ভারত ও বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ : হিজাব-টিপ, মিডিয়া-সুশীল এবং আমাদের করণীয়
প্রারম্ভিকা
ভারতীয় উপমহাদেশ; ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলিয়ে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হিন্দুত্ববাদী ভারত এর প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মুসলিম ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে তাদের দখলদারিত্ব ও খবরদারি চলিয়ে আসছে। হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর, সিকিম ও অন্যান্য আরও কিছু দেশ দখল করেছে তারা প্রকাশ্য দিবালোকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে তারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও আভ্যন্তরীণ নানান বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে বার বার। এভাবে তারা দেশগুলোকে দুর্বল এবং তাদের প্রতি নির্ভরশীল বানিয়ে আস্তে আস্তে দেশগুলো দখলের পায়তারা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।
সম্প্রতি নেপাল ও ভুটান সহ কিছু দেশ ভারতের এই সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে কিছুটা সক্ষম হলেও, এই জালে এখনো আটকে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী ভারত যতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, ততটা অন্য কোন প্রতিবেশী দেশে পারেনি। ভারত ও বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহও তাই এগিয়ে যায় অনেকটা সমান তালে।
ভারত বরাবরই ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী দেশ। কাশ্মীর হায়দ্রাবাদ ও জু'নগর দখলের পাশাপাশি এসকল দেশে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যাও চলিয়েছে ভারত। আর এই সবকিছুই ঘটেছিল ‘কথিত গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক’ কংগ্রেস সরকারের শাসনামলেই। এভাবে আস্তে আস্তে একদিকে তারা গণতন্ত্র আর অসাম্প্রদায়িকতার অলিক স্বপ্নে বিভোর করে মুসলিমদেরকে লাগাতার বোকা বানিয়ে গেছে, মুসলিমদেরকে শতধা বিভক্ত করে তাঁদেরকে করেছে দুর্বল ও অনিরাপদ। অপরদিকে তারা নির্বিঘ্নে শক্তি সঞ্চার করার সুযোগ দিয়ে গেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদেরকে; কখনো কখনো তাদেরকে গুজরাট-দিল্লীর মত মুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হাত পাকিয়ে নেওয়ার সুযোগও করে দিয়েছে।
তবে এসকল ক্ষেত্রে ভারতের ‘গণতন্ত্রের মুখ খ্যাত কথিত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণী’ এবং হলুদ মিডিয়া সহজ-কোমল ভাষায় তাদের কিছুটা সমালোচনা করেছে ঠিকই; তবে সেসকল নামেমাত্র সমালোচনা উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুসলিম-বিরোধী আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। উল্টো তাদের এই কোমল ভাষায় সমালোচনা হিন্দুত্ববাদের উগ্রতাকে ভারতজুড়ে নির্বিঘ্নে ছড়িয়ে যেতে সাহায্যই করেছে।
আবার এই কথিত অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীই মুসলিমদের সামান্যতম ভুলকেও ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচার করে সেটাকে মহাপাপ সাব্যস্ত করেছে সবসময়। হিন্দুত্ববাদীদের স্বার্থে সামান্যতম আঘাত লাগে- মুসলিমদের এমন যেকোন কর্মকাণ্ডকেই তারা প্রচার করেছে সাম্প্রদায়িক ও দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড হিসেবে। তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছে মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ নানান বিষয় নিয়েও।
এভাবে তারা জনমনে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নরম-কোমল-উন্নত চেহারা, আর মুসলিমদের এক ভয়ংকর দানবীয় চিত্র ও চরিত্র অঙ্কন করতে পেরেছে। মিডিয়া, দালাল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এমনকি সিনেমা-নাটক ব্যবহার করেও তারা তাদের ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী এই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গেছে সমানতালে। যাতে করে মুসলিমদেরকে আরও দুর্বল, আরও নিরাপত্তাহীন এবং আরও অসহায় করে সহজেই তাদেরকে বাগে আনা যায়; আর প্রয়োজনে গণহত্যা চালিয়ে মুসলিমমুক্ত অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার হিন্দুত্ববাদী উগ্র এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যায় সহজেই। বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এদিকেই খোলাখুলি ইঙ্গিত করছে এখন।
এই কাজে নিজস্ব বাহিনী গঠনের পাশাপাশি তারা মুসলিমদের মাঝেও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী এমন এক দালাল শ্রেণী তৈরি করেছে নানান কৌশলে, যাদেরকে দিয়ে তারা সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে, প্রয়োজনে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও ব্ল্যাকমেইল করে নিজ দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কাজ করিয়ে নিতে পারবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আমদেরকে পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে হয়তো।
সম্প্রতি এক হিন্দু শিক্ষিকাকে ‘টিপ পরার করণে’ অপমানজনক কথা বলার অভিযোগ উঠেছিল ঢাকার এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর ভাষায় ক্ষণে ক্ষণেই নিত্যনতুন সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা গেছে মিডিয়াকে। সাংসদ থেকে শুরু করে মিডিয়া সেলিব্রেটি, বুদ্ধিজীবীমহল সবখানেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অনেক কথিত সুশীল পুরুষ প্রতিবাদ স্বরূপ টিপ পরে ফেইসবুকে ছবি আপ্লোড করতে থাকে। এমনও বলা হচ্ছিল যে, টিপ পরায় হিন্দু শিক্ষিকাকে অপমানজনক কথা বলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, এমনকি আফগানিস্তানের সাথেও তুলনা করা হচ্ছিল বাংলাদেশকে। মিডিয়া আর প্রগতিশীলদের তর্জন-গর্জনে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার জানা যায়, টিপ কান্ডে তদন্তে কটূক্তির কোন প্রমান পায়নি কমিটি। প্রমানিত হবার আগেই বরখাস্ত হয়েছেন কন্সটেবল নাজমুল তারেক। কোন ধরণের অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই ইসলাম বিদ্বেষী বাংলা ট্রিবিউন নির্লজ্জতার সাথে নাজমুল তারেকের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটা নিউজ করেছিল। তবে নাজমুল তারেক হৃদয় মন্ডলের মত ‘কাছের মানুষ’ কিংবা ‘আপনজন’ না হওয়ায়, জাফর স্যারেরা সমবেদনায় কাতর হয়ে নিজেকে এরেস্ট করার প্রস্তাব পেশ করেননি। তার জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে কেউ প্রতিবাদও করেনি। তদন্ত কমিটি যখন কোন হেনস্থার প্রমান পেলনা, তখন এরা কোন কথা বলবে না। বিষয়টি এভাবে দেখা যায়- এরা বলবে আপনি দোষী এবং আপনাকে আঘাত করবে। এরপরে তদন্তে যাই প্রমান হোক তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তারা জানে এ সিস্টেম তাদের এই জুলুমের পক্ষেই থাকবে।
তাদের অবস্থান বুঝার সুবিধার্থে আমরা একটু পিছনের ঘটনায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি।
|| ২০২১ এর এপ্রিলে মুখে দাঁড়ি ও পরনে পাঞ্জাবি থাকায় অভীক শীল অর্ক নামের এক হিন্দু যুবককে হেফাযত সন্ত্রাসী হিসেবে গ্রেফতার করতে চায় পুলিশ। সে যে আসলে হিন্দু তা প্রমাণ করার জন্য পাজামা খুলে প্রমাণ দিতে বলে পুলিশ। টিপ পরার মতো এখানেও ভিক্টিম ছিল হিন্দু। কিন্তু হেনস্থার কারণ ছিল হেফাযতে ইসলামের সদস্য হিসেবে সন্দেহ। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ জানালে ইসলামের অনুষঙ্গ দাড়ি, টুপি পাঞ্জাবি বা, আপাত ভাবে হলেও হেফাযতে ইসলামকে সমর্থন করা হয়। তাই কোনো প্রতিবাদ আসেনি সুশীল বুদ্ধিজীবী বা মিডিয়া-পাড়া থেকে। কেউ তখন দাড়ি রেখে পাঞ্জাবি পরে অভীক শীলের পাশে দাড়ায়নি!
|| ২০২২ সালের ১৫ই মার্চ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ্য সুনীল চন্দ্র দাস ক্লাসে বলে- হিজাব পরলে ভূতের মতো লাগে। হিজাবের নিচে খারাপ মানুষ থাকে। এখানে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই। কেউ হিজাব পরে এগিয়ে আসেনি! ফেইসবুকে ঝড় তুলেনি!
