নরসিংদী থেকে শ্বেতপত্র : কথিত প্রগতিশীল-বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার মুখোশ উন্মোচন
বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহলের যে অংশটি কথিত অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তাদের মধ্যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা ঘাদানিক অন্যতম; হলুদ মিডিয়ার কাভারেজও তারাই পায় বেশি। কথিত উদারপন্থী-বামপন্থী সকলেরই অংশগ্রহণ ও সমর্থন আছে এদের সাথে। এই কথিত সুশীল ও মিডিয়া চক্র মূলত প্রগতিশীলতা-অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি মুখরোচক শ্লোগানের আড়ালে ইসলাম বিরধিতা এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রচার ও প্রসার করে। তবে এই সুশীল-মিডিয়া চক্রের কৌশলে ইসলাম বিদ্বেষ ও বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিষয়টি সম্প্রতি ‘১১৬ জন সম্মানিত আলেমের নামে শ্বেতপত্র’ প্রকাশ, এবং ‘নরসিংদীতে অশ্লীল পোশাক পরিহিতা নারীকে সমর্থনের’ ঘটনায় আবারো জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
প্রথমেই আমরা নরসিংদীর ঘটনায় দৃষ্টিপাত করব।
কিছুদিন আগেই নরসিংদিতে অশ্লীল পোশাক পরিহিতা এক মেয়েকে কথিত হেনস্থার ঘটনায় দেশের কথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং মিডিয়া বেশ সরব ছিল। অশ্লীল পোশাক এবং অশ্লীলতার পক্ষে কিছু একটা করতে বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, চেতনাজীবী সকলের সরব উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। তাদের অনুসারিদেরকে আবার লাঠি নিয়ে মিছিল ও প্রতিবাদও করতে দেখা গছে।
আবার অপর একটি ঘটনায় আমরা দেখলাম- প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী একজন নারীকে লাঠি পেটা করতে করতে রাস্তায় ফেলে দেয় এবং তারপরেও লাঠি পেটা করা হয়। কিন্তু সেই ঘটনায় কোন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী বা চেতনাজীবীকে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি।
নরসিংদীর ঘটনায় প্রশাসন একজন বয়স্ক মহিলাকে গ্রেফতার দেখিয়ে খুবই কৃতিত্ব দাবি করছে। সেই পর্দানশীল নারীর অপরাধ ছিল এটাই যে, তিনি অশ্লীল পোশাক পরিহিতা সেই তরুণীকে তার পোশাকের ব্যপারে বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের অশ্লীল ও ‘কথিত স্বাধীনচেতা’ পোশাকের বিরুদ্ধে কথা শুনেই সেই মেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। সে তার কথিত বন্ধুদের নিয়ে একজন বয়স্ক মহিলার সাথে অকথ্য ভাষায় বিবাদ শুরু করে দেয়। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই স্টেশনের অন্যরা এগিয়ে আসেন এই বয়স্ক মহিলার পক্ষে।
কিন্তু মিডিয়া এটাকে ‘নারীর কথিত স্বাধীনতার উপর ধর্মান্ধ সমাজের হস্তক্ষেপ’ হিসেবে উপস্থাপন করে। অবশ্য এই মিডিয়ার চরিত্র এমনই; এরা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণই করে থাকে। আর অশ্লীলতা এবং অশ্লীলতার ধারক-বাহকদের পক্ষে এরা যারপরনাই নিবেদিতপ্রাণ।
একজন শিক্ষিকা যখন বাধ্য হয়ে তার দশম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলের সাথে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দেয়, তখন তারা ঐ শিক্ষিকার শাস্তি দাবি করে। আবার স্কুল পড়ুয়া সমকামি যুগল বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে যখন তাদের পরিবার তাদেরকে ধরে আনে, তখন তারা ঐ অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামি জুগলের পক্ষ হয়ে শিরোনাম করে- “ঘর বাঁধা হল না বিলকিস-আঁখির, অবশেষে খালি হাতেই ফিরে যেতে হল বাড়ি।” এরা তাদেরকে সেলিব্রেটি বানায় যারা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে হাতের তালুতে অশ্লীল স্লোগান দেখায়!
