লড়াই। এই অবিশ্বাস্য বিজয়ের ফলে আরবের ভূমিতে ইসলামের প্রচার একটি নতুন মাত্রায় উপনীত হয়। এক কান থেকে অপর কানে পৌঁছতে থাকে ইসলামের নতুন শক্তির অভ্যুদয়-বার্তা। ফলশ্রুতিতে মানুষের মাঝে ইসলামকে জানার কৌতুহল জাগতে থাকে। ইসলামকে জানতে গিয়ে তারা জানতে পারে ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্যের কথা, জানতে পারে ন্যায় ও ইনসাফের নীতিমালা। আর তখন তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হতে থাকে ইসলামের মাহাত্ম্য। দিক্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত। পৃথিবী অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে, এক নতুন বিশ্ব-পরাশক্তির। সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
বদরের চেতনাকে আমরা কোনদিকে প্রবাহিত করছি?
গাযওয়ায়ে বদর যুগে যুগে উম্মাহকে জিহাদের পথে পরিচালিত করেছে। বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত করেছে। উম্মাহর জীবনে যখন দুর্দিন নেমে আসত, তখন উম্মাহর উলামায়ে কেরাম জাতিকে বদরের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করতেন। ইতিহাস থেকে আমরা এমনটাই জানতে পারি।কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য আজ এটাই যে, হাল যামানার মুসলিম উম্মাহ যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাফের-মুশরিকদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যখন বদরের চেতনাকে পুঁজি করে আমাদের করণীয় ছিল একটি শক্তিশালী বদরী বাহিনী গড়ে তোলা এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া, তখন আমরা বদরের চেতনাকে ব্যবহার করছি অর্থ কালেকশনের কাজে। “বদরী কমিটি” নামে ডোনারদের তালিকা করছি। আর সেই বদরী কমিটিতে স্থান পাচ্ছে এমন সব লোক, যারা জানেইনা যে বদরী বাহিনী কারা ছিল। বদরী বাহিনীর ফজীলতই বা কী? আর কী কারণেই বা তাদের এই ফজীলত লাভ হল? এই বদরী কমিটিতে এমন লোকের নামও দেখা যায়, যারা বদরের প্রকৃত চেতনাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এবং সরাসরি বদরের প্রকৃত চেতনাকে নির্মূল করতে মাঠে-ময়দানে কাজ করে। আমাদের তো শুধু অর্থের প্রয়োজন, সেই প্রয়োজন পূরণে যদি বদরের চেতনাকে ধ্বংসের মিশনে লিপ্ত এমন কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে তাতে তেমন কি আর সমস্যা?যারা বদর কমিটির সদস্য হয় তাদের সামনে কখনো খুলে বলা হয়নি, বদর কী জিনিস? বদরের প্রকৃত চেতনা কী হওয়া উচিত ছিল? তাদের বলা হয়নি কখনো, বদরের চেতনা আমাদের থেকে কী ধরনের কুরবানী চায়? তাদেরকে মাসিক বা বাৎসরিক কিছু অনুদানের বিনিময়েই দেখানো হয়েছে বদরীদের মর্যাদা লাভের লোভ। অথচ তারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।বদরের সেই সু-মহান কুরবানী-স্পৃহাকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি? যে চেতনা দিয়ে কুফরের মজবুত মেরুদণ্ড ভেঙে, পুরা বিশ্ব জয় করা সম্ভব ছিল সেই চেতনাকে আমরা এ কোন দিকে প্রবাহিত করছি? এভাবেই কাফেররা আমাদের মানসিকতা সঙ্কীর্ণ থেকে আরও সঙ্কীর্ণ করেছে আর তারা নিশ্চিন্তে বিশ্বের ক্ষমতা ভোগদখল করে রেখেছে। আমাদের ভয় হয়, যদি অবস্থা এভাবেই চলতে থাকে তাহলে একটা সময় এসে মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে যে, “রাসূলের যুগে বদর নামে হয়তো কোনো মাদরাসা ছিল আর সেই মাদরাসায় যারা দান করত তাদেরকে বলা হতো বদরী কমিটি”!
