কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-২।। ধর্ষণ যাদের সংস্কৃতি
কাশ্মীরি মুসলিম নারীদের উপর ভারতীয় দখলদার সেনারা যে পরিমাণ শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালায়, তা হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের নারীরাও কখনো কল্পনা করতে পারবে না। কাশ্মিরী নারীদের ধর্ষণ করা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং এটি হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় বাহিনীর একটি অন্যতম যুদ্ধ-কৌশল। মূলত কাশ্মীরের মুসলিম নারীদের তারা ধর্ষণ করে স্বাধীনতাকামীদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য। দখলদারিত্বের বিরোধিতা করার শাস্তি হিসেবে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী।
যখনই কোনো স্বাধীনতাকামী দল দখলদার ভারতীয় বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, তখনই এই দখলদাররা কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিম নারীদের ওপর। স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পেরে এই দখলদাররা তখন প্রতিশোধ হিসেবে ধর্ষণ করে সেই এলাকায়ই বসবাসকারী নারীদের। এই কাপুরুষেরা তাদের রাইফেলের সামনে যাকে পায় তাকেই খুন করে; চাই সে বৃদ্ধ হোক, কিংবা শিশু। সেই সাথে তারা পুড়িয়ে দেয় মুসলিমদের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সব সম্পদ।
ঠিক এমনই এক ঘটনার শিকার একজন নারীর সাথে কথা হয় আমার। ধরা যাক তাঁর নাম রহিমা। একদিন দখলদার বাহিনী রহিমার গ্রামে আক্রমণ চালাতে আসে। তাদের উদ্দেশ্য স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়া। দখলদার সেনারা রহিমার গ্রামে এলে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই হায়েনাদের হাতে ধরা পড়েন রহিমা। এরপর রহিমাকে পেটাতে পেটাতে মাটিতে শুইয়ে দেয় তারা।
রহিমার সাথে ছিলেন আরও সাতজন যুবতী। তারাও রহিমার মতো জীবন-সম্মান বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছিলেন গ্রাম থেকে পালানোর। কিন্তু রহিমার মতো তাদেরও ধরে ফেলে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী। হিন্দুত্ববাদী সেনারা তাঁদের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে আনে গ্রামে। এরপর সেই হায়েনাদের একটি দল তাঁদের ঘিরে ধরে প্রায় এক ঘণ্টা যাবত চালায় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন শেষে সেই নিরীহ নারীদের মধ্য থেকেই রহিমাকে বাছাই করে তারা এবং সাথে করে নিয়ে যায় নিজেদের ক্যাম্পে। কিন্তু সেখানে আসলে রহিমার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও ভয়াবহ নির্যাতন।
ক্যাম্পে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সেনারা প্রায় দশ দিনেরও বেশি সময় ধরে ধর্ষণ করে রহিমাকে। ধর্ষণের পর ঐ নগ্ন অবস্থায়ই একটি গর্তে ফেলে রাখা হতো তাঁকে। খাওয়ার সময় হলে রহিমার মুখে ছুঁড়ে ফেলা হতো তাদের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশগুলো। গর্ত থেকে রহিমাকে তখনই তোলা হতো, যখন মানুষরূপী সেই পশুদের কাম-লালসা জেগে উঠতো। অতঃপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা সিগারেট ধরাতো, আর সেই সিগারেটের আগুন নেভাতো রহিমার শরীরে।
রহিমার প্রতি একসময় তাদের চাহিদা শেষ হয়ে যায়। তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নদীর ধারে। এরপর বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয় রহিমার মাথার খুলিতে। আসলে একজন কাশ্মীরি মুসলিম নারীর জন্য এই হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মূল্যবান গুলি নষ্ট করতে চায়নি। এরপর রহিমার নিথর দেহ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। নদীতে তাঁকে খুঁজে পান গ্রামের অন্য মহিলারা। তাঁরাও দখলদার সেনাদের থেকে নিজেদের জীবন ও সম্মান বাঁচাতে লুকিয়ে ছিলেন সেখানে। পরে তাঁরাই রহিমাকে একটি নিরাপদ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নিয়ে যান আজাদ কাশ্মিরে।
আমি লক্ষ্য করলাম, বেয়নেটের আঘাতের কারণে রহিমার এক সময়ের সুন্দর চেহারাটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেই ঘটনা তাঁকে এতটাই আঘাত করেছে যে, নিজের নামও ভুলে গেছেন তিনি। সাক্ষাতকার নেওয়ার সময় তিনি তাঁর নাম, বয়স, পরিবার কিংবা গ্রামের নাম কিছুই ঠিকমতো আমাকে বলতে পারেননি। তাঁকে দেখে আমার বুঝতে দেরি হলো না যে, এই পৃথিবীতে এখন তাঁর দেহটি ছাড়া আর কিছুই বেঁচে নেই। তাঁর দেহের ভেতর থাকা পূর্বের সত্ত্বাটিকে আসলে সেদিনই খুন করে ফেলা হয়েছে, যেদিন তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী দখলদার ধর্ষকদের ধর্ষণের কারণে তিনি গর্ভবতী ছিলেন। রহিমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ঠিক পরদিনই আমি জানতে পারি, তিনি এক শিশুর জন্ম দিয়েছেন।
কাশ্মীরে সকল বয়সের এবং সমাজের সকল স্তরের মহিলাদের ধর্ষণ করে হিন্দু সেনারা। নারীর স্বাস্থ্য কিংবা শারীরিক অবস্থার প্রতিও দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন মনে করে না এই পাষণ্ডের দল। জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরের একটি গ্রামে ১১ বছর বয়সী এক শিশু এবং ৭২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁদের উভয়কেই ধর্ষণ করেছে দখলদার ভারতীয় বাহিনী। কাশ্মীরে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুই-একজন পথভ্রষ্ট হিন্দু সেনারাও এর কারণ নয়। এই ধর্ষণ মূলত কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের একটি সুসংগঠিত এবং পরিকল্পিত যুদ্ধ নীতি। এর মাধ্যমে তারা কাশ্মীরের মুসলিমদের স্বাধীনতার স্পৃহা শেষ করে দিতে চায়, দমন করতে চায় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংগ্রাম।
আমি যখন সাক্ষাৎকারের জন্য কাশ্মীরের মুসলিম নারীদের সাথে দেখা করতে যাই, তখন পুরুষদের থেকে আলাদা একটি পৃথক স্থানে তাঁদের সাথে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়। ধর্ষিত হওয়ার কারণে তাঁরা নিজেদের এতটাই কলঙ্কিত এবং কলুষিত মনে করেন যে, তাঁদের পুরুষদের সামনে নিজেদের যন্ত্রণার কথা তাঁরা বলতে পারেন না। কাশ্মীরের এই মুসলিম নারীরা সকলেই ধর্ষণের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। কারণ ধর্ষণের পর তাঁরা যেই অসম্মান ও লাঞ্ছনার মুখোমুখি হন তার চেয়ে মৃত্যুই তাঁদের কাছে অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করেন তাঁরা।
কাশ্মীরে দখলদার বাহিনীর দ্বারা মুসলিম নারীদের ধর্ষণের সঠিক সংখ্যাটি কখনোই জানা সম্ভব নয়। কারণ ভুক্তভোগীদের অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে চান না। তারপরও বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এবং সাংবাদিকদের পাওয়া তথ্যমতে কাশ্মীরে এখন পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। যদিও তারা মনে করেন যে, এমন হয়তো আরও সাত হাজারের বেশি ঘটনা থাকতে পারে যেগুলোর ভুক্তভোগীরা সামনে আসতে অনিচ্ছুক।
কাশ্মীরে এভাবেই ধর্ষণকে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে দখলদার হিন্দুত্ববাদীরা। পুরুষের মতো যুদ্ধ করতে না পেরে বরং কাপুরুষের মতো নিরীহ মুসলিম মহিলাদের উপরই নিজেদের পুরুষত্ব প্রমাণ করতে পছন্দ করে এই হিন্দুত্ববাদীরা।
মূল লেখক : উইলিয়াম ডব্লিও বেকার (William W. Baker)
অনুবাদক : আবু-উবাইদা
অনুবাদক : আবু-উবাইদা
তথ্যসূত্র :
বইঃ কাশ্মীর হ্যাপি ভ্যালী, ভ্যালী ওফ ডেথ (Kashmir Happy Valley, Valley of Death) [Page: 63-66];
প্রকাশনীঃ ডিফেন্ডার্স পাবলিকেশন্স আইএনসি (Defenders Publications, INC.)
প্রথম প্রকাশিতঃ ১৯৯৪
প্রথম পর্ব পড়ুন–https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
Comment