আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়ন কেন মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ!
২০২১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের (IEA) আবির্ভাবের পর, আফগানিস্তান সমস্ত আফগানদের জন্য সাধারণ বাড়িতে পরিণত হয়েছে। সারা দেশে নিরাপত্তা অনেক গুণ উন্নত হয়েছে। আর জনগণকে ধীরে ধীরে দেশের উন্নয়নে একযোগে কাজ করতে এক কাতারে নিয়ে আসছেন তালিবান উমারাগণ।
উমারাগণ জাতিকে এটা বুঝাতে সক্ষম হচ্ছেন যে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে- যদি বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, রাজনীতিবিদ এবং নেতারা আফগানিস্তানের জনগণের কাছে দেশের জাতীয় স্বার্থের পরিচয় তুলে ধরেন; আর যদি সেই অনুযায়ী নিজেদের ও জনগণের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করেন।
গবেষণায় প্রমাণিত যে, আফগানিস্তান দেশটি বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ইসলামী ইমারাত প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে খনিজ ও খনি হিসাবে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ এখন বিদেশিদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে আফগানদের নিজস্ব মালিকানাধীন হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্।
আর আফগানিস্তানের জনগণও এই সত্য ভালো করে জানে যে, ভিন্ন কোনো দেশ আফগানদেরকে তাদের দেশ গড়তে সাহায্য করবে না, যতক্ষণ না আফগানরা নিজেরা সেদিকে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সবার আগে আফগানদের পবিত্র ধর্ম ইসলামের পতাকাতলে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইমারতে ইসলামী প্রশাসন। তাঁরা ইতিমধ্যে সারা দেশে ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন, কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া না করেই।
আফগানরা সাধারণ মুসলিমরাও এখন তাদের দেশের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য ভালো সুযোগ পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে দেশটির দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জোড়ালো তৎপরতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ৪০ বছরের যুদ্ধবিদ্ধস্ত এবং সম্পূর্ণ বিদেশি সাহায্য-নির্ভর হয়ে পরা একটি দেশের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে জাতীয় বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে তালিবান প্রশাসন এর প্রমাণ ইতিমধ্যে দিয়েছে।
আর উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসাবে বিবেচিত যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তালিবান উমারা ও কর্মকর্তাগণ; যাতে তারা উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের আপামর জনগণকে সামিল করতে পারছেন আলহামদুলিল্লাহ্। সাহায্য সংস্থাগুলোর তহবিল ও প্রণোদনা অভাবিদের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করছেন তারা। দেশের খনি, কৃষি ও অন্যান্য শিল্পখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে উতসাহিত করার পাশাপাশি অসংখ্য নতুন লাইসেন্স প্রদান করছেন তারা।
ইতিমধ্যে আরব আমিরাতের সাথে বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে যাচ্ছে ইমারতে ইসলামিয়া। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ যেমন ইরান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পাশাপাশি দুই বৃহৎ পরাশক্তি চীন ও ভারতেও নিজেদের পণ্য রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন ইমারার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ। রাশিয়ার সাথেও বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানির চুক্তি করেছে ইমারতে ইসলামিয়া।
আর ইরান ইতিমধ্যে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করা শুরু করেছে।
সম্প্রতি ভারকে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে নর্থ-সাউথ করিডোর দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যে সহযোগিতা করায় সম্মতিও জানিয়েছে ইসলামী ইমারত; নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন তাঁরা। যদিও এর তীব্র বিরোধী ছিল পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা।
শুরুটা হয়েছিল পপী চাষ নিষিদ্ধ করে কৃষকদের ‘রেড গোল্ড’ জাফরান এবং গম চাষে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট তালিবান নেতৃত্ব সারা দেশ জুড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন খাল খনন করে কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন, কৃষকদের দিয়েছেন বিনামূল্যে বীজ ও সার।
আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে আফগানিস্তানে ইতিমধ্যে শত শত কিলোমিটার সড়ক ও সেতু নির্মাণ ও মেরামত করেছে তালিবান সরকার। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, ইতিমধ্যে একটি মজবুত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন ইমারতে ইসলামিয়ার উমারাগণ।
আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উপমহাদেশের মুক্তি:
এখানে পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত সংঘর্ষ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করেই সুন্নি পশতুন জাতিকে বিভক্ত করে বেআইনিভাবে তৎকালীন আফগান-ব্রিটিশ ভারত সীমান্তে ডুরান্ড লাইন টেনে দিয়েছিল, যা বর্তমানে পাক-আফগান সীমান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। তবে সাময়িক সম্মতি দিলেও এই লাইন কখনোই মেনে নেয় নি আফগান জাতি; তালিবানের নেতৃত্ব ইসলামী চেতনায় নবউজ্জীবিত আফগানরাও যে এটা মেনে নিবে না, সেটাই স্বাভাবিক। সীমান্তে তাই তালিবান মুজাহিদরা পাকিস্তানের প্রতিটি অন্যায়ের করা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, উপড়ে ফেলছেন সীমান্তে পাকিস্তানের দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া।
দেশভাগের সময়ই মূলত ব্রিটিশরা অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সুন্নিপ্রধান অঞ্চলগুলো যেমন বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীর এগুলোকে ভাগ ও আলাদা করে পাকিস্তানে তাদের বন্ধুপ্রতিম শিয়া রাফেজিদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাবান করে দিয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সুন্নি পাশতুন নেতৃত্বাধিন টিটিপি খাইবার অঞ্চলকে শিয়াপ্রধান পাকিদের দখল থেকে মুক্ত করতে পারলে, কাশ্মীরি মুজাহিদরাও তখন তাদের সরবরাহ লাইনগুলো নির্বিঘ্ন-নিশ্চিত করতে পারবেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতের উপর সেটা তখন হবে চরম এক বজ্রাঘাত। পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র সাব্যস্ত করে ভারত তখন সরাসরি ইসলামী শক্তির সাথে মোকাবেলায় নেমে পরতে পারে বলে মনে করছেন ইসলামী বিশ্লেষকরা।
আফগানিস্তানের তালিবান নেতৃত্ব তাই এখন চাইবেন, যেকোনো মূল্যে প্রতিবেশী যেকোন দেশের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল খাটিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতকে সমৃদ্ধ করা; যা তাঁরা ইতিমধ্যে করে যাচ্ছেন। আর ইতিমধ্যে তাঁরা অ্যামেরিকার নষ্ট করে রেখে যাওয়া অনেক যুদ্ধযান ও আকাশযান মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করেছেন, যে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই দিকটি বাহ্যত আগফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে অত্র অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহিনীতে পরিণত করবে ইনশাআল্লাহ্; বা ইতিমধ্যে করেছে।
তালিবানের গোয়েন্দা বাহিনী GDI ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে; আর তাদের রয়েছে দীর্ঘ ৪০ বছরের যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাদের হাতে আটক হওয়া খারেজি আইএস গোষ্ঠীর সদস্যরা এই স্বীকারোক্তিও দিয়েছে যে, আফগান যুদ্ধের নানান সময়ে তারা পূর্বতন মার্কিন-সমর্থিত সরকারের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছে।
ইতিহাস কি বলে?
আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম উম্মাহর জন্য, এমনকি বিশ্ব শান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের জালেম পরাশক্তিগুলো যুগে যুগে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাভুত হয়েছে; যেকারনে আফগানিস্তানকে অভিহিত করা হয় ‘Graveyard of Empires’ বা সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্তান হিসেবে।
কেননা সাম্প্রতিক অতীতে এখানে পরাজয় বরণ করেছে ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও অ্যামেরিকা তথা ন্যাটো বাহিনী।
আমরা যদি আরও একটু আগের ইতিহাসে যাই, শিয়া সাফাভিদ শক্তি আর তাতারিরাও বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারেনি আফগান মুসলিম জাতিকে। যুগে যুগেই এই আফগান জাতি প্রতিরক্ষার দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিম উম্মাহর জন্য, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলোতে পালন করেছে উম্মাহর ত্রাণকর্তার ভূমিকা।
আফগান সুলতান মাহমুদ গজনবীই মুহাম্মাদ বিন কাসিমের পর গড়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের ইসলামী শাসনের ভিত। এরপর মুহাম্মাদ ঘুড়ি আর খিলজি সুলতানরা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে করেছেন সমৃদ্ধ ও আলোকোজ্জ্বল। আর তাদের পথ ধরেই বখতিয়ার খিলজি বাংলা অঞ্চলকে করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী প্রভাব থেকে মুক্ত।
এরপর মুসলিম ভারত যখন মারাঠা আক্রমনে দিশেহারা, মুঘল বাদশাও যখন মারাঠাদের কর দিয়ে মসনদ টিকিয়ে রেখেছিলেন, আফগান বীর আহমাদ শাহ্ আবদালি তখন ছুটে এসেছেন উপমহাদেশের মুসলিমদের ত্রানকর্তা হয়ে। আর অত্যাচারি শিখ ও ইংরেজ যৌথ শক্তিকেও বহুযুগ ধরে আটকে রেখেছেন আগফগানের বীর মুজাহিদরাই। ইতিহাস সাক্ষী, কালের সন্ধিক্ষণে এসে যতবার উপমহাদেশ ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, ততবারই তাদের উদ্ধারে আফগান মুসলিমরা ঘোড়া ছুটিয়েছেন ময়দান থেকে ময়দানে।