|| গতো ২৮ মার্চ সোমবার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ক্লাসে এক ছাত্রী নেকাব না খোলায় হুমকি দেয়। পরের দিন থেকে তাকে আর ক্লাসে বসার সুযোগ দেওয়া উচিত না বলেও জানায়। প্রতিবাদ নেই এ ঘটনাতেও ।
৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে এমন তীব্র মাত্রার হিজাব বিদ্বেষ নতুন নয়। হিজাব পরা, দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি পরার কারণে স্কুল কলেজ, অফিস আদালতে হেনস্থা হওয়া, কটূক্তির শিকার হওয়া বেশ কমন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে এখন। মার্কেটে প্রবেশ করতে না দেয়া, চাকরি পাওয়ার জন্য ক্লিন শেইভ শর্ত করে দেয়া এগুলো নতুন নয়। কিন্তু টিপ ইস্যু নিয়ে আজ যারা মাতোয়ারা তারা কিন্তু তাদের আজকের এই নীতি অনুসরণ করে কোন ব্যাক্তির দাড়ি রাখা কিংবা কোন মহিলার হিজাব পরার উপরে আক্রমন আসলে কোন অবস্থান নেয় না।
এবার আরও একটু আগের ঘটনায় যাওয়া যাক
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি দাস ২০১৬ সালের ১৩ই মে মুহাম্মাদ ﷺ কে নিয়ে কটূক্তি করে। নবী করিম ﷺ কে অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা সমবেত হলে, শামীম ওসমানের বড় ভাই স্থানীয় এমপি সেলিম উসমান বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য আই ওয়াশ মূলক শাস্তি হিসেবে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেকুল্যার মহল ও মিডিয়া পাড়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মুহাম্মাদ ﷺ কে ব্যঙ্গ করার চাইতে কান ধরানোকেই বড় অপরাধ হিসেবে প্রচার করে তারা। শিক্ষক পেশার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য শামল কান্তির পাশে দাঁড়ানোর জন্য কান ধরে প্রতিবাদ করে তারা।
অথচ ঠিক এর কিছুদিন পরেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে চরম মারধোর ও লাঞ্ছনার শিকার হন কয়েকজন শিক্ষক। কথিত সেকুল্যার মহল কিন্তু তখন নীরবতা বজায় রাখে। আবার ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাজশাহী পলিটেকনিক্যালের অধ্যক্ষ যোহর নামায পড়ে ফিরছিলেন অফিসে। অন্যায় আবদার না মানায় এসময় তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ। এসময়ও কান ধরে প্রতিবাদকারীরা নীরবতা বজায় রাখে।
টিপ ইস্যু নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিগত কয়েক বছরের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করেআমরা দেখতে পাই -
প্রথমত, কোনো হিন্দু ইসলাম অবমাননা করলে, কোন সুন্নাহ যেমন দাড়ি টুপি এসব নিয়ে কটাক্ষ করলে তারা হিন্দুর পক্ষই গ্রহণ করে এবং উল্টো মুসলিমদের উগ্রবাদী, মৌলবাদী, জঙ্গি, রাজাকার ইত্যাদি ট্যাগ দেয়। এমনকি মুসলিমদের রক্ত ঝরানোর জন্য মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, কোনো হিন্দু সামান্যতম হেনস্থা কিংবা কথিত হেনস্থার শিকার হলেই সেটাকে মিডিয়া এজেন্ডা হিসেবে প্রচার করে। এটাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, একাত্তরের চেতনার উপর আঘাত হিসেবে প্রচার করে। সেই সাথে এটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়। ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে হিন্দুপ্রেমিক প্রশাসনের হাতে মুসলিমরাই চরমভাবে নির্যাতিত , শোষিত হয়ে দিন পার করলেও তারা এই ন্যারেটিভ দাঁড় করায় যে বাংলাদেশের মুসলিমদের হাতে হিন্দুরা খুবই নির্যাতিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, মুসলিম বা সাধারণ হিন্দু নির্যাতিত হলেও যদি তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসলাম এবং মুসলিমদের সমর্থন করা হয় পরোক্ষভাবেও, তাহলে তারা প্রতিবাদ না করে নীরব থাকে। ইসলামের কোনো অনুষঙ্গের অবমাননা হলে এরা চুপ করে কল্পিত সুখ সাগরে ভেসে যায়। এমনকি এরা পর্দা করা, দাড়ি টুপি , শুদ্ধভাবে সালাম দেওয়া ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোকে জংগীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবেও প্রচার করে।
কাজেই টিপ ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদকারীরা যে আসলে তাদের নিজেদের আদর্শের মানদণ্ডেই দ্বি-মুখী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ ভাবে তারা যে কাদের বন্ধু আর কাদের শত্রু এবং তাদের উদ্দেশ্য কী তাও বলাই বাহুল্য।
আরেকটি ঘটনায় দৃষ্টিপাত করা যাক
ময়মনসিংহে এক হিন্দু ধর্মের ছাত্রীকে নাকি জোর করে বোরখা পরানো হয়েছে। ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া কাওয়ালটি ইসলামিয়া হাইস্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেনীর ছাত্রী চৈতী রাজভর। অথচ ঐ মেয়ে এবং তার বাবা একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছে যে, চৈতি মূলত তার মুসলিম বান্ধবিদের সাথে ম্যাচিং করে বোরখা পরেছিল সখের বসে। তখন সেই স্কুলের হিন্দু শিক্ষিকা গোপা সরকার ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না’ বলে ঐ ছাত্রীর একটি ছবি তুলে নেয়। সেই ছবি দিয়ে ফেইসবুকে ‘হিন্দু ছাত্রীকে জোর করে হিজাব পরানোর’ মিথ্যা দাবি করে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া হয়। বেসরকারি সংস্থা হাঙ্গার প্রজেক্ট এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জয়ন্ত কর-এর কাছে ছবি দিয়েছিলেন ঐ শিক্ষিকা, পরে তিনি নাকি আর কিছুই জানেন না; পোস্টদাতাকেও নাকি চিনেন না তিনি। তার এমন দাবিই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছে মিডিয়া, সুশীল সমাজ, প্রশাসন সবাই।
পুরো ঘটনাটিই যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ নিয়ে কিন্তু কোন উচ্চ বাচ্য নেই। এমনকি এত বড় দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়ার মত অপরাধ করার পরেও সেই হিন্দু শিক্ষিকা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। আপনি যদি আমাদের মত এই সন্দেহ করেন যে, যদি কোন কারনে প্রশাসন তাকে আদর করে 'বুঝিয়ে বলার জন্য' ডেকেও নেয়, জাফর সাহেবরা রাস্তায় এসে তখন বলবেন, ওগো আমাকেও নিয়ে যাও।
এই মডেল গুলো আমাদের সামনে অপরিচিত নয়। আমাদের কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, এটি তাদের নিত্যদিনের কাজ। গাড়ির মধ্যে গরুর গোশত আছে বলে হত্যা করে ফেলা, বাবরি মসজিদে রাতের আধারে মুর্তি রেখে মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া, নিজেরা আগুন দিয়ে মুসলিমদের উপরে দোষ চাপানো। মিল পাওয়া যাচ্ছে সম্পূর্ণই!