২০০১ সালে আফগানিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসে তালিবানের হাতে বন্দী হন একজন ব্রিটিশ সাংবাদিকা ও প্রাক্তন রেস্পেক্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী “ইভন রিডলি” (Yvonne Ridley), বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেন দশ দিন পর। এরপর তিনি নিজ দেশে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তালেবানের হাতে বন্দী হওয়াকে তিনি নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করেন এবং “ইন দ্যা হেন্ডস অব তালিবান” নামে একটি বই লিখেন।তেমনিভাবে, ২০১৮ সালের নভেম্বরে আল কায়েদার সোমালিয়ান শাখা হারাকাতুশ শাবাবের হাতে বন্দী হন সিলভিয়া রোমানো নামক একজন ইতালিয়ান স্বেচ্ছাসেবিকা। কেনিয়া থেকে বন্দী হওয়ার পর ১৮ মাস পর্যন্ত তিনি আশ-শাবাবের হাতে বন্দী জীবন-যাপন করেন। এই ১৮ মাসে তিনি ইসলামকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে বন্দীদের প্রতি মুসলিমদের সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি স্বেচ্ছায় স্ব-প্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজের নাম পালটে “সিলভিয়া আয়েশা” নাম রাখেন।[৯] অন্য এক রেওয়াতে এসেছে হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথাও এসেছে। কারণ তিনিও বন্দীদের হত্যা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
২।বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
৩।বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
কুরাইশ নেতা উমাইহা ইবনে খালফের মৃত্যু
উমাইয়া ইবনে খালফ কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ও সর্দারদের একজন ছিল। মক্কার জীবনে রাসূলকে অনেক কষ্ট দিত। বদর যুদ্ধের অনেক পূর্বে একবার হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহুর থেকে নিজ মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী শুনেছিল। সা’দ ইবনে মুয়ায (রাঃ) তাকে বলেছিলেন, আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে, তুমি মুসলিমদের হাতেই নিহত হবে। এ কারণে যখন মক্কার বাহিনী বের হচ্ছিল তখন সে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আবু জাহলের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে আসতে বাধ্য হয়।উমাইয়া ছিল প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুনিব। মক্কায় থাকাকালীন হযরত বিলাল (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করার কারণে উমাইয়া ইবনে খালফ তাঁকে সীমাহীন কষ্ট দিত। বুকের উপর বিশাল একখণ্ড পাথর চেপে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে রাখত।বদর যুদ্ধে কাফেররা যখন সমানে মারা পড়ছিল তখন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) উমাইয়া ও তার ছেলের হাত ধরে। কারণ তিনি উমাইয়ার বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাই তিনি উমাইয়াকে হত্যা না করে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন বিলাল (রাঃ) উমাইয়াকে দেখলেন তখন চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কুরাইশ-নেতা উমাইয়াকে ধরো! সে যদি বেঁচে যায় তাহলে আমি বাঁচব না!!’ এই আওয়াজ শুনতেই আনসারগণ দৌড়ে আসলেন। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) উমাইয়ার ছেলেকে আনসারদের হাতে ছেড়ে দিলেন, যেন তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হন এবং উমাইয়ার পেছনে না পড়েন। আনসারগণ তাকে হত্যা করে আবার উমাইয়ার পেছনে দৌড়ালেন। হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ) উমাইয়ার উপর শুয়ে পড়লেন, যেন আনসাররা তাকে হত্যা করতে না পারে। কিন্তু আনসাররা আব্দুর রহমানের পায়ের নিচ দিয়ে তরবারি ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এতে আব্দুর রহমান (রাঃ) এর পায়েও চোট লেগেছিল।
কমবখত আবু জাহলের মৃত্যু
