আফগানিস্তানে সিআইএ’র মনস্তাত্ত্বিক লড়াই : তালিবানের বিরুদ্ধে এবার গর্ভবতী নারী হত্যার ‘নিরেট’ প্রপ্যাগান্ডা!
ঘটনাটি ২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারীর এক রাতের। ক্রুসেডার মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট ঘোষণা করেছে যে, তারা আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের খাতাবা এলাকায় একদল (তালিবান) বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে। এসময় তারা একটি ঘরে আটকে রাখা ৩ মহিলার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে। যাদেরকে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো।
ন্যাটোর এমন দাবির পর পরই ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মিডিয়াগুলো বিশ্বের সামনে এটিকে “তালিবান কর্তৃক একটি অনার কিলিং” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
জানা যায় যে, ঐ ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া নিহতদের মধ্যে দুই নারীই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সব মিলিয়ে ঐ বাড়িতে মোট ৭ জন নিহত হন।
হলুদ মিডিয়াগুলো সংবাদটিকে তখন খুব ফলো করে প্রচার করে। যার মাধ্যমে তারা “তালিবানদের হিংস্র এবং গর্ভবতী মহিলাদের হত্যাকারী” হিসেবে বিশ্বের সামনে ছবি আঁকার চেষ্টা করে। অপরদিকে এই হামলা দ্বারা মিডিয়াগুলি আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের বৈধতা দিতে বিশ্বকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে, এই “বর্বর” তালিবানদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতেই ন্যাটো আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছে।
হামলার বিষয়ে পেন্টাগনের বিবৃতি
আমরা হামলার মূল ঘটনার সত্যতা জানার আগে, অভিযানটি নিয়ে সিআইএ ও পেন্টাগনের প্রোপাগান্ডা মূলক বিবৃতিটি একবার দেখে নিই –
“সিআইএ-এর তথ্যের ভিত্তিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার রাতে পাকতিয়া প্রদেশে একটি যৌথ অভিযান চালায় ন্যাটো-আফগান বাহিনী। যেখানে জঙ্গিদের কার্যকলাপের তদন্ত করতে গিয়েছিল সামরিক বাহিনী। পরে যৌথ বাহিনী গার্ডেজ জেলার খাতাব গ্রামের একটি আবাসিক কম্পাউন্ড ঘেরাও করে। তখন বিদ্রোহীরা কম্পাউন্ড থেকে তাদের উপর গুলি চালায়। তখন সেখানে উভয় বাহিনীর মাঝে লড়াই শুরু হয়, বেশ কিছু বিদ্রোহী নিহত হয় এবং বিপুল সংখ্যক পুরুষ, মহিলা ও শিশু পালিয়ে যায়। তবে ন্যাটো বাহিনীর হাতে ৮ বিদ্রোহী আটক হয়। কম্পাউন্ডের ভিতরে, সৈন্যরা তিনজন মহিলার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। সেনারা ঘরে ঢুকার আগেই যাদেরকে গলা কেটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।”
প্রোপাগ্যান্ডার জন্য সিআইএ-র ভুল টার্গেট নির্ধারণ
আফগান যুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা “সিআইএ” তালিবানদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধেরই একটি অংশ ছিলো তালিবানদের বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। আর এতে সিআইএ সফলও ছিলো।
কিন্তু ২০১০ সালে, প্রোপাগান্ডার অংশ হিসাবে পাকতিয়ায় পরিচালিত হামলাটি ছিলো সিআইএ-এর একটি ভুল টার্গেট নির্ধারণ। ফলে তাদের এই প্রোপাগান্ডা জনগণের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। কেননা তারা উক্ত প্রোপাগান্ডার জন্য যেই বাড়িটিকে টার্গেট করেছিলো, তা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং তাদেরই হয়ে কাজ করা গোলাম তাজিক পুলিশ কমান্ডার মোহাম্মদ দাউদ শারাবুদ্দিনের। তাছাড়া এই পরিবারের একাধিক ব্যাক্তিই ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ফলে এই পরিবার কণ্ঠস্বর দেশের জনগণ সহজেই চিনতে সক্ষম হয়। অপরদিকে সিআইএ’র প্রোপাগ্যান্ডার বস্তুতে পরিণত হওয়া এমন হাজারো পরিবার রয়েছে, যাদের কণ্ঠস্বর বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছাতে পারেনি। কেননা তারা ছিলেন বেসামরিক হতদরিদ্র জনগণ।
