কলোনিয়াল মিডিয়ার রানী এলিজাবেথ বন্দনা : ‘ডি-কলোনাইজেশন ন্যারেটিভ’ বনাম বাস্তবতা
“ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যে নাকি সূর্য অস্ত যেত না।” কিন্তু সেই সূর্য অস্ত না যাওয়া সাম্রাজ্যের পেছনে যে কী মাত্রার রক্তপিপাসু আগ্রাসী মানসিকতা ছিল, কতো পরিমাণ মানুষকে সেই ‘সূর্যাস্ত না যাওয়া’ সাম্রাজ্যের পিপাসার বলি হতে হয়েছিল – সেই আলাপের প্রতি এখনও তেমন সুবিচার দেখা যায় না। বরং ব্রিটিশরা জমিনে জমিনে কলোনিয়াল দাস বানানোর যে সিস্টেম বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেই সিস্টেমের গর্ভ থেকে প্রতিনিয়তই কলোনিয়াল দাসদের জন্ম হয়েছে। আর সেই কলোনিয়াল দাসেরা মেইন্সট্রিম মিডিয়াগুলোতে এখনও ব্রিটিশদের লুটতরাজ আর রক্তপিপাসু আগ্রাসনের পক্ষে সাফাই গায়, এখনও ওদের ছিটানো উচ্ছিষ্টের গুণগানে ভরা ন্যারেটিভ বকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২) ব্রিটিশ রাজ পরিবারের রাণীর মৃত্যুর পর বিষয়গুলো আরেকবার জোরালোভাবে সামনে এলো।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয়েছিল। আর কারও কারও মতে সেই পতন সম্পন্ন হয়েছে ১৯৯৭-এ হংকংয়ের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে যাই হোক, আরও বেশ কয়েক যুগ আগে থেকেই ব্রিটিশদের ‘রাজ্য’ পরিচালনা হয় অন্যসব গণতান্ত্রিক দেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’ আর পার্লামেন্টারি সিস্টেমের আদলে। কিন্তু তবুও কেন ব্রিটিশরা সাদা হাতি পালার ন্যায় ‘রাজ পরিবার’, ‘রাণী’ কিংবা নাইট উপাধি ইত্যাদি পুরোনো প্রথা আঁকড়ে ধরে রেখেছে তা কি কখনও ভেবে দেখেছি আমরা?
একেবারে সহজ ভাষায়, এইসব ওরা ধরে রেখেছে, কেননা এইগুলো ওদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা আর সাম্রাজ্যবাদী গোঁয়ার্তুমির প্রতীক। সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে, কিন্তু রাজ পরিবার, রাণী ইত্যাদি প্রথাগুলো বাজে খরচ বাড়ালেও অহমিকাবশত ওরা সেগুলো আঁকড়ে থেকেছে।
আমাদের জন্য আফসোস আমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাস ভুলে গিয়েছি। আমরা ভুলে গিয়েছি, যুগের পর যুগ ধরে ব্রিটিশদের হরিলুটের যতো হিসেব। একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ‘উতসা পাটনায়েকের নতুন গবেষণা প্রায় দুই শতাব্দীর বিশদ তথ্যের ভিত্তিতে দেখিয়েছে যে, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সময়কালে ব্রিটেন শুধু ভারত থেকেই প্রায় ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার চুরি করেছিল। পাঠক এই গবেষণার বিস্তারিত দেখতে পারেন আল-জাজিরার প্রতিবেদনের লিঙ্ক থেকে –
‘ব্রিটেন ভারতবর্ষকে সভ্য-ভব্য-উন্নত করেছে’- কলোনিয়াল দাস মিডিয়ার ছড়ানো এই ‘মিথ’কে উতসা পাটনায়েকের গবেষণা একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। শুধু তাই নয়। একইসাথে তা প্রমাণ করে যে, উল্টো ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বের থেকে সম্পদ চুরি করে করেই ব্রিটেন সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার! এখনকার ব্রিটেনের বাৎসরিক মোট দেশীয় উৎপাদনের ১৭ গুণ।
এই তো গেল সাম্রাজ্যের চুরির আলাপ। ভারতবর্ষে নীল চাষীদের দুঃখ, হিন্দু জমিদারদের শোষণ ইত্যাদি বর্ণনা করতে গেলে তো কষ্টের একেকটা মহাকাব্য বনে যায়।
কিন্তু আজকে আমরা সেদিকে এগোবো না। শুধু কলোনিয়াল মিডিয়ার আরেকটা প্রভাবশালী মিথকে এড্রেস করবো মাত্র। আর তা হলো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময় যা-ই হয়েছে, সেগুলো তো আর সদ্য মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয় এলিজাবেথ করেনি। বরং সে তো ব্রিটিশদের ডি-কলোনাইজেশনেই ছিল।
যেন ব্রিটিশদের ডি-কলোনাইজেশন খুব একেবারে স্বেচ্ছায় হয়েছে।
এই ন্যারেটিভে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামক জালিম দৈত্য যে স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর্যুপরি আন্দোলনে ‘বাধ্য হয়ে’ নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছে, সেই সত্যকে একদিকে চেপে যাওয়া হয়। একইসাথে ২য় এলিজাবেথকে সতীসাধ্বী বানিয়ে দেওয়া হয়।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, এই বুড়ির শাসনকালে হওয়া কিছু নৃশংস ঘটনার বয়ান –
