বাংলাদেশে কিছু লোক আছে যারা খুব গর্ব সহকারে বলে বেড়ায় যে, বাংলাদেশ নাকি সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে; রাস্তা-ঘাট, ফ্লাই-ওভারের জোয়ারে উন্নয়নে ভাসছে বাংলাদেশ; বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার মানে প্রায় ৩ লাখ টাকা! বিপরীতে, এই গোষ্ঠীর লোকেরা সাধারণ ইসলামী মানসিকতার লোকদেরকে খোঁটা দেয় এই বলে যে, ওরা দেশটাকে আফগানিস্তান বানিয়ে ফেলতে চায়। তারা বুঝাতে চায় যে, আফগানিস্তান অত্যন্ত নিম্ন মানের দেশ আর বাংলাদেশ অনেক উঁচু মানের দেশ।
কিন্তু আসলে বাস্তবতা কী বলে?
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট অ্যামেরিকা আফগানিস্তান থেকে পালাতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার সাথে ২০ বছর এবং তালেবান সরকারকে হামলার পর আমেরিকার সাথে আরও ২০ বছর – প্রায় টানা ৪০ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশের ক্ষমতা ২য় বারের মত গ্রহণ করে তালিবানরা।
অর্থনৈতিকভাবে প্রায় বিপর্যস্ত একটি দেশকে আরও বিপদে ফেলতে ‘মানবাধিকারের পতাকাবাহী’ পশ্চিমারা আফগানিস্তানের রিজার্ভের ৯৫০ কোটি ডলার জব্দ করে রাখে, যার ৭০০ কোটি ডলার আটকে রাখা হয় অ্যামেরিকান ব্যাংকে। এরকম এক সংকটময় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব পরে তালিবানদের ঘাড়ে।
তালিবানের শরিয়াহ শাসনের দুই বছরও পূর্ণ হয়নি এখনও। অপরদিকে, বাংলাদেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনের ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে এখন পর্যন্ত কোনো দেশ স্বীকৃতিও দেয়নি। বিপরীতে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৫০টি দেশ।
তাছাড়া, বর্তমানে সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা চলমান। বাংলাদেশ সরকার তো এখন সকল কিছুর পেছনেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দেয়। সার্বিক এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের অর্থনীতির তুলনা করে দেখা যাক, বাস্তবতা কী!
তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে আফগানিস্তানে কমেছে মুদ্রাস্ফীতির চাপ। ২০২২ সালের জুলাইয়ে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৮.৩ শতাংশ, ঐ বছরের ডিসেম্বরে সেটা এক লাফে কমে হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। এরপর তিন মাসের ব্যবধানে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ কমে হয়েছে ৩.৫ শতাংশ। এগুলো কারও মনগড়া কথা নয়। বরং, বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের মার্চ মাসের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ৯.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালের মার্চ মাসে ছিল ৬.২২ শতাংশ। অর্থাৎ, ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ।
বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও প্রায় আকাশচুম্বী। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে স্বাভাবিক মৌলিক প্রয়োজনীয় খাবারের দামও। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী আফগানিস্তানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম কমছে। ২০২২ সালের মার্চের সাথে তুলনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মার্চে দ্রব্যমূল্য ৪.১ শতাংশ কমেছে। থার্ড-পার্টি মনিটরিং অ্যাজেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্য আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান বাজারগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।
কেমন যেন মনে হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার খারাপ প্রভাব অলৌকিকভাবে আফগানিস্তানকে স্পর্শই করতে পারেনি!
শুধু তাই নয়! মুদ্রাস্ফীতি কমার সাথে সাথে সকল মুদ্রার বিপরীতে বেড়েছে আফগানি মুদ্রার মান। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে আফগান মুদ্রার মান ৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারতীয় রুপির বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৭ শতাংশ, ইউরোর বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৩ শতাংশ, ১০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে পাকিস্তানি রুপির বিপরীতে, এবং ২২.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ইরানিয়ান তুমানের বিপরীতে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদেশি মুদ্রার মজুদও বেড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিদেশি মুদ্রা সরবরাহকারীরা।
বিপরীতে, বাংলাদেশের মুদ্রার মানের কী অবস্থা? ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার মান ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। এখন অবশ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারের মান বাধ্যতামূলক বেধে দেওয়ায় সেটা ১০৫ এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশী টাকার মান এতটাই কমেছে যে, সরকার বাধ্য হয়েছে ডলারের দাম বেধে দিতে, যেন বাহ্যিক ভাবে মনে হয় টাকার মান স্থিতিশীল আছে। এটা আসলে ভিতরের সদরঘাট অবস্থাকে ঢেকে রাখার জন্য উপরে ফিটফাট দেখানোর চোরাই রাস্তা!
এদিকে, ইসলামি ইমারত প্রশাসন বিদেশি মুদ্রা পাচারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এর ফলে আফগান মুদ্রার মান শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ-সম্পদ পাচার করছে বাংলাদেশের সরকারি লোকেরাই। ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। ফলে, বাংলাদেশের মুদ্রার মান খুব দ্রুতই কমছে। বর্তমানে বাংলাদেশের টাকার মান আফগানি মুদ্রার চেয়েও কম! ১ আফগানি মুদ্রার বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ১.২৩ টাকা।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ইসলামি ইমারত সরকার প্রায় সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত ও যথাসময়ে বেতন দিচ্ছেন। একই সাথে আফগানিস্তানে বেড়েছে দক্ষ ও অদক্ষ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান। ২০২২ সালের মার্চ মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে কর্মসংস্থানের উন্নতি ঘটেছে। এছাড়া, আফগানিস্তানে মানুষের শ্রমের মূল্যও বেড়েছে, যদিও সেটা পরিমাণে কম।
সর্বোপরি ইসলামি ইমারত সরকার আফগানিস্তান পুনর্গঠনে অর্থনৈতিকভাবে এখন পর্যন্ত বেশ দৃঢ়ভাবেই সফলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে ‘সিঙ্গাপুর’ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের টাকার মানও আফগানিস্তানের মুদ্রার চেয়ে কমছে। এই তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারে বাধ দিতে না পারলে, পুরো বাংলাদেশই একসময় তলিয়ে যাবে অতল গহ্বরে।
তথ্যসূত্র:
1. AFGHANISTAN ECONOMIC MONITOR, 25 April 2023
– https://tinyurl.com/cjn4jmf8
2. Inflation Rate Of Bangladesh
– https://tinyurl.com/b42uzx5z
Comment