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) বর্ণনা করেন, “বদর যুদ্ধে আমি যুদ্ধের কাতারে দাঁড়ানো ছিলাম। হঠাৎ দেখি দুই কিশোর সাহাবী আমার দু’পাশে এসে দাঁড়াল। তারা হল, হযরত মুয়ায ইবনে আফরা ও মুয়ায ইবনে আমর (রাঃ)। [৬] তাদের একজন আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা! আবু জাহলটা কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি তাকে দিয়ে কী করবে?’ সে বলল, ‘আমি শুনেছি সে রাসূলকে খুব কষ্ট দিত। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তাকে দেখামাত্রই আমি তাকে হত্যা করব। আল্লাহর ক্বসম! তাকে দেখার পর আমার ছায়া তার ছায়া থেকে কিছুতেই আলাদা হবে না যতক্ষণ না আমি তাকে হত্যা করি বা শাহাদাত লাভ করি।’ আমি হাতের ইশারায় আবু জাহলকে দেখিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে তারা সেদিকে দৌড়ে গেল এবং আবু জাহলকে ধরাশায়ী করে ফেলল।”মুয়ায ইবনে আমর (রাঃ) যখন আবু জাহলের উপর আঘাত করেন তখন আবু জাহলের ছেলে ইকরিমাহ পিতার সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং মুয়ায ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহুতে সজোরে আঘাত করে। ফলে তাঁর বাহু কেটে যায়। কিন্তু একটু চামড়া অবশিষ্ট ছিল বিধায় তা ঝুলছিল। পরবর্তীতে এই হাতটির কারণে যুদ্ধ করতে তাঁর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছিল, তাই হাতটি পায়ের নিচে ধরে এক টানে চামড়ার অবশিষ্ট অংশ ছিড়ে ফেলেন এবং এভাবেই সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকেন। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে তিনি ইন্তিকাল করেন। [৭]যুদ্ধ তখন শেষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেউ আবু জাহলের খবর নিয়ে আসো। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু জাহলের খোঁজে বের হলেন। তখনো আবু জাহলের জীবন প্রদীপ কিছুটা বাকি ছিল। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল সে।আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমি তার বুকের উপর বসলাম। আবু জাহল চোখ খোলে আমাকে বলল, ‘হে রাখাল! তুই তো অনেক উঁচু স্থানে বসে গেছিস! এত উঁচু স্থানে ইতিপূর্বে কেউ বসতে পারেনি!’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর শোকর।’ তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন দল বিজয়ী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিজয়ী হয়েছেন।’ এরপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখন তোর কী ইচ্ছা?’
আমি বললাম, ‘তোর গর্দান কেটে নিতে এসেছি৷’
সে বলল, ‘আচ্ছা! এই যে আমার তরবারি! এটা খুব ধারালো, দ্রুত তোর উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করবে। আমার মাথা কাটার সময় গলার নিচের অংশ থেকে কাটিস, যেন মাথাটা বড় দেখায়। কেউ দেখলেই যেন বুঝতে পারে এটা কুরাইশদের সর্দারের মাথা। আর মুহাম্মাদকে বলে দিস, আমি ইতিপূর্বে তার প্রতি যতটুকু বিদ্বেষ রাখতাম আজকে তা আরো বৃদ্ধিই পেয়েছে।’এরপর তিনি কমবখতের গর্দান কেটে রাসূলের পায়ের কাছে রাখেন এবং তার আখেরি পয়গামও পৌঁছে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এটা আমার উম্মতের ফেরাউন ছিল। বনী ইসরায়েলের ফেরাউনও তো মরতে সময় ঈমানের কালিমা পড়তে চেয়েছিল কিন্তু আমার উম্মতের এই ফেরাউন মরতে সময়ও কুফুরী করতে করতেই মরেছে।”যুদ্ধের ফলাফল
দ্বিতীয় হিজরির ১৭-এ রমাদানের এই মহান যুদ্ধে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের সম্মানজনক বিজয় দান করেছেন। আর কাফের ও মুশরিকদের করেছেন লাঞ্ছিত, অপদস্ত। এ দিনে ১৪ জন মুসলিম পান করেছেন শাহাদাতের অমিয় সুধা। এরমধ্যে ৬ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবী আর ৮ জন ছিলেন আনসার। মুশরিকদের ৭০ জন নিহত আর ৭০ জন বন্দী হয়। কুরাইশদের বড় বড় ২৪ জন নেতা এই যুদ্ধে নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে হিজরতের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ জন নেতার ১১ জন নেতাও ছিল। তাদের মৃতদেহ একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলিমরা পর্যাপ্ত গনীমতপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তিনদিন ময়দানে অবস্থান করে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসেন।
বন্দীদের ব্যাপারে নমনীয়তা: আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তিরস্কার
