‘আমি চীনা সরকারকে ঘৃণা করি’
পাঞ্চিং ব্যাগে একের পর এক ঘুষি দিচ্ছে ইমরান। পশ্চিম ইস্তাম্বুলের একটি বক্সিং জিমে অনুশীলন করছে সে। ১৬ বছর বয়সী এই উইঘুর তরুণ প্রায় ৬ বছর আগে তার বোনের সাথে জিনজিয়াং (পূর্ব তুর্কিস্তান) থেকে পালায়। এরপর ইস্তাম্বুলে এসে এই স্থানে একটি বাড়ি খুঁজে পেয়েছে সে।
সহজ কোনো হিজরত ছিল না এটি। ২০১৭ সালে তার বাবা-মা তাদের সন্তানদের নতুন জীবনে সহায়তার জন্য কিছু অর্থ পাঠাতে চেষ্টা করেছিলেন। এরপর থেকে বাবা-মায়ের সাথে কথা হয় না ইমরানের।
“আমার মা-বাবাকে ২৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারণ হলো, তারা আমার বোন ও আমার কাছে বিদেশে টাকা পাঠিয়েছিলেন,” কথাগুলো বলার সময় ইমরানের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। “সর্বমোট পঞ্চাশ বছর!”
এই জিম সেন্টারে চীনের বর্বর আগ্রাসনের শিকার হয়ে অনাথ হওয়া উইঘুর সন্তানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। উইঘুররা মুসলিম জাতি। শত হাজার উইঘুরকে বন্দী করেছে চীন; ‘রি-এডুকেশন’ ক্যাম্পে পাঠিয়েছে আরও দশ লক্ষাধিক উইঘুরকে।একটি মুসলিম জাতির নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে চীন।
প্রশিক্ষণ শুরুর আগে মাদুরের উপর সিজদা দিচ্ছে আট কিশোর। তাদের সবাই-ই পরিবারের সদস্য হারিয়েছে।
পালওয়ান জিমের লক্ষ্য হলো স্বজনহারা তরুণদের সহায়তা করা। এসব তরুণদের স্বজনরা হয় নিরুদ্দেশ অথবা কারাবন্দী হয়ে আছেন। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
কত সংখ্যক উইঘুর চীন থেকে পালিয়েছেন, তা জানা যায় না; তবে ইস্তাম্বুলের এই কোণে হাজার হাজার নির্বাসিতের বসবাস রয়েছে। সর্বমোট প্রায় ৫০,০০০ উইঘুর এখন তুরস্কে বাস করে।
বক্সিং জিমের আশপাশের এলাকায় উইঘুরদের বসবাস। এখানে উইঘুররা সংঘবদ্ধভাবে বাস করার চেষ্টা করছেন।
ব্যাকারিগুলো এক ধরনের গোলাকার ও ঘন নান রুটি বিক্রি করে। জিনজিয়াংয়ের জনপ্রিয় খাবার এটি। কিছু দোকানে অর্ধচন্দ্র ও তারকা খচিত আকাশী নীল পতাকা উড়ছে। এই পতাকা ১৯৪০ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান রিপাবলিকে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন এটি পরিণত হয়েছে উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকে।
ইমরানের বয়স যখন ১১ বছর, তাকে গ্রেফতার করেছিল চাইনিজ পুলিশ। ১২ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল তখন। ছাড়া পেয়েই প্রবাসে পাড়ি জমায় ইমরান।
পরিকল্পনা ছিল তার পুরো পরিবার চীন ত্যাগ করবে। তবে তার মা-বাবা এবং আরও দুই সহোদর চীন ত্যাগ করতে সফল হননি। আজও সে নিশ্চিত না, তার অন্য বোনদের সাথে কী হয়েছে।
“আমি অন্তত আমার বড় বোনের সাথে থাকতে পেরে খুশি,” বলছে ইমরান। “তাকে পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ, কারণ আমরা একই গর্ভ থেকে এসেছি।”
এই দুজনও খুব কষ্টে পালাতে সক্ষম হন। কিছু কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার পর তৃতীয় বারের চেষ্টায় তারা চীন ছাড়ার অনুমতি পান। বেইজিংয়ের নেট বন্ধ করার মিশন তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছিল।
৩১ বছর বয়সী সেমেরজান সাইদি জিমটি চালান। জিমটিকে বলা হয় পালওয়ান, উইঘুরদের কাছে এর মানে হলো ‘বীর’। তিনি এই জিমের মাধ্যমে স্বজনহারা উইঘুর যুবকদের সহায়তা করেন।
প্রশিক্ষণ চলছে। কোচ চিৎকার করে নির্দেশনা দিচ্ছেন তার অনুসারীদের। কখনও উচ্চ লাফ দিতে, আবার কখনও নিচে ঝুঁকে চলতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