প্রিয়া সাহার ঘটনাও আমাদের কাছে বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। সে পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ দিয়েছল যে, বাংলাদেশে নাকি ৩৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৩ কোটি) হিন্দু গায়েব হয়ে গেছে। নিজের ভাইয়ের ভাঙা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সে ট্রাম্পকে বলেছিল যে, মুসলিম মৌলবাদীরা তার বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ তার এলাকার হিন্দুরাই তার এই মিথ্যা নাটক ফাঁস করে দিয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনাতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হলেও, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আবার, সম্প্রতি হিজাব পরে স্কুলে আসায় ২০ জনের মতো ছাত্রীকে গাছের মোটা ডাল দিয়ে চরম মারধর করেছে আমদিনি পাল নামের এক হিন্দু শিক্ষিকা। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে গত ৬ এপ্রিল ২০২২ তারিখে।
নির্যাতনের শিকার ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আফরিন বলেন, বুধবার দুপুরে জাতীয় সংগীতের পর লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনি পাল কেন হিজাব পড়ে স্কুলে এসেছে এ কথা জিজ্ঞাসা করেন এবং ইউক্যালিপ্টাস গাছের ডাল দিয়ে তাদেরকে পিটান। শিক্ষিকা তাদেরকে জানিয়ে দেন - স্কুলে কোনো পর্দা চলবে না। ঢং করে আসছো। বাসায় গিয়ে বোরখা পড়ে থাকো। যখন তোমরা মহাদেবপুর বাজারে যাবে তখন পর্দা করবে। স্কুলে আসলে মাথার কাপড় ফেলে আসবে। তিনি ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার জন্য টানাটানিও করেন। এমনকি যারা হিজাব ছাড়া শুধু মাস্ক পড়ে এসেছিল তাদের মাস্কও খুলে দেন।
সে হুমকি দিয়ে বলে, 'কাল থেকে যদি হিজাব ও মাস্ক পড়ে আসো তাহলে পিটিয়ে তোমাদের পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে।’
অভিভাবকেরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা স্কুল ঘেরাও করেন। কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষিকা এদিন স্কুলে আসেননি। একটি প্রভাবশালী মহল বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে।
কেন টিপ এবং হিজাব ইস্যু এত গরম হয়ে উঠেছিল?
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর যাবত পর্দার উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। পর্দা করার কারণে প্রতিনিয়ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিস আদালত থেকে রাস্তাঘাট সবস্থানেই মুসলিম নারীদের হেনস্থা, অপমান, লাঞ্ছনা বৈশ্যম্যের শিকার হতে হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সম্প্রতি কিছু প্রতিবাদ শুরু হয়েছে মুসলিম নারীদের পক্ষ থেকে। হিজাব বিদ্বেষের ইস্যুগুলো সামনে আসা শুরু করেছে। এর ফলে হিন্দুপ্রেমিক সেকুল্যারদের ইসলাম বিদ্বেষী প্রকৃত চেহারা উন্মোচন হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমন সময় টিপ ও হিজাব ইস্যু তাদের অবস্থান ধরে রেখে উচ্চ স্বরে চিৎকার করার আদর্শ সুযোগ! এর মাধ্যমে আসলে ইসলাম বিদ্বেষী সেকুল্যাররা যেমন হিজাব বিদ্বেষ থেকে মুসলিমদের মনোযোগ ঘোরাতে পারবে, সেই সাথে বাংলাদেশ ধর্মান্ধ উগ্রবাদী, মৌলবাদীদের দখলে চলে গিয়েছে যারা রাস্তাঘাটে হিন্দু শিক্ষিকাকে সামান্য টিপ পরার কারণে লাঞ্ছিত করে এমন ন্যারেটিভ সামনে নিয়ে এসে মুসলিমদের, বিশেষ করে হিজাব নিয়ে আন্দোলনকারীদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়া যাবে।
সেই সাথে কর্ণাটকের হিজাব ইস্যুতে এবং ইসলামবিদ্বেষী নানান ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আছে। এই সুযোগে ভারত টিপ পরার ইস্যুকে হাইলাইট করে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করবে। নিজেদের উপর থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ ঘুরাবে। এই কাজ শুরু করেছে ভারত ইতিমধ্যে। টিপ পরায় বাংলাদেশের পুলিশ সদস্য হিন্দু শিক্ষিকাকে খুন করার হুমকি দিয়েছে এমন বক্তব্য সামনে রেখে তারা মিছিল শোডাউন শুরু করেছে। এই চক্রটি আসলে অনেক পুরোনো।
মোদী-প্রেমিক বুদ্ধিজীবী আর ভারতের দালাল মিডিয়ার চেহারা আমাদের সামনে স্পষ্ট। বাংলাদেশে মুসলিমরা জনসংখ্যার আকারে সংখ্যাগুরু হলেও আসলে তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু। হিন্দুরা নয়, বরং মোদি প্রেমিকদের হাতে হিজাব পরা, দাড়ি টুপি পাঞ্জাবির কারণেই তারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। হাজার সাল কা বাদলা লে লিয়া- ইন্দিরা গান্ধির এই উক্তি ছিল ইসলামের প্রতি শতভাগ আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। আজও তাদের দালালরা আমাদের মাঝেই আছে, আমাদেরকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
ভারতের মরণ-কামড় এবং আমাদের করণীয়
এ দেশে আমি এবং আপনি যদি ইসলাম মেনে চলতে চাই, তবে আমরা নিরাপদ নই। কারণ, আমাদের এই সিস্টেম যা ভারতের কাছে দাসত্বের দস্তখতে পরিচালিত,- তা ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু! তাদের শত্রুতা ব্যাক্তি আমি কিংবা আপনার সাথে নয়। তাদের শত্রুতা আমাদের দ্বীন, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের ধর্ম, আমাদের ইসলামী মুল্যবোধ আর আমাদের ইসলামের সাথে।
আমাদেরকে এই সত্য স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে যে, দিনে দিনে মুসলিমরাই এ দেশে সংখ্যালঘু হচ্ছেন, অ-পরিচিত হচ্ছেন, আর সবচেয়ে বেশী অ নিরাপদ হচ্ছেন। এবং দাদা-বাবুরারাই দিন দিন আরো কাছের মানুষ হচ্ছে, আপন জন হচ্ছে।
মনে রাখতা হবে, এ দেশে নাজমুল তারেকরাই মাজলুম এবং তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিক ভাবে জুলুমের শিকার, শুধুমাত্র ইসলামের কারণে। এটি ই হচ্ছে সেই অনিবার্য সঙ্ঘাতের অশনি সংকেত, আগ্রাসী ভারতের কাছে দস্তখত দেয়া দাসত্বের জিন্দেগির নমুনা মাত্র!