মৌ মৌ বিদ্রোহের দমন (১৯৫২-১৯৬০)
কয়েক দশক ধরে ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে পড়ে অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, দখলদারিত্ব এবং সহিংসতার পর ১৯৫২ সালে কেনিয়ার জঙ্গিদের একটি দল, যারা কিনা মাউ মাউ বিদ্রোহী নামে পরিচিত, তাদের দেশে শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারী এবং তাদের অনুগত স্থানীয়দের বিরুদ্ধে একটি উপনিবেশ-বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করে।
সেই অভ্যুত্থান ছিল কয়েক দশক ধরে চলে আসা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য কেনিয়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে আরও বেশি জমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিক্রিয়া, সাদাদের খামারগুলিতে স্থানীয়দের কম মজুরি শ্রমে বাধ্য করার প্রতিক্রিয়া।
তো দ্বিতীয় এলিজাবেথের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই, ১৯৫২-এর অক্টোবরে, ব্রিটিশরা কেনিয়ার সেই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে। এক লক্ষেরও বেশি কিকুয়ু, নেরু এবং এমবু উপজাতীয় কেনিয়ানকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন, মারধর এবং যৌন নির্যাতন করা হয়। কেনিয়ার মানবাধিকার কমিশনের মতে, ১৯৫২-১৯৬০ এ ব্রিটিশরা ৯০,০০০ কেনিয়ানকে হত্যা, পঙ্গু বা নির্যাতন করেছিল এবং ১৬০,০০০ জনকে ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল।
রক্তাক্ত রবিবার (Bloody Sunday)
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেরিতে একটি মিছিল চলাকালীন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ভিড়ের উপর গুলি চালায়। এই ঘটনা ইতিহাসে ব্লাডি সানডে নামে পরিচিত। সেদিন ২৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়, যাদের মধ্যে ১৪ জন মারা যায়। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেদিন ১০৮ রাউন্ড গোলাবারুদ নিক্ষেপ করেছিল।
১৯৭১ সালের আগস্টে ব্রিটিশ সরকার একটি আইন পাশ করেছিল, যার আওতায় সন্দেহভাজন আইরিশদেরকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারই প্রতিক্রিয়ায় উত্তর আয়ারল্যান্ড সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশন উক্ত মার্চের আয়োজন করেছিল। আর সেখানেই নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে আহত করা হয়, যাদের মধ্যে ১৪ জন পরবর্তীতে মারা যায়।
কেনিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর হোয়াইট ফসফরাস ব্যবহার
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেন্সকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ‘হোয়াইট ফসফরাস’ ব্যবহারের অভিযোগ তোলে, ঠিক সেসময় কেনিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর এই নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহারের স্বীকারোক্তি সামনে আসে। যে কেমিক্যাল নিয়ে ন্যাটো থেকে শুরু করে পশ্চিমা মিডিয়াতে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, সেই একই কেমিক্যাল ব্রিটিশরা ব্যবহার করার স্বীকারোক্তি এলেও তেমন কোনো রি-অ্যাকশনই দেখা যায় না। এই হলো কলোনিয়াল মিডিয়ার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
এমন ঘটনা আরও অনেক আছে। আর এগুলোর সবই কিন্তু ফিরিঙ্গিদের সাদা হাতি রাজ পরিবার আর ‘নিরীহ’ রাণী এলিজাবেথের সময়েই হয়েছে। কিন্তু কলোনিয়াল মিডিয়ার সিলেক্টিভ সাংবাদিকতায় সেসব বরাবরের মতোই সাধারণের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।
এভাবেই আগ্রাসী সাম্রাজ্যগুলো আমাদের ইতিহাসকে ভুলিয়ে রাখে, আর বর্তমানকে করে রাখে চোখের আড়াল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে আম্রিকান সাম্রাজ্য এভাবেই চলে এসেছে, এখনও চলছে। অল্পই পারছে সত্যকে খুঁজে ফিরে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে। আর সেই উপলব্ধিতে সাহায্য করতেই আমরা আপনাদের পাশে রয়েছি ইনশাআল্লাহ।
“ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যে নাকি সূর্য অস্ত যেত না।” কিন্তু সেই সূর্য অস্ত না যাওয়া সাম্রাজ্যের পেছনে যে কী মাত্রার রক্তপিপাসু আগ্রাসী মানসিকতা ছিল, কতো পরিমাণ মানুষকে সেই ‘সূর্যাস্ত না যাওয়া’ সাম্রাজ্যের পিপাসার বলি হতে হয়েছিল – সেই আলাপের প্রতি এখনও তেমন সুবিচার দেখা যায় না। বরং ব্রিটিশরা জমিনে জমিনে কলোনিয়াল দাস বানানোর যে সিস্টেম বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেই সিস্টেমের গর্ভ থেকে প্রতিনিয়তই কলোনিয়াল দাসদের জন্ম হয়েছে। আর সেই কলোনিয়াল দাসেরা মেইন্সট্রিম মিডিয়াগুলোতে এখনও ব্রিটিশদের লুটতরাজ আর রক্তপিপাসু আগ্রাসনের পক্ষে সাফাই গায়, এখনও ওদের ছিটানো উচ্ছিষ্টের গুণগানে ভরা ন্যারেটিভ বকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২) ব্রিটিশ রাজ পরিবারের রাণীর মৃত্যুর পর বিষয়গুলো আরেকবার জোরালোভাবে সামনে এলো।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয়েছিল। আর কারও কারও মতে সেই পতন সম্পন্ন হয়েছে ১৯৯৭-এ হংকংয়ের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে যাই হোক, আরও বেশ কয়েক যুগ আগে থেকেই ব্রিটিশদের ‘রাজ্য’ পরিচালনা হয় অন্যসব গণতান্ত্রিক দেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’ আর পার্লামেন্টারি সিস্টেমের আদলে। কিন্তু তবুও কেন ব্রিটিশরা সাদা হাতি পালার ন্যায় ‘রাজ পরিবার’, ‘রাণী’ কিংবা নাইট উপাধি ইত্যাদি পুরোনো প্রথা আঁকড়ে ধরে রেখেছে তা কি কখনও ভেবে দেখেছি আমরা?
একেবারে সহজ ভাষায়, এইসব ওরা ধরে রেখেছে, কেননা এইগুলো ওদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা আর সাম্রাজ্যবাদী গোঁয়ার্তুমির প্রতীক। সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে, কিন্তু রাজ পরিবার, রাণী ইত্যাদি প্রথাগুলো বাজে খরচ বাড়ালেও অহমিকাবশত ওরা সেগুলো আঁকড়ে থেকেছে।
আমাদের জন্য আফসোস আমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাস ভুলে গিয়েছি। আমরা ভুলে গিয়েছি, যুগের পর যুগ ধরে ব্রিটিশদের হরিলুটের যতো হিসেব। একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ‘উতসা পাটনায়েকের নতুন গবেষণা প্রায় দুই শতাব্দীর বিশদ তথ্যের ভিত্তিতে দেখিয়েছে যে, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সময়কালে ব্রিটেন শুধু ভারত থেকেই প্রায় ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার চুরি করেছিল। পাঠক এই গবেষণার বিস্তারিত দেখতে পারেন আল-জাজিরার প্রতিবেদনের লিঙ্ক থেকে –
‘ব্রিটেন ভারতবর্ষকে সভ্য-ভব্য-উন্নত করেছে’- কলোনিয়াল দাস মিডিয়ার ছড়ানো এই ‘মিথ’কে উতসা পাটনায়েকের গবেষণা একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। শুধু তাই নয়। একইসাথে তা প্রমাণ করে যে, উল্টো ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বের থেকে সম্পদ চুরি করে করেই ব্রিটেন সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার! এখনকার ব্রিটেনের বাৎসরিক মোট দেশীয় উৎপাদনের ১৭ গুণ।
এই তো গেল সাম্রাজ্যের চুরির আলাপ। ভারতবর্ষে নীল চাষীদের দুঃখ, হিন্দু জমিদারদের শোষণ ইত্যাদি বর্ণনা করতে গেলে তো কষ্টের একেকটা মহাকাব্য বনে যায়।
কিন্তু আজকে আমরা সেদিকে এগোবো না। শুধু কলোনিয়াল মিডিয়ার আরেকটা প্রভাবশালী মিথকে এড্রেস করবো মাত্র। আর তা হলো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময় যা-ই হয়েছে, সেগুলো তো আর সদ্য মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয় এলিজাবেথ করেনি। বরং সে তো ব্রিটিশদের ডি-কলোনাইজেশনেই ছিল।
যেন ব্রিটিশদের ডি-কলোনাইজেশন খুব একেবারে স্বেচ্ছায় হয়েছে।
এই ন্যারেটিভে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামক জালিম দৈত্য যে স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর্যুপরি আন্দোলনে ‘বাধ্য হয়ে’ নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছে, সেই সত্যকে একদিকে চেপে যাওয়া হয়। একইসাথে ২য় এলিজাবেথকে সতীসাধ্বী বানিয়ে দেওয়া হয়।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, এই বুড়ির শাসনকালে হওয়া কিছু নৃশংস ঘটনার বয়ান –
