মুসলিম সেনাপতি মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.)
আরবের উত্তর-পূর্ব কোণে ইউফ্রেটিস (ফুরাত) নদীর তীর ঘেঁষে ছিল বনু বকরের বসবাস। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে বনু বকর ইসলাম গ্রহণ করে। গোত্রটির অবস্থান পারস্যের সীমান্ত অঞ্চল ঘেঁষে। ফুরাতের পূর্বতীর থেকেই পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা শুরু। বনু বকরের সর্দার ছিলেন হারিসার বেটা মুসান্না। ইতিহাসের পাতায় তিনি মুসান্না ইবনে হারিসা নামে প্রসিদ্ধ।
১৩ হিজরীর ১২ রমাদান বুওয়াইবের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ইতিহাসের পাতায় একজন মহান সিপাহসালার খ্যাতি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি পারসিকদের বিরুদ্ধে অনেকগুলি যুদ্ধে শরিক হয়েছেন এবং কতগুলিতে সফল নেতৃত্বও দিয়েছেন। পারসিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের চূড়ান্ত বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল কাদিসিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে। কাদিসিয়ার সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের নেতৃত্ব হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু দিলেও, এ যুদ্ধের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন হযরত মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.)। জীবন তাঁর সঙ্গ না দেওয়ায় তিনি কাদিসিয়ার যুদ্ধে শরিক হতে পারেন নি।
পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াফাতের পর ততকালীন পারস্যসম্রাট ইউফ্রেটিস নদী অতিক্রম করে বনু বকরের উপর আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের পেছনে পারস্যের আগ্রাসী নীতি ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ যে উদ্দেশ্যটি ছিল সেটি হলো- ইসলাম ও মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান শক্তির উত্থানকে দমিয়ে দেওয়া। খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত আবু বকর (রা.) এর অনুমতিক্রমে হযরত মুসান্না ইবনে হারিসা (রা). বনু বকরের যোদ্ধাদের নিয়ে ততকালীন বিশ্ব পরাশক্তি পারস্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। একেবারেই সামান্য জনশক্তি ও নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পারস্যের মতো এত বিশাল ও শক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি ছোট ছোট বাহিনী তৈরি করে ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হবে না। তাই তিনি পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে মদীনা থেকে সাহায্যের আবেদন পাঠান।
খলিফা আবু বকর (রা.) সবেমাত্র ফেতনায়ে ইরতিদাদ দমন করে কিছুটা অবসর হলেন। মুজাহিদরা এখনও বিভিন্ন রণাঙ্গনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। যারা মদীনাতে ফিরে এসেছেন তারাও দীর্ঘযুদ্ধ শেষে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সার্বিকভাবে মদীনার অবস্থা মুসান্নার সাহায্যার্থে সেনা পাঠানোর অনুকূলে ছিল না। তাই যারা স্বেচ্ছায় ইরাকের নতুন রণাঙ্গনে যেতে ইচ্ছুক শুধু তাদেরকে নিয়ে হযরত আবু বকর (রা.) একটি বাহিনী গঠন করে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.) এর নেতৃত্ব তা পারস্য সীমানা অভিমুখে রাওয়ানা করিয়ে দেন। সে হিসেবে ১০ হাজার মুজাহিদের এক বাহিনী নিয়ে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। পূর্ব থেকে যুদ্ধ করতে থাকা মুসান্না ও তার ৮ হাজার মুজাহিদ বাহিনী উবুল্লাতে এসে মিলিত হন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের সাথে। মোট ১৮ হাজার যোদ্ধা নিয়ে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ লড়তে থাকেন পারস্যের বিরুদ্ধে। উবুল্লা, হীরা, আম্বার ও আইনুত-তামারসহ ছোট বড় প্রায় ১৫ টি যুদ্ধে তিনি কাফেরদেরকে লজ্জাজনক পরাজয় উপহার দেন। ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন পারস্যের রাজধানী টেসিফোনের (তিসফুন) দিকে।