টিপ ইস্যুতেও আমরা দেখেছিলাম, অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই তারা নাজমুল তারেকের বিরুদ্ধে এবং ঐ হিন্দু শিক্ষিকার পক্ষে টিপ পরে প্রতিবাদ জানিয়েছে, টক-শো ও মিডিয়াতে তরকের ঝড় উঠিয়েছে। কিন্তু তদন্তে যখন নাজমুল তারেক নিরদশ প্রমাণিত হল, এবং ঐ হিন্দু শিক্ষিকা মিথ্যা অভিযোগকারী প্রমাণিত হল, তখন এই সুশীলরা এবং এদের অনুসারীরা একেবারেই নিসচুপ হয়ে যায়।
ইসলামি চিন্তাবীদরা তাই বলছেন, আসলে অশ্লীলতা এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থায়ী হয়ে গেছে। তাই অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সমাজের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াও তারা সহ্য করতে পারে না। আর এর মাধ্যমে যদি ইসলাম ও মুসলিমদের হেয় করার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তো তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে আসবে।
এরা কি তাহলে এটাই চায় যে, আমাদের এই সমাজ অশ্লীলতায় ভরে যাক, এখান থেকে সভ্যতা উঠে যাক, আর নগ্নতা ও অশ্লীলতা প্রসার পাক? এটি তাদের সুপরিকল্পিত এজেন্ডা নয় কি? জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রশ্নগুলোর জবাব সম্পর্কে আমাদেরকে একমত হতে হবে।
অশ্লীল এবং একই সাথে অসামাজিক পোশাকের পক্ষে এরা কতটা সরব হল! অথচ একজন বয়স্ক মহিলাকে গ্রেফতার করে যখন তার শরীর থেকে বোরকা খুলে ফেলতে বাধ্য করা হল, তখন তাঁর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে তারা কিছুই বলেনি। কারণ এটা করলে আদতে ইসলামের পক্ষে কথা বলা হয়ে যাবে, তাই তারা এটা করেনি। একজন বোরকা পরিহিতা পর্দানশীন মহিলাকে কোন আইনে তারা বোরকা খুলতে বাধ্য করল- এই প্রশ্নও তারা কেউ করেনি!
এবার সম্মানিত আলেমে-দ্বীনদের বিরুদ্ধে ঘাদানিক’এর শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনায় নজর দেওয়া যাক।
গত মাসেই দেশের শতাধিক আলেম এবং সহস্রাধিক মাদ্রাসার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে অর্থায়নের সম্পর্ক এনে “মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন” নামক কথিত গণকমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত এই কথিত গনকমিশন তাদের ঐ মনগড়া প্রতিবেদন বা শ্বেতপত্র জমা দিয়েছে দুদক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয়ে।
দেশের প্রচলিত মানব রচিত আইন অনুযায়ী, এমন কাজের কোন অধিকার এই কথিত কমিশনের নেই। স্বাধীন কোন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন রকম তদন্ত, অনুসন্ধান বা নজরদারি করার অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র বিচার বিভাগ কিংবা প্রশাসনের যথাযথ ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে।
আর বাস্তবতা হচ্ছে – বর্তমানে আমাদের এই দেশ আজ ইসলাম বিদ্বেষের অন্যতম শ্রেনীকক্ষে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, মিডিয়া, প্রশাসন – সমস্ত জায়গাতেই আজ ইসলাম বিদ্বেষ প্রবল। উল্লেখিত এসকল সেক্টরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণও প্রবল। এমন অবস্থায় ইসলাম বিদ্বেষের এই উর্বর ভূমিতে কথিত গণকমিশন তদন্তের নামে ইসলামের উপরে আক্রমন করে এদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের কোণঠাসা করতে চাইবে – এটা খুবই স্বাভাবিক!
কমিশনের নামের দিকেও দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।
ঘাদানিক কমিশনটির নাম দিয়েছে – ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বর্তমান সময়ে এই নামগুলোর বিশেষ রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। এই নামগুলো শুধুমাত্র কিছু শব্দ নয়, বরং এই বিশেষ নামগুলোর সহায়তায় তৈরি করা হয় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতপন্থা, মোকাবেলা করা হয় প্রতিপক্ষকে। বিশেষ ভাবে বর্তমান সময়ে স্থানীয় এবং বিশ্ব রাজনীতিতে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ এই পরিভাষা গুলো উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাবহার করা হয়। বর্তমান বিশ্বে যত জায়গায় আমরা স্থানীয় বা বৈশ্বিক ভাবে আগ্রাসন, জুলুম, নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখতে পাই, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই পরিভাষাগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যায়, এবং নির্যাতনের শিকার হিসেবে দেখা যায় ইসলাম এবং মুসলিমদের। এভাবেই ভারতের আজ্ঞাবহ আমাদের এই দালাল সরকার ও রাষ্ট্রব্যাবস্থা শত্রু বা প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসলাম এবং মুসলিমদের বেছে নিয়েছে।
তাছাড়া আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, যে কথিত গণকমিশন মাদ্রাসাগুলোর সাথে সন্ত্রাসী অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তাদের নিজেদের অর্থায়ন কিভাবে হয়? শাহরিয়ার কবির অবসর গ্রহণ করেছে ১৯৯২ সালে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত ঘাদানিকের অর্থায়ন কে করে? তারা তাদের কথিত এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞের অর্থ কোথায় পায়?