আমাদেরকে ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থার দিকেও নজর রাখতে হবে। আফগানিস্তানে তালিবানের হাতে পশ্চিমা ও আগ্রাসী জোটের শোচনীয় পরাজয় থেকে ভারত এটা বুঝতে পেরেছে যে, কাশ্মীর অচিরেই তার হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। তাই কাশ্মীরে দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে এবং উপমহাদেশের মুসলিমদের আরও কোণঠাসা করতে ভারত এখন মরণকামড় দিচ্ছে। কাশ্মীরে তারা ব্যাপক সৈন্য সমাগম করেছে। পাশাপাশি ভারতজুড়ে ইসলামবিদ্বেষী উগ্র জিঘাংসা ছড়িয়ে দিতে হিন্দুত্ববাদীদেরকে ‘অঘোষিত ফ্রি লাইসেন্স’ দিয়ে রেখেছে। তারা ভারতজুড়ে মুসলিমদের সাথে যা ইচ্ছা তাই আচরণ করছে। একের পর এক ইস্যু সামনে এনে মুসলিমদের উস্কে দিচ্ছে, যাতে করে মুসলিম গণহত্যা শুরু করার একটা অজুহাত দার করানো যায়।
গো-রক্ষা ইস্যু, এনআরসি, সিএএ, ধারা ৩৭০ বাতিল, মুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস, নামাজে বাঁধা দান, হিজাব ইস্যু, সবশেষ মাইকে আজান দেওয়া নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি - এসবই করা হচ্ছে সাধারণ হিন্দুদেরকে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যায় সংযুক্ত করতে। কারণ এটা করা ছাড়া মুসলিমমুক্ত অখণ্ড ভারত গড়ার অলীক স্বপ্ন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আসাম ও ত্রিপুরায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম নিধন ও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের পর, সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের একের পর এক মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়া ও গণহত্যা বাস্তবায়নের শপথ পাঠে এটা নিশ্চিত যে, ভারতের মুসলিমদের উপর এক চূরান্ত গণহত্যা আসন্ন। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ডঃ উইলিয়াম স্ট্যান্টনের মত ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে এমন সতর্কতা জারি করেছেন। কোন কোন বিশ্লেষক এটাও বলেছে যে, ভারতে সল্প মাত্রায় গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে; এখন তা শুধু ব্যাপক আকারে শুরু হওয়ার পালা। কাশ্মীর পরিস্থিতিও তাদেরকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য করেছে; যদিও কাশ্মীরে সল্প মাত্রায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন মুসলিমরা, যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে।
সকল শ্রেণীর হিন্দুদের মুসলিম গণহত্যায় উস্কে দিতে শেষ কাজটি করেছে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি। মুসলিমদের হাতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ার মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী নিয়ে বানাও ছবিটিতে হিন্দুদেরকে ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করে, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদেরকে উগ্র, মৌলবাদী, কামুক ও রক্তপিপাশু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; যদিও কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে দখলদার ভারতীয় সৈন্যরা একদিকে মুসলিমদেরকে হাজারে হাজারে গুম-খুন-ধর্ষণ করছে। আরেকদিকে মন্দিরের পুরোহিত ও বাবা-ছেলের হাতে ৮ বছরের শিশু আসিফা ধর্ষণ ও হত্যায় মতো ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে এমনভাবে দর্শকদের প্রভাবিত করেছে যে, ভারতজুড়ে ইতিহাস না জানা সাধারণ হিন্দুরা মুসলিমদেরকেই অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে। বিভিন্ন হলে হলে গিয়ে সিনেমা শেষ হওয়ার পর বিজেপি, আরএসএস, বজরং দল ও হিন্দুসভার নেতা-কর্মীরা ভাষণ দিয়ে দর্শকদের জিঘাংসা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর আবার বাইরে এসে সেই দর্শকরা শুনছে তাদের ধর্মীয় গুরুদের মুসলিম নিধনের আহ্বান। হিন্দু ঐ কথিত ধর্মগুরুরা এমনকি মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ করার প্রকাশ্য আহ্বানও জানাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, পূজা-পারবন ও হনুমান চল্লিসার পরে উগ্র হিন্দুরা মিছিল নিয়ে মুসলিমদের বাড়ি-ঘর ও দোকান-পার্টে হামলা চালাচ্ছে, অগ্নি-সংযোগ করছে, মসজিদে গেরুয়া পতাকা টানিয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি বিতর্কিত ধর্মগুরু জ্যোতি নরসিংহানন্দ আবারো মুসলিমদের মারতে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এর পরপরই আরেক কথিত ধর্মগুরু জ্যোতি কৃষ্ণানন্দ প্রস্তাবিত মুসলিম গণহত্যার জন্য একটি তফসিল ঘোষণা করেছে; এতে সে পূর্ব উত্তরপ্রদেশ থেকে এটি শুরু হবে বলেও জানিয়েছে।
ঐ উগ্র সাধু কৃষ্ণানন্দ ঘোষণা করেছে যে, "প্রস্তাবিত গণহত্যা শুরু হবে পূর্বাচল (পূর্ব উত্তরপ্রদেশ) থেকে। আমরা ধর্ম যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।"
আবারো আমরা ডঃ স্ট্যান্টন এবং অন্যান্য গণহত্যা বিশেষজ্ঞের সতর্কবার্তা মনে করিয়ে দিচ্ছি। তারা বলছেন যে, ভারত ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা বাস্তবায়নের ঠিক আগের ধাপে রয়েছে, এবং সেখানে ক্ষুদ্র পরিসরে মুসলিম গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে।
নিজ দেশের মুসলিমদের এভাবে গণহত্যার দিকে ধাবিত করার পাশাপাশি, বাংলাদেশেই সেই গণহত্যার ঢেউ আছড়ে ফেলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে, বিজেপি নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী এবং অন্যান্যরা বাংলাদেশ দখল করার হুমকি দিয়েছে বহুবার। পাশাপাশি তারা তাদের এদেশীয় দালালদেরকে দিয়ে কথিত ‘হিন্দু নির্যাতনের’ ন্যারেটিভ দার করিয়ে এদেশে সেনা অনুপ্রবেশ ঘটানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে। গত বছর কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার জেরে যখন ‘অচেনা লোকেরা’ বিভিন্ন মন্দিরে হামলা-ভাংচুর চালিয়েছিল, তখন ভারতের বিভিন্ন নেতা এবং বিশেষ করে ইস্কনের নেতারা জাতিসংঘে এই মর্মে চিঠি দিয়েছিল যে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে, এবং জাতিসংঘ সেখানে সেনা পাঠাক, অথবা ভারত সেখানে হিন্দু রক্ষায় সেনা পাঠাক।
বাংলাদেশেও ভারতের ইশারায় ইস্কন ও হিন্দু মহাজোটের মতো উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে নানান উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এমনকি তারা মুসলিমদের উপর হামলা চালাতে হিন্দুদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহিত করছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি’র প্রধান দিলিপ ঘোষ আবার বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশেকে ভারতের অংশ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা এখন স্পষ্ট যে, ভারতে মুসলিম গণহত্যা শুরু করেই তারা হাত বাড়াবে বাংলাদেশের দিকে। কিংবা কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন,- এমনও হতে পারে যে, বাংলাদেশে আবার কোন বড় ধরণের ‘হিন্দু নির্যাতনের নাটক’ মঞ্চায়ন করে সেটাকেও তারা একই সাথে বাংলাদেশে সরাসরি আগ্রাসন চালানোর এবং ভারতে ব্যাপক-ভিত্তিক মুসলিম গণহত্যা শুরু করার অজুহাত হিসেবে দার করাতে পারে।
বিশ্লেষকরা এখন এটাও স্পষ্ট করেই বলছেন যে - আগ্রাসী ভারত, ভারতের অনুগত এদেশের শাসন কাঠামো, কথিত বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া, শিক্ষা ব্যাবস্থা, সামাজিক ব্যাবস্থা, সংস্কৃতি সকল কিছু সুনির্দিষ্টভাবে ইসলাম ও মুসলিমের প্রতি আক্রমন করেই যাচ্ছে। আমরা অধিকাংশই ভুলে থাকার কিংবা চোখ বন্ধ করে থাকার বিলাসিতা উপভোগ করতে পারি; তবে সেক্ষেত্রে আসন্ন বিপদের সময়ে শুধু নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ করতে পারব না।
তবে, শত্রুজোট যতো শক্তিশালীই হোক, তারা কিন্তু অপরাজেয় নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে ভারত ও বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনাগুলো, মিডিয়া ও সুশীলদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এবং তাদের জঘন্য চক্রান্তগুলো সামনে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য।
সেই সাথে হক্কানি উলামায়ে কেরামের মুসলিমদের প্রতি ‘নববী মানহাজ’ অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের যে আহ্বান- সেটা ব্যাপকভাবে যদি সাধারণ মুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা সম্ভাব্য বিপদের মাত্রা কমিয়ে আনতে পাড়বো অনায়াসে।
বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, এখন আমাদেরকে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কেননা আমাদের শত্রুরা ইতিমধ্যে তাদের জিঘাংসা ও আক্রোশ স্পষ্ট করে দিয়েছে। এখনো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা সম্পর্কে দোলাচলে থাকা নিঃসন্দেহে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় হবে বলেই মনে করেন তাঁরা। কেননা এই অবস্থান বাতিলের বিরুদ্ধে হক্কের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের অবস্থান। এগিয়ে আসা একজন মুসলিম হিসেবে আপনার আমার কর্তব্য। আর কালবিলম্ব শুধু আপনার-আমার বিপদকেই ঘনীভূত করতে পারবে।
লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর
তথ্যসূত্র :
১। টিপ নিয়ে কটূক্তির প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি
- https://tinyurl.com/2p83krs2
২। ময়মনসিংহে হিন্দু মেয়েকে জোর করে বোরকা পরানোর অভিযোগ । সত্য নাকি গভীর ষড়যন্ত্র
- https://tinyurl.com/smxmr98c
৩। নওগাঁয় হিজাব পরার অপরাধে ২০ ছাত্রীকে পেটালেন শিক্ষিকা
- https://tinyurl.com/378864ve
৪। ‘মুসলিমদের মারতে অস্ত্র তুলে নিন’, জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ফের ‘ঘৃণা ভাষণ’ বিতর্কিত ধর্মগুরুর
- https://tinyurl.com/2p9yhd2d
৫। Clashes erupt in India’s New Delhi during Hindu procession
- https://tinyurl.com/4fb85dfb
৬। Hindu Monk Announces ‘Dharam Yudh’ against Muslims
- https://tinyurl.com/ydjeheme
video link - https://tinyurl.com/yh793vmz
প্রারম্ভিকা
ভারতীয় উপমহাদেশ; ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলিয়ে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হিন্দুত্ববাদী ভারত এর প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মুসলিম ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে তাদের দখলদারিত্ব ও খবরদারি চলিয়ে আসছে। হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর, সিকিম ও অন্যান্য আরও কিছু দেশ দখল করেছে তারা প্রকাশ্য দিবালোকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে তারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও আভ্যন্তরীণ নানান বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে বার বার। এভাবে তারা দেশগুলোকে দুর্বল এবং তাদের প্রতি নির্ভরশীল বানিয়ে আস্তে আস্তে দেশগুলো দখলের পায়তারা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।
সম্প্রতি নেপাল ও ভুটান সহ কিছু দেশ ভারতের এই সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে কিছুটা সক্ষম হলেও, এই জালে এখনো আটকে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী ভারত যতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, ততটা অন্য কোন প্রতিবেশী দেশে পারেনি। ভারত ও বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহও তাই এগিয়ে যায় অনেকটা সমান তালে।
ভারত বরাবরই ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী দেশ। কাশ্মীর হায়দ্রাবাদ ও জু'নগর দখলের পাশাপাশি এসকল দেশে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যাও চলিয়েছে ভারত। আর এই সবকিছুই ঘটেছিল ‘কথিত গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক’ কংগ্রেস সরকারের শাসনামলেই। এভাবে আস্তে আস্তে একদিকে তারা গণতন্ত্র আর অসাম্প্রদায়িকতার অলিক স্বপ্নে বিভোর করে মুসলিমদেরকে লাগাতার বোকা বানিয়ে গেছে, মুসলিমদেরকে শতধা বিভক্ত করে তাঁদেরকে করেছে দুর্বল ও অনিরাপদ। অপরদিকে তারা নির্বিঘ্নে শক্তি সঞ্চার করার সুযোগ দিয়ে গেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদেরকে; কখনো কখনো তাদেরকে গুজরাট-দিল্লীর মত মুসলিমদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হাত পাকিয়ে নেওয়ার সুযোগও করে দিয়েছে।
তবে এসকল ক্ষেত্রে ভারতের ‘গণতন্ত্রের মুখ খ্যাত কথিত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণী’ এবং হলুদ মিডিয়া সহজ-কোমল ভাষায় তাদের কিছুটা সমালোচনা করেছে ঠিকই; তবে সেসকল নামেমাত্র সমালোচনা উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুসলিম-বিরোধী আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। উল্টো তাদের এই কোমল ভাষায় সমালোচনা হিন্দুত্ববাদের উগ্রতাকে ভারতজুড়ে নির্বিঘ্নে ছড়িয়ে যেতে সাহায্যই করেছে।
আবার এই কথিত অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীই মুসলিমদের সামান্যতম ভুলকেও ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচার করে সেটাকে মহাপাপ সাব্যস্ত করেছে সবসময়। হিন্দুত্ববাদীদের স্বার্থে সামান্যতম আঘাত লাগে- মুসলিমদের এমন যেকোন কর্মকাণ্ডকেই তারা প্রচার করেছে সাম্প্রদায়িক ও দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড হিসেবে। তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছে মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ নানান বিষয় নিয়েও।
এভাবে তারা জনমনে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নরম-কোমল-উন্নত চেহারা, আর মুসলিমদের এক ভয়ংকর দানবীয় চিত্র ও চরিত্র অঙ্কন করতে পেরেছে। মিডিয়া, দালাল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এমনকি সিনেমা-নাটক ব্যবহার করেও তারা তাদের ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী এই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গেছে সমানতালে। যাতে করে মুসলিমদেরকে আরও দুর্বল, আরও নিরাপত্তাহীন এবং আরও অসহায় করে সহজেই তাদেরকে বাগে আনা যায়; আর প্রয়োজনে গণহত্যা চালিয়ে মুসলিমমুক্ত অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার হিন্দুত্ববাদী উগ্র এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যায় সহজেই। বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এদিকেই খোলাখুলি ইঙ্গিত করছে এখন।
এই কাজে নিজস্ব বাহিনী গঠনের পাশাপাশি তারা মুসলিমদের মাঝেও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী এমন এক দালাল শ্রেণী তৈরি করেছে নানান কৌশলে, যাদেরকে দিয়ে তারা সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে, প্রয়োজনে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও ব্ল্যাকমেইল করে নিজ দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কাজ করিয়ে নিতে পারবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আমদেরকে পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে হয়তো।
সম্প্রতি এক হিন্দু শিক্ষিকাকে ‘টিপ পরার করণে’ অপমানজনক কথা বলার অভিযোগ উঠেছিল ঢাকার এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর ভাষায় ক্ষণে ক্ষণেই নিত্যনতুন সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা গেছে মিডিয়াকে। সাংসদ থেকে শুরু করে মিডিয়া সেলিব্রেটি, বুদ্ধিজীবীমহল সবখানেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অনেক কথিত সুশীল পুরুষ প্রতিবাদ স্বরূপ টিপ পরে ফেইসবুকে ছবি আপ্লোড করতে থাকে। এমনও বলা হচ্ছিল যে, টিপ পরায় হিন্দু শিক্ষিকাকে অপমানজনক কথা বলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, এমনকি আফগানিস্তানের সাথেও তুলনা করা হচ্ছিল বাংলাদেশকে। মিডিয়া আর প্রগতিশীলদের তর্জন-গর্জনে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার জানা যায়, টিপ কান্ডে তদন্তে কটূক্তির কোন প্রমান পায়নি কমিটি। প্রমানিত হবার আগেই বরখাস্ত হয়েছেন কন্সটেবল নাজমুল তারেক। কোন ধরণের অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই ইসলাম বিদ্বেষী বাংলা ট্রিবিউন নির্লজ্জতার সাথে নাজমুল তারেকের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটা নিউজ করেছিল। তবে নাজমুল তারেক হৃদয় মন্ডলের মত ‘কাছের মানুষ’ কিংবা ‘আপনজন’ না হওয়ায়, জাফর স্যারেরা সমবেদনায় কাতর হয়ে নিজেকে এরেস্ট করার প্রস্তাব পেশ করেননি। তার জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে কেউ প্রতিবাদও করেনি। তদন্ত কমিটি যখন কোন হেনস্থার প্রমান পেলনা, তখন এরা কোন কথা বলবে না। বিষয়টি এভাবে দেখা যায়- এরা বলবে আপনি দোষী এবং আপনাকে আঘাত করবে। এরপরে তদন্তে যাই প্রমান হোক তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তারা জানে এ সিস্টেম তাদের এই জুলুমের পক্ষেই থাকবে।
তাদের অবস্থান বুঝার সুবিধার্থে আমরা একটু পিছনের ঘটনায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি।
|| ২০২১ এর এপ্রিলে মুখে দাঁড়ি ও পরনে পাঞ্জাবি থাকায় অভীক শীল অর্ক নামের এক হিন্দু যুবককে হেফাযত সন্ত্রাসী হিসেবে গ্রেফতার করতে চায় পুলিশ। সে যে আসলে হিন্দু তা প্রমাণ করার জন্য পাজামা খুলে প্রমাণ দিতে বলে পুলিশ। টিপ পরার মতো এখানেও ভিক্টিম ছিল হিন্দু। কিন্তু হেনস্থার কারণ ছিল হেফাযতে ইসলামের সদস্য হিসেবে সন্দেহ। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ জানালে ইসলামের অনুষঙ্গ দাড়ি, টুপি পাঞ্জাবি বা, আপাত ভাবে হলেও হেফাযতে ইসলামকে সমর্থন করা হয়। তাই কোনো প্রতিবাদ আসেনি সুশীল বুদ্ধিজীবী বা মিডিয়া-পাড়া থেকে। কেউ তখন দাড়ি রেখে পাঞ্জাবি পরে অভীক শীলের পাশে দাড়ায়নি!
|| ২০২২ সালের ১৫ই মার্চ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ্য সুনীল চন্দ্র দাস ক্লাসে বলে- হিজাব পরলে ভূতের মতো লাগে। হিজাবের নিচে খারাপ মানুষ থাকে। এখানে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ নেই। কেউ হিজাব পরে এগিয়ে আসেনি! ফেইসবুকে ঝড় তুলেনি!