ইমরানের বয়স যখন ১১ বছর, চাইনিজ পুলিশ তাকে ১২ ঘণ্টার জন্য আটকে রেখেছিল। এরপর সে ইস্তাম্বুলের নির্বাসিত জীবনে যোগ দেয়। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকারসেমেরজান সাইদি বলেন, বক্সিং জিম এবং যুব কেন্দ্র উইঘুর যুবকদের জন্য একটি সামাজিক মিলন স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখানে তারা অধ্যয়ন করেন এবং সামাজিকীকরণের সুযোগ ঘটে। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
জনাব সাইদি কয়েকশত শিশু ও তরুণদের নিয়ে যুব কেন্দ্র ও বক্সিং জিমে কাজ করেন। এর মধ্য থেকে অর্ধেক ছেলেই তাদের পিতা-মাতার মধ্য থেকে অন্তত একজনকে হারিয়েছে।
তিনি নিজেও তার পরিবারকে হারিয়েছেন। বহু বছর ধরে তিনি তার বোনের সাথে কথা বলতে পারেন না। এমনকি তাকে ভাবতে হয় যে, তার বোনের বয়স এখন কত হবে!
“খুবই খারাপ এটি,” জনাব সাইদি বলেন। “আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আমার শরণার্থী বন্ধুরা পর্যন্ত তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”
তবে “পূর্ব তুর্কিস্তানে তো কোনো যুদ্ধ নেই,” বললেন জনাব সাইদি। তবুও সেখানে থাকা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা যায় না। উইঘুররা তাদের মাতৃভূমিকে পূর্ব তুর্কিস্তান বলতেই পছন্দ করে। কিন্তু চীনারা এর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে জিনজিয়াং।
যুবকেন্দ্রটি ইংরেজি ক্লাস থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্কন কর্মশালার আয়োজনও করে। এখানে উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। উইঘুরদের অনেকে জনাব সাইদিকে সম্মানসূচক ‘বড় ভাই’ বলে ডাকেন।
জনাব সাইদি বলেন, “দেশে গণহত্যার শিকার হওয়ার ফলে অনেক উইঘুর একসাথে এখানে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সত্যিকারের সম্প্রদায়ে পরিণত হতে আরও সময় লাগবে।”
পরদিন এই সেন্টারে একটি অনুষ্ঠান হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে চেয়ারের ব্যবস্থা করছেন মুখারেম মাহমুদ। ২০১৭ সালে তার মা-বাবা নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর, তিনি শুনেন যে তার বাবাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং মা-কে দেওয়া হয়েছে ৬ বছরের কারাদণ্ড।
তাদের অপরাধ ছিল কেবল তাদের কন্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য কয়েকশত পাউন্ড পাঠানো। চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাছে নাকি প্রমাণ আছে যে তার মা-বাবা বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাহায্য করে।
“আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল, হতাশা ঘিরে ধরেছিল,” মিসেস মাহমুদ বলেন। ২৫ বছর বয়সী এই নারী নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এখনও তার মা-বাবার পাঠানো পুরোনো মেসেজগুলোই বার বার পড়েন।
“এক বছর হলো আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। তবে এ কথা আমার মা-বাবাকে জানাতে পারিনি,” বললেন তিনি।
ইস্তাম্বুলে চাইনিজ দূতাবাসের কাছে বিক্ষোভ করার সময় উইঘুর বিক্ষোভকারীদের একাংশ। ফটো ক্রেডিট: রয়টার্স।
কিছু উইঘুররা ভাগ্যক্রমে পালাতে পেরেছেন। কিন্তু পেছনে রেখে যেতে হয়েছে তাদের সন্তানদের। এর ফলে দুঃখ তাদের পিছু ছাড়ছে না। আব্দুস সাত্তার হাজি ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য কয়েকবার জিনজিয়াংয়ের কারাগারে বন্দী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পালাতে সক্ষম হলেও পেছনে রয়ে গেছে তাঁর সাত সন্তান এবং ২০ নাতি-নাতনি।