যাইহোক, তখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে পাকতিয়া প্রদেশের পুলিশ প্রধান আজিজ আহমেদ ওযার্দাকী। তিনি জানান যে, বাড়িতে মার্কিন বাহিনীর হামলায় নিহতদের ৩ জন ছিলেন পুরুষ এবং ৩ জন মহিলা। যাদেরকে মার্কিন বাহিনী “তালিবান জঙ্গি” বলে দাবি করেছে। তিনি বলেন, বাড়িতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি এমন সময় ঘটেছে, যখন বাসিন্দারা একটি শিশুর জন্মদিন উদযাপন করছিল।
আফগান সংবাদ মাধ্যম pajhwoh কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম দস্তগীর জানান যে, মার্কিন বিশেষ বাহিনী দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিয়া প্রদেশে একই পরিবারের চার সদস্যসহ একজন জেলা গোয়েন্দা প্রধানকে গুলি করে হত্যা করেছে। যেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাউদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা তার ছেলের জন্মদিন উদযাপন করছিলো। কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশী সেনারা গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাসভবনে অভিযান চালায়। তিনি জানান, নিহতদের মধ্যে দাউদ, তার ভাই জহির, অ্যাটর্নি অফিসের একজন কর্মচারী এবং তিনজন নারী রয়েছেন।
নৃশংস হত্যাকান্ডের বিবরণ
দুঃখজনক যে, সিএনএন সহ পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এই হামলার সামান্যতম তদন্ত ও সন্দেহ ছাড়াই ঘটনাটিকে এমনভাবে প্রচার করেছে, যেমনটা ন্যাটো দাবি করেছে। একইসাথে মিডিয়াগুলি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার বাসিন্দাদের দাবিকেও তখন সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছে।
ফলে সংবাদ মাধ্যম ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ এর সাংবাদিক আমির শাহ, হামলার বিষয়ে পেন্টাগনের দাবির পর্যালোচনা শুরু করেন। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে তিনি নিহতদের স্বজনদের সাথে ফোনে কথা বলেন। যখন তারা নিহতদের মৃত্যুর জন্য ক্রুসেডার মার্কিন বাহিনীকেই দায়ী করে।
পরিবারের হামিদুল্লাহ নামক এক সদস্য জানান যে, তারা প্রায় ২০ জনের মত বাড়িতে একটি ছেলের জন্মদিন উদযাপন করতে জড়ো হয়েছিলেন। আর মার্কিন বিশেষ বাহিনীর একটি দল কম্পাউন্ডটি ঘিরে ফেলে। তখন একজন লোক এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে উঠানে বের হয়ে আসেন। ঠিক তখনই মার্কিন বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পুলিশ কমান্ডার দাউদ বাড়ি থেকে বের হন ঘটনার বিষয়টি জানার জন্য। তখন মার্কিন বাহিনী তাকেও গুলি করে হত্যা করে।
এরপর বর্বর মার্কিন বাহিনী বাড়ির অন্যদের জোর করে উঠোনে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে এবং তাদের হাত পিঠের পিছনে বেঁধে রাখে। এরপর হামিদুল্লাহ আর বিস্তারিত বলতে পারেন নি, বরং তিনি কাঁদতে শুরু করেন।
পরিবারের অন্য একজন সদস্য জানান, মহিলাদের প্রথমে গুলি করে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। এরপর তাদেরকে আলাদা একটি কক্ষে নিয়ে যায় সেনারা। সেখানে নিয়ে মহিলাদের কাপড় সরিয়ে তথ্য নষ্ট করতে শুরু করে মার্কিন সেনারা। প্রথমে তারা ধারালো ছুরি দিয়ে গুলি লাগার স্থানগুলো কাটে ফেলে এবং বুলেট বের করতে গর্ভবতী মহিলাদের পেটও কর্তন করে। এরপর তারা বুলেটের স্থানগুলো মেডিসিন দিয়ে ধুয়ে ফেলে। সর্বশেষ মহিলাদের গলা কেটে তাদের মৃত দেহগুলো ঝুলিয়ে দেয় সন্ত্রাসী মার্কিন সেনারা।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক মাসেরও (১৬ মার্চ) বেশি সময় পরে, “টাইমস অফ লন্ডন” এই ঘটনা সম্পর্কে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে উঠে আসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ন্যাটোর বানানো গল্পের সত্যতা। যাতে প্রকৃতপক্ষে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে বাসিন্দাদের দেওয়া ভয়ঙ্কর সব তথ্য উঠে আসে।