|| গতো ২৮ মার্চ সোমবার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ক্লাসে এক ছাত্রী নেকাব না খোলায় হুমকি দেয়। পরের দিন থেকে তাকে আর ক্লাসে বসার সুযোগ দেওয়া উচিত না বলেও জানায়। প্রতিবাদ নেই এ ঘটনাতেও ।
৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে এমন তীব্র মাত্রার হিজাব বিদ্বেষ নতুন নয়। হিজাব পরা, দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি পরার কারণে স্কুল কলেজ, অফিস আদালতে হেনস্থা হওয়া, কটূক্তির শিকার হওয়া বেশ কমন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে এখন। মার্কেটে প্রবেশ করতে না দেয়া, চাকরি পাওয়ার জন্য ক্লিন শেইভ শর্ত করে দেয়া এগুলো নতুন নয়। কিন্তু টিপ ইস্যু নিয়ে আজ যারা মাতোয়ারা তারা কিন্তু তাদের আজকের এই নীতি অনুসরণ করে কোন ব্যাক্তির দাড়ি রাখা কিংবা কোন মহিলার হিজাব পরার উপরে আক্রমন আসলে কোন অবস্থান নেয় না।
এবার আরও একটু আগের ঘটনায় যাওয়া যাক
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি দাস ২০১৬ সালের ১৩ই মে মুহাম্মাদ ﷺ কে নিয়ে কটূক্তি করে। নবী করিম ﷺ কে অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা সমবেত হলে, শামীম ওসমানের বড় ভাই স্থানীয় এমপি সেলিম উসমান বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য আই ওয়াশ মূলক শাস্তি হিসেবে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেকুল্যার মহল ও মিডিয়া পাড়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মুহাম্মাদ ﷺ কে ব্যঙ্গ করার চাইতে কান ধরানোকেই বড় অপরাধ হিসেবে প্রচার করে তারা। শিক্ষক পেশার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য শামল কান্তির পাশে দাঁড়ানোর জন্য কান ধরে প্রতিবাদ করে তারা।
অথচ ঠিক এর কিছুদিন পরেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে চরম মারধোর ও লাঞ্ছনার শিকার হন কয়েকজন শিক্ষক। কথিত সেকুল্যার মহল কিন্তু তখন নীরবতা বজায় রাখে। আবার ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাজশাহী পলিটেকনিক্যালের অধ্যক্ষ যোহর নামায পড়ে ফিরছিলেন অফিসে। অন্যায় আবদার না মানায় এসময় তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ। এসময়ও কান ধরে প্রতিবাদকারীরা নীরবতা বজায় রাখে।
টিপ ইস্যু নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিগত কয়েক বছরের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করেআমরা দেখতে পাই -
প্রথমত, কোনো হিন্দু ইসলাম অবমাননা করলে, কোন সুন্নাহ যেমন দাড়ি টুপি এসব নিয়ে কটাক্ষ করলে তারা হিন্দুর পক্ষই গ্রহণ করে এবং উল্টো মুসলিমদের উগ্রবাদী, মৌলবাদী, জঙ্গি, রাজাকার ইত্যাদি ট্যাগ দেয়। এমনকি মুসলিমদের রক্ত ঝরানোর জন্য মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, কোনো হিন্দু সামান্যতম হেনস্থা কিংবা কথিত হেনস্থার শিকার হলেই সেটাকে মিডিয়া এজেন্ডা হিসেবে প্রচার করে। এটাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, একাত্তরের চেতনার উপর আঘাত হিসেবে প্রচার করে। সেই সাথে এটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়। ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে হিন্দুপ্রেমিক প্রশাসনের হাতে মুসলিমরাই চরমভাবে নির্যাতিত , শোষিত হয়ে দিন পার করলেও তারা এই ন্যারেটিভ দাঁড় করায় যে বাংলাদেশের মুসলিমদের হাতে হিন্দুরা খুবই নির্যাতিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, মুসলিম বা সাধারণ হিন্দু নির্যাতিত হলেও যদি তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসলাম এবং মুসলিমদের সমর্থন করা হয় পরোক্ষভাবেও, তাহলে তারা প্রতিবাদ না করে নীরব থাকে। ইসলামের কোনো অনুষঙ্গের অবমাননা হলে এরা চুপ করে কল্পিত সুখ সাগরে ভেসে যায়। এমনকি এরা পর্দা করা, দাড়ি টুপি , শুদ্ধভাবে সালাম দেওয়া ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোকে জংগীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবেও প্রচার করে।
কাজেই টিপ ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদকারীরা যে আসলে তাদের নিজেদের আদর্শের মানদণ্ডেই দ্বি-মুখী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ ভাবে তারা যে কাদের বন্ধু আর কাদের শত্রু এবং তাদের উদ্দেশ্য কী তাও বলাই বাহুল্য।
আরেকটি ঘটনায় দৃষ্টিপাত করা যাক
ময়মনসিংহে এক হিন্দু ধর্মের ছাত্রীকে নাকি জোর করে বোরখা পরানো হয়েছে। ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া কাওয়ালটি ইসলামিয়া হাইস্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেনীর ছাত্রী চৈতী রাজভর। অথচ ঐ মেয়ে এবং তার বাবা একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছে যে, চৈতি মূলত তার মুসলিম বান্ধবিদের সাথে ম্যাচিং করে বোরখা পরেছিল সখের বসে। তখন সেই স্কুলের হিন্দু শিক্ষিকা গোপা সরকার ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না’ বলে ঐ ছাত্রীর একটি ছবি তুলে নেয়। সেই ছবি দিয়ে ফেইসবুকে ‘হিন্দু ছাত্রীকে জোর করে হিজাব পরানোর’ মিথ্যা দাবি করে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া হয়। বেসরকারি সংস্থা হাঙ্গার প্রজেক্ট এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জয়ন্ত কর-এর কাছে ছবি দিয়েছিলেন ঐ শিক্ষিকা, পরে তিনি নাকি আর কিছুই জানেন না; পোস্টদাতাকেও নাকি চিনেন না তিনি। তার এমন দাবিই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছে মিডিয়া, সুশীল সমাজ, প্রশাসন সবাই।
পুরো ঘটনাটিই যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ নিয়ে কিন্তু কোন উচ্চ বাচ্য নেই। এমনকি এত বড় দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়ার মত অপরাধ করার পরেও সেই হিন্দু শিক্ষিকা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। আপনি যদি আমাদের মত এই সন্দেহ করেন যে, যদি কোন কারনে প্রশাসন তাকে আদর করে 'বুঝিয়ে বলার জন্য' ডেকেও নেয়, জাফর সাহেবরা রাস্তায় এসে তখন বলবেন, ওগো আমাকেও নিয়ে যাও।
এই মডেল গুলো আমাদের সামনে অপরিচিত নয়। আমাদের কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, এটি তাদের নিত্যদিনের কাজ। গাড়ির মধ্যে গরুর গোশত আছে বলে হত্যা করে ফেলা, বাবরি মসজিদে রাতের আধারে মুর্তি রেখে মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া, নিজেরা আগুন দিয়ে মুসলিমদের উপরে দোষ চাপানো। মিল পাওয়া যাচ্ছে সম্পূর্ণই!