এর উত্তর আমরা খুঁজে পাব ডিজিএফআই এর অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ হালিমের বক্তব্যে। এই সম্পর্কে তিনি বলেছেন, -“আবার অনেককে র ভাতাও প্রদান করে থাকে। এসব ব্যাক্তিবর্গ র এর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে এবং র এর দেয়া নীতি আদর্শ প্রচার করে।”
এই গণকমিশনের আরেক মুখ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক নিজেই মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগে অভিযুক্ত। লন্ডনে তার ৩-৪ টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, যার কোনটির মূল্য ২ লাখ পাউন্ডেরও বেশি। সেই অর্থ সে কিভাবে উপার্জন করেছে বা কিভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে- ের উপযুক্ত কোন উত্তর সে দিতে পারেনি। আর বিচারক হিসেবেও তার কর্মকাণ্ড এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল যে, খোদ আওয়ামীলীগের নেতারাই তাকে অপসারনের দাবি জানিয়েছিল।
কমিটির আরেক সদস্য তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে স্বয়ং তার মা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে যে, তার মেয়েকে অনৈতিক কাজে বাঁধা দেওয়ায় সে উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। নিজের ভাইকেও সে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বাবার বাড়ি একাই দখল করে আছে। এই মানিক-তুরিন গংরাই কিনা ১১৬ জন আলেম ও হাজার মাদ্রাসার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শ্বেতপত্র প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! আর এই কথিত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিজীবন অনুসন্ধান করলে সকলের অবস্থাই একই রকম পাওয়া যাবে।
কথিত গণকমিশন এ দেশের আলেমশ্রেনী এবং মাদ্রাসা গুলোকে টার্গেট করে আসলে ইসলামকেই টার্গেট করেছে। তাঁরা তাদের ইসলামবিদ্বেষ আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি। আগ্রাসী ভারতের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা “র” অনবরত এ দেশে ইসলাম বিদ্বেষ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত এবং তাদের এই কাজে সহায়তা করে থাকে এ দেশেরই কথিত এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। ডিজিএফআই এর অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ হালিম বলেছিলেন, “র’এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামপন্থীদের স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।”
কথিত প্রগতিবাদী সুশীল-মিডিয়া চক্র এবং এই গণকমিশন, এদের এজাতীয় কর্মকাণ্ড আসলে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণের নামান্তর। এখানে আসলে কথিত গণকমিশন মুল শত্রু নয়, তারা কেবল ফুট-সোলজার মাত্র। বরং আগ্রাসী ভারত এবং ভারতের আজ্ঞাবহ ইসলাম বিরোধী সরকারই হচ্ছে মূল শত্রু। এরা সকলে মিলে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ বানাতে এদেশেও ভারতের সমান্তরাল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।
বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, কথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও মিডিয়া আসলে এদেশে অশ্লীলতা বেহায়াপনা, নোংরা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং হিন্দুত্ববাদের এদেশীয় ধারক, বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। এরা আজ ইসলামের সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতায় নেমেছে। তাদের এসকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা এদেশে একদিকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, অপরদিকে ভারতজুড়ে মুসলিমদের উপর যে ক্রেকডাউন চলছে- সেদিক থেকেও এদেশের মুসলিমদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে চাইছে। এদেশে এরা কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের ন্যূনতম উপস্থিতি মেনে নিবে না; এরা এদেশে কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে থাকতে দেবে না। এদেরকে তাই ভালমত চিনে নেওয়া, এবং এদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকা ও অপরকে সজাগ করে মানসিকভাবে এদের মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকাকে জাতির জন্য আবশ্যক মনে করছেন ইসলামি চিন্তাবীদগণ।
লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর
বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহলের যে অংশটি কথিত অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তাদের মধ্যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা ঘাদানিক অন্যতম; হলুদ মিডিয়ার কাভারেজও তারাই পায় বেশি। কথিত উদারপন্থী-বামপন্থী সকলেরই অংশগ্রহণ ও সমর্থন আছে এদের সাথে। এই কথিত সুশীল ও মিডিয়া চক্র মূলত প্রগতিশীলতা-অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি মুখরোচক শ্লোগানের আড়ালে ইসলাম বিরধিতা এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রচার ও প্রসার করে। তবে এই সুশীল-মিডিয়া চক্রের কৌশলে ইসলাম বিদ্বেষ ও বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিষয়টি সম্প্রতি ‘১১৬ জন সম্মানিত আলেমের নামে শ্বেতপত্র’ প্রকাশ, এবং ‘নরসিংদীতে অশ্লীল পোশাক পরিহিতা নারীকে সমর্থনের’ ঘটনায় আবারো জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
প্রথমেই আমরা নরসিংদীর ঘটনায় দৃষ্টিপাত করব।
কিছুদিন আগেই নরসিংদিতে অশ্লীল পোশাক পরিহিতা এক মেয়েকে কথিত হেনস্থার ঘটনায় দেশের কথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং মিডিয়া বেশ সরব ছিল। অশ্লীল পোশাক এবং অশ্লীলতার পক্ষে কিছু একটা করতে বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, চেতনাজীবী সকলের সরব উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। তাদের অনুসারিদেরকে আবার লাঠি নিয়ে মিছিল ও প্রতিবাদও করতে দেখা গছে।
আবার অপর একটি ঘটনায় আমরা দেখলাম- প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী একজন নারীকে লাঠি পেটা করতে করতে রাস্তায় ফেলে দেয় এবং তারপরেও লাঠি পেটা করা হয়। কিন্তু সেই ঘটনায় কোন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী বা চেতনাজীবীকে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি।
নরসিংদীর ঘটনায় প্রশাসন একজন বয়স্ক মহিলাকে গ্রেফতার দেখিয়ে খুবই কৃতিত্ব দাবি করছে। সেই পর্দানশীল নারীর অপরাধ ছিল এটাই যে, তিনি অশ্লীল পোশাক পরিহিতা সেই তরুণীকে তার পোশাকের ব্যপারে বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের অশ্লীল ও ‘কথিত স্বাধীনচেতা’ পোশাকের বিরুদ্ধে কথা শুনেই সেই মেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। সে তার কথিত বন্ধুদের নিয়ে একজন বয়স্ক মহিলার সাথে অকথ্য ভাষায় বিবাদ শুরু করে দেয়। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই স্টেশনের অন্যরা এগিয়ে আসেন এই বয়স্ক মহিলার পক্ষে।
কিন্তু মিডিয়া এটাকে ‘নারীর কথিত স্বাধীনতার উপর ধর্মান্ধ সমাজের হস্তক্ষেপ’ হিসেবে উপস্থাপন করে। অবশ্য এই মিডিয়ার চরিত্র এমনই; এরা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণই করে থাকে। আর অশ্লীলতা এবং অশ্লীলতার ধারক-বাহকদের পক্ষে এরা যারপরনাই নিবেদিতপ্রাণ।
একজন শিক্ষিকা যখন বাধ্য হয়ে তার দশম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলের সাথে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দেয়, তখন তারা ঐ শিক্ষিকার শাস্তি দাবি করে। আবার স্কুল পড়ুয়া সমকামি যুগল বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে যখন তাদের পরিবার তাদেরকে ধরে আনে, তখন তারা ঐ অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামি জুগলের পক্ষ হয়ে শিরোনাম করে- “ঘর বাঁধা হল না বিলকিস-আঁখির, অবশেষে খালি হাতেই ফিরে যেতে হল বাড়ি।” এরা তাদেরকে সেলিব্রেটি বানায় যারা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে হাতের তালুতে অশ্লীল স্লোগান দেখায়!