দুনিয়াজুড়ে নিজেদের সকল অন্যায় যুদ্ধের পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে আনতে এবং জনমতকে প্রভাবিত করতে এভাবেই সন্ত্রাসী অ্যামেরিকা তার হলুদ মিডিয়া-কে ব্যাবহার করে মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য প্রচার করে থাকে। আফগানিস্তানে আগ্রাসনের ২০ বছর ধরেই তারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য সব প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়ে আসছে, যা এখনো চলমান। আফগান ছেড়ে যাওয়ার পরেও তারা এখন আফগান নারীদের শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক প্রোপ্যাগান্ডা চালাচ্ছে। আবার আফগআনিস্তানের সাময়িক আর্থিক মন্দার জন্য তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তালিবান প্রশাসনকেই দায়ী করার প্রানান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তারা যে জোচ্চুরি করে আফগান সাধারণ জনগনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আটক করে রেখেছে, সেই বিষয়ে কিন্তু তাদের দালাল মিডিয়াগুলো তেমন কিছুই বলে না। কি নিকৃষ্ট পর্যায়ের মিথ্যুক আর নির্লজ্জ এরা!
এখন তারা আফগান নারীদের শিক্ষা আর শিশুদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার! আর যখন বিদেশি আগ্রাসন চলাকালে তাদের ‘সভ্য’ সৈনিকরা হাজার হাজার আফগান নারীকে হত্যা-ধর্ষণ করেছে, এবং হাজার হাজার শিশুকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, দালাল মিডিয়া বা ডলার-পোষ্য কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে তখন তাদের বিরুদ্ধে কিচ্ছুটি বলতে শোনা যায়নি। তবে উম্মাহর নারী-শিশুদের জান-মাল-ইজ্জত রক্ষায় যারা বদ্ধপরিকর, সেই মহান মুজাহিদদের বেলায় তারা তিলকে তাল বানিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট রটনা রটাতে যারপরনাই সিদ্ধহস্ত।
নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে তারা উম্মাহর সেই মহান সন্তানদেরকে জনগনের সামনে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে ও করছে, যারা কিনা নিজের সন্তানের হাসিমুখের পরোয়া না করে আগ্রাসী শত্রুর মোকাবেলায় নিজেদের যান-মাল উজার করে দিচ্ছেন, যাদের দিন-রাত কাটে উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে রবের সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তায়, যাদের দিন কাটে যুদ্ধের ময়দানে আর রাত কাটে জায়নামাজে।
তবে, ষড়যন্ত্র সর্বশেষে ষড়যন্ত্রকারীর উপরই বর্তায়। অটল মনোবল আর পর্বত-টলানো বিশ্বাসের সামনে মিথ্যা ফিকে হয়ে যায়, আঁধার চিড়ে বের হয়ে আসে আলো। সন্ত্রাসী মার্কিনীদের এই মিথ্যাচার তাদেরকে না রক্ষা করতে পেরেছে আফগানিস্তানে, আর না রক্ষা করতে পারছে সোমালিয়া এবং অন্যান্য ভূখণ্ডে। তাদের এই চতুর্মুখি ষড়যন্ত্র আর প্রোপ্যাগান্ডার জাল ছিন্ন করে উম্মাহর বীর সন্তানেরা অচিরেই নতুন দিগন্তের সুচনা করবেন ইনশাআল্লাহ্। আফগানের মতোই বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে তাঁরা উড়াবেন উম্মাহর বিজয়কেতন। সত্য প্রবল বেগে উদ্ভাসিত হচ্ছে, আর মিথ্যা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হতে যাচ্ছে; কারণ মিথ্যার ধর্মই হলো- তা ধ্বংসশীল।
তথ্যসূত্র:
1. Bodies found gagged, bound after Afghan ‘honor killing’
http://edition.cnn.com/2010/WORLD/as...ies/index.html
2. How Americans are propagandized about Afghanistan