কিন্তু ততদিনে সিরিয়া সংলগ্ন রোম সীমান্তেও রোমকরা মুসলিমদের সাথে সীমান্তযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। সেখানে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে মুসলিমদের অবস্থা কিছুটা শোচনীয় হয়ে পড়ে। ফলে খলীফা আবু বকর (রা.) খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে রোম সীমান্তে চলে যাবার নির্দেশনা পাঠান৷ খলিফার নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ৯ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়া সীমান্তে ছুটে যান। বাকি ৯ হাজার রেখে যান মুসান্না ইবনে হারিসার কাছে। তিনি তাদেরকে নিয়েই অসীম সাহসিকতার সাথে লড়তে থাকেন। ময়দানে খালিদের অনুপস্থিতি তিনি বুঝতে দেন নি শত্রুসেনাদের।
একসময় তিনি পুনরায় সেনা সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং স্বীয় ভাই মুয়ান্না ইবনে হারিসাকে মদীনায় পাঠান। খলীফা অবু বকর (রা.) তখন শয্যাশায়ী। তবুও তিনি পরবর্তী খলিফা হযরত উমর (রা.)-কে ইরাকের রণাঙ্গনে সেনাসাহায্য পাঠানোর অসিয়ত করে যান। সে অনুযায়ী হযরত উমর (রা.) ১ হাজারের একটি বাহিনী হযরত আবু উবাইদ ইবনে মাসউদ আস-সাকাফী (রা.) এর নেতৃত্বে পারস্য অভিমুখে রাওয়ানা করিয়ে দেন। তিনিও পরপর কয়েকটি যুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর সেতুর যুদ্ধে পারস্য সেনাপতি বাহমান জাযাবিয়ার মুখোমুখি হন।
সেতুর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পরাজয়
ইউফ্রেটিস (ফুরাত) নদীর দু’পাশে দুটি বাহিনী যুদ্ধের জন্য অপেক্ষমাণ। পারস্য সেনাপতি বাহমান জাযাবিয়া মুসলিম সেনাপতি আবু উবাইদ আস-সাকাফির কাছে জানতে চায়- কারা সেতু অতিক্রম করবে? আমরা না তোমরা? ঈমানী বলে বলিয়ান ও শাহাদাতের নেশায় ব্যাকুল কিন্তু যুদ্ধের বিষয়ে কিছুটা অদূরদর্শী সেনাপতি আগ-পিছ না ভেবে বলে ফেলেন, “খোদার কসম, আমরা কখনোই ভীতু ও কাপুরুষ নই, আমরা অবশ্যই নদী অতিক্রম করে যুদ্ধ করব।” অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অন্যদের অনেক বুঝানো সত্ত্বেও তিনি নিজের এই আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। নদী অতিক্রম করার পরপরই সবাই বুঝতে পারে তারা কাফেরদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে।
পারসিকরা ময়দানে বিশালাকৃতির হাতি নামিয়ে দিলে মুসলিমদের ঘোড়াগুলো যুদ্ধের কাতার তছনছ করে ছুটাছুটি শুরু করে দেয়। ১৩ হিজরীর ২৩ শাবান। এদিন ফুরাত নদীর স্বচ্ছ পানি রক্তিম হয়ে গিয়েছিল মুসলিমদের তপ্ত-লাল রক্তে। সপ্তম শতাব্দীতে বাগদাদে বর্বর তাতারিদের বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ছাড়া ফুরাত এত বেশি মুসলিম-রক্ত আর কখনোই দেখেনি। সামনে শত্রু আর পেছনে ফুরাতের অথৈ জলরাশি। দিশেহারা হয়ে পড়ে মুসলিম বাহিনী। তাদের পক্ষে এই আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুসলিম সেনাপতির একটু অদূরদর্শিতা পুরো বাহিনীকে অনিবার্য পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়। স্বয়ং সেনাপতিসহ অনেক মুসলিম শাহাদাত বরণ করেন।
তারপর পূর্ব থেকেই নির্ধারিত আরও কয়েকজন সেনাপতি শাহাদাত বরণ করার পর বাহিনীর নেতৃত্ব তুলে নেন হযরত মুসান্না (রা.) এবং অতি কৌশলে সেতু পার হয়ে অবশিষ্ট যোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে আসেন। এই যুদ্ধে তিনি নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হন, যা পরবর্তী সময়ে তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিল।
এ যুদ্ধে চার থেকে ছয় হাজার মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। বেঁচে ফিরেন মাত্র চার হাজার। এদের মধ্যে দুই হাজার পালিয়ে মদীনায় চলে যান। বাকি মাত্র দুই হাজার থেকে যান মুসান্না ইবনে হারিসার (রা.) সাথে। তিনি যুদ্ধের বিস্তারিত অবস্থা খলিফা হযরত উমরের (রা.) কাছে লিখে পাঠান।
উল্লাইসের যুদ্ধ
হযরত মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) আহত হলেও দমে যান নি৷ নিজের সাথে থাকা দুই হাজার মুজাহিদকেই তিনি বিন্যস্ত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে ফেলেন।