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৭০ জন যুদ্ধবন্দী নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন, যাদের মধ্যে তাঁর আপন চাচা আব্বাসও আছেন। ৭০ জনকে আনসারদের মাঝে বণ্টন করে দেন এবং সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে রাখেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ পেয়ে আনসার সাহাবীদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা প্রথমেই বন্দীদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন, এরপর কিছু থাকলে নিজেরা খেতেন। না হলে খেজুর খেয়ে দিনাতিপাত করতেন। বন্দীদের প্রতিও যে এত সুন্দর আচরণ করা যায়, তা কল্পনাও করতে পারত না কুরাইশ বন্দীরা। বন্দীদের সাথে মুসলিদের এমন উত্তম আচরণে প্রভাবিত হয়ে বন্দীদের অনেকেই পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। [৮]এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বসলেন বন্দীদের ব্যপারে পরামর্শ করতে। প্রথমেই হযরত উমর (রাঃ) নিজের মত পেশ করলেন এভাবে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এদের প্রত্যেকের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হোক৷ এরা সবাই কাফেরদের সর্দার!”তার এই মতটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনঃপূত হল না। তিনি আবারও পরামর্শ চাইলেন। এবারও হযরত উমরের সেই একই মত, এদের প্রত্যেকের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হোক। এবং সবাই নিজের আপনজনের গর্দান উড়াবে। আলীকে আদেশ দেওয়া হোক তার ভাই আকীলের গর্দান উড়াতে। আমরা আল্লাহ তা’আলাকে দেখিয়ে দিতে চাই যে, আল্লাহর ভালোবাসার সামনে দুনিয়ার আপনদের হত্যা করতেও কুণ্ঠিত নই আমরা।
কিন্তু হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত ছিল কিছুটা সহানুভূতিপূর্ণ। তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা তো আমাদেরই ভাই, আত্মীয়-স্বজন। আমরা তাদের থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিতে পারি, হয়তো আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ইসলামের জন্য কবুল করে নিবেন৷”এই মতটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনঃপূত হল। তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই সহানুভূতিপূর্ণ মতের উপর নিজের সিন্ধান্ত শুনিয়ে দিলেন। প্রত্যেকের থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এই মতটি হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত আল্লাহ তা’আলারও পছন্দ ছিল না। তাই আল্লাহ তা’আলা এই মর্মে পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল করে সতর্ক করলেন :مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہٗۤ اَسۡرٰی حَتّٰی یُثۡخِنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ تُرِیۡدُوۡنَ
عَرَضَ الدُّنۡیَا ٭ۖ وَاللّٰہُ یُرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ؕ وَاللّٰہُ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ.
لَوۡلَا کِتٰبٌ مِّنَ اللّٰہِ سَبَقَ لَمَسَّکُمۡ فِیۡمَاۤ اَخَذۡتُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ.
“কোনো নবীর জন্য এটা উচিত না যে, তাঁর হাতে যুদ্ধবন্দী থাকবে, কিন্তু তাদের হত্যা করে তিনি জমিনে রক্ত প্রবাহিত করবেন না! তোমরা পার্থিব সম্পদ কামনা কর, অথচ আল্লাহ তা’আলা আখেরাতের কল্যাণ চান। আল্লাহ তা’আলা মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
যদি পূর্ব থেকেই লিখিত একটি বিষয় না হত, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ সেজন্য ভয়াবহ আযাব তোমাদেরকে স্পর্শ করত।” (সূরা আনফাল, আয়াত নং-৬৭-৬৮)
এই আয়াতদ্বয় নাযিল হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর (রাঃ) কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর বলতে থাকেন, “আজকে যদি আযাব এসেই যেত, তাহলে এক উমর ছাড়া আর কেউ রক্ষা পেত না।” [৯]সবশেষে বন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিন্ধান্তই বলবত থাকে। আল্লাহ তা’আলা হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে রাসূলকে জানিয়ে দেন যে, আজকে তোমাদের এই ৭০ জনকে ছেড়ে দেওয়ার কারণে আগামী বছর তোমাদের ৭০ জনকে জীবন দিতে হবে। এটা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেন এবং বলেন, “আল্লাহ তা’আলা আমাদের থেকে যাকে চাইবেন তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দিবেন।”