ইতিহাসের সেই ধারা আজো চলমান। উপমহাদেশের মুসলিমদের দিকে আজ ধেয়ে আসছে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল ঝড়, ধেয়ে আসছে এক অনিবার্য সংঘাত। আর এই বিপদের গভীর অমানিশায় আশার আলো হয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আফগান মুসলিমরা, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সোভিয়েত ও ন্যাটো বাহিনীকে একে একে পরাজিত করার পর। রাজনৈতিক মাঠেও তাঁরা নাকানিচুবানি খাইয়ে চলেছেন বিশ্ব মোড়লদের। তাদের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম জাতির অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন তাঁরা। আর তাদের এই অবস্থানকে কোরআন-হাদিসের ভবিষ্যৎবাণীর আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের এই শক্তিশালী উত্থান গোটা মুসলিম উম্মাহকেই সম্মানিত করবে; এমনকি গোটা বিশ্বব্যবস্থার অন্ধকার-গলিতে আলোকসঞ্চার করার ভিত্তি নির্মাণ করছেন তাঁরা।
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই আমাদের উচিৎ, নিজেদের ও উম্মাহর স্বার্থে আফগান মুসলিম জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণার্থে নিজেদের ন্যূনতম ভূমিকা পালন করা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে উত্থিত পশ্চিমা মিথ্যা প্রোপ্যাগান্ডার জবাব দিতে পারি, তাদের পক্ষে নিজেদের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করতে পারি, আর সুযোগ থাকলে পারি নিজের অর্থ-সামর্থ্য দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে।
বিশ্ব ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুসলিম হিসেবে আমাদের ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করতে আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত আছি তো?
২০২১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের (IEA) আবির্ভাবের পর, আফগানিস্তান সমস্ত আফগানদের জন্য সাধারণ বাড়িতে পরিণত হয়েছে। সারা দেশে নিরাপত্তা অনেক গুণ উন্নত হয়েছে। আর জনগণকে ধীরে ধীরে দেশের উন্নয়নে একযোগে কাজ করতে এক কাতারে নিয়ে আসছেন তালিবান উমারাগণ।
উমারাগণ জাতিকে এটা বুঝাতে সক্ষম হচ্ছেন যে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে- যদি বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, রাজনীতিবিদ এবং নেতারা আফগানিস্তানের জনগণের কাছে দেশের জাতীয় স্বার্থের পরিচয় তুলে ধরেন; আর যদি সেই অনুযায়ী নিজেদের ও জনগণের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করেন।
গবেষণায় প্রমাণিত যে, আফগানিস্তান দেশটি বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ইসলামী ইমারাত প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে খনিজ ও খনি হিসাবে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ এখন বিদেশিদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে আফগানদের নিজস্ব মালিকানাধীন হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্।
আর আফগানিস্তানের জনগণও এই সত্য ভালো করে জানে যে, ভিন্ন কোনো দেশ আফগানদেরকে তাদের দেশ গড়তে সাহায্য করবে না, যতক্ষণ না আফগানরা নিজেরা সেদিকে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সবার আগে আফগানদের পবিত্র ধর্ম ইসলামের পতাকাতলে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইমারতে ইসলামী প্রশাসন। তাঁরা ইতিমধ্যে সারা দেশে ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন, কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া না করেই।
আফগানরা সাধারণ মুসলিমরাও এখন তাদের দেশের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য ভালো সুযোগ পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে দেশটির দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জোড়ালো তৎপরতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ৪০ বছরের যুদ্ধবিদ্ধস্ত এবং সম্পূর্ণ বিদেশি সাহায্য-নির্ভর হয়ে পরা একটি দেশের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে জাতীয় বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে তালিবান প্রশাসন এর প্রমাণ ইতিমধ্যে দিয়েছে।
আর উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসাবে বিবেচিত যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তালিবান উমারা ও কর্মকর্তাগণ; যাতে তারা উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের আপামর জনগণকে সামিল করতে পারছেন আলহামদুলিল্লাহ্। সাহায্য সংস্থাগুলোর তহবিল ও প্রণোদনা অভাবিদের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করছেন তারা। দেশের খনি, কৃষি ও অন্যান্য শিল্পখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে উতসাহিত করার পাশাপাশি অসংখ্য নতুন লাইসেন্স প্রদান করছেন তারা।