পারসিকরা ভেবেছিল মুসলিমরা এই পরাজয়ের পর ইরাকের মাটিতে আর থাকবে না। কেউ থেকে থাকলে তাদেরকে ধাওয়া করার জন্য একটি বাহিনী নদী পার হয়ে পশ্চিমে আসে। মুসান্না (রা.) তাদেরকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে ফেলেন৷ যাদের মধ্যে বড় বড় কয়েকজন কমাণ্ডারও ছিল। ইতিহাসে এই যুদ্ধ উল্লাইসের যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়৷
বুওয়াইবের যুদ্ধের জন্য সেনা সংগ্রহ
খলিফা হযরত উমর (রা.) বিস্তারিত অবস্থা জেনে খুবই মর্মাহত হন। পারস্য বাহিনীর উপর বড় ধরনের কোনো সফল আক্রমণ পরিচালনা করা তিনি জরুরী মনে করছিলেন। নতুবা সেনাদের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
কিন্তু সমস্যা হলো, এত বড় একটি পরাজয়ের পর পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিল না কেউ। অপরদিকে সিরিয়ার রণাঙ্গনে মুসলিমদের অবস্থা সুবিধাজনক ছিল বিধায় সকলে সিরিয়ার রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য আগ্রহী ছিল। তাই হযরত উমর (রা.) জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) এর নেতৃত্বাধীন বাজিলা গোত্রকে গনীমতের নির্ধারিত অংশের চেয়ে বেশি দেওয়ার অঙ্গীকার দিয়ে ইরাকের রণাঙ্গনে রাওয়ানা করিয়ে দেন। আবার ধর্মত্যাগী মুরতাদদের যারা নতুন করে ইসলাম ধর্মে ফিরে এসেছিলেন তাদেরকে তিনি ইরাকের রণাঙ্গনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) আশপাশের আরব গোত্রগুলোকেও যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করেন। এখানেও তিনি সফলতার মুখ দেখেন। আশপাশের শুধু মুসলিম গোত্রই নয়, অনেক অমুসলিম গোত্রও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়৷ সব মিলিয়ে মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) এর সাথে ১২ হাজার যোদ্ধা মিলিত হন। তিনি তাদেরকে নিয়ে বর্তমান ইরাকের নিকটবর্তী ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে বুওয়াইব নামক স্থানে সমবেত হন। তার বিরুদ্ধে সেনানায়ক মেহরান আল-হামদানি দেড় লাখ পারস্যসেনা নিয়ে ফুরাত নদীর পুবপাশে সমবেত হয়।
যুদ্ধের সূচনা
পারস্য সেনানায়ক মেহরান দূত মারফত জানতে চায়, নদী কি তোমরা পার হবে না আমরা? বিচক্ষণ সেনাপতি মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) আবু উবাইদ আস-সাকাফীর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেন নি৷ তিনি সকলের সাথে পরামর্শ করে দূতকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন, “তোমরা বরং নদী পার হয়ে এপারে এসো।” পারস্য-সেনারা নদী পার হয়ে পশ্চিম পাশে সমবেত হতে থাকে। মুসলিম সেনাপতি পুরা বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। একটি মাইমানাহ বা ডান অংশ, একটি মাইসারাহ বা বাম অংশ, আরেকটি হলো কলব বা মধ্যবর্তী বাহিনী। পারস্য সেনাপতি মেহরানও নিজ বাহিনীকে সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুত করে ফেলেছে।
দিনটি ছিল ১৩ হিজরীর ১২ রমাদান। ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান করছে দুটি সশস্ত্র বাহিনী। একটি হকের অপরটি বাতিলের, একটি ন্যায় ও ইনসাফের অপরটি অন্যায় ও যুলুমের। মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) সবাইকে রোযা ভেঙে ফেলতে বলেন। তিনি নিজ ঘোড়ায় আরোহন করে চক্কর দিতে দিতে তাদেরকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) সকলের সাথে নম্র ও কোমল আচরণ করেন, আচরণ ও উচ্চারণে সকলের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাঁর দ্বারা কেউ কষ্ট পাবে এমন কোনো কাজ তিনি করেন নি। এসব কারণে সকলেই তাঁর প্রতি মুগ্ধ ও আন্তরিক ছিলেন। নেতৃত্বদানে কেউ তার কোনো রকমের ত্রুটি ধরতে পারেন নি।
তিনি বলে দেন, আমি তিনবার তাকবীর ধ্বনি দেব, তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। চতুর্থ তাকবীর শুনলে তোমরা আক্রমণ করবে। কিন্তু প্রথম তাকবীর দেওয়ার সাথে সাথে বনু ইজলের লোকেরা আক্রমণ করতে তাড়াহুড়ো শুরু করে দিলে সেনাপতি তাদের কাছে এ-ই মর্মে সংবাদ পাঠালেন যে, তোমরা আমাকে লজ্জিত করো না। এ বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে তারা সংশোধন হয়ে গেল। আনন্দের আতিশয্যে তাঁর চেহারায় ফুটে ওঠে ঈষৎ হাসির রেখা।
লড়াই যখন তুঙ্গে