3. https://www.nytimes.com/2010/04/06/w...afghan.html?hp
ঘটনাটি ২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারীর এক রাতের। ক্রুসেডার মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট ঘোষণা করেছে যে, তারা আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের খাতাবা এলাকায় একদল (তালিবান) বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে। এসময় তারা একটি ঘরে আটকে রাখা ৩ মহিলার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে। যাদেরকে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো।
ন্যাটোর এমন দাবির পর পরই ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মিডিয়াগুলো বিশ্বের সামনে এটিকে “তালিবান কর্তৃক একটি অনার কিলিং” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
জানা যায় যে, ঐ ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া নিহতদের মধ্যে দুই নারীই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সব মিলিয়ে ঐ বাড়িতে মোট ৭ জন নিহত হন।
হলুদ মিডিয়াগুলো সংবাদটিকে তখন খুব ফলো করে প্রচার করে। যার মাধ্যমে তারা “তালিবানদের হিংস্র এবং গর্ভবতী মহিলাদের হত্যাকারী” হিসেবে বিশ্বের সামনে ছবি আঁকার চেষ্টা করে। অপরদিকে এই হামলা দ্বারা মিডিয়াগুলি আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের বৈধতা দিতে বিশ্বকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে, এই “বর্বর” তালিবানদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতেই ন্যাটো আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছে।
হামলার বিষয়ে পেন্টাগনের বিবৃতি
আমরা হামলার মূল ঘটনার সত্যতা জানার আগে, অভিযানটি নিয়ে সিআইএ ও পেন্টাগনের প্রোপাগান্ডা মূলক বিবৃতিটি একবার দেখে নিই –
“সিআইএ-এর তথ্যের ভিত্তিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার রাতে পাকতিয়া প্রদেশে একটি যৌথ অভিযান চালায় ন্যাটো-আফগান বাহিনী। যেখানে জঙ্গিদের কার্যকলাপের তদন্ত করতে গিয়েছিল সামরিক বাহিনী। পরে যৌথ বাহিনী গার্ডেজ জেলার খাতাব গ্রামের একটি আবাসিক কম্পাউন্ড ঘেরাও করে। তখন বিদ্রোহীরা কম্পাউন্ড থেকে তাদের উপর গুলি চালায়। তখন সেখানে উভয় বাহিনীর মাঝে লড়াই শুরু হয়, বেশ কিছু বিদ্রোহী নিহত হয় এবং বিপুল সংখ্যক পুরুষ, মহিলা ও শিশু পালিয়ে যায়। তবে ন্যাটো বাহিনীর হাতে ৮ বিদ্রোহী আটক হয়। কম্পাউন্ডের ভিতরে, সৈন্যরা তিনজন মহিলার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। সেনারা ঘরে ঢুকার আগেই যাদেরকে গলা কেটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।”
প্রোপাগ্যান্ডার জন্য সিআইএ-র ভুল টার্গেট নির্ধারণ
আফগান যুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা “সিআইএ” তালিবানদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধেরই একটি অংশ ছিলো তালিবানদের বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। আর এতে সিআইএ সফলও ছিলো।
কিন্তু ২০১০ সালে, প্রোপাগান্ডার অংশ হিসাবে পাকতিয়ায় পরিচালিত হামলাটি ছিলো সিআইএ-এর একটি ভুল টার্গেট নির্ধারণ। ফলে তাদের এই প্রোপাগান্ডা জনগণের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। কেননা তারা উক্ত প্রোপাগান্ডার জন্য যেই বাড়িটিকে টার্গেট করেছিলো, তা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং তাদেরই হয়ে কাজ করা গোলাম তাজিক পুলিশ কমান্ডার মোহাম্মদ দাউদ শারাবুদ্দিনের। তাছাড়া এই পরিবারের একাধিক ব্যাক্তিই ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ফলে এই পরিবার কণ্ঠস্বর দেশের জনগণ সহজেই চিনতে সক্ষম হয়। অপরদিকে সিআইএ’র প্রোপাগ্যান্ডার বস্তুতে পরিণত হওয়া এমন হাজারো পরিবার রয়েছে, যাদের কণ্ঠস্বর বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছাতে পারেনি। কেননা তারা ছিলেন বেসামরিক হতদরিদ্র জনগণ।