প্রিয়া সাহার ঘটনাও আমাদের কাছে বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। সে পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ দিয়েছল যে, বাংলাদেশে নাকি ৩৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৩ কোটি) হিন্দু গায়েব হয়ে গেছে। নিজের ভাইয়ের ভাঙা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সে ট্রাম্পকে বলেছিল যে, মুসলিম মৌলবাদীরা তার বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ তার এলাকার হিন্দুরাই তার এই মিথ্যা নাটক ফাঁস করে দিয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনাতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হলেও, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আবার, সম্প্রতি হিজাব পরে স্কুলে আসায় ২০ জনের মতো ছাত্রীকে গাছের মোটা ডাল দিয়ে চরম মারধর করেছে আমদিনি পাল নামের এক হিন্দু শিক্ষিকা। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে গত ৬ এপ্রিল ২০২২ তারিখে।
নির্যাতনের শিকার ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আফরিন বলেন, বুধবার দুপুরে জাতীয় সংগীতের পর লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনি পাল কেন হিজাব পড়ে স্কুলে এসেছে এ কথা জিজ্ঞাসা করেন এবং ইউক্যালিপ্টাস গাছের ডাল দিয়ে তাদেরকে পিটান। শিক্ষিকা তাদেরকে জানিয়ে দেন - স্কুলে কোনো পর্দা চলবে না। ঢং করে আসছো। বাসায় গিয়ে বোরখা পড়ে থাকো। যখন তোমরা মহাদেবপুর বাজারে যাবে তখন পর্দা করবে। স্কুলে আসলে মাথার কাপড় ফেলে আসবে। তিনি ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার জন্য টানাটানিও করেন। এমনকি যারা হিজাব ছাড়া শুধু মাস্ক পড়ে এসেছিল তাদের মাস্কও খুলে দেন।
সে হুমকি দিয়ে বলে, 'কাল থেকে যদি হিজাব ও মাস্ক পড়ে আসো তাহলে পিটিয়ে তোমাদের পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে।’
অভিভাবকেরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা স্কুল ঘেরাও করেন। কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষিকা এদিন স্কুলে আসেননি। একটি প্রভাবশালী মহল বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে।
কেন টিপ এবং হিজাব ইস্যু এত গরম হয়ে উঠেছিল?
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর যাবত পর্দার উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। পর্দা করার কারণে প্রতিনিয়ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিস আদালত থেকে রাস্তাঘাট সবস্থানেই মুসলিম নারীদের হেনস্থা, অপমান, লাঞ্ছনা বৈশ্যম্যের শিকার হতে হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সম্প্রতি কিছু প্রতিবাদ শুরু হয়েছে মুসলিম নারীদের পক্ষ থেকে। হিজাব বিদ্বেষের ইস্যুগুলো সামনে আসা শুরু করেছে। এর ফলে হিন্দুপ্রেমিক সেকুল্যারদের ইসলাম বিদ্বেষী প্রকৃত চেহারা উন্মোচন হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমন সময় টিপ ও হিজাব ইস্যু তাদের অবস্থান ধরে রেখে উচ্চ স্বরে চিৎকার করার আদর্শ সুযোগ! এর মাধ্যমে আসলে ইসলাম বিদ্বেষী সেকুল্যাররা যেমন হিজাব বিদ্বেষ থেকে মুসলিমদের মনোযোগ ঘোরাতে পারবে, সেই সাথে বাংলাদেশ ধর্মান্ধ উগ্রবাদী, মৌলবাদীদের দখলে চলে গিয়েছে যারা রাস্তাঘাটে হিন্দু শিক্ষিকাকে সামান্য টিপ পরার কারণে লাঞ্ছিত করে এমন ন্যারেটিভ সামনে নিয়ে এসে মুসলিমদের, বিশেষ করে হিজাব নিয়ে আন্দোলনকারীদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়া যাবে।
সেই সাথে কর্ণাটকের হিজাব ইস্যুতে এবং ইসলামবিদ্বেষী নানান ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আছে। এই সুযোগে ভারত টিপ পরার ইস্যুকে হাইলাইট করে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করবে। নিজেদের উপর থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ ঘুরাবে। এই কাজ শুরু করেছে ভারত ইতিমধ্যে। টিপ পরায় বাংলাদেশের পুলিশ সদস্য হিন্দু শিক্ষিকাকে খুন করার হুমকি দিয়েছে এমন বক্তব্য সামনে রেখে তারা মিছিল শোডাউন শুরু করেছে। এই চক্রটি আসলে অনেক পুরোনো।
মোদী-প্রেমিক বুদ্ধিজীবী আর ভারতের দালাল মিডিয়ার চেহারা আমাদের সামনে স্পষ্ট। বাংলাদেশে মুসলিমরা জনসংখ্যার আকারে সংখ্যাগুরু হলেও আসলে তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু। হিন্দুরা নয়, বরং মোদি প্রেমিকদের হাতে হিজাব পরা, দাড়ি টুপি পাঞ্জাবির কারণেই তারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। হাজার সাল কা বাদলা লে লিয়া- ইন্দিরা গান্ধির এই উক্তি ছিল ইসলামের প্রতি শতভাগ আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। আজও তাদের দালালরা আমাদের মাঝেই আছে, আমাদেরকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
ভারতের মরণ-কামড় এবং আমাদের করণীয়
এ দেশে আমি এবং আপনি যদি ইসলাম মেনে চলতে চাই, তবে আমরা নিরাপদ নই। কারণ, আমাদের এই সিস্টেম যা ভারতের কাছে দাসত্বের দস্তখতে পরিচালিত,- তা ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু! তাদের শত্রুতা ব্যাক্তি আমি কিংবা আপনার সাথে নয়। তাদের শত্রুতা আমাদের দ্বীন, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের ধর্ম, আমাদের ইসলামী মুল্যবোধ আর আমাদের ইসলামের সাথে।
আমাদেরকে এই সত্য স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে যে, দিনে দিনে মুসলিমরাই এ দেশে সংখ্যালঘু হচ্ছেন, অ-পরিচিত হচ্ছেন, আর সবচেয়ে বেশী অ নিরাপদ হচ্ছেন। এবং দাদা-বাবুরারাই দিন দিন আরো কাছের মানুষ হচ্ছে, আপন জন হচ্ছে।
মনে রাখতা হবে, এ দেশে নাজমুল তারেকরাই মাজলুম এবং তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিক ভাবে জুলুমের শিকার, শুধুমাত্র ইসলামের কারণে। এটি ই হচ্ছে সেই অনিবার্য সঙ্ঘাতের অশনি সংকেত, আগ্রাসী ভারতের কাছে দস্তখত দেয়া দাসত্বের জিন্দেগির নমুনা মাত্র!
আমাদেরকে ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থার দিকেও নজর রাখতে হবে। আফগানিস্তানে তালিবানের হাতে পশ্চিমা ও আগ্রাসী জোটের শোচনীয় পরাজয় থেকে ভারত এটা বুঝতে পেরেছে যে, কাশ্মীর অচিরেই তার হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। তাই কাশ্মীরে দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে এবং উপমহাদেশের মুসলিমদের আরও কোণঠাসা করতে ভারত এখন মরণকামড় দিচ্ছে। কাশ্মীরে তারা ব্যাপক সৈন্য সমাগম করেছে। পাশাপাশি ভারতজুড়ে ইসলামবিদ্বেষী উগ্র জিঘাংসা ছড়িয়ে দিতে হিন্দুত্ববাদীদেরকে ‘অঘোষিত ফ্রি লাইসেন্স’ দিয়ে রেখেছে। তারা ভারতজুড়ে মুসলিমদের সাথে যা ইচ্ছা তাই আচরণ করছে। একের পর এক ইস্যু সামনে এনে মুসলিমদের উস্কে দিচ্ছে, যাতে করে মুসলিম গণহত্যা শুরু করার একটা অজুহাত দার করানো যায়।
গো-রক্ষা ইস্যু, এনআরসি, সিএএ, ধারা ৩৭০ বাতিল, মুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস, নামাজে বাঁধা দান, হিজাব ইস্যু, সবশেষ মাইকে আজান দেওয়া নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি - এসবই করা হচ্ছে সাধারণ হিন্দুদেরকে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যায় সংযুক্ত করতে। কারণ এটা করা ছাড়া মুসলিমমুক্ত অখণ্ড ভারত গড়ার অলীক স্বপ্ন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আসাম ও ত্রিপুরায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম নিধন ও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের পর, সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের একের পর এক মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়া ও গণহত্যা বাস্তবায়নের শপথ পাঠে এটা নিশ্চিত যে, ভারতের মুসলিমদের উপর এক চূরান্ত গণহত্যা আসন্ন। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ডঃ উইলিয়াম স্ট্যান্টনের মত ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে এমন সতর্কতা জারি করেছেন। কোন কোন বিশ্লেষক এটাও বলেছে যে, ভারতে সল্প মাত্রায় গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে; এখন তা শুধু ব্যাপক আকারে শুরু হওয়ার পালা। কাশ্মীর পরিস্থিতিও তাদেরকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য করেছে; যদিও কাশ্মীরে সল্প মাত্রায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন মুসলিমরা, যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে।