টিপ ইস্যুতেও আমরা দেখেছিলাম, অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই তারা নাজমুল তারেকের বিরুদ্ধে এবং ঐ হিন্দু শিক্ষিকার পক্ষে টিপ পরে প্রতিবাদ জানিয়েছে, টক-শো ও মিডিয়াতে তরকের ঝড় উঠিয়েছে। কিন্তু তদন্তে যখন নাজমুল তারেক নিরদশ প্রমাণিত হল, এবং ঐ হিন্দু শিক্ষিকা মিথ্যা অভিযোগকারী প্রমাণিত হল, তখন এই সুশীলরা এবং এদের অনুসারীরা একেবারেই নিসচুপ হয়ে যায়।
ইসলামি চিন্তাবীদরা তাই বলছেন, আসলে অশ্লীলতা এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থায়ী হয়ে গেছে। তাই অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সমাজের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াও তারা সহ্য করতে পারে না। আর এর মাধ্যমে যদি ইসলাম ও মুসলিমদের হেয় করার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তো তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে আসবে।
এরা কি তাহলে এটাই চায় যে, আমাদের এই সমাজ অশ্লীলতায় ভরে যাক, এখান থেকে সভ্যতা উঠে যাক, আর নগ্নতা ও অশ্লীলতা প্রসার পাক? এটি তাদের সুপরিকল্পিত এজেন্ডা নয় কি? জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রশ্নগুলোর জবাব সম্পর্কে আমাদেরকে একমত হতে হবে।
অশ্লীল এবং একই সাথে অসামাজিক পোশাকের পক্ষে এরা কতটা সরব হল! অথচ একজন বয়স্ক মহিলাকে গ্রেফতার করে যখন তার শরীর থেকে বোরকা খুলে ফেলতে বাধ্য করা হল, তখন তাঁর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে তারা কিছুই বলেনি। কারণ এটা করলে আদতে ইসলামের পক্ষে কথা বলা হয়ে যাবে, তাই তারা এটা করেনি। একজন বোরকা পরিহিতা পর্দানশীন মহিলাকে কোন আইনে তারা বোরকা খুলতে বাধ্য করল- এই প্রশ্নও তারা কেউ করেনি!
এবার সম্মানিত আলেমে-দ্বীনদের বিরুদ্ধে ঘাদানিক’এর শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনায় নজর দেওয়া যাক।
গত মাসেই দেশের শতাধিক আলেম এবং সহস্রাধিক মাদ্রাসার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে অর্থায়নের সম্পর্ক এনে “মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন” নামক কথিত গণকমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত এই কথিত গনকমিশন তাদের ঐ মনগড়া প্রতিবেদন বা শ্বেতপত্র জমা দিয়েছে দুদক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয়ে।
দেশের প্রচলিত মানব রচিত আইন অনুযায়ী, এমন কাজের কোন অধিকার এই কথিত কমিশনের নেই। স্বাধীন কোন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন রকম তদন্ত, অনুসন্ধান বা নজরদারি করার অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র বিচার বিভাগ কিংবা প্রশাসনের যথাযথ ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে।
আর বাস্তবতা হচ্ছে – বর্তমানে আমাদের এই দেশ আজ ইসলাম বিদ্বেষের অন্যতম শ্রেনীকক্ষে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, মিডিয়া, প্রশাসন – সমস্ত জায়গাতেই আজ ইসলাম বিদ্বেষ প্রবল। উল্লেখিত এসকল সেক্টরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণও প্রবল। এমন অবস্থায় ইসলাম বিদ্বেষের এই উর্বর ভূমিতে কথিত গণকমিশন তদন্তের নামে ইসলামের উপরে আক্রমন করে এদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের কোণঠাসা করতে চাইবে – এটা খুবই স্বাভাবিক!
কমিশনের নামের দিকেও দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।
ঘাদানিক কমিশনটির নাম দিয়েছে – ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বর্তমান সময়ে এই নামগুলোর বিশেষ রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। এই নামগুলো শুধুমাত্র কিছু শব্দ নয়, বরং এই বিশেষ নামগুলোর সহায়তায় তৈরি করা হয় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতপন্থা, মোকাবেলা করা হয় প্রতিপক্ষকে। বিশেষ ভাবে বর্তমান সময়ে স্থানীয় এবং বিশ্ব রাজনীতিতে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ এই পরিভাষা গুলো উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাবহার করা হয়। বর্তমান বিশ্বে যত জায়গায় আমরা স্থানীয় বা বৈশ্বিক ভাবে আগ্রাসন, জুলুম, নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখতে পাই, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই পরিভাষাগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যায়, এবং নির্যাতনের শিকার হিসেবে দেখা যায় ইসলাম এবং মুসলিমদের। এভাবেই ভারতের আজ্ঞাবহ আমাদের এই দালাল সরকার ও রাষ্ট্রব্যাবস্থা শত্রু বা প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসলাম এবং মুসলিমদের বেছে নিয়েছে।
তাছাড়া আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, যে কথিত গণকমিশন মাদ্রাসাগুলোর সাথে সন্ত্রাসী অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তাদের নিজেদের অর্থায়ন কিভাবে হয়? শাহরিয়ার কবির অবসর গ্রহণ করেছে ১৯৯২ সালে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত ঘাদানিকের অর্থায়ন কে করে? তারা তাদের কথিত এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞের অর্থ কোথায় পায়?