যাইহোক, তখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে পাকতিয়া প্রদেশের পুলিশ প্রধান আজিজ আহমেদ ওযার্দাকী। তিনি জানান যে, বাড়িতে মার্কিন বাহিনীর হামলায় নিহতদের ৩ জন ছিলেন পুরুষ এবং ৩ জন মহিলা। যাদেরকে মার্কিন বাহিনী “তালিবান জঙ্গি” বলে দাবি করেছে। তিনি বলেন, বাড়িতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি এমন সময় ঘটেছে, যখন বাসিন্দারা একটি শিশুর জন্মদিন উদযাপন করছিল।
আফগান সংবাদ মাধ্যম pajhwoh কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম দস্তগীর জানান যে, মার্কিন বিশেষ বাহিনী দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিয়া প্রদেশে একই পরিবারের চার সদস্যসহ একজন জেলা গোয়েন্দা প্রধানকে গুলি করে হত্যা করেছে। যেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাউদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা তার ছেলের জন্মদিন উদযাপন করছিলো। কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশী সেনারা গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাসভবনে অভিযান চালায়। তিনি জানান, নিহতদের মধ্যে দাউদ, তার ভাই জহির, অ্যাটর্নি অফিসের একজন কর্মচারী এবং তিনজন নারী রয়েছেন।
নৃশংস হত্যাকান্ডের বিবরণ
দুঃখজনক যে, সিএনএন সহ পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এই হামলার সামান্যতম তদন্ত ও সন্দেহ ছাড়াই ঘটনাটিকে এমনভাবে প্রচার করেছে, যেমনটা ন্যাটো দাবি করেছে। একইসাথে মিডিয়াগুলি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার বাসিন্দাদের দাবিকেও তখন সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছে।
ফলে সংবাদ মাধ্যম ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ এর সাংবাদিক আমির শাহ, হামলার বিষয়ে পেন্টাগনের দাবির পর্যালোচনা শুরু করেন। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে তিনি নিহতদের স্বজনদের সাথে ফোনে কথা বলেন। যখন তারা নিহতদের মৃত্যুর জন্য ক্রুসেডার মার্কিন বাহিনীকেই দায়ী করে।
পরিবারের হামিদুল্লাহ নামক এক সদস্য জানান যে, তারা প্রায় ২০ জনের মত বাড়িতে একটি ছেলের জন্মদিন উদযাপন করতে জড়ো হয়েছিলেন। আর মার্কিন বিশেষ বাহিনীর একটি দল কম্পাউন্ডটি ঘিরে ফেলে। তখন একজন লোক এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে উঠানে বের হয়ে আসেন। ঠিক তখনই মার্কিন বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পুলিশ কমান্ডার দাউদ বাড়ি থেকে বের হন ঘটনার বিষয়টি জানার জন্য। তখন মার্কিন বাহিনী তাকেও গুলি করে হত্যা করে।
এরপর বর্বর মার্কিন বাহিনী বাড়ির অন্যদের জোর করে উঠোনে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে এবং তাদের হাত পিঠের পিছনে বেঁধে রাখে। এরপর হামিদুল্লাহ আর বিস্তারিত বলতে পারেন নি, বরং তিনি কাঁদতে শুরু করেন।
পরিবারের অন্য একজন সদস্য জানান, মহিলাদের প্রথমে গুলি করে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। এরপর তাদেরকে আলাদা একটি কক্ষে নিয়ে যায় সেনারা। সেখানে নিয়ে মহিলাদের কাপড় সরিয়ে তথ্য নষ্ট করতে শুরু করে মার্কিন সেনারা। প্রথমে তারা ধারালো ছুরি দিয়ে গুলি লাগার স্থানগুলো কাটে ফেলে এবং বুলেট বের করতে গর্ভবতী মহিলাদের পেটও কর্তন করে। এরপর তারা বুলেটের স্থানগুলো মেডিসিন দিয়ে ধুয়ে ফেলে। সর্বশেষ মহিলাদের গলা কেটে তাদের মৃত দেহগুলো ঝুলিয়ে দেয় সন্ত্রাসী মার্কিন সেনারা।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক মাসেরও (১৬ মার্চ) বেশি সময় পরে, “টাইমস অফ লন্ডন” এই ঘটনা সম্পর্কে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে উঠে আসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ন্যাটোর বানানো গল্পের সত্যতা। যাতে প্রকৃতপক্ষে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে বাসিন্দাদের দেওয়া ভয়ঙ্কর সব তথ্য উঠে আসে।
দুনিয়াজুড়ে নিজেদের সকল অন্যায় যুদ্ধের পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে আনতে এবং জনমতকে প্রভাবিত করতে এভাবেই সন্ত্রাসী অ্যামেরিকা তার হলুদ মিডিয়া-কে ব্যাবহার করে মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য প্রচার করে থাকে। আফগানিস্তানে আগ্রাসনের ২০ বছর ধরেই তারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য সব প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়ে আসছে, যা এখনো চলমান। আফগান ছেড়ে যাওয়ার পরেও তারা এখন আফগান নারীদের শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক প্রোপ্যাগান্ডা চালাচ্ছে। আবার আফগআনিস্তানের সাময়িক আর্থিক মন্দার জন্য তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তালিবান প্রশাসনকেই দায়ী করার প্রানান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তারা যে জোচ্চুরি করে আফগান সাধারণ জনগনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আটক করে রেখেছে, সেই বিষয়ে কিন্তু তাদের দালাল মিডিয়াগুলো তেমন কিছুই বলে না। কি নিকৃষ্ট পর্যায়ের মিথ্যুক আর নির্লজ্জ এরা!
এখন তারা আফগান নারীদের শিক্ষা আর শিশুদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার! আর যখন বিদেশি আগ্রাসন চলাকালে তাদের ‘সভ্য’ সৈনিকরা হাজার হাজার আফগান নারীকে হত্যা-ধর্ষণ করেছে, এবং হাজার হাজার শিশুকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, দালাল মিডিয়া বা ডলার-পোষ্য কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে তখন তাদের বিরুদ্ধে কিচ্ছুটি বলতে শোনা যায়নি। তবে উম্মাহর নারী-শিশুদের জান-মাল-ইজ্জত রক্ষায় যারা বদ্ধপরিকর, সেই মহান মুজাহিদদের বেলায় তারা তিলকে তাল বানিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট রটনা রটাতে যারপরনাই সিদ্ধহস্ত।
নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে তারা উম্মাহর সেই মহান সন্তানদেরকে জনগনের সামনে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে ও করছে, যারা কিনা নিজের সন্তানের হাসিমুখের পরোয়া না করে আগ্রাসী শত্রুর মোকাবেলায় নিজেদের যান-মাল উজার করে দিচ্ছেন, যাদের দিন-রাত কাটে উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে রবের সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তায়, যাদের দিন কাটে যুদ্ধের ময়দানে আর রাত কাটে জায়নামাজে।
তবে, ষড়যন্ত্র সর্বশেষে ষড়যন্ত্রকারীর উপরই বর্তায়। অটল মনোবল আর পর্বত-টলানো বিশ্বাসের সামনে মিথ্যা ফিকে হয়ে যায়, আঁধার চিড়ে বের হয়ে আসে আলো। সন্ত্রাসী মার্কিনীদের এই মিথ্যাচার তাদেরকে না রক্ষা করতে পেরেছে আফগানিস্তানে, আর না রক্ষা করতে পারছে সোমালিয়া এবং অন্যান্য ভূখণ্ডে। তাদের এই চতুর্মুখি ষড়যন্ত্র আর প্রোপ্যাগান্ডার জাল ছিন্ন করে উম্মাহর বীর সন্তানেরা অচিরেই নতুন দিগন্তের সুচনা করবেন ইনশাআল্লাহ্। আফগানের মতোই বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে তাঁরা উড়াবেন উম্মাহর বিজয়কেতন। সত্য প্রবল বেগে উদ্ভাসিত হচ্ছে, আর মিথ্যা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হতে যাচ্ছে; কারণ মিথ্যার ধর্মই হলো- তা ধ্বংসশীল।
লেখক : ত্বহা আলী আদনান
তথ্যসূত্র:
1. Bodies found gagged, bound after Afghan ‘honor killing’
http://edition.cnn.com/2010/WORLD/as...ies/index.html
2. How Americans are propagandized about Afghanistan
3. https://www.nytimes.com/2010/04/06/w...afghan.html?hp
Comment