“চীনে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই; চাইনিজদের হাতে বহু নির্মমতার শিকার হয়েছি আমি,” ৭৪ বছর বয়সী ডেন্টিস্ট আব্দুস সাত্তার বলছেন এ কথা। এখন তিনি তার অনাড়ম্বর বাড়িতে মুষ্টিমেয় রোগী দেখেন।
একটি উইঘুর দোকানে আব্দুস সাত্তার হাজি। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
কোনো কোনো দিন তিনি তার গলায় বিশাল প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছেন এবং অন্যান্য উইঘুরদের সাথে তুর্কিতে অবস্থিত চায়না দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তার প্লেকার্ডে লেখা ছিল “চীন! আমার পরিবারকে মুক্তি দাও!”
একদিকে চীনে ধার্মিকতার সামান্যতম নিদর্শন দেখানোর ফলে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে বন্দী করা হয়েছে, অন্যদিকে ইস্তাম্বুলে উইঘুর যুবকরা গর্বের সাথে তাদের বিশ্বাস নিয়ে বড় হচ্ছে।
মিসেস মাহমুদ একটি আবায়া (পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের কালো পোশাক) পরেছেন। ইমরান মাত্র তিন মাসে পবিত্র কুরআন হিফজ করেছে এবং এখন সে বক্সিং ক্লাসের আগে সালাতে ইমামতি করে।
এখনও বিশ্বের এই অংশটাতে বহু উইঘুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। তাদের বড় একটি অংশ উদ্বাস্তু। অনেকে তুর্কিতে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার আগে কাগজপত্র ছাড়াই মানবপাচারের পথ ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এমনকি যারা তুরস্কের নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতিপত্র পেয়েছেন, তাদেরকেও চীনে ফেরত পাঠানোর ভয় রয়েছে। ২০১৭ সালে একটি প্রত্যার্পণ চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয় চীন ও তুরস্ক। চীন ইতোমধ্যে এর অনুমোদন দিয়েছে, এখন তুরস্কের পার্লামেন্ট থেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে এটি।
জিমের ঘড়িটি নীল অর্ধচন্দ্র ও তারায় মোড়ানো। এই ঘড়িতে যখন রাত ৯:৩০ বাজে, ইমরানের প্রশিক্ষণ শেষ হয় তখন।
সে চেষ্টা করছে ইস্তাম্বুলের সাথে মানিয়ে নিতে। নতুন নতুন বন্ধু বানিয়েছে। কিন্তু এসবের কিছুই তার নিজ বাড়ির প্রতিস্থাপন হতে পারে না। কিন্তু সম্ভবত সে তার বাড়িতে আর কখনোই যেতে পারবে না।
“আমি আমার আশপাশের লোকজন, সমস্ত জায়গা, আর এগুলোকে কীভাবে অনুভব করেছি, তার সবকিছু মনে আছে,” বলছে ইমরান।
“আমি চীনা সরকারকে ঘৃণা করি। তারা চীনা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য না।”
তথ্যসূত্র:
1. ‘I hate the Chinese government’: Uyghur orphans unleash their fury at boxing club sanctuary
– https://tinyurl.com/44j5j3bp
পাঞ্চিং ব্যাগে একের পর এক ঘুষি দিচ্ছে ইমরান। পশ্চিম ইস্তাম্বুলের একটি বক্সিং জিমে অনুশীলন করছে সে। ১৬ বছর বয়সী এই উইঘুর তরুণ প্রায় ৬ বছর আগে তার বোনের সাথে জিনজিয়াং (পূর্ব তুর্কিস্তান) থেকে পালায়। এরপর ইস্তাম্বুলে এসে এই স্থানে একটি বাড়ি খুঁজে পেয়েছে সে।
সহজ কোনো হিজরত ছিল না এটি। ২০১৭ সালে তার বাবা-মা তাদের সন্তানদের নতুন জীবনে সহায়তার জন্য কিছু অর্থ পাঠাতে চেষ্টা করেছিলেন। এরপর থেকে বাবা-মায়ের সাথে কথা হয় না ইমরানের।
“আমার মা-বাবাকে ২৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারণ হলো, তারা আমার বোন ও আমার কাছে বিদেশে টাকা পাঠিয়েছিলেন,” কথাগুলো বলার সময় ইমরানের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। “সর্বমোট পঞ্চাশ বছর!”