এর উত্তর আমরা খুঁজে পাব ডিজিএফআই এর অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ হালিমের বক্তব্যে। এই সম্পর্কে তিনি বলেছেন, -“আবার অনেককে র ভাতাও প্রদান করে থাকে। এসব ব্যাক্তিবর্গ র এর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে এবং র এর দেয়া নীতি আদর্শ প্রচার করে।”
এই গণকমিশনের আরেক মুখ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক নিজেই মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগে অভিযুক্ত। লন্ডনে তার ৩-৪ টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, যার কোনটির মূল্য ২ লাখ পাউন্ডেরও বেশি। সেই অর্থ সে কিভাবে উপার্জন করেছে বা কিভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে- ের উপযুক্ত কোন উত্তর সে দিতে পারেনি। আর বিচারক হিসেবেও তার কর্মকাণ্ড এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল যে, খোদ আওয়ামীলীগের নেতারাই তাকে অপসারনের দাবি জানিয়েছিল।
কমিটির আরেক সদস্য তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে স্বয়ং তার মা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে যে, তার মেয়েকে অনৈতিক কাজে বাঁধা দেওয়ায় সে উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। নিজের ভাইকেও সে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বাবার বাড়ি একাই দখল করে আছে। এই মানিক-তুরিন গংরাই কিনা ১১৬ জন আলেম ও হাজার মাদ্রাসার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শ্বেতপত্র প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! আর এই কথিত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিজীবন অনুসন্ধান করলে সকলের অবস্থাই একই রকম পাওয়া যাবে।
কথিত গণকমিশন এ দেশের আলেমশ্রেনী এবং মাদ্রাসা গুলোকে টার্গেট করে আসলে ইসলামকেই টার্গেট করেছে। তাঁরা তাদের ইসলামবিদ্বেষ আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি। আগ্রাসী ভারতের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা “র” অনবরত এ দেশে ইসলাম বিদ্বেষ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত এবং তাদের এই কাজে সহায়তা করে থাকে এ দেশেরই কথিত এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। ডিজিএফআই এর অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ হালিম বলেছিলেন, “র’এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামপন্থীদের স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।”
কথিত প্রগতিবাদী সুশীল-মিডিয়া চক্র এবং এই গণকমিশন, এদের এজাতীয় কর্মকাণ্ড আসলে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণের নামান্তর। এখানে আসলে কথিত গণকমিশন মুল শত্রু নয়, তারা কেবল ফুট-সোলজার মাত্র। বরং আগ্রাসী ভারত এবং ভারতের আজ্ঞাবহ ইসলাম বিরোধী সরকারই হচ্ছে মূল শত্রু। এরা সকলে মিলে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ বানাতে এদেশেও ভারতের সমান্তরাল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।
বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, কথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও মিডিয়া আসলে এদেশে অশ্লীলতা বেহায়াপনা, নোংরা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং হিন্দুত্ববাদের এদেশীয় ধারক, বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। এরা আজ ইসলামের সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতায় নেমেছে। তাদের এসকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা এদেশে একদিকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, অপরদিকে ভারতজুড়ে মুসলিমদের উপর যে ক্রেকডাউন চলছে- সেদিক থেকেও এদেশের মুসলিমদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে চাইছে। এদেশে এরা কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের ন্যূনতম উপস্থিতি মেনে নিবে না; এরা এদেশে কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে থাকতে দেবে না। এদেরকে তাই ভালমত চিনে নেওয়া, এবং এদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকা ও অপরকে সজাগ করে মানসিকভাবে এদের মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকাকে জাতির জন্য আবশ্যক মনে করছেন ইসলামি চিন্তাবীদগণ।
লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর