গত ৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় হিন্দু সম্মেলন’, যার শ্লোগান ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের ‘জয় শ্রীরাম’ ও ‘হিন্দু স্বার্থে এক মত’। হিন্দু মহাজোটের সভাপতি বিধান বিহারী গোস্বামীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনটি।
ভারতে মুসলিম গণহত্যার প্রতীক হয়ে উঠা আর.এস.এস-এর শ্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’, এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘হিন্দু স্বার্থে এক মত’ এই শ্লোগান। তবে হিন্দু নেতাদের ভাষ্য, এই শ্লোগান দিয়ে তারা বাংলাদেশের কথিত “সাম্প্রদায়িক অপশক্তি”র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছে।
তবে, কথিত ‘সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের আহ্বান’এর এই সম্মেলনে ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষের উপস্থিতি তাদের এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান প্রকাশ করছে। এটা তাদের গোপন অভিসন্ধি কিছুটা হলেও প্রকাশ পায়।
এখানে প্রশ্ন হলো, এই কথিত “সাম্প্রদায়িক অপশক্তি” কে বা কারা? বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু নেতারা কাদেরকে সাম্প্রদায়িক মনে করেন এই দেশে? এদেশের ৯২ ভাগ নাগরিক মুসলিম; ধর্মপ্রাণ এই গোটা মুসলিম সমাজকে এবং সম্মানিত আলেমসমাজকেই কি টার্গেট করা হচ্ছে না এই কথিত “সাম্প্রদায়িক অপশক্তি” ট্যাগ ব্যবহার করে?
বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্যের জন্য কুখ্যাতি পাওয়া দিলীপ ঘোষের মতো কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতার উপস্থিতিতে অন্যান্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী বক্তারাও ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করেছে।
এই সম্মেলনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও উপস্থিত ছিল, যে সম্মানিত আলেম-ওলামাদের নিয়ে প্রকাশ্যে কটূক্তি করার জন্য কুখ্যাত। চরম সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠীর জাতীয় সম্মেলনে শরীক হয়ে হাসানুল হক ইনু বলেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, সাম্প্রদায়িকতার আলখাল্লা পড়ে মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে।”
ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা করবে না, ভাগ করবে না, বৈষম্য করবে না। সব পাড়ায় বাঙালি দেখতে চাই, সব পাড়ায় মানুষ দেখতে চাই।”
সে আবার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি হয়ে যুদ্ধ করেছে মন্তব্য করে জাসদ সভাপতি বলে, “মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা বলে আত্মাহুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, সাম্প্রদায়িকতার আলখাল্লা পড়ে মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে।”
অর্থাৎ, ‘বাংলাদেশের হিন্দুরা নির্যাতিত’- এই ন্যারেটিভ দাড় করিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভারতের বাংলাদেশ দখলের যে প্রকল্প, তার সমর্থন ও সম্প্রসারণের যথেষ্ট উপাদান মজুদ ছিল এই উগ্র হিন্দু সমাবেশে।
সম্মেলনে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিকও উপস্থিত ছিল, যাকে বাংলাদেশে বিজেপির প্রতিনিধি ও পৃষ্ঠপোষক বলে বিবেচনা করা হয়। ধর্মীয় সংখ্যাতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সংসদে আসন নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বিজেপির বাংলাদেশের এই পৃষ্ঠপোষক। সে আরও বলেছে, “পাকিস্তান যখন গঠন করা হয় তখনও বাংলাদেশে হিন্দু ছিল ৩৩ শতাংশ। সেটা বর্তমানে কমতে কমতে এখন ৭.৯ শতাংশে নেমেছে। সেসময় পাকিস্তানের সংসদে হিন্দু এমপি ছিল ৭২ জন, বর্তমানে সেটা কমতে কমতে ১৬ জনে নেমেছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হলেও কোনো হিন্দু এমপি এর প্রতিবাদ করেননি।”
অথচ শতকরা হার কমলেও এদেশে হিন্দুদের মোট সংখ্যা বেড়েছে- এ কথা হিন্দু বক্তারা ও তাদের সহযোগিরা সবসময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এড়িয়ে যায়। আর এই শতকরা হার কমার পেছনে প্রধান কারণ হলো এদেশের হিন্দুরা এদেশে কাজ করে টাকা-পয়সা জমা করে ভারতে গিয়ে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতা এবং হিন্দুদের নিম্ন জন্মহারের তুলনায় মুসলিমদের উচ্চ জন্মহার- এই অকাট্য বিষয়গুলোও কৌশলে গোপন করা হয়।
আরেকটি অবাক করা বিষয় হলো, হিন্দুদের এই উগ্রবাদী সম্মেলনে সারাদেশ থেকে আগত হিন্দু মহাজোটের চার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তারাও কি তাহলে ইতিমধ্যে হিন্দুত্ববাদের এক বড় পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছে?
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং সালমা ইসলামও এই হিন্দু সম্মেলনে বক্তব্য রাখে। তারাও হয়তো দেশের টাল-মাটাল পরিস্থিতিতে দিল্লীর ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাঙ্গালি মুসলিম জাতি যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, ঠিক সেই সময়ে এদেশে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-আরএসএসের দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের এমন প্রকাশ্য আস্ফালন (সম্মেলনের নামে) কোন অশুভ চক্রান্তেরি ইঙ্গিত দিচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতির আলোকে বিষয়টি সচেতন মুসলিমদের গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিৎ। আসন্ন বিপর্যয় মোকাবেলায় সবারই এখন অন্তত আদর্শিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ।
লেখক : আবু আব্দুল্লাহ
তথ্যসূত্র :
১। হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-এর শ্লোগান জয় শ্রীরাম শীরে ধারণ করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা
– https://tinyurl.com/2p9t5ue3
Comment