কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা || পর্ব-৩ || নাসরুল্লাহপুরার হত্যাকাণ্ড
১৯৯২ সালের ১৩ই জুলাই। জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে নাসরুল্লাহপুরা শহরে যাবার সময় দখলদার হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর টহলকৃত চারটি গাড়িতে আক্রমণ চালায় কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলিমরা। এতে দখলদারদের চারটি গাড়িতেই আগুন লেগে যায়। পরবর্তী দুই ঘণ্টা ধরে স্বাধীনতাকামীদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সাতজন সেনা নিহত হয় দখলদারদের।
বন্দুকযুদ্ধের প্রায় দুই ঘন্টা পর দখলদার বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ৩০টি জিপ ও অন্যান্য যুদ্ধ যান সঙ্গে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা বলেন, দখলদাররা একটি সেতুর কাছে তাদের গাড়িগুলি পার্ক করে গ্রামে প্রবেশ করে। সেই গ্রামের বাইরের একজন বাসিন্দা এশিয়া ওয়াচকে বলেন, “সন্ধ্যা ৭টার দিকে দখলদার সেনারা ঐ গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ বেশ কয়েকজন চিকিৎসাকর্মী নিয়ে সেই গ্রামে প্রবেশ করে। তারা আমাকেও তাদের সাথে গ্রামে যেতে বলে।”
গ্রামে ঢোকার পর তিনি যা দেখেন সে বিষয়ে এশিয়া ওয়াচকে বলেন, “গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে ছয়জনের মৃতদেহ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে বেশ কয়েকবার গুলি করা হয়েছে তাদের। এমনকি তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো তাদের। নিহতরা সকলেই ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, যারা শুলিপোরা গ্রাম থেকে এখানে এসেছিলেন কাজ করতে। এরপর সেখান থেকে কিছু দূরে একটি বাড়ির বারান্দায় একজন বাবা ও তাঁর ছেলের মৃতদেহ দেখতে পাই আমরা। তাদেরকেও গুলি করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এরও কিছু দূরে, আমরা একজন কৃষক ও অন্য আরও একজনের মৃতদেহ দেখতে পাই; তাদেরও গুলি করা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেকেরই পেটে ও বুকে গুলি করেছিল দখলদাররা।”
নিহতদের মাঝে একজন ছিলেন সুলাইমান মীর (৭৫) ও তাঁর ছেলে আব্দুল মজিদ (৩৫)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৩টার দিকে ওই বাড়িতে পাঁচজন দখলদার সেনা আসে। তখন আব্দুল মজিদ ও সুলাইমান বাড়ির ভিতরে প্লাস্টারিঙের কাজ করছিলেন এবং তাদের হাত কাদা-মাখা ছিল। আব্দুল মজিদের স্ত্রী চার-পাঁচজন প্রতিবেশী নারীর সঙ্গে ওই বাড়িতেই ছিলেন। তিনি তার স্বামীকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন, কারণ কিছুক্ষণ আগেই সেখানে অনেক গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান তারা। আব্দুল মজিদের স্ত্রী এশিয়া ওয়াচকে বলেন-
“গোলাগুলির সময় কিছু বুলেট এসে আমাদের বাড়িতে পড়ে। তাই ঘটনাটি দেখতে আমার স্বামী বাহিরে যান। বাইরে বেরোতেই এক সেনা তাঁর ঘাড় ধরে টেনে বারান্দা থেকে নামিয়ে দেয়। তখন আমার স্বামীকে বাঁচাতে আমি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু তারা তাদের রাইফেলের বাট দিয়ে আমাকে আঘাত করে এবং একপাশে সরিয়ে দেয়। এরপর তারা আমার স্বামীর পেটে দুইবার এবং পিঠে একবার গুলি করে। আমার শ্বশুর বাড়ির ভিতরেই ছিলেন। এক দখলদার বেয়নেট দিয়ে তাঁর পেটে ছুরিকাঘাত করে। এরপর একজন তাঁর পিঠে এবং হাতে গুলি করে।”