মৌ মৌ বিদ্রোহের দমন (১৯৫২-১৯৬০)
কয়েক দশক ধরে ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে পড়ে অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, দখলদারিত্ব এবং সহিংসতার পর ১৯৫২ সালে কেনিয়ার জঙ্গিদের একটি দল, যারা কিনা মাউ মাউ বিদ্রোহী নামে পরিচিত, তাদের দেশে শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারী এবং তাদের অনুগত স্থানীয়দের বিরুদ্ধে একটি উপনিবেশ-বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করে।
সেই অভ্যুত্থান ছিল কয়েক দশক ধরে চলে আসা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য কেনিয়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে আরও বেশি জমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিক্রিয়া, সাদাদের খামারগুলিতে স্থানীয়দের কম মজুরি শ্রমে বাধ্য করার প্রতিক্রিয়া।
তো দ্বিতীয় এলিজাবেথের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই, ১৯৫২-এর অক্টোবরে, ব্রিটিশরা কেনিয়ার সেই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে। এক লক্ষেরও বেশি কিকুয়ু, নেরু এবং এমবু উপজাতীয় কেনিয়ানকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন, মারধর এবং যৌন নির্যাতন করা হয়। কেনিয়ার মানবাধিকার কমিশনের মতে, ১৯৫২-১৯৬০ এ ব্রিটিশরা ৯০,০০০ কেনিয়ানকে হত্যা, পঙ্গু বা নির্যাতন করেছিল এবং ১৬০,০০০ জনকে ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল।
রক্তাক্ত রবিবার (Bloody Sunday)
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেরিতে একটি মিছিল চলাকালীন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ভিড়ের উপর গুলি চালায়। এই ঘটনা ইতিহাসে ব্লাডি সানডে নামে পরিচিত। সেদিন ২৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়, যাদের মধ্যে ১৪ জন মারা যায়। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেদিন ১০৮ রাউন্ড গোলাবারুদ নিক্ষেপ করেছিল।
১৯৭১ সালের আগস্টে ব্রিটিশ সরকার একটি আইন পাশ করেছিল, যার আওতায় সন্দেহভাজন আইরিশদেরকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারই প্রতিক্রিয়ায় উত্তর আয়ারল্যান্ড সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশন উক্ত মার্চের আয়োজন করেছিল। আর সেখানেই নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে আহত করা হয়, যাদের মধ্যে ১৪ জন পরবর্তীতে মারা যায়।
কেনিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর হোয়াইট ফসফরাস ব্যবহার
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেন্সকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ‘হোয়াইট ফসফরাস’ ব্যবহারের অভিযোগ তোলে, ঠিক সেসময় কেনিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর এই নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহারের স্বীকারোক্তি সামনে আসে। যে কেমিক্যাল নিয়ে ন্যাটো থেকে শুরু করে পশ্চিমা মিডিয়াতে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, সেই একই কেমিক্যাল ব্রিটিশরা ব্যবহার করার স্বীকারোক্তি এলেও তেমন কোনো রি-অ্যাকশনই দেখা যায় না। এই হলো কলোনিয়াল মিডিয়ার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
এমন ঘটনা আরও অনেক আছে। আর এগুলোর সবই কিন্তু ফিরিঙ্গিদের সাদা হাতি রাজ পরিবার আর ‘নিরীহ’ রাণী এলিজাবেথের সময়েই হয়েছে। কিন্তু কলোনিয়াল মিডিয়ার সিলেক্টিভ সাংবাদিকতায় সেসব বরাবরের মতোই সাধারণের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।
এভাবেই আগ্রাসী সাম্রাজ্যগুলো আমাদের ইতিহাসকে ভুলিয়ে রাখে, আর বর্তমানকে করে রাখে চোখের আড়াল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে আম্রিকান সাম্রাজ্য এভাবেই চলে এসেছে, এখনও চলছে। অল্পই পারছে সত্যকে খুঁজে ফিরে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে। আর সেই উপলব্ধিতে সাহায্য করতেই আমরা আপনাদের পাশে রয়েছি ইনশাআল্লাহ।
লিখেছেন : সাদ মুনতাসির