এভাবেই ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযানের সমাপ্তি ঘটে। শত শত বছর ধরে চলতে থাকা কুফুর-শিরকের একচ্ছত্র আধিপত্যে এই প্রথম আঘাত লাগে। শত বছরের কুফুরী বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে ঈমান ও কুফুরের প্রথম লড়াই। এর মাধ্যমেই কুফুরী সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
সেদিন থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে ঈমান ও কুফুরের এই লড়াই। এই উম্মাহর শেষ বাহিনী দাজ্জালের সাথে লড়াই করা পর্যন্ত চলতে থাকবে হক্ব ও বাতিলের এই লড়াই। এই অবিশ্বাস্য বিজয়ের ফলে আরবের ভূমিতে ইসলামের প্রচার একটি নতুন মাত্রায় উপনীত হয়। এক কান থেকে অপর কানে পৌঁছতে থাকে ইসলামের নতুন শক্তির অভ্যুদয়-বার্তা। ফলশ্রুতিতে মানুষের মাঝে ইসলামকে জানার কৌতুহল জাগতে থাকে। ইসলামকে জানতে গিয়ে তারা জানতে পারে ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্যের কথা, জানতে পারে ন্যায় ও ইনসাফের নীতিমালা। আর তখন তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হতে থাকে ইসলামের মাহাত্ম্য। দিক্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত। পৃথিবী অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে, এক নতুন বিশ্ব-পরাশক্তির। সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
বদরের চেতনাকে আমরা কোনদিকে প্রবাহিত করছি?
গাযওয়ায়ে বদর যুগে যুগে উম্মাহকে জিহাদের পথে পরিচালিত করেছে। বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত করেছে। উম্মাহর জীবনে যখন দুর্দিন নেমে আসত, তখন উম্মাহর উলামায়ে কেরাম জাতিকে বদরের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করতেন। ইতিহাস থেকে আমরা এমনটাই জানতে পারি।কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য আজ এটাই যে, হাল যামানার মুসলিম উম্মাহ যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাফের-মুশরিকদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যখন বদরের চেতনাকে পুঁজি করে আমাদের করণীয় ছিল একটি শক্তিশালী বদরী বাহিনী গড়ে তোলা এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া, তখন আমরা বদরের চেতনাকে ব্যবহার করছি অর্থ কালেকশনের কাজে। “বদরী কমিটি” নামে ডোনারদের তালিকা করছি। আর সেই বদরী কমিটিতে স্থান পাচ্ছে এমন সব লোক, যারা জানেইনা যে বদরী বাহিনী কারা ছিল। বদরী বাহিনীর ফজীলতই বা কী? আর কী কারণেই বা তাদের এই ফজীলত লাভ হল? এই বদরী কমিটিতে এমন লোকের নামও দেখা যায়, যারা বদরের প্রকৃত চেতনাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এবং সরাসরি বদরের প্রকৃত চেতনাকে নির্মূল করতে মাঠে-ময়দানে কাজ করে। আমাদের তো শুধু অর্থের প্রয়োজন, সেই প্রয়োজন পূরণে যদি বদরের চেতনাকে ধ্বংসের মিশনে লিপ্ত এমন কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে তাতে তেমন কি আর সমস্যা?যারা বদর কমিটির সদস্য হয় তাদের সামনে কখনো খুলে বলা হয়নি, বদর কী জিনিস? বদরের প্রকৃত চেতনা কী হওয়া উচিত ছিল? তাদের বলা হয়নি কখনো, বদরের চেতনা আমাদের থেকে কী ধরনের কুরবানী চায়? তাদেরকে মাসিক বা বাৎসরিক কিছু অনুদানের বিনিময়েই দেখানো হয়েছে বদরীদের মর্যাদা লাভের লোভ। অথচ তারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।বদরের সেই সু-মহান কুরবানী-স্পৃহাকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি? যে চেতনা দিয়ে কুফরের মজবুত মেরুদণ্ড ভেঙে, পুরা বিশ্ব জয় করা সম্ভব ছিল সেই চেতনাকে আমরা এ কোন দিকে প্রবাহিত করছি? এভাবেই কাফেররা আমাদের মানসিকতা সঙ্কীর্ণ থেকে আরও সঙ্কীর্ণ করেছে আর তারা নিশ্চিন্তে বিশ্বের ক্ষমতা ভোগদখল করে রেখেছে। আমাদের ভয় হয়, যদি অবস্থা এভাবেই চলতে থাকে তাহলে একটা সময় এসে মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে যে, “রাসূলের যুগে বদর নামে হয়তো কোনো মাদরাসা ছিল আর সেই মাদরাসায় যারা দান করত তাদেরকে বলা হতো বদরী কমিটি”!