সকল শ্রেণীর হিন্দুদের মুসলিম গণহত্যায় উস্কে দিতে শেষ কাজটি করেছে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি। মুসলিমদের হাতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ার মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী নিয়ে বানাও ছবিটিতে হিন্দুদেরকে ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করে, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদেরকে উগ্র, মৌলবাদী, কামুক ও রক্তপিপাশু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; যদিও কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে দখলদার ভারতীয় সৈন্যরা একদিকে মুসলিমদেরকে হাজারে হাজারে গুম-খুন-ধর্ষণ করছে। আরেকদিকে মন্দিরের পুরোহিত ও বাবা-ছেলের হাতে ৮ বছরের শিশু আসিফা ধর্ষণ ও হত্যায় মতো ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে এমনভাবে দর্শকদের প্রভাবিত করেছে যে, ভারতজুড়ে ইতিহাস না জানা সাধারণ হিন্দুরা মুসলিমদেরকেই অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে। বিভিন্ন হলে হলে গিয়ে সিনেমা শেষ হওয়ার পর বিজেপি, আরএসএস, বজরং দল ও হিন্দুসভার নেতা-কর্মীরা ভাষণ দিয়ে দর্শকদের জিঘাংসা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর আবার বাইরে এসে সেই দর্শকরা শুনছে তাদের ধর্মীয় গুরুদের মুসলিম নিধনের আহ্বান। হিন্দু ঐ কথিত ধর্মগুরুরা এমনকি মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ করার প্রকাশ্য আহ্বানও জানাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, পূজা-পারবন ও হনুমান চল্লিসার পরে উগ্র হিন্দুরা মিছিল নিয়ে মুসলিমদের বাড়ি-ঘর ও দোকান-পার্টে হামলা চালাচ্ছে, অগ্নি-সংযোগ করছে, মসজিদে গেরুয়া পতাকা টানিয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি বিতর্কিত ধর্মগুরু জ্যোতি নরসিংহানন্দ আবারো মুসলিমদের মারতে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এর পরপরই আরেক কথিত ধর্মগুরু জ্যোতি কৃষ্ণানন্দ প্রস্তাবিত মুসলিম গণহত্যার জন্য একটি তফসিল ঘোষণা করেছে; এতে সে পূর্ব উত্তরপ্রদেশ থেকে এটি শুরু হবে বলেও জানিয়েছে।
ঐ উগ্র সাধু কৃষ্ণানন্দ ঘোষণা করেছে যে, "প্রস্তাবিত গণহত্যা শুরু হবে পূর্বাচল (পূর্ব উত্তরপ্রদেশ) থেকে। আমরা ধর্ম যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।"
আবারো আমরা ডঃ স্ট্যান্টন এবং অন্যান্য গণহত্যা বিশেষজ্ঞের সতর্কবার্তা মনে করিয়ে দিচ্ছি। তারা বলছেন যে, ভারত ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা বাস্তবায়নের ঠিক আগের ধাপে রয়েছে, এবং সেখানে ক্ষুদ্র পরিসরে মুসলিম গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে।
নিজ দেশের মুসলিমদের এভাবে গণহত্যার দিকে ধাবিত করার পাশাপাশি, বাংলাদেশেই সেই গণহত্যার ঢেউ আছড়ে ফেলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে, বিজেপি নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী এবং অন্যান্যরা বাংলাদেশ দখল করার হুমকি দিয়েছে বহুবার। পাশাপাশি তারা তাদের এদেশীয় দালালদেরকে দিয়ে কথিত ‘হিন্দু নির্যাতনের’ ন্যারেটিভ দার করিয়ে এদেশে সেনা অনুপ্রবেশ ঘটানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে। গত বছর কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার জেরে যখন ‘অচেনা লোকেরা’ বিভিন্ন মন্দিরে হামলা-ভাংচুর চালিয়েছিল, তখন ভারতের বিভিন্ন নেতা এবং বিশেষ করে ইস্কনের নেতারা জাতিসংঘে এই মর্মে চিঠি দিয়েছিল যে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে, এবং জাতিসংঘ সেখানে সেনা পাঠাক, অথবা ভারত সেখানে হিন্দু রক্ষায় সেনা পাঠাক।
বাংলাদেশেও ভারতের ইশারায় ইস্কন ও হিন্দু মহাজোটের মতো উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে নানান উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এমনকি তারা মুসলিমদের উপর হামলা চালাতে হিন্দুদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহিত করছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি’র প্রধান দিলিপ ঘোষ আবার বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশেকে ভারতের অংশ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা এখন স্পষ্ট যে, ভারতে মুসলিম গণহত্যা শুরু করেই তারা হাত বাড়াবে বাংলাদেশের দিকে। কিংবা কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন,- এমনও হতে পারে যে, বাংলাদেশে আবার কোন বড় ধরণের ‘হিন্দু নির্যাতনের নাটক’ মঞ্চায়ন করে সেটাকেও তারা একই সাথে বাংলাদেশে সরাসরি আগ্রাসন চালানোর এবং ভারতে ব্যাপক-ভিত্তিক মুসলিম গণহত্যা শুরু করার অজুহাত হিসেবে দার করাতে পারে।
বিশ্লেষকরা এখন এটাও স্পষ্ট করেই বলছেন যে - আগ্রাসী ভারত, ভারতের অনুগত এদেশের শাসন কাঠামো, কথিত বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া, শিক্ষা ব্যাবস্থা, সামাজিক ব্যাবস্থা, সংস্কৃতি সকল কিছু সুনির্দিষ্টভাবে ইসলাম ও মুসলিমের প্রতি আক্রমন করেই যাচ্ছে। আমরা অধিকাংশই ভুলে থাকার কিংবা চোখ বন্ধ করে থাকার বিলাসিতা উপভোগ করতে পারি; তবে সেক্ষেত্রে আসন্ন বিপদের সময়ে শুধু নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ করতে পারব না।
তবে, শত্রুজোট যতো শক্তিশালীই হোক, তারা কিন্তু অপরাজেয় নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে ভারত ও বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনাগুলো, মিডিয়া ও সুশীলদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এবং তাদের জঘন্য চক্রান্তগুলো সামনে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য।
সেই সাথে হক্কানি উলামায়ে কেরামের মুসলিমদের প্রতি ‘নববী মানহাজ’ অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের যে আহ্বান- সেটা ব্যাপকভাবে যদি সাধারণ মুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা সম্ভাব্য বিপদের মাত্রা কমিয়ে আনতে পাড়বো অনায়াসে।
বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, এখন আমাদেরকে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কেননা আমাদের শত্রুরা ইতিমধ্যে তাদের জিঘাংসা ও আক্রোশ স্পষ্ট করে দিয়েছে। এখনো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা সম্পর্কে দোলাচলে থাকা নিঃসন্দেহে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় হবে বলেই মনে করেন তাঁরা। কেননা এই অবস্থান বাতিলের বিরুদ্ধে হক্কের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের অবস্থান। এগিয়ে আসা একজন মুসলিম হিসেবে আপনার আমার কর্তব্য। আর কালবিলম্ব শুধু আপনার-আমার বিপদকেই ঘনীভূত করতে পারবে।
লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর
তথ্যসূত্র :
১। টিপ নিয়ে কটূক্তির প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি
- https://tinyurl.com/2p83krs2
২। ময়মনসিংহে হিন্দু মেয়েকে জোর করে বোরকা পরানোর অভিযোগ । সত্য নাকি গভীর ষড়যন্ত্র
- https://tinyurl.com/smxmr98c
৩। নওগাঁয় হিজাব পরার অপরাধে ২০ ছাত্রীকে পেটালেন শিক্ষিকা
- https://tinyurl.com/378864ve
৪। ‘মুসলিমদের মারতে অস্ত্র তুলে নিন’, জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ফের ‘ঘৃণা ভাষণ’ বিতর্কিত ধর্মগুরুর
- https://tinyurl.com/2p9yhd2d
৫। Clashes erupt in India’s New Delhi during Hindu procession
- https://tinyurl.com/4fb85dfb
৬। Hindu Monk Announces ‘Dharam Yudh’ against Muslims
- https://tinyurl.com/ydjeheme
video link - https://tinyurl.com/yh793vmz
Comment