বেলা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যুদ্ধও প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। রণাঙ্গন জুড়ে শুধু ধুলাবালি আর ধুলাবালি। ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি আর তরবারির ঝনঝনানিতে ময়দান কেঁপে ওঠে। দেড় লাখ কাফেরের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন মাত্র ১২ হাজার মুজাহিদ। শাহাদাতের নেশায় ব্যাকুল যেন সবাই। হযরত মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) ও তাঁর গোত্রকে সাথে নিয়ে মেহরানের উপর আক্রমণ করে বসেন৷ শত্রুবাহিনীর ডান অংশ তছনছ হয়ে যায়। উভয় বাহিনীর কলব তথা মধ্যবর্তী অংশ একসাথে মিশে যায়। শত্রুবাহিনী ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
মুসান্না ইবনে হারিসার আপন ভাই মাসউদ ইবনে হারিসা ঘোরতর আহত হন এবং শেষ অবধি শাহাদাত বরণ করেন। আহত অবস্থায় তিনি বলতে থাকেন, হে বনু বকরের যোদ্ধারা! আমার মৃত্যু যেন তোমাদেরকে হতাশায় না ফেলে দেয়। তোমরা নিজেদের পতাকা সমুন্নত রাখো। অবশেষে হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) পারস্য সেনাপতি মেহরান আল-হামদানির শির কেটে ফেলতে সক্ষম হন। অবশ্য কারো কারো মতে তাগালিব গোত্রের এক খৃস্টান যোদ্ধা মেহরানকে হত্যা করেছিল। এ সংবাদ শুনে পারস্য বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে৷ যে যেদিকে পারে সেদিকেই পালিয়ে যেতে থাকে।
পলায়নরত শত্রুসেনারা মারা যায় অনেকে। অনেকে মারা যায় ফুরাত নদীর অথৈ জলরাশিতে ডুবে। দেড় লাখ সেনার মধ্যে এক লাখ নিহত হয় এই যুদ্ধে, বাকিরা কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যায়।
এই যুদ্ধে মুসলিমরা সেতুর যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন অক্ষরে অক্ষরে। পারস্য বাহিনীর আনন্দ-উল্লাস, দুঃখ ও বেদনার সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। বিশাল এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে অবশ্য ৪ হাজার মুজাহিদকেও শাহাদাতের সুধা পান করতে হয়েছিল।
শত্রুবাহিনীর যারা পালিয়ে যাচ্ছিল তাদের পেছনে ধাওয়া করতে মুসান্না ইবনে হারিসা (রা.) একটি দল পাঠিয়ে দেন। শত্রুবাহিনী যে সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে এসেছিল মুসান্না ইবনে হারিসা সেই সেতু ভেঙে ফেলেন। তাদের সামনে থাকে ফুরাত আর পেছনে ধাওয়াকারী মুসলিম বাহিনী। তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়ংকর মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য। আল্লাহ তা’আলা বিজয়ের মাস মাহে রামাদানের বরকতে এভাবেই মুসলমানদের বিজয়ী করেছেন। ফালিল্লাহিলহামদু কুল্লুহু, ওয়া লাহুশশুকরু কুল্লুহু। ওয়া সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলা আবদিহি ওয়া রাসূলিহি। আলাইহিমুস সালামু ওয়াস সালাম।
তথ্যসূত্র:
(১) তারিখে তাবারী
(২) আল কামিল ফিত তারিখ
আগের পর্বগুলো পড়ুন :
১। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
– https://alfirdaws.org/2022/04/01/56426/
২। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/05/56473/
৩। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
৪। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ ।। পর্ব-৪ ।। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [তৃতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/14/56664/
৫। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৫।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(প্রথম কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/18/56729
৬। বিজয়ের মাস : মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৬।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(দ্বিতীয় কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/23/56840/
৭। বিজয়ের মাস; মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৭।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়; আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(শেষ কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/05/01/56964/
Comment