এই জিম সেন্টারে চীনের বর্বর আগ্রাসনের শিকার হয়ে অনাথ হওয়া উইঘুর সন্তানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। উইঘুররা মুসলিম জাতি। শত হাজার উইঘুরকে বন্দী করেছে চীন; ‘রি-এডুকেশন’ ক্যাম্পে পাঠিয়েছে আরও দশ লক্ষাধিক উইঘুরকে।একটি মুসলিম জাতির নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে চীন।
প্রশিক্ষণ শুরুর আগে মাদুরের উপর সিজদা দিচ্ছে আট কিশোর। তাদের সবাই-ই পরিবারের সদস্য হারিয়েছে।
পালওয়ান জিমের লক্ষ্য হলো স্বজনহারা তরুণদের সহায়তা করা। এসব তরুণদের স্বজনরা হয় নিরুদ্দেশ অথবা কারাবন্দী হয়ে আছেন। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
কত সংখ্যক উইঘুর চীন থেকে পালিয়েছেন, তা জানা যায় না; তবে ইস্তাম্বুলের এই কোণে হাজার হাজার নির্বাসিতের বসবাস রয়েছে। সর্বমোট প্রায় ৫০,০০০ উইঘুর এখন তুরস্কে বাস করে।
বক্সিং জিমের আশপাশের এলাকায় উইঘুরদের বসবাস। এখানে উইঘুররা সংঘবদ্ধভাবে বাস করার চেষ্টা করছেন।
ব্যাকারিগুলো এক ধরনের গোলাকার ও ঘন নান রুটি বিক্রি করে। জিনজিয়াংয়ের জনপ্রিয় খাবার এটি। কিছু দোকানে অর্ধচন্দ্র ও তারকা খচিত আকাশী নীল পতাকা উড়ছে। এই পতাকা ১৯৪০ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান রিপাবলিকে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন এটি পরিণত হয়েছে উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকে।
ইমরানের বয়স যখন ১১ বছর, তাকে গ্রেফতার করেছিল চাইনিজ পুলিশ। ১২ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল তখন। ছাড়া পেয়েই প্রবাসে পাড়ি জমায় ইমরান।
পরিকল্পনা ছিল তার পুরো পরিবার চীন ত্যাগ করবে। তবে তার মা-বাবা এবং আরও দুই সহোদর চীন ত্যাগ করতে সফল হননি। আজও সে নিশ্চিত না, তার অন্য বোনদের সাথে কী হয়েছে।
“আমি অন্তত আমার বড় বোনের সাথে থাকতে পেরে খুশি,” বলছে ইমরান। “তাকে পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ, কারণ আমরা একই গর্ভ থেকে এসেছি।”
এই দুজনও খুব কষ্টে পালাতে সক্ষম হন। কিছু কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার পর তৃতীয় বারের চেষ্টায় তারা চীন ছাড়ার অনুমতি পান। বেইজিংয়ের নেট বন্ধ করার মিশন তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছিল।
৩১ বছর বয়সী সেমেরজান সাইদি জিমটি চালান। জিমটিকে বলা হয় পালওয়ান, উইঘুরদের কাছে এর মানে হলো ‘বীর’। তিনি এই জিমের মাধ্যমে স্বজনহারা উইঘুর যুবকদের সহায়তা করেন।
প্রশিক্ষণ চলছে। কোচ চিৎকার করে নির্দেশনা দিচ্ছেন তার অনুসারীদের। কখনও উচ্চ লাফ দিতে, আবার কখনও নিচে ঝুঁকে চলতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
ইমরানের বয়স যখন ১১ বছর, চাইনিজ পুলিশ তাকে ১২ ঘণ্টার জন্য আটকে রেখেছিল। এরপর সে ইস্তাম্বুলের নির্বাসিত জীবনে যোগ দেয়। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকারসেমেরজান সাইদি বলেন, বক্সিং জিম এবং যুব কেন্দ্র উইঘুর যুবকদের জন্য একটি সামাজিক মিলন স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখানে তারা অধ্যয়ন করেন এবং সামাজিকীকরণের সুযোগ ঘটে। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