সেখানের আরেকজন বাসিন্দা মোহাম্মদ রমজানের স্ত্রী এশিয়া ওয়াচকে বলেন, অনেক নারী-পুরুষ দখলদারদের থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তের একটি বাড়িতে গিয়ে জড়ো হন। তাদের মধ্যে ২০ জন বারান্দায় ছিলেন। সেখানে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ির দরজার সামনে ছিলেন। তিনি এশিয়া ওয়াচকে বলেন-
“দখলদাররা এসে চারিদিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। তারা বারান্দা থেকে দু’জনকে পাশের ঘরে টেনে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হামিদ ভাট। হামিদ পেশায় ছিলেন একজন দর্জি। তিনি তাঁর দুই হাত জোড় করে সেই নিষ্ঠুরদের কাছে তাঁর জীবন ভিক্ষা চান। কিন্তু তারা তাঁকে স্বাধীনতাকামী হিসেবে সন্দেহ করে। হামিদ বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি দিলাওয়ার নই। এরপরও দখলদাররা হামিদের হাঁটুতে গুলি করে। হামিদ মেঝেতে পড়ে গেলে তারা এরপর হামিদের বুকে গুলি করে।”
তারপর দখলদাররা মোহাম্মদ ইউসুফ নামের একজনকে ধরে নিয়ে যায়। ইউসুফকে টেনে হিঁচড়ে একটি ঘরে নেবার সময় এক দখলদার তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে। দখলদাররা এরপর সেই ঘরের চারিদিকে গুলি চালায়। চলে যাবার সময় তারা নিহতদের মৃতদেহগুলি টেনে হিঁচড়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।
এইগুল হচ্ছে কাশ্মীরের সেই একেক টুকরো বাস্তবতা, যা অনেক ডলার খরচ করে ঢেকে রেখেছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।
মূলসূত্র :
বই- কাশ্মীর হ্যাপি ভ্যালী, ভ্যালী ওফ ডেথ (Kashmir Happy Valley, Valley of Death) [Page: 79-80];
প্রকাশনী- ডিফেন্ডার্স পাবলিকেশন্স আইএনসি (Defenders Publications, INC.)
প্রথম প্রকাশিত- ১৯৯৪
লেখক- উইলিয়াম ডব্লিও বেকার (William W. Baker)
অনুবাদক : আবু-উবায়দা
১৯৯২ সালের ১৩ই জুলাই। জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে নাসরুল্লাহপুরা শহরে যাবার সময় দখলদার হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর টহলকৃত চারটি গাড়িতে আক্রমণ চালায় কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলিমরা। এতে দখলদারদের চারটি গাড়িতেই আগুন লেগে যায়। পরবর্তী দুই ঘণ্টা ধরে স্বাধীনতাকামীদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সাতজন সেনা নিহত হয় দখলদারদের।
বন্দুকযুদ্ধের প্রায় দুই ঘন্টা পর দখলদার বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ৩০টি জিপ ও অন্যান্য যুদ্ধ যান সঙ্গে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা বলেন, দখলদাররা একটি সেতুর কাছে তাদের গাড়িগুলি পার্ক করে গ্রামে প্রবেশ করে। সেই গ্রামের বাইরের একজন বাসিন্দা এশিয়া ওয়াচকে বলেন, “সন্ধ্যা ৭টার দিকে দখলদার সেনারা ঐ গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ বেশ কয়েকজন চিকিৎসাকর্মী নিয়ে সেই গ্রামে প্রবেশ করে। তারা আমাকেও তাদের সাথে গ্রামে যেতে বলে।”
গ্রামে ঢোকার পর তিনি যা দেখেন সে বিষয়ে এশিয়া ওয়াচকে বলেন, “গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে ছয়জনের মৃতদেহ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে বেশ কয়েকবার গুলি করা হয়েছে তাদের। এমনকি তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো তাদের। নিহতরা সকলেই ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, যারা শুলিপোরা গ্রাম থেকে এখানে এসেছিলেন কাজ করতে। এরপর সেখান থেকে কিছু দূরে একটি বাড়ির বারান্দায় একজন বাবা ও তাঁর ছেলের মৃতদেহ দেখতে পাই আমরা। তাদেরকেও গুলি করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এরও কিছু দূরে, আমরা একজন কৃষক ও অন্য আরও একজনের মৃতদেহ দেখতে পাই; তাদেরও গুলি করা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেকেরই পেটে ও বুকে গুলি করেছিল দখলদাররা।”
নিহতদের মাঝে একজন ছিলেন সুলাইমান মীর (৭৫) ও তাঁর ছেলে আব্দুল মজিদ (৩৫)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৩টার দিকে ওই বাড়িতে পাঁচজন দখলদার সেনা আসে। তখন আব্দুল মজিদ ও সুলাইমান বাড়ির ভিতরে প্লাস্টারিঙের কাজ করছিলেন এবং তাদের হাত কাদা-মাখা ছিল। আব্দুল মজিদের স্ত্রী চার-পাঁচজন প্রতিবেশী নারীর সঙ্গে ওই বাড়িতেই ছিলেন। তিনি তার স্বামীকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন, কারণ কিছুক্ষণ আগেই সেখানে অনেক গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান তারা। আব্দুল মজিদের স্ত্রী এশিয়া ওয়াচকে বলেন-
“গোলাগুলির সময় কিছু বুলেট এসে আমাদের বাড়িতে পড়ে। তাই ঘটনাটি দেখতে আমার স্বামী বাহিরে যান। বাইরে বেরোতেই এক সেনা তাঁর ঘাড় ধরে টেনে বারান্দা থেকে নামিয়ে দেয়। তখন আমার স্বামীকে বাঁচাতে আমি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু তারা তাদের রাইফেলের বাট দিয়ে আমাকে আঘাত করে এবং একপাশে সরিয়ে দেয়। এরপর তারা আমার স্বামীর পেটে দুইবার এবং পিঠে একবার গুলি করে। আমার শ্বশুর বাড়ির ভিতরেই ছিলেন। এক দখলদার বেয়নেট দিয়ে তাঁর পেটে ছুরিকাঘাত করে। এরপর একজন তাঁর পিঠে এবং হাতে গুলি করে।”
সেখানের আরেকজন বাসিন্দা মোহাম্মদ রমজানের স্ত্রী এশিয়া ওয়াচকে বলেন, অনেক নারী-পুরুষ দখলদারদের থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তের একটি বাড়িতে গিয়ে জড়ো হন। তাদের মধ্যে ২০ জন বারান্দায় ছিলেন। সেখানে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ির দরজার সামনে ছিলেন। তিনি এশিয়া ওয়াচকে বলেন-
“দখলদাররা এসে চারিদিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। তারা বারান্দা থেকে দু’জনকে পাশের ঘরে টেনে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হামিদ ভাট। হামিদ পেশায় ছিলেন একজন দর্জি। তিনি তাঁর দুই হাত জোড় করে সেই নিষ্ঠুরদের কাছে তাঁর জীবন ভিক্ষা চান। কিন্তু তারা তাঁকে স্বাধীনতাকামী হিসেবে সন্দেহ করে। হামিদ বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি দিলাওয়ার নই। এরপরও দখলদাররা হামিদের হাঁটুতে গুলি করে। হামিদ মেঝেতে পড়ে গেলে তারা এরপর হামিদের বুকে গুলি করে।”
তারপর দখলদাররা মোহাম্মদ ইউসুফ নামের একজনকে ধরে নিয়ে যায়। ইউসুফকে টেনে হিঁচড়ে একটি ঘরে নেবার সময় এক দখলদার তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে। দখলদাররা এরপর সেই ঘরের চারিদিকে গুলি চালায়। চলে যাবার সময় তারা নিহতদের মৃতদেহগুলি টেনে হিঁচড়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।
এইগুল হচ্ছে কাশ্মীরের সেই একেক টুকরো বাস্তবতা, যা অনেক ডলার খরচ করে ঢেকে রেখেছে হিন্দুত্ববাদী ভারত।
মূলসূত্র :
বই- কাশ্মীর হ্যাপি ভ্যালী, ভ্যালী ওফ ডেথ (Kashmir Happy Valley, Valley of Death) [Page: 79-80];
প্রকাশনী- ডিফেন্ডার্স পাবলিকেশন্স আইএনসি (Defenders Publications, INC.)
প্রথম প্রকাশিত- ১৯৯৪
লেখক- উইলিয়াম ডব্লিও বেকার (William W. Baker)
অনুবাদক : আবু-উবায়দা
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
পর্ব-১ https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
পর্ব-২ https://alfirdaws.org/2022/09/25/59476/
পর্ব-১ https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
পর্ব-২ https://alfirdaws.org/2022/09/25/59476/
Comment