ইতিমধ্যে আরব আমিরাতের সাথে বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে যাচ্ছে ইমারতে ইসলামিয়া। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ যেমন ইরান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পাশাপাশি দুই বৃহৎ পরাশক্তি চীন ও ভারতেও নিজেদের পণ্য রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন ইমারার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ। রাশিয়ার সাথেও বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানির চুক্তি করেছে ইমারতে ইসলামিয়া।
আর ইরান ইতিমধ্যে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করা শুরু করেছে।
সম্প্রতি ভারকে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে নর্থ-সাউথ করিডোর দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যে সহযোগিতা করায় সম্মতিও জানিয়েছে ইসলামী ইমারত; নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন তাঁরা। যদিও এর তীব্র বিরোধী ছিল পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা।
শুরুটা হয়েছিল পপী চাষ নিষিদ্ধ করে কৃষকদের ‘রেড গোল্ড’ জাফরান এবং গম চাষে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট তালিবান নেতৃত্ব সারা দেশ জুড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন খাল খনন করে কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন, কৃষকদের দিয়েছেন বিনামূল্যে বীজ ও সার।
আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে আফগানিস্তানে ইতিমধ্যে শত শত কিলোমিটার সড়ক ও সেতু নির্মাণ ও মেরামত করেছে তালিবান সরকার। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, ইতিমধ্যে একটি মজবুত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন ইমারতে ইসলামিয়ার উমারাগণ।
আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উপমহাদেশের মুক্তি:
এখানে পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত সংঘর্ষ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করেই সুন্নি পশতুন জাতিকে বিভক্ত করে বেআইনিভাবে তৎকালীন আফগান-ব্রিটিশ ভারত সীমান্তে ডুরান্ড লাইন টেনে দিয়েছিল, যা বর্তমানে পাক-আফগান সীমান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। তবে সাময়িক সম্মতি দিলেও এই লাইন কখনোই মেনে নেয় নি আফগান জাতি; তালিবানের নেতৃত্ব ইসলামী চেতনায় নবউজ্জীবিত আফগানরাও যে এটা মেনে নিবে না, সেটাই স্বাভাবিক। সীমান্তে তাই তালিবান মুজাহিদরা পাকিস্তানের প্রতিটি অন্যায়ের করা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, উপড়ে ফেলছেন সীমান্তে পাকিস্তানের দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া।
দেশভাগের সময়ই মূলত ব্রিটিশরা অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সুন্নিপ্রধান অঞ্চলগুলো যেমন বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীর এগুলোকে ভাগ ও আলাদা করে পাকিস্তানে তাদের বন্ধুপ্রতিম শিয়া রাফেজিদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাবান করে দিয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সুন্নি পাশতুন নেতৃত্বাধিন টিটিপি খাইবার অঞ্চলকে শিয়াপ্রধান পাকিদের দখল থেকে মুক্ত করতে পারলে, কাশ্মীরি মুজাহিদরাও তখন তাদের সরবরাহ লাইনগুলো নির্বিঘ্ন-নিশ্চিত করতে পারবেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতের উপর সেটা তখন হবে চরম এক বজ্রাঘাত। পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র সাব্যস্ত করে ভারত তখন সরাসরি ইসলামী শক্তির সাথে মোকাবেলায় নেমে পরতে পারে বলে মনে করছেন ইসলামী বিশ্লেষকরা।
আফগানিস্তানের তালিবান নেতৃত্ব তাই এখন চাইবেন, যেকোনো মূল্যে প্রতিবেশী যেকোন দেশের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল খাটিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতকে সমৃদ্ধ করা; যা তাঁরা ইতিমধ্যে করে যাচ্ছেন। আর ইতিমধ্যে তাঁরা অ্যামেরিকার নষ্ট করে রেখে যাওয়া অনেক যুদ্ধযান ও আকাশযান মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করেছেন, যে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই দিকটি বাহ্যত আগফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে অত্র অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহিনীতে পরিণত করবে ইনশাআল্লাহ্; বা ইতিমধ্যে করেছে।
তালিবানের গোয়েন্দা বাহিনী GDI ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে; আর তাদের রয়েছে দীর্ঘ ৪০ বছরের যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাদের হাতে আটক হওয়া খারেজি আইএস গোষ্ঠীর সদস্যরা এই স্বীকারোক্তিও দিয়েছে যে, আফগান যুদ্ধের নানান সময়ে তারা পূর্বতন মার্কিন-সমর্থিত সরকারের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছে।
ইতিহাস কি বলে?
আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম উম্মাহর জন্য, এমনকি বিশ্ব শান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের জালেম পরাশক্তিগুলো যুগে যুগে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাভুত হয়েছে; যেকারনে আফগানিস্তানকে অভিহিত করা হয় ‘Graveyard of Empires’ বা সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্তান হিসেবে।
কেননা সাম্প্রতিক অতীতে এখানে পরাজয় বরণ করেছে ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও অ্যামেরিকা তথা ন্যাটো বাহিনী।
আমরা যদি আরও একটু আগের ইতিহাসে যাই, শিয়া সাফাভিদ শক্তি আর তাতারিরাও বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারেনি আফগান মুসলিম জাতিকে। যুগে যুগেই এই আফগান জাতি প্রতিরক্ষার দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিম উম্মাহর জন্য, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলোতে পালন করেছে উম্মাহর ত্রাণকর্তার ভূমিকা।
আফগান সুলতান মাহমুদ গজনবীই মুহাম্মাদ বিন কাসিমের পর গড়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের ইসলামী শাসনের ভিত। এরপর মুহাম্মাদ ঘুড়ি আর খিলজি সুলতানরা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে করেছেন সমৃদ্ধ ও আলোকোজ্জ্বল। আর তাদের পথ ধরেই বখতিয়ার খিলজি বাংলা অঞ্চলকে করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী প্রভাব থেকে মুক্ত।
এরপর মুসলিম ভারত যখন মারাঠা আক্রমনে দিশেহারা, মুঘল বাদশাও যখন মারাঠাদের কর দিয়ে মসনদ টিকিয়ে রেখেছিলেন, আফগান বীর আহমাদ শাহ্ আবদালি তখন ছুটে এসেছেন উপমহাদেশের মুসলিমদের ত্রানকর্তা হয়ে। আর অত্যাচারি শিখ ও ইংরেজ যৌথ শক্তিকেও বহুযুগ ধরে আটকে রেখেছেন আগফগানের বীর মুজাহিদরাই। ইতিহাস সাক্ষী, কালের সন্ধিক্ষণে এসে যতবার উপমহাদেশ ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, ততবারই তাদের উদ্ধারে আফগান মুসলিমরা ঘোড়া ছুটিয়েছেন ময়দান থেকে ময়দানে।
ইতিহাসের সেই ধারা আজো চলমান। উপমহাদেশের মুসলিমদের দিকে আজ ধেয়ে আসছে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল ঝড়, ধেয়ে আসছে এক অনিবার্য সংঘাত। আর এই বিপদের গভীর অমানিশায় আশার আলো হয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আফগান মুসলিমরা, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সোভিয়েত ও ন্যাটো বাহিনীকে একে একে পরাজিত করার পর। রাজনৈতিক মাঠেও তাঁরা নাকানিচুবানি খাইয়ে চলেছেন বিশ্ব মোড়লদের। তাদের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম জাতির অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন তাঁরা। আর তাদের এই অবস্থানকে কোরআন-হাদিসের ভবিষ্যৎবাণীর আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের এই শক্তিশালী উত্থান গোটা মুসলিম উম্মাহকেই সম্মানিত করবে; এমনকি গোটা বিশ্বব্যবস্থার অন্ধকার-গলিতে আলোকসঞ্চার করার ভিত্তি নির্মাণ করছেন তাঁরা।
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই আমাদের উচিৎ, নিজেদের ও উম্মাহর স্বার্থে আফগান মুসলিম জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণার্থে নিজেদের ন্যূনতম ভূমিকা পালন করা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে উত্থিত পশ্চিমা মিথ্যা প্রোপ্যাগান্ডার জবাব দিতে পারি, তাদের পক্ষে নিজেদের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করতে পারি, আর সুযোগ থাকলে পারি নিজের অর্থ-সামর্থ্য দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে।
বিশ্ব ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুসলিম হিসেবে আমাদের ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করতে আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত আছি তো?
|||
লিখেছেন : আব্দুল্লাহ বিন নজর
Comment