জনাব সাইদি কয়েকশত শিশু ও তরুণদের নিয়ে যুব কেন্দ্র ও বক্সিং জিমে কাজ করেন। এর মধ্য থেকে অর্ধেক ছেলেই তাদের পিতা-মাতার মধ্য থেকে অন্তত একজনকে হারিয়েছে।
তিনি নিজেও তার পরিবারকে হারিয়েছেন। বহু বছর ধরে তিনি তার বোনের সাথে কথা বলতে পারেন না। এমনকি তাকে ভাবতে হয় যে, তার বোনের বয়স এখন কত হবে!
“খুবই খারাপ এটি,” জনাব সাইদি বলেন। “আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আমার শরণার্থী বন্ধুরা পর্যন্ত তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”
তবে “পূর্ব তুর্কিস্তানে তো কোনো যুদ্ধ নেই,” বললেন জনাব সাইদি। তবুও সেখানে থাকা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা যায় না। উইঘুররা তাদের মাতৃভূমিকে পূর্ব তুর্কিস্তান বলতেই পছন্দ করে। কিন্তু চীনারা এর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে জিনজিয়াং।
যুবকেন্দ্রটি ইংরেজি ক্লাস থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্কন কর্মশালার আয়োজনও করে। এখানে উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। উইঘুরদের অনেকে জনাব সাইদিকে সম্মানসূচক ‘বড় ভাই’ বলে ডাকেন।
জনাব সাইদি বলেন, “দেশে গণহত্যার শিকার হওয়ার ফলে অনেক উইঘুর একসাথে এখানে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সত্যিকারের সম্প্রদায়ে পরিণত হতে আরও সময় লাগবে।”
পরদিন এই সেন্টারে একটি অনুষ্ঠান হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে চেয়ারের ব্যবস্থা করছেন মুখারেম মাহমুদ। ২০১৭ সালে তার মা-বাবা নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর, তিনি শুনেন যে তার বাবাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং মা-কে দেওয়া হয়েছে ৬ বছরের কারাদণ্ড।
তাদের অপরাধ ছিল কেবল তাদের কন্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য কয়েকশত পাউন্ড পাঠানো। চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাছে নাকি প্রমাণ আছে যে তার মা-বাবা বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাহায্য করে।
“আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল, হতাশা ঘিরে ধরেছিল,” মিসেস মাহমুদ বলেন। ২৫ বছর বয়সী এই নারী নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এখনও তার মা-বাবার পাঠানো পুরোনো মেসেজগুলোই বার বার পড়েন।
“এক বছর হলো আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। তবে এ কথা আমার মা-বাবাকে জানাতে পারিনি,” বললেন তিনি।
ইস্তাম্বুলে চাইনিজ দূতাবাসের কাছে বিক্ষোভ করার সময় উইঘুর বিক্ষোভকারীদের একাংশ। ফটো ক্রেডিট: রয়টার্স।