নোট
[৬] এখানে অবশ্য বর্ণনার ভিন্নতা আছে। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, আবু জাহলকে আফরার দুই ছেলে হত্যা করেছেন। অর্থাৎ, মুয়ায ইবনে আফরা ও মুয়াব্বিয ইবনে আফরা। এখানে মুয়ায ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর উল্লেখ নাই। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, মুয়ায ইবনে আফরা ও মুয়ায ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তাকে হত্যা করেছেন, যেমনটি আমরাও উল্লেখ করেছি। এখানে মুয়াব্বিয ইবনে আফরার কথা নাই। ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (রঃ) বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে এই দুই বর্ণনার মাঝে সমন্বয় সাধন করেছেন। সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।[৭] তাঁর সাথী হযরত মুয়ায ইবনে আফরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বদর যুদ্ধেই শাহাদাত বরণ করেছিলেন।[৮] বন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের সেই নববী শিক্ষা মুসলিমরা এখনো ধরে রেখেছেন। তাই মুসলিমদের সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বন্দীদের ইসলাম গ্রহণের সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে।২০০১ সালে আফগানিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসে তালিবানের হাতে বন্দী হন একজন ব্রিটিশ সাংবাদিকা ও প্রাক্তন রেস্পেক্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী “ইভন রিডলি” (Yvonne Ridley), বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেন দশ দিন পর। এরপর তিনি নিজ দেশে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তালেবানের হাতে বন্দী হওয়াকে তিনি নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করেন এবং “ইন দ্যা হেন্ডস অব তালিবান” নামে একটি বই লিখেন।তেমনিভাবে, ২০১৮ সালের নভেম্বরে আল কায়েদার সোমালিয়ান শাখা হারাকাতুশ শাবাবের হাতে বন্দী হন সিলভিয়া রোমানো নামক একজন ইতালিয়ান স্বেচ্ছাসেবিকা। কেনিয়া থেকে বন্দী হওয়ার পর ১৮ মাস পর্যন্ত তিনি আশ-শাবাবের হাতে বন্দী জীবন-যাপন করেন। এই ১৮ মাসে তিনি ইসলামকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে বন্দীদের প্রতি মুসলিমদের সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি স্বেচ্ছায় স্ব-প্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজের নাম পালটে “সিলভিয়া আয়েশা” নাম রাখেন।[৯] অন্য এক রেওয়াতে এসেছে হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথাও এসেছে। কারণ তিনিও বন্দীদের হত্যা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
আগের পর্ব গুলো পড়ুন
১। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
২।বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
৩।বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
তথ্যসূত্র
(১) আল কুরআনুল কারীম। (সূরা আল ইমরান ও সূরা আনফাল)
(২) সহীহ বুখারী। (কিতাবুল মাগাযী)
(৩) সীরাতে ইবনে হিশাম।
(৪) মাগাযিল ওয়াক্বিদী।
(৫) যাদুল মা’আদ।
(৬) তাফসীরে কুরতুবী।
(৭) সীরাতে মুস্তফা।
এ ছাড়াও সীরাত ও তারিখের উপর রচিত গ্রহণযোগ্য অন্যান্য কিতাব।
(২) সহীহ বুখারী। (কিতাবুল মাগাযী)
(৩) সীরাতে ইবনে হিশাম।
(৪) মাগাযিল ওয়াক্বিদী।
(৫) যাদুল মা’আদ।
(৬) তাফসীরে কুরতুবী।
(৭) সীরাতে মুস্তফা।
এ ছাড়াও সীরাত ও তারিখের উপর রচিত গ্রহণযোগ্য অন্যান্য কিতাব।
Comment