কিছু উইঘুররা ভাগ্যক্রমে পালাতে পেরেছেন। কিন্তু পেছনে রেখে যেতে হয়েছে তাদের সন্তানদের। এর ফলে দুঃখ তাদের পিছু ছাড়ছে না। আব্দুস সাত্তার হাজি ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য কয়েকবার জিনজিয়াংয়ের কারাগারে বন্দী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পালাতে সক্ষম হলেও পেছনে রয়ে গেছে তাঁর সাত সন্তান এবং ২০ নাতি-নাতনি।
“চীনে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই; চাইনিজদের হাতে বহু নির্মমতার শিকার হয়েছি আমি,” ৭৪ বছর বয়সী ডেন্টিস্ট আব্দুস সাত্তার বলছেন এ কথা। এখন তিনি তার অনাড়ম্বর বাড়িতে মুষ্টিমেয় রোগী দেখেন।
একটি উইঘুর দোকানে আব্দুস সাত্তার হাজি। ফটো ক্রেডিট: ব্র্যাডলি সেকার
কোনো কোনো দিন তিনি তার গলায় বিশাল প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছেন এবং অন্যান্য উইঘুরদের সাথে তুর্কিতে অবস্থিত চায়না দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তার প্লেকার্ডে লেখা ছিল “চীন! আমার পরিবারকে মুক্তি দাও!”
একদিকে চীনে ধার্মিকতার সামান্যতম নিদর্শন দেখানোর ফলে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে বন্দী করা হয়েছে, অন্যদিকে ইস্তাম্বুলে উইঘুর যুবকরা গর্বের সাথে তাদের বিশ্বাস নিয়ে বড় হচ্ছে।
মিসেস মাহমুদ একটি আবায়া (পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের কালো পোশাক) পরেছেন। ইমরান মাত্র তিন মাসে পবিত্র কুরআন হিফজ করেছে এবং এখন সে বক্সিং ক্লাসের আগে সালাতে ইমামতি করে।
এখনও বিশ্বের এই অংশটাতে বহু উইঘুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। তাদের বড় একটি অংশ উদ্বাস্তু। অনেকে তুর্কিতে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার আগে কাগজপত্র ছাড়াই মানবপাচারের পথ ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এমনকি যারা তুরস্কের নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতিপত্র পেয়েছেন, তাদেরকেও চীনে ফেরত পাঠানোর ভয় রয়েছে। ২০১৭ সালে একটি প্রত্যার্পণ চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয় চীন ও তুরস্ক। চীন ইতোমধ্যে এর অনুমোদন দিয়েছে, এখন তুরস্কের পার্লামেন্ট থেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে এটি।
জিমের ঘড়িটি নীল অর্ধচন্দ্র ও তারায় মোড়ানো। এই ঘড়িতে যখন রাত ৯:৩০ বাজে, ইমরানের প্রশিক্ষণ শেষ হয় তখন।
সে চেষ্টা করছে ইস্তাম্বুলের সাথে মানিয়ে নিতে। নতুন নতুন বন্ধু বানিয়েছে। কিন্তু এসবের কিছুই তার নিজ বাড়ির প্রতিস্থাপন হতে পারে না। কিন্তু সম্ভবত সে তার বাড়িতে আর কখনোই যেতে পারবে না।
“আমি আমার আশপাশের লোকজন, সমস্ত জায়গা, আর এগুলোকে কীভাবে অনুভব করেছি, তার সবকিছু মনে আছে,” বলছে ইমরান।
“আমি চীনা সরকারকে ঘৃণা করি। তারা চীনা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য না।”
প্রতিবেদক : সাইফুল ইসলাম
তথ্যসূত্র:
1. ‘I hate the Chinese government’: Uyghur orphans unleash their fury at boxing club sanctuary
– https://tinyurl.com/44j5j3bp
Comment